এমদাদুল কাদের এর কবিতাগুচ্ছ
এমদাদুল কাদের এর কবিতাগুচ্ছ

স্বপ্নের ভালবাসা


হ্যা, এই ভালবাসার কথাটুকু তোমাকেই বলছি,
কে বলেছিল তোমাকে ভালবাসতে? যখন একাকী ছিলাম কই কেউ তো ভালবাসে নি!
বলো না আবার, আমার ছিল অনেকেই
না না, কেউ ছিল না,
কাউকেই তো দেখিনি কখনো
কেউ তো বলেনি কখনো " ভালবাসি তোমাকে "।

শতাব্দীর পর শতাব্দী হেঁটে গেছি একাকীই
দিন রাত আমার পার হয়ে গেছে নিজের একাকীত্বকে সাথে নিয়ে,
হাঁটতে গিয়ে নিজের সংগে নিজেই কথা বলেছি
নিজেই উত্তর দিয়েছি,
কোথায়, তখন তো কেউ ছিল না?
তখন তো তুমিও ছিলে না!
আজ কেন?
আজ কেন দাবী কর ভালবাসি বলে?
আমি কি বলেছিলাম?
নাকি করজোরে মিনতি করেছিলাম?
আমার তো মনে হয় না।
তবে আজ কেন ভালবাসার কথা বল?
কেন দাবী কর?

কোথায় ছিলে তুমি?
যখন আমার প্রয়োজন ছিল অসীম,
তোমার প্রতীক্ষায় যখন আমি হেঁটে গেছি বছরের প্রতিটা দিন
এক দুই করে গুণে গেছি মিনিট, ঘন্টা
রোজই তারা দেখে দেখে শেষ করেছি গননা
মেঘলা আকাশ দেখে অভিশাপ দিয়েছি মেঘকে
আর চাঁদ দেখতে গিয়ে ভুলে গিয়েছি সময়ের হিসেব,
কোথায়, তখন তো তুমি ছিলে না?
আজ ভালবাসার কথা বলে দাবী করতে এসেছো!
কেন আসতে পারলে না এক শতাব্দী আগে?
কেন সেদিন এসে বলতে পারলে না?
করতে পারলে না ভালবাসার দাবী?
কেন বলতে পারলে না " তোমাকেই চাই"

আজ আমার দুর্দিন বলেই কি এ উপহাস!
বয়স হয়ে গেছে বলেই কি কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটে!

সোনালী সৈকত, পূর্ণিমার চাঁদ আর আলোয় ঝলমলে তারার কথা অনেক শুনেছি,
শুনেছি বুকের মাঝে মিশে থাকার কথা,
পৃথিবীর সমগ্র সুখ এনে দেবে আমার হাতে একথাও শুনেছি কান ভরে
শুধু দেখাই হয়নি কিছু কোনদিন, কোনকালে।

এই আমি বসে রইবো সমুদ্রের এপারে
তুমি ওপার থেকেই দেখিয়ে যাবে স্বপ্ন
কিছু কল্পনার কথা,
সুয়োরাণীর- দুয়োরাণীর গল্প শুনাবে
শুনাবে আলিফ লায়লার প্রেমের কথা
মধুমাখা কন্ঠে শুনাবে নিজ যৌবন বিলিয়ে দেবার কাহিনী।

আমি এপার থেকেই শুনে শুনে নিজ বুকে আঁকবো এক নম্র সমুদ্র,
এক দারুণ নীল আকাশ
আঁকবো ভালবাসার এক সাদা রাজহাঁস
আঁকবো আমার আত্নার আত্নাকে।



এক মুক্তিযোদ্ধার রক্ত


আজকাল বোধকরি নস্টালজিয়ার যুগ
বয়স বেড়ে গেলে দেখা হয় আবেগের আবার,
কথায় কথায় পিছিয়ে পরি, যাত্রাহত হই
দুর্ভাগা স্মৃতি মন্থর গতিতে চলে বার বার।

৫ই মে ভাই আমার একাই ঘর ছেড়ে চলে গেলেন যুদ্ধে
জানানো হোল না কোন শুভাষিশ, শেষ দেখাও হোল না যাবার প্রাক্কালে,
ঘরে ফিরে দেখি শুন্য ঘর, শুন্য খাট, পড়ার টেবিল,শুন্য চেয়ার
শুধু ছিল একরাশ শুন্যতাই আমার হাতের নাগালে ।

দিন পার হয়ে গেল কত, চলে গেল মাসের পর মাস
এস এল আর নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে পার হোল কত রাত,
এক পকেটে গ্রেনেড আর আরেক পকেটে কার্তুজের বোঝা
এক স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছেন না ঘুমিয়েই কত রাত।

ডিসেম্বরের এমনি এক দিনে যুদ্ধের মাঝে গুলী খেয়ে পরে গেলে
সহযোদ্ধারা উঠিয়ে আনেনি তাকে মৃত ভেবে তখন
যুদ্ধের তীব্রতায় পিছু হটে তারা বাধ্য হয়ে জীবন রক্ষায়
মাটিতেই তিনি নিজ রক্তে দেশের মানচিত্র করেছিলেন অংকন।

সহযোদ্ধারা পরে পায়নি তার শবদেহ, সবুজ ঘাসে ছিল রক্তের দলা
এক মানচিত্র আঁকার প্রয়াস দেখতে পেয়েছে তারা সেদিন,
এমনি করেই বাংলার দামাল ছেলেরা একে একে দিয়েছে প্রান
রক্তের আঁখরে লিখে গেছে তারা এক স্বাধীন বাংলার গান।

আজও তারা মিশে আছে এ মাটির বুকে, আমাদের বাতাসে
এ দেশের ইঞ্চি ইঞ্চি জমিতে মিশে আছে তাদের নিঃশ্বাস,
কেউ বিশ্বাস করুক না করুক আমি দেখি তাদের নিয়ত
মন দিয়ে কান পেতে শোন,তোমরাও শুনতে পাবে এ আমার বিশ্বাস ।

সব বলে দেবো


আমার এ কষ্টের কথা একদিন ঈশ্বরের কাছে বলে দেবো
বলে দেবো এই না পাওয়ায় ব্যাথার কথা
বুকের মাঝে যা দলা পাকিয়ে বসে থাকে
সাপের মতো ছোবল মারে নিত্য।

শত শতাব্দীর আকাংখিত ইচ্ছেগুলো
বেড়ে উঠেছে এ শরীরের মাঝেই
তিল তিল করে লালন করেছি মনে
আমার কি সাধ্য ছিল তাকে থামাই?

কি বলিনি তোমায়? সবই তো বলেছি
তবে কেন দুরে সরিয়ে রাখলে?
পৃথিবীর সামনে সেজে রইলে সতী সাবত্রী
শুধু আমিই পরে রইলাম আরেক কোনে... একা।

না পরালাম কাউকে বলতে,
না পারলাম ভাগ করে নিতে কষ্টটা
জাবর কাটতে কাটতেই পার হয়ে গেল সমস্ত দুপুর
সূর্য ঢলে পরলো পশ্চিম কোণে।

আজ আমার আগ্রহ কুরে কুরে খায়
আমায়
চোখের সামনের রংধনু ফেকাসে
উবড়ো খুবড়ো রাস্তা পাহাড়ে ভরা
শুকনো খাল গুলো হটাৎ করেই ভরা নদী।

টুং টাং করে বাজা গিটার চুপ করেই শুনি
মদের গেলাসের শব্দে প্রতিক্রিয়া নেই
আলোর ভুবনে আমার জোনাকি
অপাংতেয় হয়ে ডুবে মরে আলোর মিছিলেই।



স্মৃতি


সব স্মৃতি ফিরে আসে
ফিরে আসে নদীর মতোই আমার বুকে
নিয়ে আসে পাহাড়ি মাটি, ঘোলা জল
শামুক, ঝিনুক, হিমালয়ের পাথর।

মিশে থাকে পানিতে ডিংগে নৌকার স্বাদ
নৌকার গুনের ছলাত ছলাত শব্দ
কাঁচা পলি মাটির সোঁদা গন্ধ
হিজল পাতা ঝাপিয়ে পরে বুকে পাগলের মতো।

হাজারো স্মৃতি ফিরে আসে
মা'র চেহারার উদাসী ভাব
বড় ভাইয়ের বটবৃক্ষের মতো বিশাল ছায়া
তবু্ও মন আজ একা চরম এই ক্ষনে।

দিন আসে, দিন যায়
পাখির কাকলী মিলিয়ে যায় সন্ধ্যায়,
সূর্য উঠে, ডুবে যায়
দিগন্তের শেষ মাথায়।

জন্ম যার হিমালয়ের পাথুরে মাটিতে
পথ হারায় সে আমার বুকে
আমি পথ হারাই নিজেই নিজের মাঝে
বিশাল এক গভীরতায়।

খারাপ সময়


সময়টাই খুব খারাপ হয়ে গেছে।
নস্টালজিয়া শব্দটাই বড় বিতিকিচ্ছিরি
কারনে অকারণে হুট করেই এসে যায় মনে
চোখের ঝর্নায় নামায় জোয়ার
খুব রাগ হয় শব্দটার উপর।
সিনেমার সেলুলয়েডের ফিতার মতো দেখায় একের পর এক ছবি
সেই পুরনো দিনের যখন বয়স ছিল অল্প

কথায় কথায় হাঁসি কান্না, ঝগড়া করতাম ভাইয়ের সংগে, আবার মিটিয়েও নিতাম পরে
ব্যাস, জীবন চলতো জীবনের ধারাতেই।
যুদ্ধ যখন শুরু হোল তখন যেন এক বিপ্লব হয়ে গেল লাল মোহন পোদ্দার লেনে
সব ভাইরাই হয়ে গেলেন বিপ্লবী
যেন এক একজন বদলে গেলেন গ্রেনেডে
দেশের জন্য আত্নাহূতি দেয়ার আগ্রহে কেউ কারো চেয়ে কম নয়।
ছুটে বেড়িয়ে গেলেন ইকবাল ভাই, রাজু ভাই, তারপর আমি।
পথে বিঘ্নপ্রাপ্তিতে ফিরে এসে দেখি মামুন ভাই চলে গেছেন (৫ই মে)।
দেখা হোল না,
জানানো হোল না কোন শুভাশিস,
শুন্য ঘর, শুন্য বিছানা,টেবিল,চেয়ার,
একরাশ শুন্যতায় ভরা ছিল বাতাস
গুমোট।
আমিও বেড়িয়ে পরলাম পথে।
দেরাদুনে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে আসা, যুদ্ধ করা দিনের পর দিন
ভাই আমার যেন উবেই গেলেন
কোথাও পেলাম না ভাইয়ের খবর।
হটাৎ শুনলাম ওনাকে দেখা গেছে কুষ্টিয়াতে।
নির্মল এক ঝলক মিষ্টি বাতাস ছুঁয়ে গেল মনের সব দেয়াল,
থরথর করে কাঁপন ধরলো হৃদয়ে
ভাই আমার জীবিত আছেন।

যুদ্ধ শেষে ঘরে ফেরা হোল একে একে
ফিরলেন না ইকবাল ভাই ( ওনার শহীদ হওয়ার খবর পেয়েছি জুলাই মাসে),
মামুন ভাই যেন মিশে গেলেন বাতাসে,
'৭৪ এ শুনলাম এক হৃদয় বিদারক
কাহিনী।
কুষ্টিয়ার যুদ্ধে গুলি খেয়ে পরে গেলে
সহযোদ্ধারা সাহায্য করতে পারেনি,
পারেনি ওনাকে উঠিয়ে আনতে,
পারেনি একবারও দেখতে কতটা আহত উনি।
যুদ্ধের তীব্রতায় পেছনে সরে যেতে বাধ্য হন পুরো দল
যদিই চিন্তা ছিল ভাইয়ের জন্য।
পরে এসে দেখেন ঘাষ জুড়ে রক্তের ডেলা
শরীরটা নেই কোথাও।
মৃত্যু হয়নি ওনার গুলি খেয়ে।

পরের ঘটনা শুধু কল্পনায় দেখা।

আবারও সেলুলয়েডের ফিতেতে ফিরে যাওয়া
আবারও নস্টালজিক হওয়া,
সেই '৭১ থেকে চলছে আজও
চলবে আমৃত্যু।

আজও সেই শূন্যতায় স্বাস নেয়া
বেঁচে থাকা
জীবনের তাগিদে করে যাওয়া সব কাজ।
যে জীবনগুলো ছিল আমার আসেপাশে
ঝরতে শুরু করেছে সব একে একে
আমি যে পৃথিবী
সব বুকে জায়গা দিয়ে দেবো
বুক যে বিশাল বিস্তারিত।
এই দেশের প্রতি ইঞ্চি ইঞ্চিতে মিশে আছে শহীদেদের নিঃস্বাস,রক্ত।
দেখ তুমি হাতটাকে সামনে নিয়ে
তুলে ধর লাল-সবুজ পতাকাটা,
একটু তাকাও ভাল করে,
বুক ভরে স্বাস নাও,
উপলব্ধি করবে সব।

ওনারা আছেন এখানেই
এই দেশেই,
এই মাটিতেই
এই দেশের বাতাসে
তোমার আমার নেয়া প্রতিটা নিঃস্বাসে।



সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান