অস্তাচলের পথে মুমূর্ষুর সজ্ঞা । আবদুল্লাহ আল-হারুন
অস্তাচলের পথে  মুমূর্ষুর  সজ্ঞা । আবদুল্লাহ  আল-হারুন

শেষ যাত্রার সঙ্গ দেওয়ার প্রসংগে প্রথম যে প্রশ্নটি উঠে সেটি হল, মুত্যুশয্যায় শায়িত হয়ে যিনি মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছেন, যার আরেকটা সাধারন ভাষ্য আছে, ”মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছেন” ( যদিও মানুষের এই অত্যন্ত স্বাভাবিক পরিনতিটিকে কোনমতেই যুদ্ধের সাথে তুলনা করা চলে না), রোগী যার মুখোমুখি হয়েছেন সেই মৃত্যুর সংজ্ঞাটি আসলে কি ? এখানে আমি এর একটা ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন এজন্যই বোধ করছি যে আধুনিক  চিকিৎসাবিদরা মৃত্যুর দু রকম সংজ্ঞা দিয়ে থাকেন। বস্তনিষ্ঠ পরিভাষায় মুত্যুপথযাত্রী তিনিই যার দেহযন্ত্র সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কার্যকলাপের পরম্পরা একটি ধ্বংসাত্বক প্রক্রিয়ায় এমনিভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যে মনস্তাত্বিক সাধারন চিকিৎসায় তার আর সেরে উঠার কোন পথই নেই। তার দেহগত অস্তিত্বটি সর্বক্ষেত্রেই পর্যুদস্ত হয়ে গেছে। যেমন দৃষ্টি, স্পর্স, ঘ্রান, ক্ষুধা, পিপাসা ইত্যাদি সমস্ত  বোধগুলি আর কর্মক্ষম নেই। সহৃদয় পাঠক/পাঠিকা ক্ষমা করবেন আমি মুমূর্ষূর সংজ্ঞাটি একজন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের জার্মান পুস্তক থেকে খুঁজে পেয়ে খুবই চেষ্টা করেছি এটাকে বোধগম্য বাংলায় অনুবাদ করার জন্য। ব্যর্থ যে হয়েছি তা পরে কৃতকর্মটি নিজেই পাঠ করে সম্যক উপলব্ধি করেছি ! যার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে তার বেলায় আমরা সবাই একটি অতি সাধারন সংজ্ঞা ব্যবহার করি। যা সহজবোধ্য এবং যাতে কোন কঠিন ভাবধারা নেই। সেটি হল, ডাক্তার যাকেজবাব দিয়েছেন অর্থাৎ যার আর কোনই চিকিৎসা নেই। গ্রাম বাংলার অভিজ্ঞ  কবিরাজরা সমস্ত পরিস্থিতিতেইনিদান হাকতেনএবং মৃমূর্ষুর নাড়ী টিপে প্রায় অভ্রান্তভাবে বলে দিতেন, আয়ু আর কতক্ষন অবশিষ্ট আছে ! উপরিলি­খিত ক্লাসিক ডাক্তারী সংজ্ঞাটিতে কমবেশী এটাই বলা হয়েছে। রোগীকে মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য  প্রয়োজনীয় আরও অষুধপত্রের ব্যবস্থা বা যান্ত্রিক কলাকৌশলের সব পথই  চিকিৎসকের এযাবত লব্ধ অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে এখন আর মোটেই কার্যকর নয়। চিরবিদায় নেবার সময় সত্যিই এসে গেছে।

এই চিরায়ত মৃত্যু সংজ্ঞাটি আন্তর্জাতিক সার্বজনীন। মহাপুরুষেরা একবাক্যে এটাকেই মানুষের জীবনে সবচাইতে বড় সত্য বলে অভিহিত করেচেন। প্রতিটি মানুষেরই যার প্রিয়জন বা চেনা কেউ মারা গেছেন সে

সত্যটির সাথে আজীবন মুখোমুখি হয়ে থাকে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে আরেকটি মৃত্যর কথা বলা হয়ে থাকে। তা হল মৃত হযেও যারা মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরে আসেন। ব্যক্তি নিরপেক্ষভাবে এবং সাধারন বিবেচনায় ধরনের মৃত্যুগুলি অন্য আরেকটি স্বাভাবিক মৃত্যুর মতই। নিশ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, শরীর নিস্তব্দ হয়ে যায়। হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়। তথাকথিত ক্লিনিকিাল মৃত্যুর সমস্ত চিহ্নই প্রকট হয়ে থাকে। সময় অনেক মৃতকেই নানাবিধ যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। মৃত্যুর সমস্ত লক্ষনই নি:সন্দেহে প্রতীয়মান হয়েছে। কিন্ত কোন এক অলৌকিক ব্যাখ্যার অতীত কারনে মৃতব্যক্তি কিছুক্ষন পরেই আবার বেঁচে উঠেছেন। আমেরিকার বিখ্যাত ডা: রেমন্ড মুডি, ধরনেরঘবধৎ উবধঃয ঊীঢ়বৎরবহপব“ ( প্রায় মৃত্যুর অভিজ্ঞতা) নিয়ে সহস্রাধিক ঘটনা বিশ্লেষন করেছেন। ধরনের ঘটনায় অনেক সময় নিজেও উপস্থিত থেকেছেন। পাঁচশর মত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের সাথে কথাবার্তা বলেছেন এবং বিষয়ে একাধিক বইও লিখেছেন। আমি পরে একটা আলাদা অধ্যায়ে এই চিত্তাকর্ষক এবং মৃত্যুর সাথে জড়িত একটি প্রয়োজনীয় বিষয়ে বি¯তৃত আলোচনা করব। আমি নিজেও কয়েকবার ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হয়ে সৃষ্টির একটি পরম রহস্য আর মৃত্যুকে অন্য আরেকটি বিশেষ রূপে কাছে থেকে দেখেছি। যা মৃত্যুর পরে আরেকটি জীবনে আমার বিশ্বাসকে আরও সুদৃঢ় করেছে। আসলে মৃত্যু এক পুথিবী থেকে আরেকটি পুথিবীতে সেতুবন্ধন মাত্র।

দেহের সমস্ত অংগ প্রত্যংগই কর্মহীন হয়ে গেছে, শুধুমাত্র মস্তিস্ক কর্মক্ষম। আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যায় ধরনের প্রায় মৃত রোগীকমা অবস্থান করছেন বলা হয়। একধরনের অপ্রিয় সত্য হলেও কমাটি ঠিকই বাক্যের একটি অবস্থান যেখানে এটি এখনও শেষ হয়নি। যা শেষ হলে দাঁড়ি দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। ধরনের রোগীর অস্তিত্বও কমা আর দাঁড়ির মাঝখানে। জীবনমৃত ! বেঁচে থেকেও দৈনন্দিন কাজকর্ম করার ক্ষমতা আর নেই কিন্ত মস্তিস্ক কাজ করে। কমা-পেসেন্টে দুরকম। প্রথমত: যারা চোখদুটি বন্ধ করে সব সময় ঘুমিয়ে থাকেন। দ্বিতীয়রা সর্বদা চোখ খুলে রাখেন। তাদের ঘুমানোর সময়ও চোখ খোলা থাকে। কারন চোখের পাতা বন্ধ করার ক্ষমতাও তাদের নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এদের জাগ্রত কমা রোগী বলা হয়। উভয় ক্ষেত্রেই খাওয়া, নাওয়া সব প্রাকৃতিক কর্মই অন্যের করিয়ে দিতে হয়। সাধারনত: যন্ত্রপাতি দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস নল দিয়ে দেহে তরল খাদ্য সরবরাহ করা হয়। এধরনের জীবনমৃত রোগীর সংখ্যা  ইউরোপ আমেরিকাতে ক্রমেই বাড়ছে। দীর্ঘ প্রায় ত্রিশ বছর ধরে এরকম একটি কমা-রোগী জার্মানির একটি হাসপাতালে প্রথম দিন থেকেই সম্পুর্ন অপরিবর্তিত অবস্থায় শুয়ে আছেন।  হার্র্ট এটাকের পর গত জানুয়ারি, ২০০৬ থেকে ইসরায়েলের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রি আরিয়েল স্যারন তেল আবিবের একটি হাসপাতালে কমায় পড়ে শুয়ে আছেন। এরকমের অধিকাংশই রোগীই এক সময় মারা যান। অনেকের আত্বীয় স্বজনরা আদালতের দ্বারস্থ হন, রোগীকে কৃত্রিম ভাবে (যন্ত্রাদির সাহায্যে) তথাকথিত জীবিত না রেখে জীবনরক্ষাকারী শ্বাসপ্রশ্বাসের নলটি খুলে ফেলার জন্য আইনানুগ আদেশ যোগাড়ের জন। বেশীর ভাগ আবেদনই নামঞ্জুর হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নাৎসীরা ৬০ লক্ষ ইহুদিকে বিভিন্ন কনসেন্ট্রশান ক্যাম্পে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে বা অন্যান্য অমানুষিক পদ্ধতিতে হত্যা করার ঐতিহাসিক সত্যের নিরিখে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্তা কমা-রোগীদের ধরনের ডাক্তারী সাহায্যে জীবননাশের প্রচেষ্টাকে জার্মানির আদালতেহত্যায়- সাহায্যবলে চিহ্নিত। যা আইনত একেবারেই নিষিদ্ধ। পাশাপাশি হলান্ড, ডেনমার্ক, সুইটজারল্যান্ডে ধরনের মৃত্যু-সাহায্য এখন অনেক সহজ। সেখানকার আইনও অনেক শিথিল। জার্মানি থেকে তাই বহু দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগী, দেহের অসহ্য যন্ত্রনা আর সইতে না পেরে পার্শ্ববর্তী এসব দেশে যান। য়েখানে বড় বড় শহরে ইঞ্জেকশান দিয়ে বা অষুধ খাইয়ে (কষ্টহীন) জীবননাশের জন্য ক্লিনিক আছে। অল্প টাকায় সেখানে মৃত্যু কেনা যায় ! জার্মানিতে ধরনের ক্লিনিক খোলা এখনও বেআইনি। এযাবত অনেক প্রচেষ্টাই তাই ব্যর্থ হয়েছে।

বর্তমান আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য অগ্রগতির কল্যানে অনেক মানুষের মৃত্যুই এখন আর নীলাকাশ থেকে বজ্রপাতের মত এক মুহুর্তেই ঘটে না। অবশ্য দৃর্ঘটনায় অপমৃত্যু  আর খুনখারাপীর কথা আলাদা। যখন আমরা মৃত্যুপথযাত্রীর সঙ্গ দেয়ার কথা নিয়ে আলোচনা করছি, ধরে নিতে হবে আমরা দৈনন্দিন মৃত্যুর কথাই বলছি। বয়সে, জরায় বা দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হবার পর যে মৃত্যুটি ধীরে ধীরে পা টিপে টিপে আসে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে উনবিংশ শতাব্দি নাগাদ প্রায় পৃথিবীর সর্বত্র অধিকাংশ রোগেই অকাল মৃত্যু অবধারিত ছিল। মহামারী, মড়ক, অনাহার, দুর্ভিক্ষ আর অর্থনৈতিক দুর্বিপাকে গুটিকতক ভাগ্যবান ঐশ্বর্যশালী ছাড়া আপামর জনসাধারনের কাছে যে কোন অসুখ মানেই ছিল আনিবার্য মৃত্যুর হাতছানি।

ক্লাসিক সংজ্ঞায় মৃত্যুর হঠাৎ আবির্ভাবটি তাই পাশ্চাত্যে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি আর নানা ধরনের সফল রিসার্চের কল্যানে অত্যন্ত ধীর হয়ে গেছে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই একটা দৃশ্যমান প্রক্রিয়ায় মাস বা সপ্তাহ ধরে শেষযাত্রাটি

একাকি বা হাসপাতালে অচেনা পরিবেশে শুয়ে মৃত্যুপথযাত্রীর জন্য একটি যন্ত্রনা বই আর কিছু নয়। ছাড়াও কিছু দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত রোগী আছেন যাদের চিকিৎসায় ডাক্তাররা সুনিশ্চিত হতে পারেন না কোন ব্যবস্থাটি তার জন্য প্রযোজ্য। এক্সপেরিমেন্ট চলে। আজ অষুধ, কাল আরেকটা। ডাক্তাররা বোর্ড গঠন করে আলোচনা করেন। রোগী এক সময আশাবাদি, হয়ত বেঁচে যাবে। কিন্ত পুরোনো অষুধ বদলে নতুন আরেকটি দেবার পর সে প্রত্যাশা অদৃশ্য হয়ে হতাশার জন্ম হয়। ক্যান্সারের চিকিৎসার বিভিন্ন পর্যায়ে ধরনের উঠানামা নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। আগে লয়কেমী বা শ্বাসনালীর ক্যান্সারে রোগীদের দ্রুতই অকালমৃত্যু ঘটত।

আজকাল নানাধরনের অষুধপত্রের সাহায্যে সম্পুর্ন আরোগ্য না করা গেলেও মৃত্যুকে অনেক ধীর করা সম্ভব।

ধরনের চিকিৎসার সময় রোগী অনেক সময় সচেতন থাকেন না। চেতনার অভাবে রোগী কঠিন এই ব্যাধির সাথে এক অসম সংগ্রামে লিপ্ত হন এবং এক সময়ে রোগই জয়ী হয়। জীবনের এটি একটি মধ্যবিরতির মত সময়। জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে অবস্থান। আযু যা এখনও কাগজে কলমে রয়ে গেছে, অষুধ আর যন্ত্রপাতির সাহায্যে যাকে ধরে রাখা হয়েছে। কিন্ত মৃত্যু যে কোনও সময় ঘটে যেতে পারে। আধুনিক চিকিৎসা বিদ্যার অগ্রগতির সাফল্যে ধরনের বিয়োগান্তক পরিস্থিতি আজকাল অহরহই ঘটে। যেহেতু ধরনের একটি মধ্যবর্তী কক্ষে অবস্থান ক্রমেই আত্বার উপর একটা অবহনযোগ্য বোঝা হয়ে যায় তাতে ধরে নিতে হবে যে এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী মারাত্বক সঙ্কট। ধরনের পরিস্থিতিতেই রোগীকে নিয়মিত চিকিৎসা ছাড়াও দিবারাত্রি কার্যকরি সঙ্গ দেবার প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে পড়ে।

দুটি বিশেষ প্রশ্ন এখানে বিবেচ্য। () কিভাবে মানুষ ধরনের চরম পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারে ?  () কিভাবে জীবনের এই অস্বাভাবিক পর্যায়টি এবং শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার অবনতির সমস্যাসংকুল সময়টি নিয়ন্ত্রন করা যায় বা সহ্যশক্তি দিয়ে কাটিয়ে উঠা যায় ? শুরুতেই একটি চিকিৎসাকেন্দ্রে দৈনন্দিন জীবন থেকে কিছু উদাহারন দিয়ে মৃত্যুকে রোগীর সামনে উপস্থাপনা করা যায়। এতে রোগীকে পরিস্কার করে বলা যায়, প্রতিটি মৃত্যুই একক। সব মৃত্যু পরিনতিতে এক হলেও, ব্যক্তিবিশেষে তার আগমন শেষ নিশ্বাসটি ত্যাগ প্রতিটি ক্ষেত্রেই সম্পুর্ন আলাদা। এরিষ্টোটল তাই বলেছেন: যার যার মৃত্যু তার তার নিজস্ব। একটির সাথে আরেকটির কোনই মিল নেই। মৃত্যু যে বাইরের চারপাশের পরিবেশ, পরিচিত প্রেক্ষাপট এবং ব্যাধির পরিনতির সংগে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তা সময়মত রোগীকে বিস্তারীত বললে, মৃত্য সম্পর্কে সে কৌতুহুলি হয়। সে ভাবে দেখা যাক, আমার মুত্যুটি তাহলে কেমন হবে ? কৌতুহুল এমন একটি মানবিক প্রতিক্রিয়া যা ভয় দুর করে এক ধরনের অদম্য বাসনার জন্ম দেয়। তাই কোন রকম ইতস্তত: না করে রোগীর সাথে মৃত্যু নিয়ে খোলা মনে আলোচনা করা ( অবশ্য এতে তার সম্মতি থাকতে হবে) আসন্ন মৃত্যুর জন্য তার প্রস্তুতিতে অবশ্যই সাহায্য করবে। অজানা অচেনা বিষয়ে মানুষের ভয় বেশী।

শুধুমাত্র রোগ বা চিকিৎসার ব্যর্থতাই যে মুত্যুর জন্য একমাত্র কারন তা নয়। রোগীর নিজেরও এখানে একটা উলে­খযোগ্য ভুমিকা আছে। শরীরের সুস্থতা/অসুস্থতা নিয়ে আমাদের আজন্ম অনীহা। দৈনন্দিন জীবনে কেউই এটা ভাবে না যে, তার খাওয়া, নিদ্রা নড়াচড়া, কাজকর্ম সব কিছুই একদিন তার জীবনাবসানের বাপারটিকে প্রভাবিত করবে। অসুস্থ রোগীকে তার এই অবহেলার কথাটি মনে করিয়ে দিলে, মৃত্যুর জন্য তার নিজের দায়িত্বটি নিয়েও তার একটি ভাবনা আসে। পরিনতির জন্য তার নিজস্ব একটি ভুমিকাও আছে। আজকের এই শেষযাত্রার নানা কারনের মধ্যে তার শরীর নিয়ে নিত্য অবহেলাটিও একটি।

মৃত্যুর প্রকৃত সংজ্ঞাটি চিকিৎসাবিদদের মতে এক হলেও, রোগীমাত্রেই এর কিঞ্চিত হেরফের ঘটে। আকাধিক মৃত্যুপথযাত্রীকে সঙ্গ দিলে এটা পরি¯কার বোঝা যায়। আমি নাগাদ পঞ্চাশেধিক সঙ্গ দিয়েছি। প্রতিটি মৃত্যুই আমার কাছে রোগীর সাথে কথাবার্তা বলে বা শেষ মুহুর্তে নানা ধরনের অশরীরি, ব্যাখ্যার অতীত দৃশ্য অদৃশ্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কিন্ত বিষ্ময়কর ঘটনায় আমি স্থির নিশ্চিত, প্রত্যেকেরই মৃত্যটি তার একান্তই নিজস্ব। মৃত্যতে ব্যাক্তির সারাজীবনের কর্মকান্ডের একটা নিরবিচ্ছিন্ন ছাপ পড়ে। এবং সবারই জীবন ইতিহাস আরেকজনের চাইতে সম্পুর্ন পৃথক। প্রতিটি মানুষ বাহ্যিকভাবে অবয়বে প্রায় এক হলেও অভ্যন্তরে আলাদা।

মৃত্যুর সময়টিতে ঠিক কি ঘটে তা আজও আমাদের অনেকটাই অজানা। বাইরের যারা মৃত্যুপথযাত্রীর শয্যাপার্র্শ্বে উপস্থিত থাকেন, তারাও শেষ বিদায়ের পুরো চিত্রটি দেখতে পারেন না। একমাত্র যিনি চলে গেলেন, তিনিই সব জেনেছেন এবং সব দেখেছেন। আমাদের দুভার্গ্য মুত্যুর দুয়ার থেকে যারা ফিরে আসেন তারাও মৃত্যু পরবর্তী পুর্ন অধ্যায়টি না দেখেই পৃথিবীতে ফিরে আসেন। কারন তারা সত্যিকার অর্থে মরেন নি, মৃত্যুর দৃয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। তাই তাদের দেখাটি অসম্পুর্ন, বিবরনটি পুরো নয়। আর যারা মরে যান তারা কেউ আর ফিরে এসে আমাদের আগাগোড়া কাহিনীটি জানাতে পারেন না। এমনকি প্রিয়জনদেরও স্বপ্নে দেখা দিয়ে তারা সব কিছু বলেন না। তারা কোথায় আছেন, কি করছেন, এসবরেই ভাসা ভাসা তথ্য তারা দিয়ে থাকেন। হয়ত জীবিততদের জ্ঞান আহরনের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা নেই। যা শুধু মৃত্যুতেই অর্জন করা সম্ভব। আমার মনে হয় রহস্যের পুর্ন সমাধান মানুষ কোনদিনও জীবিত থেকে করতে সক্ষম হবে না।

ইউরোপ-আমেরিকায় বিখ্যাত অনেক গবেষনা কেন্দ্রে বা ল্যাবোরেটরীতে বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রের বহু খ্যতনামা বৈজ্ঞানিকরা নিয়মিতভাবে অনুসন্ধান করে যাচ্ছেন, মানুষ মারা গেলে কি হয় তা জানতে ! মৃতের শরীরে বা মনে জীবনাবসানের পর কি পরিবর্তন ঘটে ? সে কি অভিজ্ঞতার সম্মুখিন হয় ? মুত্যু সম্পর্কে ধর্মের প্রচলিত ঐতিহ্যবাহি ব্যাখ্যায় বৈজ্ঞানিক গবেষকরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন আনেক আগেই। বিংশ শতাব্দিতে ধর্মনিরপেক্ষতার  প্রসার আর মুক্তবুদ্ধির নিরংকুশ চর্চা তার প্রভাবের ক্রমবৃদ্ধিতে জন্ম মৃতুর রহস্যের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার প্রতি মানুয়ের কৌতুহুল দিন দিন বাড়ছেই।

মৃত্যু-গবেষনা যাকে ঞযধহধঃড়মু বলা হয়ে থাকে, অবশ্য বৈজ্ঞানিক গবেষনা জগতে এখনও খুবই নতুন, কিন্ত অবিশ্বাস্যভাবে গবেষকদের কাছে এটি অত্যন্ত আকর্ষনীয় মনোজ্ঞ অনুসন্ধানের বিষয়। তারা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষনা করে মৃত্যুকে জ্ঞানের আলোতে নিয়ে আসতে চান। মরণ প্রতিটি মানুষেরই কিছু না

কিছু একটি ব্যক্তিগত চিন্তার বিষয়, কারন আমাদের প্রত্যেককেই একদিন এর সামনাসামনি হতেই হবে। আজ নাগাদ তারা যা জেনেছেন, তা খুবই জটিল আবার চিত্তকর্ষকও বটে। দেহগত এবং আধ্যাত্বিক ঘটনা বা পরিবর্তন যা মৃত্যুর সাথে সাথে ঘটে, জীববিজ্ঞান সংক্রান্ত বা আত্বিক, বাস্তব এবং অলৌকিক প্রক্রিয়া, সবই একটি দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষন করে: ”মৃত্যুই শেষ নয় এটি একটি সুস্পষ্ট আবার নতুন প্রকাশ (গধহরভবংঃধঃরড়হ) যার মাধ্যমে মানুষের জ্ঞানের পরিধি আরও বেড়ে যায়। মৃত্যুতে সে যা জানতে পারে তা তার সারা জীবনের জ্ঞানার্জনের চাইতেও অনেক বেশী। মৃত্যু এক আধ্যাত্বিক দ্বারের উন্মোচন ঘটায়। চিরগোপন এক সত্য তার মোড়ক খুলতে শুরু করে। পরিকল্পনামাফিক একটির পর আরেকটি ঘটে, যেন পুর্বনির্ধারিত একটি কালানুক্রমিক নিয়ম আর পুর্ন শুদ্ধতার সাথে।

আগেই বলেছি প্রতিটি মৃত্যুই একমোবোদ্বিতীয়ম যেমন প্রতিটি মানুষের জীবনই আরেকজনের থেকে সম্পুর্ন পৃথক। মৃত যে জীবনকে পেছনে ফেলে সামনের আরেক পৃথিবীতে মৃত্যুর দ্বার দিয়ে প্রবেশ করে, সেটি হয়ত তার আরেক ধরনের জীবন যেখানে সে তার মৃত স্বজনদের সাথে পুনরায় সাক্ষাত করে এবং বিষ্ময়ের সাথে অবলোকন করে, তারা সবাই তারই অপেক্ষায় ছিল। মৃত্যুর দুয়ার থেকে যারা ফিরে এসেছে তাদের বক্তব্য থেকে এসব অবিশ্বাস্য তথ্য গবেষকরা যোগাড় করেছেন। মানুষ তার মৃত্যুতে শেষ বারের মত প্রমান করে যে সে কতটা একক এবং অনন্য।

অনেকেই আমরা এটুক অন্তত জানি যে (বাহ্যিকভাবে) বিভিন্ন রোগে, নানাপথে এবং নানা কারনে মৃত্যুর আগমন ঘটে। কিন্ত আমাদের মধ্যে খুব কমই মন্তব্যটির সত্যিকারের পরিসীমা সম্পর্কে কোন ধারনা করতে পারি ! কিভাবে আত্বা দেহের সাথে মৃত্যুর সময় বিযুক্ত হয়, তা নিয়ে নানা মুণীর নানা মত। চারিত্রিক বৈশিষ্টে মৃত্যুটি বেঁচে থাকার সময় আমাদের নিজস্ব অবিনিময়যোগ্য মুখমন্ডলের মতই আমার একার, অদ্বিতীয়। প্রত্যেকেই তার মত করে নিজস্ব মৃত্যুর মুখোমুখি হয়, যা আরেকজনের সাথে কখনই বদলানো যায় না।

বহু কবি, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, রসিকজন এবং জ্ঞানীব্যাক্তিরা মৃত্যু সম্পর্কে অনেক কিছু লিখেছেন। কিন্ত এদের অনেকেই মৃত্যুকে একেবারে কাছে থেকে দেখেছেন বলে জানা যায় না। আমি মত্যুপথযাত্রীকে সামাজিকভাবে একবার শেষ দেখা করতে যাবার কথা বলছি না। এটা আমরা প্রায় সবাই করে থাকি। কোনও প্রিয়জন মৃত্যুশয্যায় শায়িত, তা শুনে আমরা একবার অবশ্যইশেষ দেখাকরতে যাই। এটা একান্তই একটি স্বতস্ফুর্ত মানবিক ভব্যতা। আমরা স্বীয় অপরাধের জন্য তার কাছে ক্ষমা চাইতে আগ্রহী বা রোগীকে আমার প্রতি কৃত অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চাওয়ার একটা শেষ সুযোগ করে দিতে চাই। মৃত্যুর শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত থাকা বা শেষ যাত্রায় শেষাবধি সঙ্গ এসব লেখকরা কেউ দিয়েছেন বলে আমার মনে হয় না। ডাক্তার আর  নার্সরা মৃত্যুকে কাছাকাছি থেকে দেখেন, শেষ নি:শ্বাস ত্যাগের সময়ও এরা অনেক সময় মৃতের পাশে থাকেন কিন্ত এরা পরে কেউ আবার মৃত্যু সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা অন্যকে জানানোর জন্য লেখেন না। অধিকাংশ মানুষই সারা জীবনে আকষ্মিকভাবে বা স্বেচ্ছায় একাধিক মৃত্যুকে (প্রায়সই প্রিয়জনের) অবলোকন করেন এবং মৃত্যুকে এতটা কাছে থেকে এতই ব্যাকুল হয়ে যান যে আবেগের তাড়নায় পরবর্তী সময়ে সম্পর্কে কোন উলে­খযোগ্য স্মৃতিই আর ধরে রাখতে পারেন না। মড়ক বা গণমৃত্যতে ( বিপ্লব, যুদ্ধে বা সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে) যিনি সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি হয় সংক্রামক ব্যাধির হাত থেকে আশু পরিত্রান পাবার জন্য দ্রুত টিকা নেওয়া বা অন্যান্য বিধিব্যবস্থা নিতে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েন বা নিজে গণহত্যার শিকার না হবার সৌভাগ্যে মৃত কমরেড বা সঙ্গীদের ভুলে গিয়ে নিরাপদ স্থানে যথা সম্ভব শীঘ্র যাবার জন্য ব্যতিব্যাস্ত হয়ে পড়েন। উভয় ক্ষেত্রেই পরে যখন তারা মড়ক বা গণহত্যার কোন ছবি বা বিবরন শোনেন, নিজের অভিজ্ঞতার সংগে আর মেলাতে পারেন না। ধরনের দুর্ঘটনায় কোনমতে যারা প্রানে বেঁচে যান, পরে রাতে ঘুমের মধ্যে দু:স্বপ্নের শিকার হয়েও মৃত্যুকে শুধুমাত্রই বিভীষিকা আর বিপর্যয়ের প্রতিভু বলে মনে করেন। কোন অবস্থাতেই সে আর  মৃত্যুর একটি বস্তুনিষ্ঠ নিরপেক্ষ রূপরেখা অনুভব করতে পারে না।

এজন্যই আমরা কিভাবে মারা যাই তার নৈর্ব্যক্তিক নির্ভরযোগ্য প্রতিবেদনের সংখ্যা খুবই কম। এটাও সত্য যে আজকের সময়ে ইউরোপীয় সমাজে খুব কম লোকেরাই নিজের চোখের সামনে বা শয্যাপার্শ্বে বসে থেকে

আত্বীয়স্বজনের মৃত্যু দেখতে পারে (বা আদৌ তা চায় কি না!) মাত্র অল্প সংখ্যক রোগীই নিজ বাড়ীতে বা স্বজনের গৃহে মৃত্যু বরন করে। এমতাবস্থায় খুব কমই একজন দুরারোগ্য বা ক্রনিক রেগে আক্রান্ত রোগীর শেষ সময়টি দেখার সুযোগ পায়। ছাড়া অষুধপত্র বা ব্যাথা নিরসনের নানাবিধ ব্যবস্থা রোগীর প্রাত্যহিক দেহগত প্রাকৃতিক কর্তব্যকর্মগুলি নিয়ন্ত্রনের নামে মুলত: কার্যকরীভাবে গোপন করে রাখে। শতকরা ৮০ ভাগ আমেরিকান ৭০ ভাগ জার্মান (সংখ্যাতত্ব: ১৯৯৯) হাসপাতালে মারা যান। সারাজীবন যে সব আপনজন, বন্ধুবান্ধব, সন্তান সন্ততিদের সাথে তার বসবাস তাদের চোখের আড়ালেই জীবনের সন্ধ্যাটি নেমে আসে। মৃত্যুর সংগে কিংবদস্তির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। রূপকথা বা কল্পকাহিনী সবই যেমন মানুয়ের প্রয়োজনেই

লেখা বা বলা হয়, মৃত্যুরও নানা কিংবদন্তি মানুষ তার নিজের কল্পনা দিয়েই রচনা করেছে। এগুলোর একটা উদ্দেশ্য মৃত্যুভয়কে মিথ্যা কল্পনা দিয়ে জয় করার প্রচেষ্টা। আরেকদিকে অপ্রতিরোধ্য মৃত্যুর সত্যটিকে সীমাবদ্ধ রাখা। কল্পকাহিনীর আরেকটি কাজ হল, শঙ্কাকে কমানো যা আবার প্রকৃতপক্ষেই আমাদের মনের ভেতরে শিকড় গেড়ে আছে। যদিও অনেকেই চান মৃত্যু দ্রুত আসুক বা ঘুমের মধ্যে ব্যাথা বা যন্ত্রনা না দিয়ে তার অবির্ভাব হোক। কিন্ত বাস্তবে আমরা চাই আমাদের জীবন শেষ মহুর্ত নাগাদ সফলতা আর মর্যাদায় পরিপুর্ন থাক। আমরা যেন সম্পুর্ন চেতন অবস্থায় মরতে পারি এবং সে সময়ে গোটা জীবনের আগাগোড়া হিসাব নিকাশটি শেষবারের মত সঠিকভাবে করতে পারি ! এভাবেই আমরা মৃত্যুকেও জীবনের মানদন্ড দিয়ে মাপার চেষ্টা করি। আমরা মনে করি যেমন আমরা স্বেচ্ছাধীন থেকে জীবন যাপন করি তেমনি মৃত্যুকেও ইচ্ছামত গ্রহন বা অগ্রহন করব।আমার সময় না হলে আমি যাবো কেন ?” প্রশ্নটি সবাই নিজেকে করেন। কিন্ত কেউ জানেন কি, সময়টি কখন আসবে ? দেহ আর মনের সচেতনা যে একদিন যন্ত্রনাহীন অচেতনায় পরিনত হবে, তা আমাদের জানতে হবে। এবং সেটাই পৃথিবী থেকে চিরবিদায়, যাকে আমরা মৃত্যু বলে জানি।

 


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান