জাপান-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের স্থপতি রাজনীতিবিদ হায়াকাওয়া তাকাশি - প্রবীর বিকাশ সরকার
জাপান-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের স্থপতি রাজনীতিবিদ হায়াকাওয়া তাকাশি - প্রবীর বিকাশ সরকার
জাপানের স্বনামখ্যাত রাজনীতিবিদ হায়াকাওয়া তাকাশি জন্মগ্রহণ করেছিলেন জাপানের আধুনিক তাইশোও যুগে ১৯১৬ সালে, যে বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম জাপান ভ্রমণ করেন, এবং প্রায় তিন মাস অবস্থানকালেই তাঁর জন্ম হয় ২১ আগস্ট তারিখে ওয়াকায়ামা প্রিফেকচারে, টোকিও থেকে ২৭৫ মাইল দূরে। আর যে-বছর রবীন্দ্রনাথ ইহলোক ত্যাগ করেন ১৯৪১ সালে, সে-বছর হায়াকাওয়া ২৫ বছরের যুবক, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
তরুণকালেই রাজনীতি সচেতন ছিলেন হায়াকাওয়া। স্নাতক ডিগ্রি পাওয়ার পর প্রবেশ করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হিসেবে। ১৯৪১ সালেই জাপান আমেরিকার শত্রু হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে যায়। যুদ্ধ যখন খুবই জোরালো হয়ে ওঠে তখন তিনি নৌবাহিনিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে খণ্ডকালীন নৌ বাহিনির অফিসার হিসেবে কাজ করেন। সেইসময় ১৯১৫ সাল থেকে জাপানে আশ্রিত ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর কথা বা ১৯৪৩ সালে জাপানে আগত সুভাষচন্দ্র বসুর কথা তিনি জানতেন বলাই বাহুল্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত ২২তম সংসদ নির্বাচনে নিম্নকক্ষের সাংসদ নির্বাচিত হন নির্দলীয়ভাবে। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এই প্রথম “কোকুমিনতোও” বা “জাতীয় দল” নামে কোনো রাজনৈতিক দলে যোগদান করেন। যেবছর শুরু হয়েছে টোকিওতে মিত্রবাহিনি প্রধান আমেরিকা কর্তৃক আয়োজিত “ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল ফর দি ফার ইস্ট”, সংক্ষেপে “টোকিও ট্রাইব্যুনাল।” বিচারের শুরু থেকেই আলোড়ন সৃষ্টি করে চলেছেন বিভিন্ন দেশের ১১ জন বিচারপতির মধ্যে অন্যতম ভারতীয় বিচারক বিচারপতি ড.রাধাবিনোদ পাল। পত্রপত্রিকায়, সমাবেশে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ছে, দেখাও যাচ্ছে। জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ তরুণ রাজনীতিক হায়াকাওয়া তাকাশি ভারতীয় বাঙালি বিচারপতি পালের নাম জানবেন না তা তো হতেই পারে না। জাপান ও অবিভক্ত বাংলা অঞ্চলের মধ্যে যে একটি গভীর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক চলমান তা তিনি ভালো করেই জানতেন।
কালক্রমে কিছুদিন সমাজতান্ত্রিক শিবিরেও রাজনীতি করার পর শেষপর্যন্ত স্থায়ী হন উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল “জিইউমিনশুতোও” তথা “লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি”তে। এই পার্টি থেকে ১৪ বার সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৬৩-৬৪ সাল পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং Chairperson of the National Public Safety Commission এর দায়িত্ব পাল করেন। পুনরায় ১৯৬৬-৬৭ সাল পর্যন্ত শ্রম মন্ত্রী এবং ১৯৭৬ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে। এছাড়াও মৃত্যু পর্যন্ত সরকার ও সংসদের গুরুত্বপূর্ণ কাজেও অবদান রাখেন। তাঁর কাজ, নীতিবোধ ও দায়িত্বশীলতার কারণে তাঁকে “গাকুশাহাদা” বা “গবেষকস্থানীয়” রাজনীতিবিদ হিসেবে গণ্য করা হত রাজনৈতিক মহলে। প্রচুর সুনাম যেমন কুড়িয়েছেন তেমনি ছিলেন প্রবল প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ।
১৯৭০ সালে যখন পূর্বপাকিস্তানে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস হয় এবং উপকূলবর্তী বহু জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয় তখন জাপান সরকার আর্থিক ও ত্রাণসামগ্রী প্রেরণ করে সাংসদ হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে। সেই সময় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হলে পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বরং ১৯৭১ সালে ২৫ শে মার্চ গভীর রাতে সার্চ লাইট নামক কুখ্যাত পরিকল্পনাধীন নিরস্ত্র শান্তিকামী বাঙালির ওপর নিধনযজ্ঞ চালায়। জাপান সরকার এই অমানবিক ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়। পশ্চিম পাকিস্তানকে প্রদত্ত সকল সাহিত্য-সহযোগিতা স্থগিত ঘোষণা করে, সমর্থন জানায় বাঙালির স্বাধীনতাকে। জাপান সরকারের এই উদ্যোগ বা পরিকল্পনার পেছনে যে রাজনীতিবিদ হায়াকাওয়ার প্রভাব ছিল বলাই বাহুল্য। অতিদ্রুত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা মহান মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানিয়ে হায়াকাওয়াসহ একাধিক সাংসদ তথা রাজনীতিবিদ টোকিওতে সভাসমাবেশ করে পাকিস্তান সরকারের তীব্র নিন্দা জানান। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সাধারণ জাপানি নাগরিকদের সচেতন করার উদ্যোগ নিয়ে গঠন করেন “জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন”, তিনি হন তার প্রেসিডেন্ট। ভারতে আশ্রিত শরণার্থীদের সাহায্যার্থে তহবিল গঠনে আত্মনিয়োগ করলে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরাও এগিয়ে আসেন, গঠন করেন “বাংলাদেশ সলিডারিটি ফ্রন্ট” নামে সংগঠন। উক্ত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক, বাংলা ভাষার পণ্ডিত বাঙালিপ্রেমী অধ্যাপক কাজুও আজুমা, বাংলা ভাষার গবেষক এবং রবীন্দ্রভক্ত অধ্যাপক ড.ৎসুয়োশি নারা, প্রভাবশালী সানকেইএন শিম্বুন পত্রিকার সাংবাদিক তানাকা তোশিহিসা, নারীনেত্রী হায়াশি তাকাকো, কিয়োতো মোমোয়ামা লায়ন্স ক্লাবের প্রেসিডেন্ট তাসুগি কিয়োশি প্রমুখ। এমনকি, শোওয়া সম্রাট হিরোহিতোর আত্মীয় পর্যন্ত বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে, শরণার্থীদের সাহায্যার্থে মঞ্চে উপস্থিত হয়েছিলেন! এই আন্দোলনের পেছনে যে রাজনীতিবিদ বাঙালিপ্রেমী হায়াকাওয়া তাকাশির প্রভাব ছিল তা আর না বললেও চলে।
আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে, জাপান-আমেরিকা শান্তিচুক্তি দ্বারা আবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও আমেরিকাকে থোরাই মূল্য দিয়ে জাপানের সরকার ও ক্ষমতাসীন দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সাংসদরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে প্রকাশ্যে রাজপথে নেমেছিলেন। অথচ আমেরিকা, চীন, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশসমূহ ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তান সরকারের প্রত্যক্ষ সমর্থক ও সাহায্যকারী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি প্রধান আমেরিকার কাছে পরাজিত জাপান তখনও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ ছিল না, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল সেই সুবর্ণ সুযোগ এবং জাপান তা অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সর্বপ্রথম স্বীকৃতিদাতাদেশ ভুটানের পরপরই জাপান স্বীকৃতি প্রদান করে ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তারিখে, এবং এর পেছনেও ছিল রাজনীতিবিদ হায়াকাওয়ার নেতৃত্ব। স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশে জরুরি ত্রাণ ও সাহায্য পাঠাতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন হায়াকাওয়া।
১৯৭২ সালেই জাপান সরকারের পক্ষ থেকে প্রাক্তন মন্ত্রী এবং সাংসদ হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে একাধিক রাজনীতিবিদ ও দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব শিক্ষক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক গবেষক প্যান-এশিয়ানিস্ট তানাকা মাসাআকি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহযোদ্ধা “এফ-কিকান” ইন্টেলিজেন্স মিশন প্রধান লে.কর্নেল ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাপান সফরের আমন্ত্রণ জানান।
১৯৭৩ সালে জাপান সফরে এলে বঙ্গবন্ধুকে অভূতপূর্ব অভ্যর্থনা প্রদান করা হয় লাল গালিচা বিছিয়ে। পত্রপত্রিকাগুলো ফলাও করে সংবাদ প্রচার করে। বিপুল-বিপুল উষ্ণ সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধু আন্দোলিত হন। তাঁর সঙ্গে অর্থমন্ত্রী ড.কামাল হোসেন, কন্যা শেখ রেহানা, কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেলসহ আরও সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ ছিলেন। রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা সভায় সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী অত্যন্ত প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ তানাকা কাকুয়েই। যদিওবা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা প্রথম প্রধান মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ১৯৭২ সালে তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী সাতোও এইসাকু, যিনি অতিসম্প্রতি জাপানের একাধিকবার প্রধান মন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জনকারী আবে শিনজোওর রক্তের আত্মীয়। অর্থাৎ সাতোও এইসাকুর বড়দা প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ কিশি নোসুকের ছোটভাই। কিশি দুবার প্রধান মন্ত্রী ছিলেন, ছিলেন বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর সফরকালে তাঁর সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন হায়াকাওয়া তাকাশি। তাঁর প্রভাবেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন এবং সার্বিক উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল জাপানে। সেসব তথ্যাদি ১৯৭২ সালে প্রকাশিত “নিহোন-বানগুরাদেশু কিয়োকাই” তথা “জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন” এর বুলেটিন থেকে জানা যায়। এই সংগঠনটি সাংসদ হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে এবং তিনি ছিলেন এর প্রেসিডেন্ট মৃত্যু পর্যন্ত (১৯৮২)। বঙ্গবন্ধুর সফরের সময় এক ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটে যা কূটনৈতিক নিয়ম বহির্ভূত। হায়াকাওয়া বঙ্গবন্ধুর প্রতি এতই অনুরক্ত ছিলেন যে জাহাজে চড়িয়ে সদল বঙ্গবন্ধুকে নিজের জন্মস্থান ওয়াকায়ামা-প্রিফেকচারে নিয়ে যান। সেখানেও সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। এমন ঘটনা কূটনৈতিক জগতে একেবারেই বিরল। অথচ সেই ঘটনাই ঘটিয়েছেন বঙ্গবন্ধুভক্ত রাজনীতিবিদ হায়াকাওয়া তাকাশি।
জাপানি মনীষী ওকাকুরা তেনশিন এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধুত্বের পথ ধরে হায়াকাওয়া-বঙ্গবন্ধু সম্পর্ক দুই জাতির জীবনে এক অনন্য ইতিহাস। স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের মৈত্রীবন্ধনের প্রধান উদ্যোক্তা হচ্ছেন হায়াকাওয়া তাকাশি। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু হায়াকাওয়ার জন্য একটি উপহার নিয়ে এসেছিলেন জাপান পর্যন্ত সেটা হল চামড়ার তৈরি বাংলার বাঘের মুখমণ্ডল। সেটা সম্প্রতি হায়াকাওয়ার পুত্র বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দিয়েছেন, এখন সংরক্ষিত আছে বাংলাদেশ দূতাবাসে। বাংলাদেশকে এতই ভালোবেসেছিলেন রাজনীতিবিদ হায়াকাওয়া, যে মৃত্যুর পর ইচ্ছানুয়ায়ী তাঁর চিতাভস্ম ঢাকার বৌদ্ধরাজিক মন্দিরে সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীকালে ঢাকায় নির্মিত প্যান-ফ্যাসেফিক সোনার গাঁও হোটেলের অভ্যন্তরের দেয়ালে তাঁর একটি স্মৃতিফলক খোদিত করা হয়েছে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতীক স্বরূপ। কিন্তু কত জন বাংলাদেশি জানেন বাংলাদেশপ্রেমী এই মহান জাপানি রাজনীতিবিদের নাম! খোদ আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরাই জানেন বলে মনে হয় না! জাপান প্রবাসী বাংলাদেশিরাও নয় বলেই জোরালো ধারণা হয়।
ছবি: সর্ববাঁয়ে হায়াকাওয়া তাকাশি, মাঝখানে ওয়াকায়ামা-প্রিফেকচারের গভর্নর ওওহাশি মাসাও
টোকিও
৮.৬.২০২১

সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান