মামুন মোয়াজ্জেম ।। সাক্ষাৎকার
মামুন  মোয়াজ্জেম ।। সাক্ষাৎকার

কবি মামুন মোয়াজ্জেম এর সাক্ষাতকার গ্রহনে সাহিত্যবার্তার সম্পাদক আরিফুল ইসলাম

আরিফুল: আপনি মূলত কবিতার মানুষ। আপনার কাছ থেকে কবিতার কথা জানতে চাই। কবিতা আসলে কী?

মামুন মোয়াজ্জেম: কবিতা আসলে একটি সবুজ পাতা প্রকাশ্যে সৌন্দর্য দানের আড়ালেও জীবজগৎকে যে পালন করে সর্বজীবের খাদ্যশক্তি তৈরিতে ক্লোরোফিল যেমন গোপনে তার কাজ করে, তেমনি আশা -নিরাশায় প্রাণ শক্তি যোগায় কবিতা

আরিফুল: সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে কবিতা ! কবিতা আর চাকরি দুটোকে আলাদা করেন কিভাবে ?

মামুন মোয়াজ্জেম: আসলে কবিতা চাকরি দুটোই একাকার অভ্যাসে অধ্যাসে তারা একান্নবর্তী এক ব্যক্তি সত্তাতেই চিত্তবৃত্তি ক্ষুণ্নিবৃত্তি অন্বেষায় নিবেদিত

 

আরিফুল: আপনার প্রকাশিত প্রথম বই হাতে পাওয়ার অনূভুতি কেমন ছিলো ? এ পর্যন্ত কতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে ?

মামুন মোয়াজ্জেম: প্রথম বই পাওয়ার অনুভূতি ছিল মিশ্র ছাত্রজীবনে আলাদা অহমিকা জাগানিয়া! পর্যন্ত ০৯(নয়)টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে যেমন:-() চন্দ্রাবতীর কয়েকজন সন্তান () কালো জল অন্তহীন () দৃশ্যের গোপন দরজা () তিতির ডুবানো চাঁদ () অনন্তে অন্তরীণ ( ) প্রমিত বৃক্ষের ছায়া ( ) নির্বাচিত কবিতা, আহরিতা () সাগরে অশ্বগন্ধার ঢেউ () প্রেমকথন  এর মধ্যে একটি যৌথ এবং একটি নির্বাচিত কবিতা গ্রন্থ রয়েছে

 

আরিফুল : আপনার কবি হয়ে ওঠা ! এটাকে আপনি কিভাবে দেখবেন ? মানুষ কি আসলেই কবি হয়ে ওঠে ?

মামুন মোয়াজ্জেম: যেভাবে বড় আকৃতির মানুষ হয়ে উঠেছি তেমনিভাবে মানুষ খুব ছোট হয়েই জন্মায় তারপর তার হাত পা সহ দেহ বড় হয় মন যখন খেলতে শিখেছে তখন থেকেই শব্দের স্বাদ নিতে শিখেছি কবি হয়ে আসলে কেউ ওঠে না সে কবিতায় বাস করে মাত্র

আরিফুল: অকবিতা বলে একটা শব্দ প্রায় শোনা যায় ! অকবিতা আসলে কি  ? অকবিতাও কি কবিতার অংশ?

মামুন মোয়াজ্জেম: অকবিতা বলে আসলে কিছু নেই তা ভাবের উদগীরণ উদ্গতীও বলা যায় যা সমসাময়িক ছন্দ ,শব্দ, গঠন বিন্যাসে পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে গিয়েও হয়তো পায়না তার বিকলাঙ্গতাটা থাকে তবুও এমন ভাবের যিনি ভাবুক তার কাছে হয়তো এটি কবিতাই!

আরিফুল: প্রথম পত্রিকায় বা ছোটকাগজে কবিতা লিখে কবি জগতে প্রবেশ করেন?

মামুন মোয়াজ্জেম: যদি বলা যায় তা ছোট কাগজেই উপজেলা লেভেলে কেউ একজন হঠাৎ একটি ম্যাগাজিন করলেন বঙ্গবন্ধুর ছবির প্রচ্ছদ সম্বলিত নাম তার- বিপ্লবী আবাহন আমার এক বন্ধু বললো- 'তোর একটি কবিতা দিস' দিলাম এবং তাই আমার প্রথম ছাপা অক্ষরে কবিতা ১৯৮৮ সালে এর আগে হাতের লেখা দেওয়াল পত্রিকা বা ফোল্ডারে কবিতা ছেড়েছি

 

আরিফুল: প্রথম কবিতা ও সম্প্রতি লেখা কবিতার মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান কী? একটু খুলে বলুন...

মামুন মোয়াজ্জেম: হ্যাঁ অবশ্যই  পার্থক্য বিস্তর প্রকরণ , প্রকৃতি ,আকৃতি মেজাজে দোস্তর ব্যবধান তবে মিল এক জায়গায় আর সেটি সৃষ্টির আনন্দে শৈশব থেকে অদ্যাবধি একটি কবিতা জন্মদানের আনন্দ সব কিছুর ঊর্ধ্বে একটি আলাদা দ্যোতনা দান করে

 

আরিফুল: প্রায়-ই কানে আসে একজন কবি একা ! একার সন্যাস ।  আসলেই কি একা ?

মামুন মোয়াজ্জেম: না কবি কখনো একা নন তার সদা সঞ্চরণশীল মন বিশ্ব প্রকৃতির সাথে একাকার সকলের হয়ে সে সব জায়গায় ছুটে

 

আরিফুল: কবি চরিত্রটি সমাজের চোখে রহস্যময়, সমাজের চোখে অবহেলিত, আপনার মতামত কি ?

মামুন মোয়াজ্জেম: সমাজ বদলেছে ,বদলাচ্ছে বিভিন্ন সময়ে তার বিভিন্ন চাহিদায় সে ফিক্সড হচ্ছে প্রযুক্তিগত উন্নয়নে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি আগের মত নাই যিনি কবিতার ভাব রসে সিনান করেন এই দ্রুত ধাবমান কঠিন কঠোর সময়ে সে একটা আচানক মানুষ বৈকি! মানুষ ছুটে টাকার পিছে আর কবি ধরতে যাচ্ছেন কবিতা অর্থনৈতিক মানদণ্ডে তাকে অবহেলিত মনে হলেও তিনি কিন্তু প্রজ্ঞার বিচারে অবহেলিত নন বরং সমীহ করা একজন মানুষই

 

আরিফুল: আপনি একজন কবি, আর কবি হিসেবে কবিতার সংজ্ঞা কি হওয়া উচিত বলে মনে করেন ? আসলেই কি কবিতা কোন সংজ্ঞা হয় ?

মামুন মোয়াজ্জেম: চির নিয়মে বদ্ধ একটি বিষয়কেই একটি সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় কবিতা এমনই এক  ছিনাল যে সে কোন বিধি আচার নিয়ম কোন কিছুই ধার ধরে না তাই তার সংজ্ঞা খুঁজে সংজ্ঞাহারা  হয়ে লাভ নেই 'সময়ে উচ্চারিত পাতা ঝরার শব্দ' কবিতা হয় আবার অসময়ে প্রণিপাতও কবিতার ভাবকে ধরতে পারে না

 

আরিফুল: শিল্পের মধ্যে জীবন থাকে, জীবনের অভিজ্ঞতা থাকে আপনার কবিতায় অভিজ্ঞতার কথা কতটুকু আনতে পেরেছেন ?

মামুন মোয়াজ্জেম: আসলে সবকিছুই অভিজ্ঞতারই ফসল প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষের অভিজ্ঞতা মাত্র সচেতন বা অবচেতন মনে যা ছায়াপাত করে তাই শব্দে কর্মে নিদেনপক্ষে রহস্যময় নিদ্রা স্বপ্নে হলেও ধরা দেয় আমার কবিতা পুরোটাই আমার জীবন অভিজ্ঞতা

 

আরিফুল: সাহিত্যপদক আজকাল বাজারি হয়ে গেছে, টাকা ছিটালেই নাকি পদক মেলে, কথাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত ?  

মামুন মোয়াজ্জেম: পদক প্রদানের জন্য একটা যথাযথ কর্তৃপক্ষ থাকতে হয় সে কর্তৃপক্ষের একটা মর্যাদা বা ভ্যালু থাকতে হয় কিন্তু কিছু একটা নামে টাকা খরচ করে পদক তৈরি করলেই তো তা হয়তো মেটালি একটা পদক তবে তা মোরালি পদকের মর্যাদা পায় না বর্তমানে এক গ্রুপ সমমনা আরেক গ্রুপকে পদকে পদকায়িত করে থাকেন

 

আরিফুল: আপনি একজন কবি , একজন সরকারের উদ্ধতন কর্মকতা । চাকরি জীবন কবিতায় কি কোন প্রভাব ফেলতে পেরেছে ?

মামুন মোয়াজ্জেম: পেরেছে তো অবশ্যই আমার সময়ের ভাগ বাটোয়ারা হয়েছে চাকুরী কবিতার মাঝে তাই কবিতা কিছুটা বামনাকৃতির হয়তো হয়েছে কিন্তু প্রতিতুলনার সুযোগ যেহেতু নাই তাই এটুকুই হয়তো বিকাশ হবার ছিল

 

আরিফুল: অনেক তরুণ কবিই গদ্য কবিতাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে ! গদ্য কবিতাকে আপনি কিভাবে দেখছেন ? গদ্য কবিতার ভবিষ্যৎ কী?

মামুন মোয়াজ্জেম:

গদ্য কবিতা বলে কিছু নেই যা গদ্য সে গদ্যই কিন্তু যা কবিতা তা কখনো গদ্য নয় হয়তো আমাদের যে তিন প্রকার ট্রাডিশনাল ছন্দ আছে তার বাইরে বেরিয়ে এসেছে বলে তাকে গদ্য কবিতা বলছি কিন্তু তাতেও তো পর্ব -মাত্রা এগুলো মেনেই লিখতে হয়

 

আরিফুল: গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে উগ্রপন্হীদের হাতে খুন হয়েছেন অভিজিৎ রায়, আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন, নিলয় নীল, ওয়াশিকুর রহমান বাবু প্রমুখ মুক্তমনা ব্লগারদের । ভারতেও গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবার্গিকে হত্যা করেছে কট্টর হিন্দুবাদীরা । সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিপন্ন । আপনার কি মনে হয় না যে শেষ অবধি উগ্রপন্হা এই শতাব্দীর চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়াবে ?

মামুন মোয়াজ্জেম: না মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে  পরনির্ভরশীল দুর্বল জীব তার যে বাস উপযোগী বাস্তু সংস্থান বা পন্থা তা মধ্যবর্তী মেজাজেই নির্মিত মধ্যপন্থাই সে বেঁচে থাকে  কেউ কেউ উগ্রপন্থা অবলম্বন করলেও সকল মানুষ বেশি সময়ের জন্য উগ্রপন্থা অবলম্বন করে থাকতে পারে না যা যুক্তিগ্রাহ্য মানোপযোগী তাই আখেরে চালিকা শক্তি হয় উগ্রপন্থা নয়

 

আরিফুল ইসলাম :‘কবির স্বাধীনতা’ আপনার মূল্যায়ন কী? আসলেই কি কবির কোন স্বাধীনতা আছে ?

মামুন মোয়াজ্জেম: কবিও মানুষ মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা থাকে কিন্তু সতত সে কখনো স্বাধীন নয় নানা বৃত্তির জালে সে বন্দী কবি আরও বন্দি তার ভাবের/ভাবনার  কাছে তাই সে অধিক স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে থাকে

 

আরিফুল ইসলাম : কবিতায় ছন্দ ও উপমার প্রয়োজনীয়তা স ম্প র্কে বলুন

মামুন মোয়াজ্জেম: ছন্দ উপমা ছাড়া সার্থক কবিতা লিখা সম্ভব নয় ছন্দ তাকে স্পন্দন দেয় উপমা  তাকে দেয়  সৌন্দর্য /অলঙ্কার   বা ক্ষেত্র বিশেষে শক্তি

 

আরিফুল ইসলাম : আপনি কি মনে করেন একজন কবির সামাজিক স্বীকৃতি দরকার?

মামুন মোয়াজ্জেম: সামাজিক স্বীকৃতি জোর করে আদায়ের বিষয় নয় সমাজ যখন যাকে তার উপযোগীতায় নেবে তার স্বীকৃতি সে দেবে চিরকালই কবিদের সামাজিক স্বীকৃতি ছিল কিন্তু সমাজ উন্নত মানের পণ্য চায় এবং চায় তার বিনিময়ের যোগ্যতা  এটি কবিতায় করতে পারলে কবিতা দিয়েও রুটি রুজি সম্ভব রুটি রুজি দিয়েই তো সমাজের মানুষ স্বীকৃত হয়

 

আরিফুল ইসলাম : কবি হচ্ছেন শব্দশিল্পী। অন্যান্য শিল্পীর থেকে কবির পার্থক্যটা কোথায়?

মামুন মোয়াজ্জেম: শব্দ যা অক্ষর দিয়ে তৈরি হয় আর চিত্র শিল্পীর তুলির টান নানান রঙ দিয়ে তৈরি হয় কবি বা শিল্পী উভয়ই সুন্দরকে আহ্বান করে থাকেন তাই মিলটাই বেশি পার্থক্যটা যা মাধ্যমে

 

আরিফুল: বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে ?

মামুন মোয়াজ্জেম: বিজ্ঞান প্রযুক্তি আমাদের ব্যস্ততা বাড়িয়েছে তাই মনের জায়গাও কিছুটা দখল হয়তো নিয়েছে কিন্তু মানুষ তার মনের প্রতিচ্ছবি বা প্রতিবিম্ব দেখতে চাইলে বা নিজেকে বোধ শক্তিতে উপলব্ধি করতে চাইলে সাহিত্যের বিকল্প নাই তাই সাহিত্যের যা কাজ তা সে বিজ্ঞান প্রযুক্তির ভেতর করেই যাবে

আরিফুল: একজন কবির লেখালেখির পূর্ব প্রস্তুতি কি হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন ?

মামুন মোয়াজ্জেম: পূর্ব প্রস্তুতি বলতে স্বাক্ষর জ্ঞান তো হতেই হবে পঠন পাঠনে সমসাময়িক বা আহবান চিন্তার ধারাটাকে রপ্ত করে রাখতে হবে ধ্যান অনুধ্যানতো তার থাকবেই প্রত্যেক কবি মনের গহীনে একজন ঋষি

 

আরিফুল: নতুন যারা লিখছেন তাদের সম্পর্কে কিছু বলুন ?

মামুন মোয়াজ্জেম: যারা লিখছে তারা তো লিখবেই  লিখতে পারাটা একটা গুণ এটাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে পাইরেসি বা প্ল্যাজারিজম করার মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে সাহিত্যকে সমাজে বাড়তি সুবিধা বা সমীহ  আদায়ের জন্য ব্যবহার করা যাবে না

 

আরিফুল: সাহিত্যবার্তাকে আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ

মামুন মোয়াজ্জেম: আপনাকেও ধন্যবাদ কবি



সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান