দুটো মৃত্যু || তসলিমা নাসরিন
দুটো  মৃত্যু || তসলিমা নাসরিন


পারভিন সুলতানার বড় ইচ্ছে হতো সাদা ফ্রক আর সেই ফ্রকের ওপর নীল বেল্ট পরে বই খাতা হাতে পাড়ার আর সব মেয়ের মতো আদর্শ বিদ্যালয়ে যায়। কিন্তু বয়স যত বাড়ছে, তত সে শুনছে তার বাবা তাকে ইস্কুলে পড়াবেন না। পড়তে যদি হয়ই, তাহলে পারভিনকে মাদ্রাসায় পড়তে হবে। মাদ্রাসায় কোরান হাদিস শেখানো হয়। কিছুটা অংক ইংরজি ইতিহাস ভুগোলও শেখানো হয় বটে, তা কোনওকালেও যথেষ্ট ছিল না, এখনও নয়। আত্মীয় স্বজনের মধ্যে এমন ধারণাই বদ্ধমূল যে, সন্তানদের একজন অন্তত যদি আল্লাহর পথে যায়, অর্থাৎ কোরান হাদিস শিখতে মাদ্রাসায় পড়ে, তাহলে শুধু নিজের নয়, পুরো পরিবারেরই পূণ্য হয়। সুতরাং পারভিন মাদ্রাসায় পড়লে পারভিন একা বেহেস্তে যাবে না, পরিবারের সকলে যাবে। পারভিনের বাবা পাঁচ বেলা নামাজ পড়েন, মাও। রোজা রাখেন তিরিশটা। মা মাসিকের জন্য তিরিশ রোজা রাখতে না পারলেও রোজাগুলো পরে একসময় রেখে নেন, কাজা নামাজও পরে পড়ে নেন। এই বাড়িতে পারভিন সুলতানার আর তার ভাই শফিকুল ইসলামের, বাবা মা’র মতো ধার্মিক হওয়া ছাড়া আর কোনও পথ খোলা নেই। ওদের বুদ্ধি হওয়ার আগেই বাড়িতে এক মৌলবী আসতেন আরবি পড়াতে। দু’ ভাই বোনকে দু’পাশে বসিয়ে আলিফ বে তে সে পড়াতে শুরু করেছিলেন, কোরান শরিফ প্রায় মুখস্ত করিয়ে বিদেয় হয়েছেন। পারভিনের সুলতানার প্রতিদিনের জীবনে কোরান হাদিস , অযু নামাজ, দোয়া দরুদ, ছাড়া যা আছে তা হলো চারজন মাদ্রাসার বান্ধবী। ওই বান্ধবীদেরও ইচ্ছে ছিল আদর্শ বিদ্যালয়ে যাওয়ার, কিন্তু ওরাও বাবাদের চাপে মাদ্রাসায়। ইস্কুলে যেহেতু পাঠাবেন না, অগত্যা বাড়িতে বসে থাকার চেয়ে মাদ্রাসাই ভালো। কোরান হাদিস পড়ার উত্তেজনা নেই পারভিনের, কারণ ও যথেষ্ট পড়েছে সে, তার উত্তেজনা কিছুটা বাংলা ইংরেজি পড়তে পারছে, কিছুটা অংক কষতে পারছে,কিছুটা ইতিহাস ভুগোল জানতে পারছে-- এসবে। তাছাড়া বাড়ির বাইরে বের হওয়া মানে খোলা আকাশ পেয়ে যাওয়া, দু’চারজন সমবয়সীর সংগে হাসি-ঠাট্টা হওয়া। চার দেয়ালের একঘেয়ে জগত থেকে কে বেরোতে না চায়! বাড়িতে কোরান হাদিসের বই ছাড়া অন্য কোনও বই নেই। মাদ্রাসায় খুব বেশি না হলেও কিছু বই তো ছুঁয়ে দেখা যায়, পড়েও দেখা যায়।

পারভিনের সাদামাটা জীবনে হঠাৎ করেই চরম আনন্দের একটি ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটি ঘটিয়েছে তার বড় কাকার মেয়ে রেশমি। রেশমি তার ব্যবহার করা পুরোনো একটা স্যামসুং স্মার্ট ফোন পারভিনকে উপহার দিয়েছে, সংগে সিম। আলতাফ হোসেন আপত্তি করেছিলেন পারভিনের হাতে ফোন কেন, এসব ছাইপাশ ব্যবহার করলে গুনাহ হয়। কিন্তু রেশমিই তার কাকাকে বলে, স্মার্ট ফোন প্রত্যেক মুসলমানের হাতে থাকা উচিত। এই ফোনেই পাবে কোরানের সব আয়াত, এই ফোনেই আছে হাদিসের সব বই, কাবা ঘর ঘিরে যে হজ্ব হয়, ওমরা হয়, এই ফোনেই সব লাইভ দেখা যায়। সাচ্চা মুসলমান হতে চাইলে ফোন চাই। আলতাফ হোসেনকে ইউটিউব থেকে আজান শুনিয়ে দিল, কোরান পাঠ শুনিয়ে দিল রেশমি। ফোনটি উল্টেপাল্টে দেখে আলতাফ হোসেন মাথা নেড়েছেন, এর অর্থ পারভিন চাইলে নিতেই পারে এমন একটি ফোন।
রেশমিরা ঢাকা থেকে নেত্রকোণার মদনে বেড়াতে আসে বছরে অথবা দু’বছরে একবার। তখনই রেশমির সঙ্গে তার দিন রাত গল্প হয়। রেশমি পারভিনের ঘরেই থাকে, যে ক’দিনই থাকে। দু’জনের বয়সের পার্থক্য খুব বেশি না হলেও কিছুটা তো আছেই। পারভিন ষোলো, রেশমি কুড়ি। রেশমির জগত আর পারভিনের জগত সম্পূর্ণই আলাদা। রেশমি কলেজে পড়ে, কলেজের একটি ছেলের সংগে প্রেম করে, বন্ধু বান্ধব প্রচুর, শহরে ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়ায়, রেস্তোরাঁয় যায়, সিনেমায় যায়। পারভিন ঘর থেকে মাদ্রাসা, মাদ্রাসা থেকে ঘর। এই সীমানা পেরিয়ে কোথাও যাওয়ার প্রচণ্ড সাধ থাকলেও তার সাধ্য নেই। পায়ে তার অদৃশ্য বেড়ি।

মোবাইল হাতে আসার পর থেকে পারভিনের জীবন অনেকটাই পাল্টে গেছে। ফোনটিই তার কাছে নতুন এক দুনিয়া। সত্যি বলতে এটিই তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু। এটি হাতে থাকলে তার মনে হতে থাকে পৃথিবী তার হাতের মুঠোয়। মোবাইলে সবচেয়ে বেশী তার সংগে যোগাযোগ রেশমির। রেশমিই শিখিয়ে দেয় কী করে কী ডাউনলোড করতে হবে, কী করে সেলফি তুলতে হবে, কী করে হোয়াটস আপে মেসেজ পাঠাতে হয় ,কী করে ফেসবুক করতে হয়, কী করে মেসেঞ্জারে মেসেজ পাঠাতে হয়, ফটো আপ্লোড করতে হয়। রেশমিই বলে দেয় তথ্যের জন্য গুগল কী করে ঘাঁটতে হয়। এই ফোনের জীবন বাদ দিলে পারভিনের যা থাকে, তা বাড়ির আর মাদ্রাসার জীবন। সকালে ঘুম থেকে উঠে তাকে রান্না ঘরে যেতে হয়, বাড়ির সবার জন্য নাস্তা তৈরি করতে তার ডাক পড়ে রান্না ঘরে। রক্ষণশীল ঘর, কিন্তু ঘরে তাকে হিজাব পরতে হয় না, এটি একরকম বাঁচিয়েছে। মাদ্রাসায় হিজাব পরে যেত সে, কিন্তু গত ছ’মাস সে বোরখা পরছে, কারণ মাদ্রাসার হেডমাস্টার বলে দিয়েছেন, পারভিন আর ছোট নেই, গা গতর বাড়ছে, এখন হিজাবে সব ঢেকে রাখা যাচ্ছে না, অতঃপর বোরখা চড়াতে হবে গায়ে। আলতাফ হোসেন মাদ্রাসার হেড মাস্টারের ঘোষণা শুনে বাজার থেকে এক জোড়া কালো বোরখা কিনে এনেছেন মেয়ের জন্য। পারভিন বোরখা পরে বটে, কিন্তু বোরখার ভেতরে সে কুলকুল করে ঘামতে থাকে। কেউ কি টের পায় সে কীরকম অসহ্য গরমে ভোগে, কী রকম শ্বাস বন্ধ হওয়া পরিস্থিতির মধ্যে থেকে তাকে সবার সংগে হেসে হেসে কথা বলতে হয়! শরীরের আর কিছুই নয়, শুধু তার চোখ দুটো দেখতে পায় মানুষ। চোখ দুটোয় পারভিন কাজল পরে, বাদামি রঙের ভুরু আঁকার পেন্সিল দিয়ে ভুরুদুটো তলোয়ারের মতো আঁকে। আয়নার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে সে গালে পাউডার মাখে, ঠোঁটে লিপ্সটিক মাখে। সাজার জিনিসগুলো সে নিজেই কিনেছে মায়ের সংগে বেরিয়ে। সেজেগুজে ছবি তুলে ফেসবুকেও দিয়েছে, কিন্তু ফেসবুক একাউন্ট সে নিজের নামে খোলেনি। তার ছদ্মনাম বীরাঙ্গনা। স্থান মদন নয়, নেত্রকোণা নয়, স্থান ঢাকা, ইস্কুল খাদিজাতুন্নেসা মাদ্রাসার বদলে হলি ফ্যামিলি ইস্কুল। বোরখা মাদ্রাসা নামাজ রোজা কোরান হাদিস দোয়া দরুদ পরহেজগার পিতা মাতা, ইত্যাদি নিয়ে পারভিন বাস করে বটে, কিন্তু বীরাঙ্গনার জীবনটি তার ভালো লাগে বেশি। মনে মনে ওই জীবনটি সে যাপন করে। রাতের বিছানায় মশারির আড়ালে ওই জীবনটি সে পুরোটাই পেয়ে যায়। আগে তার সংগে তার মা ঘুমোতো, কিন্তু মা অন্য ঘরে চলে গেছেন। বাবার সংগে ঘুমোয় তার আদরের পুত্রধন শফিকুল ইসলাম। শফিকুল ইসলাম তিন বছর মাদ্রাসায় পড়েছে। তারপর কী মনে হলো বাবার, ওকে মাদ্রাসা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পাড়ার সরকারি ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। পারভিনও তার বাবার কাছে আবদার করেছিল, মদন আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ে তাকেও যেন ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। তার মা-ও বাবার কাছে ভয়ে ভয়ে কথাটা পেড়েছিল। বাবা মা’কে যা বলে দিয়েছেন তা হলো, মেয়েদের ইস্কুল কলেজে পড়াই উচিত নয়, উচ্ছৃংখল হবে, আদব কায়দার বারোটা বাজবে,বখাটে কারো সংগে প্রেম করে ভেগে যাবে, বোরখা পরবে না, পর্দা করবে না, পড়লে মেয়েদের জন্য মাদ্রাসায় ভালো। তাছাড়া একটি সন্তান অন্তত মাদ্রাসায় যাক, এতে সওয়াব হবে। মেয়ে শৃংখলার মধ্যে থাকবে। বিয়ের জন্য সম্বন্ধ এলে মেয়েকে পছন্দ করবে। তাবলিগ জামাত করা বাবার কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু হয়তো আশা করারও নেই। পারভিন আশা ছেড়ে দিয়েছে।

রেশমিকে পারভিন জানিয়েছে সে কোনও ফেসবুক আইডি খোলেনি, কারণ তার আব্বু জানতে পারলে তাকে আস্ত রাখবে না। নিজের ফেসবুক আইডিটি এতই গোপন রাখতে চায় পারভিন, যে, যার এ সম্পর্কে জানার অধিকার সবচেয়ে বেশি, তাকেই জানায় না। রেশমি নিজের ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড দিয়ে রেখেছে পারভিনকে। পারভিন দিব্যি পড়ে নেয় রেশমিকে কে কী লিখছে, দেখে নেয় রেশমি কাদের বন্ধু। রেশমির বন্ধুতালিকায় ওয়াশিকুর বাবু নামে একটি লোকের লেখা পড়েছে সে। ধর্ম নিয়ে তার মন্তব্যগুলো পড়লে মনে প্রশ্নের উদয় হয়। রেশমিকে সে ফোনে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ওয়াশিকুর বাবু কী করে তোমার বন্ধু হইলো? সে তো পুরাই ইসলাম বিরোধী!’ রেশমি বলেছে, ‘নানা মতের মানুষ বন্ধুতালিকায় থাকতেই পারে। তাদের মতবাদ জানলে তো ক্ষতি নাই। বন্ধুতালিকায় বাঁশের কেল্লার মতো কট্টর ধর্মান্ধও আছে। সবার মতই জানবো। নিজে কোন মতে বিশ্বাস করবো, সেইটা নিজের ওপর’। রেশমি ফেসবুকে ব্যস্ত থাকে খুব। পারভিন রাতে রাতে মশারির তলায় চাদরে মুখ মাথা ঢেকে ফেসবুক পড়ে। যতই সে ওয়াশিকুর বাবুর লেখা পড়ে, ততই সে ছিটকে সরে যায় ফেসবুক থেকে,ততই তার জানার ইচ্ছে হয় কী লিখছে সে। ওর লেখা পড়লে প্রথম প্রথম ভয় লাগতো। মনে হতো, সে যে পড়ছে ওয়াশিকুর বাবুর লেখা, কেউ বুঝি দেখে ফেলছে। রেশমির একাউন্ট, হয়তো রেশমিও জেনে ফেলবে যে সে ওয়াশিকুরের লেখা পড়ছে । ওয়াশিকুর বাবু ধর্ম নিয়ে যে প্রশ্নগুলো করেছে, সে প্রশ্নগুলো করা, পারভিন জানে, যে, নিষিদ্ধ। এমন প্রশ্ন একবার যদি পারভিন করে, তাকে মাদ্রাসায় পেটানো হবে, মাদ্রাসা থেকে বের করেও দিতে পারে, বলা যায় না। একবার একটি মেয়ে কোরান থেকে পাতা ছিঁড়ে নিয়ে বাথ্রুমে ফেলতো, ধরা পড়ার পর ওকে বের করে দেওয়া হয়েছে মাদ্রাসা থেকে। কোরানের পাতা ছিঁড়েছিল বলে সেই মেয়েটির ওপর খুব রাগ হয়েছিল পারভিনের। মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়ার পর মেয়েটির বাবা মেয়েটিকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। অত অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়াটাও পারভিনের ভালো লাগেনি। মাদ্রাসা থেকে তাকে বের না করলেও পারতো। কিন্তু শিক্ষকদের সহ্যক্ষমতাটা, পারভিন লক্ষ করেছে, খুবই কম।

মদন উপজেলার খাদিজাতুন্নেসা ফাজিল মহিলা মাদ্রাসায় যতনা মহিলা শিক্ষক, তার চেয়ে বেশি পুরুষ শিক্ষক। পুরুষ শিক্ষকদের, পারভিন লক্ষ করেছে,সহ্য ক্ষমতা যেমন নেই, সংযমের ক্ষমতাও খুব বেশি নেই। চোখ আর হাত দুটো ছাড়া পারভিনের শরীরের আর কোনও অংশ মাদ্রাসার শিক্ষকেরা কেউ দেখেননি , কিন্তু চোখের দিকেই তাকিয়ে থাকতে সে দেখেছে দু’তিনজন শিক্ষককে, বই বা খাতা দিতে বা নিতে যাওয়ার সময় হাতও ছুঁয়েছেন শিক্ষকেরা। একবার তো পারভিনের হাত খপ করে ধরে অংকের শিক্ষক আবদুল আলীম বলেছিলেন, বাহ একেবারে মাখনের মতো। পারভিন দ্রুত ছাড়িয়ে নিয়েছিল হাত, বোরখার আড়ালে হাতদুটোকে আড়াল করে বই খাতা রেখেই পালিয়েছিল। আবদুল আলীমকে খুব ভালো লোক বলে পারভিনের কখনও মনে হয়নি। আবদুল আলীম কোরান মুখস্ত জানেন। বড় আলেম বলে নাম ডাক আছে , কিন্তু তাঁর ওই চোখদুটো থেকে দিনভর লালসা গড়ায়, সেটা শুধু পারভিন নয়, তার ক্লাসের মেয়ে রুনা আর লাভলিও জানে। আবদুল আলীমের কথা মনে হলেও ওয়াশিকুর বাবুর কথাগুলো বড় মনে পড়ে, ‘খুব স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তি ধর্মের কারণে সৎ হয়, কিন্তু অধিকাংশ অসৎ ব্যক্তিই ধর্মকে মোড়ক হিসাবে ব্যবহার করে’। এত যে ধর্মকর্ম করা মানুষ দেখছে পারভিন, আত্মীয় স্বজনের মধ্যেও ধার্মিক কম নয়, কিন্তু তার নিজের মা,খালা, ফুপু আর নানি ছাড়া আর কাউকে সৎ বলে মনে হয় না। নিজের বাবাই কি মোড়ক হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করে না? পারভিন জানে তার বাবা সরকারি বিদ্যুৎ দপ্তরে কেরানির চাকরি করছেন এবং দু’হাতে ঘুষ খাচ্ছেন, ঘুষ নিতে সে নিজেই দেখেছে, কিন্তু যেহেতু টুপি-দাড়িঅলা লোক,হজ্ব করে এসেছেন, তাবলিগ জামাতে যান, টঙ্গির ইজতেমাতেও হাজির হন, স্ত্রী কন্যাকে বোরখা পরান, সুতরাং তাকে কেউ ভাববে না মন্দ লোক বা ঘুষ খাওয়া লোক।

ওয়াশিকুরকে সে ইনবক্সে একদিন রেশমির একাউণ্ট থেকেই লিখলো, ‘ইসলামের নিন্দা করে আপনার লাভ কি শুনি? যদি পরকাল বলে কিছু থাকে, তাহলে তো দোযখে পচে মরবেন’। পারভিন উত্তরের জন্য বসে থেকেছে, উত্তর আসেনি। ওয়াশিকুর প্রতিদিন কী লিখছে না লিখছে,এ নিয়ে তার যে প্রচণ্ড কৌতূহল, তা চেষ্টা করেও কমাতে পারছে না পারভিন। মাদ্রাসা থেকে ফিরে খেতে বসার আগেই তার দেখা চাই কী লিখেছে ওয়াশিকুর। তার মা বাবা জানেন মোবাইলে মেয়ে কোরান খতম শুনছে, খুতবা শুনছে, ওয়াজ শুনছে। কেউ টের পাচ্ছে না, মেয়ে ফেসবুকে গিয়ে গিয়ে ইসলামের নিন্দে পড়ছে গোগ্রাসে। ওয়াশিকুর যখন যুক্তি দিয়ে কথা বলে, পারভিন সারাদিন তার যুক্তি নিয়ে একা একাই ভাবে। যুক্তি খণ্ডাতে পারে না। ফেসবুকে পড়া হয়ে যায় ওয়াশিকুরের লেখা ‘নাস্তিকদের কটূক্তির দাঁতভাঙ্গা জবাব’। প্রশ্নগুলো সত্যিই ধারালো, কিন্তু জবাবগুলো হাস্যকর। ফেসবুকে শুধু ওয়াশিকুর নয়, আরো কয়েকজনের লেখাও সে পড়তে শুরু করে। একটা মেয়ে তো মেয়েদের বিরুদ্ধে এত যে ধর্ষণ নির্যাতন হচ্ছে-- তার ভীষণ প্রতিবাদ করছে। মেয়েটির নাম পাপিয়া ইসলাম। রেশমির বন্ধুতালিকা থেকে ওয়াশিকুরকে পাওয়া, ওয়াশিকুরের বন্ধু তালিকা থেকে পাপিয়াকে পাওয়া। পারভিন অন্য একটি জগত পেয়ে যায়। সে ঠিক বুঝে পায় না কোন জগতটি ভালো। কারা ঠিক, ওয়াশিকুর আর তার বন্ধুরা, নাকি তার আত্মীয় স্বজন, তার পড়শি, তার মাদ্রাসার বান্ধবীরা, শিক্ষক শিক্ষিকারা? ওয়াশিকুর লিখেছে ইসলামে অন্য ধর্মানুসারীদের জাহান্নামি বলা হয়েছে। কিন্তু জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মের জন্য তো কেউ দায়ী নয়। তাহলে কেন ভালো কাজ করেও বিধর্মী মাত্রই জাহান্নামি হবে? পারভিনের মনে পড়েছে উজ্জ্বলার কথা, উজ্জ্বলা তাদের পাড়াতেই থাকে। ছোটবেলায় একসংগে মাঠে খেলতো। একবার খেলতে গিয়ে পারভিনের সেন্ডেল ছিঁড়ে গিয়েছিল, বাবা মার ভয়ে তখন মাঠে বসে চিৎকার করে কাঁদছিল পারভিন। উজ্জ্বলা বড় মায়া-চোখে তাকে দেখছিল, একসময় নিজের সেন্ডেলজোড়া তাকে পরতে দিয়ে খালি পায়ে ঘরে ফিরেছিল। ফ্রক পরা সময়ের সেই দিনগুলো এখনও মনে পড়ে। উজ্জ্বলা সাহা কী কারণে জাহান্নামে যাবে? পারভিন ভাবে, সেও যদি কোনও হিন্দু বাবা মা’র ঘরে জন্ম নিত, তাহলে সে কী দোষে জাহান্নামে যেত, মানুষ তো জন্ম নেওয়ার আগে বাবা মা কোন ধর্মের তা দেখে জন্ম নেয় না, তা ছাড়া জন্মের আগে কী করে জানবে কোন ধর্ম ভালো, কোন ধর্ম মন্দ? আট বছর বয়স থেকেই বাড়ির বাইরে পারভিনের খেলা নিষেধ। উজ্জ্বলা একবার পারভিনের খোঁজ নিতে এসেছিল, উজ্জ্বলা হিন্দু বলে পারভিনের মা দরজা খোলেননি। পারভিন জানালা দিয়ে উজ্জ্বলাকে বলে দিয়েছে, সে আর মাঠে খেলতে যাবে না। কোনওদিন পারভিন আর খেলতে যাবে না শুনে বড্ড মন খারাপ করেছিল উজ্জ্বলা। সেও সেদিন আর কারও সংগে খেলেনি।

ওয়াশিকুর ঢাকায় থাকে। পারভিন কোনোদিন ঢাকায় যায়নি। ঢাকার গল্প শুনেছে। ফেসবুকে ঢাকার ছবি দেখেছে, তার খুব ইচ্ছে করে ঢাকায় একবার বেড়াতে যেতে। হতেও তো পারে ঘুরতে ঘুরতে একদিন ওয়াশিকুরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, সংসদ ভবনের আশেপাশে, কোনও পার্কে, কোনও খাবার দোকানে । পারভিনের ইচ্ছে করে রেশমির মতো ঢাকার রাস্তায় চলাফেরা করতে । ইচ্ছে করে বোরখা নয়, হিজাব পরে ঢাকায় ঘুরবে, হিজাব তো কত স্মার্ট আর সুন্দর মেয়েরাও পরে। পারভিন নিজেও সুন্দর, যখন সাজে, তার মা বলে, তাকে পরীর মতো দেখাচ্ছে। পরী ঠিক কাকে বলে, পরীরা কোথায় থাকে তা সে জানে না। মাদ্রাসার মেয়েরা বোরখার ঢাকনা খুলে পারভিনের চেহারা দেখে নিয়েছে। তার গায়ের রঙ, তার ডাগর চোখ, তার টিকোলো নাক আর সুন্দর ঠোঁটজোড়া দেখে চোখ কপালে তোলে। এত রূপবতী মেয়ে বাপের জন্মে দেখিনি। ফেসবুকে বীরাঙ্গনা আইডির ছবিতে পারভিন নিজের সেলফি বসিয়েছে। কেউ জানে না। ওই আইডি থেকে সে ওয়াশিকুরকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। দেখতে সুন্দরী বলেই সম্ভবত বন্ধু হওয়ার জন্য অন্তত দু’শ অনুরোধ এসেছে। কারও অনুরোধ সে গ্রহণ করেনি। এর মধ্যেই ইনবক্সে প্রেম করার, সেক্স করার, বন্ধু হওয়ার আহবান করছে মানুষ। বীরাঙ্গনা একটিরও উত্তর দেয়নি। সে বসে আছে ওয়াশিকুরের জন্য। সে বসে আছে ছোটবেলার বান্ধবী উজ্জ্বলা সাহার উত্তরের জন্য। বসে আছে ফেসবুকের সেই গুণী মেয়েগুলোর জন্য, যারা বোরখা তো পরেই না, হিজাবও পরে না, বরং চুল খুলে রাখে, চুল ওড়ায় হাওয়ায়। বসে আছে পাপিয়া ইসলামের জন্য। পারভিনের চুল ঘন কালো লম্বা, এমন চুল দেখে খালা ফুপুরাও হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। পারভিনের মা বলেন, চুলে নজর দেয় ওরা। বোরখার আড়ালে চুলগুলো রয়ে যায়। পারভিনের ইচ্ছে করে মানুষ দেখুক। কিন্তু কী করে দেখবে, কালো বোরখার তলায় চাপা পড়ে থাকে তার রূপ।

এই রূপ এক দোকানে কাপড় কিনতে গিয়ে সে একবার দেখিয়েছিল নিশাতকে। বোরখার মুখ ঢাকার ঢাকনাটা সরিয়েছিল সে, কাপড়ে দাম কত লেখা আছে, তা পড়ার ছুতোয়। নিশাত পাড়ারই ছেলে। নিশাতের ছোট ভাই রিফাত শফিকুলের বন্ধু। ছোটবেলায় যখন সে উজ্জ্বলাদের সংগে মাঠে খেলতো, নিশাতকে প্রায়ই দেখতো মাঠে ফুটবল খেলছে অথবা বন্ধুদের সংগে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। এই নিশাতের সংগে ছোটবেলায় দু’এক কলি কথা হতো, বড় বেলায় আর হয় না। নিশাত জানেই না সেই পারভিন এখন দেখতে কেমন, কিন্তু পারভিন জানে নিশাত দেখতে কেমন। নিশাত কলেজে যায়। নিশাত জানে, নিশ্চয়ই খবর রাখে যে পারভিন মাদ্রাসায় যায়। পারভিনের বাবা আলতাফ হোসেন যদি এতটা ধর্মান্ধ না হতেন, তা হলে পারভিনও হয়তো কলেজেই পড়তে যেত। কিন্তু জন্ম তো খণ্ডানো যায় না। আজ এই বয়সে তার যা ইচ্ছে করে তা করার অধিকার তার নেই। বাবা মা’র ধর্মকে তার মানতে হবে, উজ্জ্বলাকে যেমন তার বাবা মা’র ধর্মকেই নিজের ধর্ম বলে মানতে হয়। পারভিন ইচ্ছে করলেই নিশাতের কলেজে গিয়ে ভর্তি হতে পারবে না। তবে তার একটাই সান্ত্বনা, মাদ্রাসা থেকে দাখিল ফাজিল পরীক্ষায় পাশ করে তাকমিল পরীক্ষায় যদি সে পাশ করতে পারে, তাহলেই মাস্টার ডিগ্রির সমমানের হয়ে যাবে তার ডিগ্রি। কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে যে চাকরি পাবে, পারভিনও সেই একই চাকরি পাবে। নিশাত কলেজে পড়ে যে ডিগ্রি নেবে, পারভিনের হাতেও একদিন থাকবে সমমানের ডিগ্রি।

পারভিনের অস্থির অস্থির লাগে। নিশাত তাকে দেখে ছোট্ট একটু হেসেছিল। কিন্তু সামনে এসে কথা বলার সাহস হয়নি তার। পারভিনও কথা বলতে যায়নি। ছোটবেলায় আর বড়বেলায় আকাশ পাতাল তফাৎ। তফাৎ হতো না, যদি না বোরখা এসে তাদের মাঝখানে শক্ত দেয়ালটি তৈরি না করতো। এই দেয়াল তো নিশাতের সঙ্গে উজ্জ্বলা বা বৃষ্টির তৈরি হয়নি। ওদের সে কথা বলতে দেখেছে। ঘরের জানালায় দাঁড়ালেই পাড়ায় কী ঘটছে কিছু না কিছু তো দেখাই যায়। পারভিনের গায়ে বোরখা ওঠার পর থেকে জানালায় দাঁড়ানোও তার জন্য নিষেধ। কিন্তু পারভিন নিষেধ অত মানতে চায় না। মা বাবা ধারে কাছে না থাকলে সে ঠিকই মুখ বের করে দেখে মানুষের হাঁটা চলা। নিশাতকে কখনও সে যেতে দেখেনি জানালার পাশ দিয়ে। তার বড় ইচ্ছে হয় নিশাতকে সে দূর থেকে প্রতিদিন দেখুক। বালক নিশাত এখন সুদর্শন সুপুরুষ। তাকে দেখতে ইচ্ছে তো হবেই।

দাখিল পরীক্ষার তিন মাস আগেই জানালায় দাঁড়ানো, এমন কী ফেসবুকের পোস্ট পড়াও কমিয়ে দিতে হয় পারভিনকে। এই পরীক্ষায় পাশ না করলে তাকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দেবে তার হাজি বাবা। বিয়ে নিশ্চয়ই কোনও হাজি বা হবু হাজি, মাদ্রাসার শিক্ষক অথবা মসজিদের ইমামের সঙ্গেই হবে। নিশাতের মতো দেখতে কাউকে বড় হয়ে বিয়ে করতে ইচ্ছে করে পারভিনের,অথবা ওয়াশিকুরের মতো কাউকে, যার যুক্তি বুদ্ধি তাকে ভাবাবে, তাকে মুগ্ধ করবে। এমন কোনও সঙ্গী পারভিন চায় না, যে শুধু চাইবে পারভিন তাকে সেবা করুক, নিজের রূপ আর গুণ দিয়ে পারভিনই শুধু তাকে মুগ্ধ করুক। পারভিন এমন সঙ্গী চায়, যে সঙ্গী তাকে তার রূপ আর গুণ দিয়েও মুগ্ধ করবে। ওয়াশিকুর দেখতে কেমন পারভিন জানে না, কিন্তু নিশাতের সৌন্দর্য পারভিনকে মুগ্ধ করে। নিশাত কি আর মাদ্রাসায় পড়া কাউকে পছন্দ করবে! নিশাতের সংগে নিশ্চয়ই বিয়ে হবে তার কলেজে পড়া কোনও মেয়ের!

পারভিন ভাবে, তার বাবা যদি বৃষ্টির বাবার মতো হতো, তাহলেই তার জীবন বদলে যেতে পারতো। বৃষ্টি ইস্কুল পাশ করে কলেজে ঢুকেছে। জিন্স পরছে, জিন্সের ওপর জামা পরে,বুকের ওপর ওড়নাটাও তাকে পরতে হয় না। কখনও আবার সার্ট পরে। দেখলে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না পারভিনের। শফিকুলের কাছ থেকে খবর পায় বৃষ্টি সিনেমা দেখতে যায় বন্ধুদের সাথে, বন্ধুদের বাড়ি যায়, ক্যাফে রেস্তোরাঁয় যায়। এই জীবন বৃষ্টি যাপন করতে পারছে, কারণ তার বাবা মেয়েদের যা খুশি পরার, বা যেখানে খুশি ঘোরার অধিকারে বিশ্বাস করেন কিন্তু পারভিনের বাবা করেন না। দুই বাবাই কিন্তু চাকরি করছেন বিদ্যুৎ দপ্তরে। দুজনই কেরানি। পারভিনের আফসোস হয়, বৃষ্টি যাকে বাবা হিসেবে পেয়েছে, তাকে সে কেন বাবা হিসেবে পায়নি!


পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে পারভিন, রাত জেগে পড়ছে। চোখের তলায় কালি জমছে। আর ওদিকে নতুন যে অধ্যক্ষ এসেছেন মাদ্রাসায়, তিনি ঘন ঘন ডেকে পাঠাচ্ছেন পারভিনকে। প্রথম দিন অধ্যক্ষের কক্ষে যেই না ঢুকেছে পারভিন, তাকে তিনি চেয়ারে বসতে বললেন। চেয়ারটাকে নিজেই টেনে কাছে আনলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ভালো পড়াশোনা হচ্ছে তো? পারভিন মাথা নেড়ে বল্লো, হচ্ছে। ক্লাসে এত ছাত্রী থাকতে তার খবর কেন তিনি জানতে চাইছেন, সে বুঝতে পারে না। লোকটির মাথায় টুপি, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি। অনেকটা তার বাবার মতো দেখতে। অধ্যক্ষের নাম সিরাজউদ্দিন। কিছুক্ষণ কেশে, মিষ্টি হেসে বললেন, ছুটির পর এসো। পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন নিয়েছো, তা আমাকে দেখতে হবে।
পারভিন দ্রুত উঠে পড়লো চেয়ার ছেড়ে। ক্লাসের যে তার চার বান্ধবী, তাদের বললো ঘটনা, জানতে চাইলো, তার কি যাওয়া উচিত ছুটির পর? দু’তিনজনই বললো, যাওয়া উচিত। শেষে ঠিক হলো, পারভিন একা যাবে না, সংগে ওরাও যাবে। ঘরে যদি ঢোকা যায় ভালো , তা না হলে দরজার কাছে দাঁড়াবে।
পারভিন ছুটির পর চার বান্ধবীকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে বলে ভেতরে ঢুকলো অধ্যক্ষের কক্ষে। আগের বারের মতো এবারও অধ্যক্ষ তাকে চেয়ারে বসতে বলে চেয়ার নিজের দিকে টানলেন। নিজের গদির চেয়ারটিতে বসে তিনি মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। পারভিন জিজ্ঞেস করলো, ‘কোনও দরকারি কথা বলবেন?’
সিরাজউদ্দিন পারভিনের দিকে ঝুঁকে, পারভিন কিছু বুঝে ওঠার আগেই, বোরখার ঢাকনা খুলে মুহূর্তের মধ্যেই মুখ খানা দেখে নিলেন। দ্রুত হাতে পারভিন ঢেকে দিল মুখ।
সিরাজউদ্দিন হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমি জানতাম আমি জানতাম, তোমার হাতের রঙ দেখেই বুঝছিলাম, তোমার মুখ থেকে নিশ্চয়ই নূর বেরোয় । দেখ, ঠিকই নূর বের হইতাছে। এত রূপসী তুমি, তোমার রূপ না জানি কত লোককে দিওয়ানা বানাইছে।’
পারভিন বোরখার তলায় কাঁপছে তখন ভয়ে এবং ক্রোধে।
-- ‘তাহলে এই কথা বলতে আমারে এইখানে ডাকছেন?’
-- ‘না না না, এই কথা বলতে ডাকবো কেন? সামনে পরীক্ষা, পড়াশোনা কেমন করতাছো, সেইটা দেখার জন্য ডাকছি।’
--’ক্লাসে তো আরো মেয়ে আছে, ওদের খোঁজ তো নিলেন না।’
--’তোমাকে আমার ভালো লাগে, তাই।’
চোখ ছোট করে বললেন সিরাজউদ্দিন।
পারভিনের ইচ্ছে হয় দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু মুরব্বিদের অসম্মান করলে চলবে কেন! হয়তো দরজার বাইরে কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকা বান্ধবীরাই বোকা বলে গালি দেবে তাকে।

এইবার খপ করে পারভিনের ডান হাত খানা ধরলেন সিরাজউদ্দিন। হাত দিয়ে চাপতে চাপতে বললেন, ‘বাহ কী নরম, কী নরম।’ হাতটি তিনি ছাড়তে চাইছেন না। হাতটি নিয়ে তিনি নিজের গালে ছোঁয়ালেন। পারভিন সরিয়ে নিতে চায় হাত, পারে না। এরপর পারভিনকে অবাক করে সিরাজউদ্দিন তাঁর আরেকটি হাত দিয়ে বোরখার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে পারভিনের স্তন টিপতে শুরু করলেন। পারভিন কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে করতে নিজেকে সিরাজউদ্দিনের হাত থেকে খুব শক্তি খাটিয়ে ছাড়িয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। বাইরে গিয়ে হাঁপাতে লাগলো। বান্ধবীরা গোল গোল চোখ করে তাকে দেখছিল, যেন সে ভীষণ এক অন্যায় করেছে।

--’দেখলি, কী করছে শয়তানটা আমারে? আমার ব্রেস্টে হাত দিছে।’ এই বলে পারভিন কাঁদতে শুরু করলো। বান্ধবীরা তাকে অধ্যক্ষের ঘরের সামনে থেকে দূরে সরিয়ে নিল। একজন বললো, ‘অন্য মাস্টারদের কাছে বিচার দে এই হেড মাস্টারের বিরুদ্ধে।’ আরেক জন বললো, ‘মুখ বুইজা থাকাই ভালো। জানাজানি হইলে লোকে পারভিনরেই খারাপ বলবে, বলবে, ও নিশ্চয়ই হেড মাস্টারের কাছ থেকে শরীরের বিনিময়ে কিছু সুবিধা আদায় করতে চাইতাছে।’ তৃতীয় জন বললো, ‘তোর বাপরে বল তাড়াতাড়ি তোর বিয়ে দিয়ে দিতে। ম্যারেড মেয়েদের দিকে হাত বাড়ানোর সাহস কারো হবে না।’ কোনও সমাধানই পারভিনের মনঃপূত হয়নি।
পরদিন আবার ডাক পড়লো পারভিনের, মহিলা পিওন এসে জানালো, পারভিন সুলতানাকে ডাকছেন হেডমাস্টার। পারভিন বলে দিয়েছে, পারভিনের লাশ যাবে, পারভিন যাবে না।

পারভিন সুলতানা যায় না সিরাজউদ্দিনের ঘরে। সিরাজউদ্দিন এরপর আর পিওন দিয়ে নয়, শিক্ষক শিক্ষিকাদের দিয়ে খবর পাঠাতে থাকেন। এত চাপ পারভিন আর নিতে পারে না। সে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। ভয়ে কাঁপে। দুঃখে কাঁদে, কিন্তু কেউ তাকে সামান্যও সান্ত্বনা দেয় না। শুধু ক্লাসের একজন মেয়েই বলে, ‘ওই শয়তানের উদ্দেশ্য তোকে রেপ করা। কিছুতেই যাবি না ওর রুমে। বাড়াবাড়ি করলে পুলিশে রিপোর্ট করবি। দেশে তো আইন বলে কিছু আছে’। এই মেয়েটি পারভিনের পুরোনো চার বান্ধবীর কেউ নয়। নতুন পরিচয় এর সঙ্গে। নতুন এসেছে সে খাদিজাতুন্নেসায়। এই মেয়েটি পারভিনের সব ঘটনা শুনে চোয়াল শক্ত করেছে। একবার বললো, ‘আমার শরীরে হাত দিতে চাইলে আমি জুতার বাড়ি দিতাম।’ জুতো ওঠাতে পারভিন পারবে না। যতই হোক লোকটি মুরব্বি। মুরব্বি বদ হলে এড়িয়ে চলা যায়, পেটানো যায় না।

এইবার ছুটির পর আরবির শিক্ষক প্রায় ধরে বেঁধে পারভিনকে নিয়ে গেলেন অধ্যক্ষের কক্ষে। পারভিনকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিলেন। অধ্যক্ষ চেয়ার ছেড়ে উঠে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিলেন ভেতর থেকে।
‘তোমার সাথে জরুরি কথা আছে, এদিকে আসো’।
‘কী কথা?’ পারভিনের গলা শুকিয়ে গেছে ভয়ে। তারপরও শুকনো গলায় সে জিজ্ঞেস করে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে সে, নড়ে না।
সিরাজউদ্দিন বলেন, ‘দাখিল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দিবো তোমাকে। আসো’।
পারভিন এক পাও নড়ে না। বলে, ‘আমার প্রশ্নপত্র চাই না। আপনে হেডমাস্টার হইয়া প্রশ্ন ফাঁস করতে চান, আপনের তো জেল হইবো’। পারভিন দরজার সিটকিনি খোলে। দৌড়ে এসে সেই দরজা বন্ধ করে টেনে পারভিনকে ঘরের মাঝখানে নিয়ে আসেন সিরাজউদ্দিন। পারভিন কেঁদে ওঠে জোরে। বাড়িতে মা’কে সে অধ্যক্ষর কথা জানিয়েছে। মা কোনও সমাধান দিতে পারেননি, তিনি পারভিনের বাবাকে জানিয়ে দিয়েছেন যে নতুন অধ্যক্ষ পারভিনের দিকে কুনজর দিচ্ছে । তার বাবা শুনে বলে দিয়েছেন পরীক্ষা সামনে তাই মেয়ে এমন নাটক শুরু করেছে। নিশ্চয়ই পরীক্ষায় পাশ হবে না ওর। আজ পারভিন সমস্ত মন প্রাণ দিয়ে চাইছে, তার বাবা নিজ চোখে অধ্যক্ষের কক্ষের এই দৃশ্য দেখুক। সিরাজউদ্দিন ক্রন্দনরত পারভিনের মুখ চেপে ধরলেন। মুখে গুঁজে দিলেন নিজের মাথার টুপিখানা। পারভিনকে তাঁর শরীরের সংগে এত জোরে চেপে ধরলেন যে পারভিন সমস্ত শক্তি দিয়েও নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। দেয়ালে সেঁটে ধরে পারভিনের বোরখা খুলে ফেললেন তিনি। কামিজের গলা দিয়ে দু হাত ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে দু’স্তন টিপতে লাগলেন। অধ্যক্ষর দাড়ি-মুখ পারভিনের মুখের ওপর পাথরের মতো চেপে আছে। পারভিনের হাতদুটো পিঠের পেছনে, দেয়ালে। হাতদুটো সে বের করতে পারছে না। সিরাজউদ্দিন তার শরীরের ভার দিয়ে পারভিনের হাত দুটোকে দেয়ালে বন্দি করেছেন। পারভিন ঠেলেও পারছে না সিরাজউদ্দিনকে শরীর থেকে সরিয়ে দিতে। সিরাজউদ্দিন এবার কামিজের বোতামগুলো টান দিয়ে খুলে ফেলেন। কামিজও টেনে ছিড়ে ফেলেন। এর পর পারভিনের ছোট ছোট স্তন মুখের ভেতর নিয়ে চুষতে থাকেন। পারভিনের হাত দুটো ধরে রাখেন দুই শক্ত হাতে। পা দুটো নিজের দু’পা দিয়ে আটকে রাখেন। পারভিনের সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে আশংকায়। সে চিৎকার করে। কোথাও তার চিৎকার পৌঁছোয় না। এবার তাকে মেঝেতে নামান সিরাজউদ্দিন। ধাক্কা দিয়ে শুইয়ে দেন। পারভিনের শরীরের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েন তিনি। তাঁর শক্ত পুরুষ দণ্ডটি পারভিনের দু ‘উরুর মাঝখানে চেপে ধরেন। পারভিনের মনে হতে থাকে, তাকে মেরে ফেলবেন সিরাজউদ্দিন। তার শরীরে আজ পর্যন্ত কেউ এভাবে হাত দেয়নি, মুখ দেয়নি। ধর্ষণের নাম সে শুনেছে, পড়েছে, এর নামই তাহলে ধর্ষণ!

হেডমাস্টারের ঘর থেকে যখন সে বেরোয়, মাদ্রাসা সুনসান, কেউ নেই কোথাও, একটি বান্ধবীও তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে নেই। তার মাথা ঘুরছিল, গা গুলোচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সে মুর্ছা যাবে। কিন্তু নিজেকে সে ভেঙ্গে পড়তে দিচ্ছিল না। সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে । হেঁটেই বাড়ি যায় সাধারণত পারভিন। সেদিন একটি রিক্সা নিল। এই অধ্যক্ষকে বিদেয় না করা অবধি সে দাখিল পরীক্ষায় বসবে না, দাঁতে দাঁত চেপে এই প্রতীজ্ঞা করলো সে নিজের কাছে।

বাড়ি ফিরে সে ফেসবুক খুলে নিজের বীরাঙ্গনা আইডিতে গিয়ে শুধু লিখলো, ‘সিরাজুদ্দিন,তুই তো পাঁচবেলা নামাজ পড়িস। সবকটা রোজাও রাখিস। তুই যে মেয়েদের ধর্ষণ করিস, সেটা তোর মা জানে তো? তোর স্ত্রী জানে তো?তোর ছেলেমেয়েরা জানে তো?’ বীরাঙ্গনা আইডি থেকে দেওয়া এই স্টেটাস দেখে কেউ বুঝবে না কে এই বীরাঙ্গনা, কে এই সিরাজউদ্দিন। বীরাঙ্গনা আইডির ফলোয়ারের সংখ্যা ৩০০, কেউ পারভিনের পরিচিত নয়। কেউ না বুঝুক পারভিন কী লিখেছে, কিন্তু পারভিন ওইটুকু লিখে ভেতরের যন্ত্রণা কিছুটা হলেও কমিয়েছে। আরেকটি স্টেটাস সে দেবে, তৈরি হয়েছে লেখার জন্য, ‘সিরাজুদ্দিন, আমি যদি জীবনে কাউকে খুন করি, তোকে খুন করবো। তোকে খুন করলে নিজেকে আমার অপরাধী বলে মনে হবে না’। কিন্তু এই স্টেটাসটা দেওয়ার আগেই একটি নয়, কয়েকটি লেখা আগুনের ফুলকির মতো ছিটকে ছিটকে এলো। ভয়ানক একটি খবর ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। খবরটি পড়ে সে ধপাস করে বসে পড়লো মাটিতে। ঢাকার রাস্তায় ওয়াশিকুর বাবুকে কে বা কারা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মেরেছে। ওয়াশিকুর তার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে সকাল বেলা অফিসে যাচ্ছিল, তখনই পেছন থেকে সন্ত্রাসীরা তাকে আঘাত করেছে। রক্তাক্ত পড়ে আছে ওয়াশিকুর, মাথা থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। রাজপথ লাল। ওয়াশিকুর কখনও নিজের ছবি দেয়নি ফেসবুকে, এই প্রথম ওয়াশিকুরকে দেখলো পারভিন, তার মৃত্যুর পর। মাত্র ২৭ বছর বয়স ছিল তার। কে খুন করেছে ওয়াশিকুরকে? যে ওয়াশিকুরের লেখা পড়ে পড়ে পারভিন সমাজের প্রচলিত সব প্রথাকে মেনে নেওয়ার আগে প্রশ্ন করতে শিখেছে,সেই ওয়াশিকুরকে হত্যা করা হলো, কারণ পারভিনের মতো মানুষদের মধ্যে ওয়াশিকুর বোধ বুদ্ধির সঞ্চার করছে বলে, অন্ধ বিশ্বাস দিয়ে নয়, সবকিছু যুক্তি দিয়ে বিচার করতে বলছে বলে! নিজে প্রায় ধর্ষিতা হতে হতে আজ ফিরেছে মাদ্রাসা থেকে। নিজের অপমানের দুঃখে, আর ওয়াশিকুরকে হারানোর দুঃখে পারভিন মেঝেয় লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে। সে প্রাণ ভরে কাঁদতে চায়। চায় না কোনও মা বাবা বা কোনও শুভাকংখী এসে এই কান্না তার বন্ধ করুক, তাকে মেঝে থেকে তুলুক।

প্রায় ঘণ্টা খানিক ওভাবে পড়ে থাকার পর পারভিন উঠে গোসল করে। গা থেকে সিরাজউদ্দিনের স্পর্শের ক্লেদ সে ঘন ঘন সাবান মাখিয়ে ধুয়ে ফেলে। পরণের কাপড়গুলো সে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। মন থেকে আর শরীর থেকে দূর করে সিরাজউদ্দিনের দেওয়া যন্ত্রণা। গোসল করে বেরিয়ে সে শুয়ে পড়ে। রাতে আর সে খাবার খায় না। মাকে জানিয়ে দেয়, সিরাজউদ্দিন তাকে তার ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করতে চেয়েছেন, কোনওভাবে সে বেঁচে ফিরেছে। কাল থেকে মাদ্রাসায় আর যাবে না। গেলে প্রতিদিনই তাকে ধর্ষণ করবেন সিরাজউদ্দিন। ওই মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষা সে দেবে না। যদি দিতেই হয় পরীক্ষা, অন্য মাদ্রাসা থেকে দেবে। আরও বলেছে, সিরাজউদ্দিনকে সে ছেড়ে দেবে না। প্রতিবাদ করবে। সে কাল সকালেই থানায় গিয়ে সিরাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করবে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করবে, তাঁকে জেলে না পুরে পারভিনের শান্তি হবে না। আইন আছে মেয়েদের যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে, এই আইনের সাহায্য সে কেন নেবে না? সে দেখেছে সে যখন চিৎকার করে ধর্ষণ থেকে বাঁচতে চাইছিল, মানুষকে ডাকছিল, মাদ্রাসার একটি প্রাণীও তাকে রক্ষা করতে আসেনি। এক আইনই তাকে রক্ষা করবে। হুজুররা সব একেকটা ধর্ষক, একেকটা শয়তান,মুখে দাড়ি রাখলে, মাথায় টুপি পরলে আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লেই কেউ ভালো লোক হয় না। যাদের ভেতর শয়তানি বেশি, তারাই হুজুর সাজে। পারভিন জানিয়ে দেয়, তার বাবা হয়তো তাকে আস্ত রাখবে না, না রাখুক, কিন্তু এটাই তার শেষ কথা, সে অন্য মেয়েদের মতো মুখ বুজে আর থাকবে না। সে কোনও পাপ করেনি, পাপ করেছেন সিরাজউদ্দিন। এ পারভিনের লজ্জা নয়। লজ্জিত যদি কাউকে হতে হয়, সিরাজউদ্দিনকে হতে হবে।


পারভিন ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। ওয়াশিকুরের লেখা পড়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের লোকদের ধর্মীয় অনুভূতিতে নাকি আঘাত লেগেছিল , তাই তারা নৃশংসভাবে কুপিয়ে মেরেছে ওয়াশিকুরকে। ওয়াশিকুর পারভিনের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করেনি, তাই বলে ওয়াশিকুরের ওপর কোনও রাগ নেই তার। বরং ওয়াশিকুরের অকাল মৃত্যুর জন্য তার যে দুঃখ হচ্ছে, এই দুঃখ সিরাজউদ্দিনের দেওয়া দুঃখের চেয়ে গভীর। পারভিন ওয়াশিকুরের লেখাগুলো আবার পড়ে। -- ‘ধর্মানুভূতি দিয়ে চাষাবাদ হয় না, উৎপাদন হয় না, শিক্ষা হয় না, গবেষণা হয় না, শিল্প -সাহিত্য হয় না। ধর্মানুভূতি দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা হয়, দাংগা হয়, লুটপাট হয়, ধর্ষণ হয়, নোংরা রাজনীতি হয়’। আর একটি লাইন পারভিন যোগ করে, ‘ ধর্মানুভূতি দিয়ে নৃশংসভাবে মানুষ খুন হয়’। ওয়াশিকুর তো জানতো না তাকে একদিন খুন করা হবে। পারভিনও জানতো না, তাকে একদিন ধর্ষণ করতে চাইবে এক মোল্লা। সিরাজউদ্দিনের মতো লোকরাই পারভিনের মতো মেয়েদের ধর্ষণ করে, ওয়াশিকুরের মতো যুবকদের হত্যা করে। এই সিরাজউদ্দিনই আগামীকাল শিক্ষক মিটিং-এ ওয়াশিকুরকে হত্যা করা সমর্থন করবেন, শুকরিয়া আদায়ের জন্য এক রাকাত নফল নামাজও পড়ে নেবেন। কেউ জানবে না, ওই ঘরেই যে সিরাজউদ্দিন মাদ্রাসার এক বোরখাপরা ছাত্রীকে বলাৎকার করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ছাত্রীটি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে পুরুষাংগ বরাবর লাথি মেরে লোকটিকে কাবু করে দরজা খুলে ছুটে বেরিয়েছিল। পারভিন সারা রাত জেগে থাকে ফোনখানা চোখের সামনে নিয়ে। পড়তে থাকে ওয়াশিকুরের লেখা, ‘কোনও ধর্মই নারীকে কথিত সম্মানটুকুও দেয়নি। তারা সম্মান দিয়েছে মাকে, বোনকে, স্ত্রীকে, কন্যাকে। যারা নিজেদেরকে এইসব পরিচয়ে সীমাবদ্ধ রেখেছে -- তারা সতী, আর যারা মানুষ হতে চেয়েছে, তাদেরকে বেশ্যা উপাধি দিয়েছে ধর্মীয় সমাজ’।

ফেসবুকে পাপিয়া ইসলামের লেখা আবার পড়ে পারভিন, পাপিয়া লিখেছে -- ‘মেয়েরা যদি যৌন হেনস্থা আর ধর্ষণের প্রতিবাদ করে, তাহলেই সমাজটাকে বদলানো যাবে। ধর্ষণ করার আগে পুরুষ বুঝে যাবে, তাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে অথবা জেলে পচে মরতে হবে। মেয়েরা ভয়ে মুখ বুজে থাকে বলেই পুরুষেরা নিশ্চিন্তে তাদের হেনস্থা করে’। পারভিন সিদ্ধান্ত নেয়, বাড়ি থেকে আপত্তি এলেও পারভিন হেনস্থার প্রতিবাদ করবে। কোত্থেকে এই সাহস পাচ্ছে সে, সে জানে না। আগে বাবার এক ধমক খেয়ে চুপ করে বসে থাকতো। বাবার আদেশ অমান্য করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আজ তার সামনে বাবা নয়, আছে বেঁচে থাকা আর মৃত্যু। বেঁচে থাকতে হলে তাকে লড়াই করতে হবে। আপস করে, মুখ বুজে, অন্যায় সহ্য করে,অপমান সহ্য করে,অত্যাচার সহ্য করে বেঁচে থাকার নাম বেঁচে থাকা নয়। এর আরেক নাম মৃত্যুই। রেশমির কাছে পারভিন ফোন করে রাত বারোটায়। রেশমি ক্ষুব্ধ হয়ে আছে ওয়াশিকুরের হত্যাকাণ্ডে। কারা মেরেছে? পারভিন ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, মাথাটা চাদরে ঢেকে, কেউ যেন শুনতে না পায়। লাগোয়া ঘর, যে কেউ শুনতে চাইলে শুনতে পারে। পারভিনের এই ঘরখানা আলাদা কোনও ঘর নয়। বসার ঘরেই হার্ডবোর্ডের পার্টিশান দেওয়া ঘর। এখানেই চৌকি পেতে থাকে পারভিন। বাকি ঘরে বড় বিছানায় ঘুমোয় বাবা আর শফিকুল, আর ছোট ঘরটায় যে ঘরটায় কাপড় চোপড় জিনিস পত্রের তিনটে আলমারি সে ঘরে বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া খাটে ঘুমোয় মা আর মেঝেয় তোশক বিছিয়ে ঘুমোয় শেফালির মা। পারভিন তার ছোট্ট ঘরটির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে না। কিন্তু আজ সে বন্ধ করেছে। গলা নামিয়ে রেশমির সংগে কথা বলছে। কারা মেরেছে ওয়াশিকুরকে এই প্রশ্নের উত্তরে রেশমি হতাশা আর ক্রোধে ফেটে পড়া কণ্ঠে বলে, ‘আর কারা? যারা অভিজিৎকে মেরেছে, তারাই , ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা । এদের মারলে নাকি বেহেস্তে যাওয়া যাবে, বেহেস্তে হুরীদের লোভে মানুষ খুন করে ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা’। ওয়াশিকুরকে খুন করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল হবে পরদিন, রেশমি ঠিক করেছে যাবে সে। বাড়িতে জানালে বাধা দেওয়া হবে, জানে সে, তাই সে কাউকে জানাবে না। প্রতিবাদ মিছিলে গেলে ওয়াশিকুরকে ফেরত পাওয়া যাবে না ঠিক। কিন্তু অন্যয়ের প্রতিবাদ না করা মানে অন্যায়কে মেনে নেওয়া। রেশমিকে সে সিরাজউদ্দিনের যৌন হেনস্থার ঘটনা বলতে চায়, কিন্তু বলে না। সম্ভবত এই ভেবে বলে না যে ওয়াশিকুরের মৃত্যুতে শোকে ডুবে আছে রেশমি, পারভিনের ঘটনা শুনলে হতাশা তাকে ভাসিয়ে নেবে। রেশমিকে সে ভীষণ ভালোবাসে। আত্মীয় স্বজনের মধ্যে এক রেশমিই তার সবচেয়ে আপন। রেশমির খুব কষ্ট হোক, পারভিন চায় না। রেশমি নামাজ রোজা না করলেও নাস্তিক নয়। কিন্তু ওয়াশিকুরের জন্য মিছিলে যাবে সে। ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করলে, রেশমির ধারণা, শুধু নাস্তিকদের জন্যই খারাপ দিন আসবে না, আস্তিকদের জন্যও খারাপ দিন আসবে। পারভিন মনে মনে বলে, ঢাকায় থাকলে সেও যোগ দিত মিছিলে। বোরখা পরে কি মিছিলে যেত পারভিন? রেশমি তো বোরখা পরে না। তার মানে কি রেশমির ধর্ম-বিশ্বাস নেই? রেশমি জোর দিয়ে বলে, ‘বোরখাওয়ালীদের চেয়ে বেশি আছে আমার ধর্ম বিশ্বাস। ঘোমটার তলায় খ্যামটা নাচ আমার ঢের দেখা আছে। মানুষ ভালো হলে যেমন হজ্বে যাওয়ার দরকার হয় না, মানুষ ভালো হলে তেমন বোরখা পরারও দরকার হয় না’।

পারভিন এইবার ফিসফিস করে বলে, কেউ যেন শুনতে না পায় বাড়ির। বাবার নাক ডাকছে, মায়েরও। কেউ শুনবে না, নিশ্চিত হয়েও পারভিন ফিসফিস করে, ‘তোমার কি একবারও সন্দেহ হয় না?’
‘কী ব্যপারে?’
‘ধর্মে।’
‘ধর্মে?’
‘হ্যাঁ ধর্মে। এই ধরো আল্লাহ রসুলে। বেহেস্ত দোযখে।’
‘তোর সন্দেহ হয়?’
‘আমার হয়। প্রায়ই হয় আজকাল। এর মধ্যে ইউটিউবে ওয়াজ শুনেছি। খারাপ খারাপ লোক আল্লাহ রসুলের বানী শোনায়। বানীগুলো কোনওটাই তো ভালো না।’
রেশমি হো হো করে হেসে ওঠে। বলে, ‘কাউরে কইস না। এইসব নিজের মনে মনে রাখ।’
পারভিন স্বস্তি পায় সন্দেহের কথাটা বলে। রেশমিকে ধরে, ‘তুমি এইবার আল্লাহর কসম কইরা কও তোমার সন্দেহ কি কোনোদিনই হয় নাই? একবারের জন্যও হয় নাই? এক মুহূর্তের জন্যও না?’
রেশমি বলে, ‘কার না হয় সন্দেহ, ক? বড় বড় পীর, হুজুর, সবারই হয়। কিন্তু সন্দেহ হয় কইলে তো ওয়াশিকুরের মতো মরতে হইবো। তাই সবাই মুখোশ পইরা থাকে, সবাই ভান করে, বিশ্বাসের ভান। পীর হুজুররা বিশ্বাস ভাংগাইয়া ব্যবসা কইরা লইতাছে।’
রেশমির সঙ্গে প্রায় ভোর অবধি কথা হয় পারভিনের। আযানের পর তার ঘুম পায়। ফোনে কথা বন্ধ করে পারভিন ঘুমোয়। ঘুম ভাঙ্গে বেলা করে। মাদ্রাসায় না গিয়ে সে তৈরি হয় থানায় যাওয়ার জন্য। সে তার মাকে বলে, সে আজ বোরখা পরবে না, পরবে হিজাব। হিজাব পরলে শরীর হাল্কা লাগে। সারা শরীর কালো একটি আলখাল্লা দিয়ে ঢেকে রাখা হলে আলখাল্লার ভারই তো তাকে নত করে ফেলে। হিজাব পরে অন্তত মাথা তো কিছুটা উঁচু করে চলাফেরা করা যায়। সত্যি সত্যিই বোরখা পরে না সে। মা আর ভাই শফিকুলকে সঙ্গে নিয়ে সিরাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করতে থানায় যায়। থানায় জানায় খাদিজাতুন্নেসা মহিলা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ তাকে ধর্ষণ করার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছেন , এর মধ্যে তাঁর রুমে ডেকে নিয়ে গিয়ে নানা ভাবে যৌন হেনস্থা করেছেন । পারভিন বলে দেয় কী বলেছে তাকে হেডমাস্টার। তাকে দাখিল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দিয়ে দেবেন গোপনে, ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করবে পারভিন। দাখিলের প্রশ্নপত্র আগে থেকে পাওয়ার কোনও ইচ্ছে পারভিনের নেই। আর সবার মতোই সে পরীক্ষায় বসবে। যে নম্বর তার ভাগ্যে আছে, সে তা পাবে। খারাপ করলে খারাপ, ভালো করলে ভালো।

থানার ওসি অদ্ভুত ব্যবহার করেছেন পারভিনের সংগে। মা আর ভাইকে বাইরে বসতে বলে ভেতরে শুধু পারভিনকে ঢুকতে বলেছেন। খুঁটিনাটি জানতে চেয়েছেন কী করে সিরাজউদ্দিন তার হাত ধরলেন, ঠিক কোথায় কোথায় ঢুকিয়েছেন হাত, ঢুকিয়ে কী করেছেন, স্তন যদি টেপেনই, কীভাবে টিপেছেন, কতটা জোরে টিপেছেন, ডান স্তন নাকি বাম স্তন। জানতে চেয়েছেন পারভিনের শরীরের আর কোন কোন জায়গা স্পর্শ করেছেন সিরাজউদ্দিন । স্পর্শ করার বাইরে আর কিছু করেছেন কিনা। আর কিছু মানে? আর কিছু মানে আর কিছু। সিরাজউদ্দিন কি নিজের পাজামা খুলেছিলেন? হ্যাঁ খুলেছিলেন। ওসি বললেন, ‘খুললে কী বেরোলো, সাইজ কী? কালার কী? সব তো বলতে হবে। জিনিসটা বাঁকা না সোজা, কোনও জন্মদাগ আছে কিনা। ‘
পারভিন বলে, ‘আমি তাকাই নাই ওইদিকে।’
‘তোমারে করতে চাইছে, কিন্তু করে নাই। তাইলে তোমার অভিযোগটা কিসের?’ বলতে বলতে ওসি নিজের মোবাইল দিয়ে ভিডিও তুলতে থাকে পারভিনের। পারভিন দুহাতে মুখ ঢাকে। মুখ ঢাকা অবস্থায় সে প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকে।
‘শরীরের নিচের অংশে হাত দিছিল?’
‘দিছিল।’
‘তোমার পায়জামা খুলছিল?’
‘খোলার চেষ্টা করছিল, কিন্তু খুলতে পারে নাই।’
‘খুলতে পারে নাই ? তাইলে অভিযোগটা কী তোমার?’
‘অভিযোগটা হইল, সে খোলার চেষ্টা করছিল। অভিযোগটা হইল সে আমার গায়ের বিভিন্ন জায়গায় জোর করে হাত দিছে। আমারে মাটিতে ফালাইয়া কাপড় চোপড় খুলার চেষ্টা করছে। আমার হাত টান দিয়া নিয়া তার ইয়ে ধরাইছে। আমি জোরে লাত্থি দিছি তার ইয়েতে, তাই ছুটতে পারছি। মাদ্রাসা ছুট্টি হইয়া গেলে আমারে তার রুমের ভিতরে ডাকে। সেইদিন দিছে দরজা বন্ধ কইরা। আমি যে কিভাবে তার হাত থেকা বাঁচছি, সে আমি জানি।’ পারভিন মুখ দু’হাতে ঢেকেই কাঁদতে কাঁদতেই বলে ওসির কাছে।
ওসি বার বারই বলেন, ‘হাত সরাও। মুখটা দেখাও। কান্নার কী হইছে? কিছু তো শেষ পর্যন্ত হয় নাই। তোমার ইজ্জত তো নষ্ট হয় নাই। তাইলে কান্দো কেন?’
তারপরও অঝোরে কাঁদে পারভিন।
এই কান্না এবং আলাপচারিতার ভিডিও ওসি তার ফেসবুকে পোস্ট করেন। মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে পড়ে ভিডিও।



সিরাজউদ্দিনের যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে থানায় এফ আই আর করেছে পারভিন। আদালতে এখন মামলা চলবে সিরাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে। যৌন হেনস্থা ধর্ষণ ইত্যাদির মামলায় এখন জামিন পাওয়া দুরূহ। চোয়াল শক্ত হয় তার, লোকটাকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বে পারভিন। মেয়ে বলেই তাকে দুর্বল ভেবেছে তারা। মেয়েরাও যে সবল হতে পারে, সাহসী হতে পারে, দৃঢ়চেতা হতে পারে, তা মানুষ ভুলেই গিয়েছিল। রেশমিকে সেদিনই পারভিন জানিয়েছে যে সে এক ধর্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ধর্ষকটি তাকে ধর্ষণ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। ঘটনাটি ঘটেছে তাদের মাদ্রাসাতেই, তাদের অধ্যক্ষের ঘরেই। ধর্ষকটি আর কেউ নয়, তাদের অধ্যক্ষই। পারভিন জানিয়েছে সে মাদ্রাসা বয়কট করেছে, দাখিল পরীক্ষা সে দেবে না।

রেশমি সব শুনে বললো, ‘তোর দুইটা কাজ করতে হবে এই মুহূর্তে। মাদ্রাসায় যাইতে হবে, নিয়মিত ক্লাস করতে হবে। পরীক্ষা দিতে হবে। এগুলো না করলে হবে তোর হেরে যাওয়া। তুই হারবি কেন, দোষ তো তুই করস নাই’। যে দোষ করেছে, সে মাদ্রাসা থেকে বেরোবে, আমি বেরোবো কেন? ঠিকই তো। পারভিন থানায় রিপোর্ট করার পর মাদ্রাসায় যেতে শুরু করে, তবে বোরখা পরে নয় আর, হিজাব পরে। ক্লাসের বান্ধবীদের সে জানিয়ে দিয়েছে, সে অধ্যক্ষের কীর্তিকলাপ থানায় জানিয়েছে।

মাদ্রাসায় অন্য দিনের মতোই সে যায়। পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়। অধ্যক্ষ তাকে আর ডাকেন না তাঁর ঘরে। পারভিনের মুখখানা যারা আগে দেখেনি বোরখার কারণে, তারা মুগ্ধ নয়নে দেখে। বান্ধবীরা আগেই বোরখা সরিয়ে দেখে নিয়েছিল, অথবা বাড়িতে গিয়ে দেখেছে, তারা জানেই যে পারভিন সুন্দরী, তাদের অবাক হওয়ার কিছু নেই। বোরখা ফেলে হিজাব পরাটায় তারাও বেশ চমকিত। তাদেরও ইচ্ছে করে বোরখা ফেলে দিতে, কিন্তু বাপ ভাইয়ের হুমকিধামকির কারণে পারছে না। পারভিনের হিজাব যে সহজে তার বাবা বা মা মেনে নিয়েছেন তা নয়। কিন্তু পারভিন বলে দিয়েছে, ‘বোরখা পরি বলে আমারে দুর্বল আর নিরীহ ভাবছে মাস্টারেরা। তাই আমারে হেনস্থা করতাছে। হিজাবি মেয়েগুলারে ওপর ঝাপাইয়া পড়তে কিন্তু সাহস পায় না। ওদেরে কামড়াইলে ওরাও কামড় দিয়া দেয়। বোরখাওয়ালীরা পারে না, ওদের দাঁত মুখ আড়াল করা থাকে। আশে পাশে কী হইতাসে, বোরখা পরা থাকলে দেখা যায় না। এই জন্য বোরখাওয়ালীদের আক্রমণ করা শয়তানদের জন্য সোজা।’

শফিকুল সায় দিয়েছে বোনের কথায়। তার মা শুধু ভাবলেন, ‘না জানি এই রূপ দেখে পাড়ার বখাটে ছেলেরা আবার পটিয়ে পাটিয়ে বিয়ে করে ফেলে, বাবার বক্তব্য, লোকে কী বলবে! আপনার মেয়ে পর্দা পুশিদা মতো ছিল, বোরখা ছাইড়া হিজাব ধরলো কেন? পারভিন বলে দিল, ‘আব্বু, তুমি বইলা দিবা আমার মেয়ে তো বোরখা ছাইড়া বিকিনি ধরে নাই। বোরখা ছাড়ছে, হিজাব ধরছে, হিজাব তো পর্দাই। মাদ্রাসার সব মেয়ে তো বোরখা পরে না, হিজাবও তো পরে। তাছাড়া বোরখাটা প্র্যাক্টিক্যাল না। বোরখা পরা ছিলাম বইলা ওইদিন আমার ওপর হামলা করতে পারছে ওই লোক।’
‘কোন লোক?’
আলতাফ হোসেন এখনও জানেন না মাদ্রাসায় ঠিক কী ঘটেছে।
‘ওইটা শুইনা তোমার আর কাম নাই। তুমি নিজের চাকরি বাকরি করো। আমারে ইস্কুলে না দিয়া মাদ্রাসায় দিছ, যন্ত্রণা তো আমার পোহাইতেই হইব কিছু।’
‘কোন লোক কী করছে?’ আলতাফ হোসেন চেঁচিয়ে জানতে চান।
‘আমার কাছে শুনতে চাইও না, আম্মুর কাছে শুইনা নিও।’
এই বলে বেরিয়ে যায় পারভিন। তার চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরে।

মাদ্রাসার গেটের কাছেই একটি লোক সামনে এসে দাঁড়ায়, বলে, ‘থানায় কমপ্লেইন্ট করছস। উইথড্র কর, এখনও সময় আছে।’
পারভিন আশপাশটা আড়চোখে দেখে নেয়, যে লোকটা সামনে দাঁড়িয়েছে, সে একা আসেনি, একই বয়সের, একই পোশাক পরা আরও তিনটে লোক কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে দল বেঁধেই আসা হয়েছে।
পারভিন বলে, ‘উইথড্র করবো না, কী করবেন?’
লোকটি বলে, ‘ভালোয় ভালোয় বলতাছি। কথা শুন। নাইলে কিন্তু খারাপ হইবো।’
পারভিন বলে, ‘আমার আর কী খারাপ করবি তরা? তদের হুজুরের মতো রেইপ করবি তো, আর কী করবি? অস্ত্র তো তোদের একটাই।’
বলে চলে যায় মাদ্রাসার ভেতরে।
ছুটির সময় দেখে ওরা দাঁড়িয়ে আছে। এইবারও পথ আটকে একই কথা বলে, ‘এখনও সময় আছে উইথড্র কর। পরে পস্তাইবি।’
পারভিন সাফ সাফ জানিয়ে দেয়, সে কেইস উইথড্র করবে না, পাপীকে পাপের শাস্তি ভোগ করতে হবে।

এর পরের দিন, এর পরের দিনের পরের দিনও পারভিন দেখে মাদ্রাসায় আসা যাওয়ার পথে হুমকি দেওয়া চারটে লোক দাঁড়িয়ে আছে। দু’ চোখ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে ঘৃণা। পারভিন তাদের সামনে দিয়ে দ্রুত হেঁটে যায়, যেন তাদের দেখেনি। তার ইচ্ছে করে হুমকি দেওয়া লোকগুলোর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করতে। কিন্তু সেদিন ওসি যেভাবে প্রশ্ন করছিলেন, তার ইচ্ছে করে না আবার থানায় যেতে। এরা যে অধ্যক্ষের পোষা গুন্ডা, তা বুঝতে পারে পারভিন। ওদের পরণে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি, মুখে গোঁফ নেই কিন্তু দাড়ি আছে। এই চেহারাটা ভয়ঙ্কর।

পরের সপ্তাহে পারভিন মাদ্রাসায় যায়নি। পরীক্ষার আগে আগে যাওয়াটা খুব দরকার, রেশমিও বলেছিল মাদ্রাসায় যাবি না কেন, তুই তো কোনও অন্যায় করস নাই। কিন্তু তারপরও পারভিনের মনে হতে থাকে হয়তো ওই লোকগুলো তাকে টেনে থানায় নিয়ে যাবে সিরাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ বাতিল করার জন্য। সমাজটা এরকম, যে, কাউকে, বিশেষ করে মেয়েদের, যে কোনও জায়গায় টেনে হিঁচড়ে নেওয়া যায়। লোকে ভাবে, মেয়ে নিশ্চয়ই কোনও খারাপ কাজে লিপ্ত ছিল, তাকে এখন তার ভালোর জন্য সরিয়ে আনা হচ্ছে। এত যে ধর্ষণ ঘটছে, তারপরও মেয়েদের যারা রাস্তাঘাটে হেনস্থা করছে, মানুষ ভেবেই নেয়, হেনস্থা তো আর খামোকা করছে না, নিশ্চয়ই হেনস্থা করার মতো কারণ ওই মেয়ে ঘটিয়েছে।

পারভিনের বাবা জানতে চেয়েছিলেন পরীক্ষার আগে পারভিন এভাবে ক্লাস কামাই করছে কেন। পারভিনের মা-ই উত্তর দিয়েছেন, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করার পর অধ্যক্ষের লোকেরা ওকে হুমকি দিচ্ছে, অভিযোগ বাতিল না করলে পারভিনের নাকি রক্ষে নেই। ও এখন ভয় পাচ্ছে মাদ্রাসায় যেতে। আলতাফ হোসেন বলেন, কিন্তু এভাবে তো বেশিদিন চলবে না। তার তো আজ না হোক কাল যেতেই হবে। পরীক্ষায় ফেল করা চলবে না। ফেল করলে তড়িঘড়ি যে কারও সংগে বিয়ে দিয়ে দেবো বলে দিও।

পরের সপ্তাহে পারভিন মাদ্রাসায় যায়। সকালে সে লোকগুলোকে দেখতে পায় না। বিকেলে বেরোতে বেরোতে তার একটু দেরি হয় যায় সেদিন। ক্লাসের এক ছাত্রী তাকে শেষ পিরিয়ডে একটা অংক দেখিয়ে দিতে বল্লো, সেই অংকটি করতে গিয়েই দেরি। কিন্তু যখন সে বেরোবে তখনই চার বোরখাওয়ালী তাকে ঘিরে ধরে। এদের চোখ মুখ দেখা যাচ্ছে না। মেয়ে বলে মনে হচ্ছে না এদের, কথা বলছে এরা, কিন্তু পুরুষের কণ্ঠস্বরে। এই মাদ্রাসা তো সম্পূর্ণই মেয়েদের। কী করে ঢোকার সুযোগ পায় পুরুষেরা। মেয়েরাই কি শুধু বোরখা পরে? ছেলেরাও বোরখা পরে, তবে ক্রাইম করার জন্য, আর কিছুর জন্য নয়। বোরখা না পরলে মেয়েরা ড্যাবড্যাব করে তাকাবে, এই ভয়ে কি ছেলেরা বোরখা পরবে কোনওদিন! যেমন মেয়েরা পরে! ছেলেদের যৌন আকর্ষণ যেন না জাগে মেয়েদের চুল থেকে শুরু পায়ের নখ অবধি দেখে, সে জন্য তো মেয়েরা ঢেকে রাখে চুল থেকে পায়ের নখ অবধি।

বোরখাওয়ালী দুজন পারভিনকে টেনে মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে যায়। পেছন পেছন বাকি দুজন বোরখাওয়ালী আসে। এক বোরখাওয়ালির বোরখার তলায় বড় একটি পাঁচ কেজি কৌটো। সেটি হঠাৎই , পারভিন কিছু বুঝে ওঠার আগেই, পারভিনের শরীরে ঢেলে দিল। পারভিন বুঝে যায় এ কেরোসিন, সারা শরীরে তার কেরোসিনের গন্ধ। দৌড়ে ছাদ থেকে সে পালাতে চায়, কিন্তু ধরে ফেলে তাকে এক বোরখাওয়ালি। পারভিন অনুমান করে বোরখার আড়ালে ওরা ওই হুমকি দেওয়া লোকগুলো। গোঁফ নেই দাড়ি আছে -ওই হিংস্র চোখের লোকগুলো। ওদের শক্তি প্রচন্ড, টেনে তাকে ছাদের মাঝখানে দাঁড় করায় ওরা। তারপর তো যে কাজের জন্য এসেছে সেটি করে, ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় পারভিনের দিকে। দপ দপ করে সারা শরীর জ্বলে ওঠে পারভিনের। বোরখা -পরা পুরুষগুল বোরখা ছাদেই খুলে রেখে পালিয়ে যায় হাওয়ার বেগে। পারভিন আগুন জ্বলা শরীরেই ছাদ থেকে নেমে আসে। মাদ্রাসা ছুটি হয়ে গেছে, গেট পর্যন্ত সে দৌড়োতে পারে, এর পর আর পারে না। রাস্তার লোকেরা তাকে ঘিরে ধরে। দেখতে থাকে সে পুড়ছে। কেউ একজন এম্বুলেন্সে খবর দেয়। সেই এম্বুলেন্স আসতে আসতে যতক্ষণ সময় নেয়, ততক্ষণে শরীরের নব্বই ভাগ পুড়ে গেছে পারভিনের। হাসপাতালে খবর পেয়ে বাবা মা ভাই আর কয়েকজন আত্মীয় স্বজন আসে,পাড়ার লোকজনও ভিড় করে,ভিড়ের মধ্যে নিশাতকে দেখতে পায় পারভিন। বড় হওয়ার পর নিশাত তাকে এই প্রথম বোরখা আর হিজাব ছাড়া দেখলো। আলতাফ হোসেন হাউমাউ করে কাঁদছিলেন, পারভিন বললো, ‘আমি তো মরেই যাচ্ছি আব্বু, আমার জন্য কানবা না। সিরাজউদ্দিন যেন জেল থেকে ছাড়া না পায়, সেইটা খেয়াল কইরো। ও ছাড়া পাইলে মাদ্রাসার প্রত্যেকটা মেয়ের সর্বনাশ করবে। ও নিজের মেয়েকেও ছাড়বে না।’

মদন সদর হাসপাতালের মেঝেয়ে গড়িয়ে কাঁদেন পারভিনের মা। শফিকুল দেয়ালে মাথা ঠুকে কাঁদে। নিশাত বোবা চোখে চেয়ে থাকে। পারভিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।


যতক্ষণ সময় নেয়, ততক্ষণে শরীরের নব্বই ভাগ পুড়ে গেছে পারভিনের।
হাসপাতালে খবর পেয়ে বাবা মা ভাই আর কয়েকজন আত্মীয় স্বজন আসে,পাড়ার
লোকজনও ভিড় করে,ভিড়ের মধ্যে নিশাতকে দেখতে পায় পারভিন। বড় হওয়ার
পর নিশাত তাকে এই প্রথম বোরখা আর হিজাব ছাড়া দেখলো। আলতাফ হোসেন
হাউমাউ করে কাঁদছিলেন, পারভিন বললো, ‘আমি তো মরেই যাচ্ছি আব্বু, আমার
জন্য কানবা না। সিরাজউদ্দিন যেন জেল থেকে ছাড়া না পায়, সেইটা খেয়াল
কইরো। ও ছাড়া পাইলে মাদ্রাসার প্রত্যেকটা মেয়ের সর্বনাশ করবে। ও নিজের
মেয়েকেও ছাড়বে না।’
মদন সদর হাসপাতালের মেঝেয়ে গড়িয়ে কাঁদেন পারভিনের মা। শফিকুল
দেয়ালে মাথা ঠুকে কাঁদে। নিশাত বোবা চোখে চেয়ে থাকে। পারভিন শেষ নিঃশ্বাস
ত্যাগ করে।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান