অরণ্য আপনের গুচ্ছকবিতা
অরণ্য আপনের গুচ্ছকবিতা
তসলিমার শাড়ি

যে চোখের নিচে পড়ে আছি পুনাতন কবরের মতো
সে চোখ আমার সাথে কথা বলেনি
ভাগ্যিস কথা হয়নি
চোখের হৃদয় ছিঁড়ে যেত
আমার চোখ থেমে গেছে তোমার শাড়িতে
আমি ইনিয়েবিনিয়ে বলব না, ভান করব না
নামাজে দাঁড়ানোর মতো বলব, আমার চোখ ফিরিয়ে দাও
তোমার শাড়িতে আমার চোখ হারিয়ে গেছে
আমার হাতে এখনও কয়েক ফোঁটা রক্ত বেঁচে আছে
তোমাকে দিতে পারি
তোমার শাড়ি দেখলে আমার চোখ, আমার রক্ত গল্প বলতে শুরু করে
আমার আঙুলে আকাশ ধরা পড়ে, আমার পায়ে সমুদ্র হাঁটা শুরু করে
আমি আমার দুঃখ লুকিয়ে রাখি
যাতে তোমার চোখ থেকে আমার চোখের জল না আসে

রাস্তায় কেউ নেই
ঘরেও কেউ নেই
এই পৃথিবীতেও কেউ নেই
তুমি ঝর্ণার ঝরঝরে দুপুরের মতো আমার চোখে আস
আমার চোখ জানতে পারে না
আমার চোখেও কেউ ছিল না
তোমার শাড়িতে রাত করব
যে রাতের পর ভোর হবে না

প্রেমের সমস্ত গোলাপ তোমার
মানবতার সমস্ত সৌন্দর্য তোমার
তোমার কথা বলতে গেলে অক্ষর ছোটো হয়ে যায়
দুঃখিনি বর্ণমালা গরিব হয়ে যায়
তোমার শাড়ির পাড়ে বসে আব্বাসি যেন গান ধরে
তুমি জেরুজালেমের হৃদয় আর কাশ্মিরের কান্না
দেশে দেশে তোমার মতো মানুষ হচ্ছে রাজনীতির চুলায় রান্না

তোমার শাড়ি একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়
ছোটো বাচ্চারা খেলা করে
আম্মার ছোটোবেলার মতো দেখতে তোমার শাড়ি
তোমার শাড়ি আস্ত একটা ভগবানের বাড়ি।

খেয়ে দিয়েছে

যে গাছের ছায়া আমার ছিল, মাথার ওপর ভেঙে পড়ে আমাকে খেয়ে দিয়েছে
যে নদীর পানিতে আমি সাঁতার কাটি, সে নদী আমাকে টেনে নিয়ে খেয়ে দিয়েছে
ডাক টিকেট কেনার স্বপ্ন, হলুদ খাম কেনার স্বপ্ন
মাইল খানিক সাইকেল পেলে পত্রিকা কেনার স্বপ্ন
আমাকে খেয়ে দিয়েছে
হারিকেনের লাল আলোতে খসখস করে কলম চলার শব্দ আমাকে খেয়ে দিয়েছে
জরাজীর্ণ চিৎপাত দুপুরের কান্না, সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ার রং
আমাকে খেয়ে দিয়েছে
কবিতায় পাওয়া অভিবাদন
রাস্তায় পাওয়া সালাম
আমাকে খেয়ে দিয়েছে
আমার কান্নার জিবে আমাকে চেটেপুটে পান করেছে
আমার অসহায়ত্বের কথাগুলি আমাকে খেয়ে দিয়েছে

প্রতিদিন সকালে আমার কলম আমার অাঙুল খোঁজে
আমার বাড়ির রাস্তা আমার চোখ খোঁজে
আমাকে যারা খুন করেছে, তারা চোর
তারা আমার চোখ থেকে জমি চুরি করেছে
তারা আমার ভিতর থেকে হৃদয় চুরি করেছে

আমার সরল বিশ্বাস, কাঁচা চিন্তা
কখনও এই ভুল কখনও ওই ভুল আবার কখনও সমস্ত ভুল
আমাকে খেয়ে দিয়েছে
আমি তো অন্ধকারেই বাঁচতে চেয়েছিলাম, আলোর চোখ আমাকে কটমট করে খেয়ে দিয়েছে
আমার ভালোবাসাটাও ভুল, না ভালোবাসাটাও ভুল
আমাকে অাঙুলে তুলে খেয়ে দিয়েছে, আমাকে চোখে নিয়ে খেয়ে দিয়েছে

যারা বলেছে, আপন, তুমি জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি
যারা বলেছে, তোমার কথা মাথায় আছে আপন!
যারা বলেছে, তোমার জন্য চেষ্টা করছি আপন!
যারা বলেছে, এই চোখের কাজল তোমার জন্য
যারা বলেছে, এই বুকের ঢিপি তোমার জন্য
যারা বলেছে, তোমার সাথে বেড়ে উঠব
যারা বলেছে, তোমার বুকে রাত খুঁটব
কেউ আমাকে বাঁচতে দেয়নি, আমাকে কামড়েকুমড়ে খেয়ে দিয়েছে

বইয়ের ভিতর লাল কালিতে আন্ডারলাইন করার শখ ছিল
আমাকে খেয়ে দিয়েছে।

শোকোবতী নদী

সমুদ্র হাঁটে না দেখে আমি নদীর নেওটা ছিলাম
ডানাঝাপ্টা নদী, জলোবতী নদী
এক নদী যার গায়ে গায়ে ছিল বনের গন্ধ আর গাছের ছায়া
জলের মধ্যে ডুক্কি দিয়ে দেখতাম মাছেদের হাট
আম্মা আমার নদী ছিল যার পাড়ায় পাড়ায় ছিল ঘাট
মানুষের মুখে মুখে তাঁর গ্রাম, চোখে চোখে তাঁর নাম
নৌকায় মারা গেছে আমার নদী, বিশ্বাস করবে তুমি?
তুমি ডুবলে না, নদী তো ডুবে গেল আপন!

তারারা আকাশ নিয়ে কোথায় বেখবর হল
আকাশ পড়ে তোমার নাম খুঁজে পেয়েছিলাম
রাত সূর্যকে গিলতে পারে কিন্তু তারাকে নয়
আম্মা আমার তারা ছিল

মনের জগতটা এমনভাবে লুট হয়ে গেছে মা!
বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে, মাটি মরে গেছে
মাটির মধ্যে নদী মরে গেছে
বাতাস মরা মাছের মতো পেট ফুলে পড়ে আছে

এত অন্ধকারের বৃষ্টি হয়েছে যে নদী আর দেখা যায় না
হাউমাউ করে চোখে জলের আলো ফেলি
নদী চোখে পড়ে না
জলের নদী সমুদ্রের মাটিতে হারিয়ে গেছে
ঢেউ থেকে পড়ে গিয়ে আমার নদী মারা গেছে
আমি ডুবিনি, নদী তো ডুবে মারা গেল

যতটা পানি দেখেছি, ততটা নদী দেখতে পারিনি
পানির ভিতর অনেক নদী
পাখিদের এত শোরগোল
গাছ দেখে নদী ভয় পেয়ে গেছে
মানুষের এত হাঁকডাক
নৌকা দেখে নদী দরজায় খিল এঁটে দিয়েছে

নদীর পেছনে আমি
আমার পেছনে সমুদ্র
বাঁশির সুরেই নদী ভেঙে ভেঙে গেল
কোন মুখপোড়া, কোন হাঁদু অমন করে বাঁশিতে সুর তুলেছিল?

সমস্ত জীবন চোখের মধ্যে নিয়ে বুজে গেল, ডুবে গেল

পাউসেপলার জীবন

জিবের নিচে একটা চিঠি আছে, পড়তে পার
আমি তোমার ফুল নিতে পারিনি, ঠিক বলেছ আমি পাথর
ঘরে ফুলদানি নেই, ফুল নিয়ে রাখতাম কোথায়
আমি পাথরই, রাতে জ্বলা পাথর, দুঃখের পাথরে ঘষা খেয়ে বারুদের মতো জ্বলে উঠি
আত্মা পুড়ে যায়
চোখ আকাশে তুলে রাখলে দেখতে পাবে না
দুঃখের সামনে বসে নিজেকে মাছের ভাগার মতো লাগে
চোখের নদীতে পানি কম ছিল না তবু জীবনের নৌকা আটকে গেল

আমার দরজায় একটা তারা দেখতাম-- তোমাকে পাওয়ার আশার
এটা তুমি সঙ্গে নিয়ে গেছ-- উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠার সময়
তারপর থেকে আমার আকাশ একা ও অন্ধকার
আর কোনও তারা ওঠেনি

হৃদয় দিয়ে ভাগ্য ধরে রাখতে পারিনি অথচ তুমি ভাগ্যের মেয়ে ছিলে না
পুজো দিয়ে তোমাকে ধরেছিলাম ভগবানের কাছে
আমি কাচ না ভাই, আমি বিক্ষিপ্ত হয়ে যাই ঠিকই
কিন্তু চিৎকার দিতে পারি না
গুমরে কাঁদি, বালিশ ভিজাই, আকাশটাকে জলে ভাসাই
বুকের ভিতর গরম হাওয়া ফোঁস করে ওঠে গলায় ঘুঙুর বাঁধা বাছুর গোরুর মতো

আমার পাউসেপলার জীবন, চোখ তুলে তাকান যায় না, কাছে ভিড়া যায় না
নাক ধরতে হয়, বমি আসে

আমার ভিতর মসজিদ ঘুমিয়ে আছে, আমি মরে গেলাম
সে জানতেই পারল না

আমার ভাগ্যের তারা লুকিয়ে থাকে দিনের ভিতরে
আমি কি করব এত পুজো করে!

তসলিমার শাড়ি

একটা কবিতা তোমার শাড়িতে বিলের মাছের মতো ভেসে উঠেছিল
আমি তক্কেতক্কে ছিলাম, বুঝোই তো আমি একজন জেলে প্রেমিক
ঠিকঠাক কবিতাটা জালে বন্দি করতে পেরেছিলাম
তোমার শাড়ি একটা বিল, একটা হাওড়
তোমার শাড়িতে নেমে গেলে মনে হয় মন্দিরে নেমেছি
চারদিকে ভগবানের জট
তোমার শাড়িতে নেমে গেলে মনে হয়
সমুদ্রে নেমেছি
চারদিকে উঠতি জলের কটমট
এই কবিতাটা আমার মনে ঝড় তুলছে, আমার রক্তে আজানের ধ্বনি হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে
মনে হচ্ছে তোমার শাড়ি বদরের যুদ্ধের ময়দান
কাফেরদের খতম করে তোমাকে পেয়েছি

এই কবিতাটা তুমি বাড়িতে নিয়ে যাও, তুমি যেন কোথায় থাক? দিল্লি না মদিনা? নিয়ে যাও
কবিতাটা পড়
বুঝতে পারবে আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি আর কতটা চাই
তোমার চুলের পাড়া যেন একটা প্রেমের মহাদেশ
কিছুটা স্বপ্ন কিছুটা কেশ

তুমি শুদ্ধ প্রমিত বাংলা উচ্চারণ
কোথাও আঞ্চলিকতার খেদ নেই, ধর্মের মেদ নেই
তুমি একটা নীল শাড়ির আসমান
আমি যেন দেখতে বসেছি ঈদের চাঁন
তোমার শাড়ির আলগা সীমানা
তোমার ব্লাউজের সংসার থেকে বের হয়ে একটা মাছ মেলেছে ডানা
হাওয়া দিচ্ছে নাভির পালে
টোল পড়ছে শাড়ির গালে
ব্লাউজ থেকে উঁকি দেওয়া মাছ কোমরের খাদে নেমে গেছে
আমি তোমার খোলা পিঠে একটা কবিতা হিজিবিজি করতে থাকলাম
এই কবিতাটা তুমি বাড়ি নিয়ে যাও
তুমি যেন কোথায় থাক? দিল্লি না মদিনা?

তোমার শাড়ির জানলা দরজা খুলে বয়ে যাচ্ছে বুনো বনের গন্ধ মেখে সমুদ্রের নোনতা হাওয়া
আমি চিল্লে চিল্লে বলছি একটা মাছ দিয়ে যাও
তোমার শাড়িতে তুমুল ঢেউ ওঠে, মনে হয় কোনও হাফেজ মাথা কুটে কুরান পড়ছে
ইয়াদ হচ্ছে না, তবু সে মাথা কুটছে
জলে ভুটভুটি হয়, মাছের দাঁতে শাড়ির পিঠ খুলে যাচ্ছে
মন চাঙ্গা হয়ে ওঠে, এইবার অনেক মাছ জালে আটকাবে

তোমার শাড়ির হাওড়ে বিকেলের সাথে আমি ডুবে গিয়েছিলাম
তোমার অাঙুলের সন্ধ্যা আমার চোখে ভরে দিয়েছিলে
আমি আর দেখতে পাইনি
তখন আমি স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলাম
তোমার শাড়ির পড়ন্ত আঁচল
আমার পুরো আকাশটা খেয়ে বসেছিল।

পুত্রবধূ

মানুষ যে মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে গেছে
কোন আসমানে খোদা সেজদায় পড়ে গেছে?
লাইনে দাঁড়ান বলছি, পোশাকটা খুলছি
রাজনীতি একটা বেগানা পুরুষ
বাড়িতে আসছে, ঘোমটা দাও বউ
আমরা একেকজন বাড়ির ভিতরে ঘোমটা দেওয়া পুত্রবধূ
আমাদের হাতে ক্ষুধার অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে
আমরা অস্ত্র তাক করেছি আমাদের দিকে
আমরা জীবন দিতেছি মৃত্যুর কাছে লিখে

সব মানুষের দুঃখ আছে
আমার কাছে বাংলাদেশের দুঃখ আছে
প্রশ্ন করব না
কে আলোর তলে ধারালো অন্ধকার পুষছে
চাঁদের কপালে কে টিপ পরাচ্ছে
সূর্যের মাথায় কে টুপি পরাচ্ছে
আকাশের সিঁথিতে কে সিঁদুর লাগাচ্ছে
হাওয়াকে কে ভাগাচ্ছে
আমি বলব না
আমি চিৎকার করে বলতে পারি
আমি লিখে বলতে পারি
আমি ছবি এঁকে বলতে পারি
কিন্তু আমি বলব না
চিন্তার ওপর জাল ফেলে রাখব
রক্তে পানি ঢেলে থাকব
বিবেকে তালা মেরে ফেলব

এই মুখের পেছনে মুখোশ আছে
আমি খুলব না
এই খবরের পেছনে খবর আছে
আমি বলব না
আমার ঘর আছে, আমি বলব না
আমার জীবন আছে, আমি বলব না
আলোর নামে মৃতের ছায়া মাথার ওপর কে ছাতা করছে
আমি বলব না
কারণ আমি বাড়ির ভিতরের পুত্রবধূ
হাতে চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ
বারান্দায় ভেজা লাল শাড়ি ঝুলছে
খোলা জানালায় রবীন্দ্রনাথের রেকর্ড বাজছে

এই গল্পের পেছনে কে আছে
আমি বলব না
নাটকের এই স্ক্রিপ্ট কে লিখছে
আমি বলব না
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বয়লার মুরগির খাঁচা
শিক্ষকগুলো সংযোগহীন কারেন্টের খাম্বা
নিরাপত্তার নামে ঠোঁটের বসন্ত কে কেড়ে নিচ্ছে
জিহবা কেটে কে কণ্ঠস্বর জব্দ করছে
আমি বলব না

মানুষ আকাশটা টুপি ভেবে পরেছে
তোমরা মানুষকে ভুল বুঝ না
লজ্জা ঢাকার জন্য মানুষ সাহায্যের কাফন পরেছে
তোমরা মানুষকে ভুল বুঝ না
কোথাও না কোথাও সুর সরে গেছে
পৃথিবীটা মানুষের ওপর চটে গেছে

চাষ হচ্ছে বেকারত্বের ফসল রক্তের জমিনে
এই রক্ত কার?
তোমার নূরের ঝলকে
একটা দুঃখের পাথর দুঃখের পাহাড় হয়ে যাচ্ছে
তোমার ভাষা নির্মম
তোমার অাঙুল খুনি
ইশারায় আমাদের ভাগ্য কচুকাটা হচ্ছে
কে তুমি?
আমি বলব না
আমি তো বাড়ির ভিতরের পুত্রবধূ
সালাম দিচ্ছ, গলা খাকারি দিচ্ছ, তুমি একটা বেগানা পুরুষ
আমি ঘোমটা দিচ্ছি, শাশুড়ি মা চা আনছে, বসো


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান