আমীনুর রহমান । শিরোনামহীন ৫টি কবিতা

শিরোনামহীন ৪৭
তখন তোমার কেমন লাগে
সারবাঁধা বকের ডানার মত আঙুলেরা যখন
বিগলিত আফ্রিকার সুগন্ধে বিলি কেটে যায়,
সকালের সূর্যকে নিপাট বৃক্ষেরা কানে কানে বলে,
এসে বসো ডালে,
পদ্মেরা ঘুমের আড়ালে হাতছানি দিলে
জলের যৌবন খুলে যায় নদীর উজানে
তখন তোমার কেমন লাগে, বল?
তখন তোমার কেমন লাগে
অযুত আলস্যে যখন শুয়ে থাকে শহরের নিয়ন বাতি
আর তুমি আঁতিপাতি খুঁজে ফেরো নোলকের লাল পুঁতি
প্রভাতি রঙের সূচ গেঁথে গেলে নিঃশ্বাসের অগ্রভাগে
তখন তোমার কেমন লাগে?
তখন তোমার কেমন লাগে
যখন সে সুখে মরে যায়, অথচ সে মরে না
ওড়ে না আঁচলের ঘ্রাণ অথবা ঘটেনা সময়ের প্রস্থান
শুধু ঢেকে রাখে সুখ নামাবলি এঁকে অনুরাগে
তখন তোমার কেমন লাগে
যখন সে অবিরল কথা কয় সুখের রঙে ভরে ওঠে ফুলঝুড়ি
জলের জাঙাল ভেঙে নাভিপদ্ম দিবারাত্রি জাগে
বল তো, তখন তোমার কেমন লাগে?
শিরোনামহীন ৪৬
যেখানে দাঁড়িয়েছিলে সেখানে আর কী কী ছিল
আকাশ নদী সমুদ্র বা কৃষ্ণচূড়ার আদিম উল্লাস?
কী ছিল আর, একবার মনে করে বলো তো দেখি।
পাখিদের দূরপাল্লা উজান কি ছিল আকাশের কোঁচড়ে
ছিল নাকি কয়েকটা মুহূর্ত জোড়া মিছরিদানা আলো?
কী ছিল বাতাসে? ছিল কি চিবুক ছোঁয়া চিকুরের
অমৃতস্য অনুভব, উপকূলে উন্মনা উজানের টান
পায়ের তলায় মরে যাওয়া সলাজ বালুকা?
ভরভরন্ত সকলই কি ছিল পূর্ণকুম্ভের কাছে?
ধানী জমির গর্ভবতী ক্ষেত, নিঃসঙ্গ বাবলার একহারা ডাল
অথবা পায়ের তলায় হাহাকারের মত বিছিয়ে থাকা ছিন্নপত্রাবলি?
এসবও কি ছিল, অথবা তাও ছিল না?
নাকি তুমি এসে দাঁড়ালে দোরে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে
আর সব কিছু এক মুহূর্তে মূল্যহীন হয়ে যায়?
শিরোনামহীন ৪৫
শঙ্খবর্ণের দোতলা বাড়িটার সত্যিই কোন দোষ ছিল না,
মাধবীর কচি পাতা, দুটো জুলুজুলু চড়ুই
ঝুম বৃষ্টি বা দেয়াল ঘেঁষা বিথীকার মত
পাহারাদার দেবদারু গাছেরাও ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ,
অমন একান্ত দুপুরে বৃষ্টি মুখর জলে কোমর ভিজিয়ে
পত্রমোচি কুরচির নিবিড় বৃন্তও অবেলায় ঘুমিয়ে ছিল।
সেই ঘোর লাগার দুপুরে এক পলকা সুতোর মত
নিঃসঙ্গতায় ডুবে যেতে যেতে বাড়িটার যে কী হলো
ইট থেকে বালু, বালু থেকে সিমেন্ট, ছাদ থেকে সিঁড়ি
জানলা-গরাদ-অর্গলের সকল বাঁধন খসে খসে পড়ল
যেন অন্তহীন আকাশ থেকে খণ্ডিত তারারা
পরম নির্ভরতায় টুপটাপ বাড়িটার ঠোঁটে বুকে মুখে
আছড়ে পড়ল-
সেই প্রথম বাড়িটা বুঝতে পারলো
জানালার পাশে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা
কন কনে শীতে কাঠ কয়লায় আগুন জ্বালানো,
আর শঙ্খবাড়ির ভেতর শঙ্খিনীর জ্বলে ওঠার পার্থক্য কী।
শিরোনামহীন ৪৪
তোমাকে হারানোর আগে
পাখি ডাকা ভোরের মত একখানা বসত ভিটে ছিল আমার
এঁটেল মাটির দেয়াল, চৌচালা ঘর, এক টুকরো বাগান,
মধুগন্ধী কুরচিতে ছিল দুলে ওঠা আশ্চর্য সকাল
সমবেত সবুজে একুশটি দুর্বার দুর্দমনীয় দৃঢ়তা
আর ছিল পাতকুয়োর জলে পিপাসা মেটানো অমৃতষ্য জল।
তোমাকে হারানোর আগে
আমার ও আমাদের এরকম সবই ছিল,
ঐ যেমন সকল গেরস্ত বাড়িতেই থাকে
বাথানে গরু, গম্বুজের মত খড়ের গাদা,
পুঁইয়ের মাচা, নারিকেল সুপারির একহারা উড়ন্ত পাতা,
লাউয়ের ডগার মত গলে পড়া ছায়াদের হামাগুড়ি খেলা
তোমাকে হারানোর আগে এমন সবই ছিল আমার
যবের উদ্ধত পাতায় ছিল একমুঠো খামার
যেখানে সেকার নামের বাজপাখি তার শকুনী ঠোঁটে
মানুষের জ্ঞানদৃষ্টি খুঁটে খেয়ে অন্ধ করে দেয় নি,
ধর্ম তখনো একপেয়ে বক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নি
রুপালি পুঁটির লোভে দুর্গন্ধ কাদায়
নধর গাভিটির নাম তখনো উষ্ট্র হয়ে ওঠে নি
জলে ভেজা মাটি তখনো দো’আশ আর এঁটেলের বুকে
ফলিয়ে তুলছিল রবিশস্যের আগামী জীবন
তখনো বাংলা নামের দেশটি
বালিমাখা মরুভূমির আদি কামকলার প্রতিরূপ হয়ে ওঠে নি
তখন আমার ও আমাদের সবই ছিল-
হারিয়ে যাবার আগে, সেই শেষবার
তুমি আমার ও আমাদের এবং সকল মানুষের দেশ ছিলে…
শিরোনামহীন ৪৩
তোমাকে রেখে এসেছি
হাকালুকির বাম পাঁজরের খাঁজে
জাগ দেয়া পাট আর ঘানি ভাঙা খৈলের মতন জলে ডুবিয়ে-
পান-বরজের ছায়ায় ছায়ায়
চায়ের কচি পাতায় হেলান দেয়া অনায়াস ছায়াবৃক্ষের নিচে।
তোমাকে রেখে এসেছি
কান্তজির অনন্ত পবিত্রতায় টেরাকোটা রেখায় রেখায়
শতাব্দীর দেয়ালচিত্র, পায়রা নদীর আদিবাসী সুখে
শঙ্খনিধির ক্লান্ত খিলানে
শঙ্কাহীন জালালি কবুতর আর চঞ্চল চড়ুইয়ের ঠোঁটে।
তোমাকে রেখে এসেছি
মোমবাতির মোলাম আলোয়, লোবানের সুগন্ধে
চালের রুটি ফকিরের মাজার মিলাদি জিলাপির কাছে
কুঠিবাড়ি আর কপোতাক্ষের স্রোতে
শা’জাদপুর ঢেকে রেখে ছেউড়িয়ার নকশি কাঁথার রঙে।
তোমাকে রেখে এসেছি
দোলে দুর্গায় প্রবারণায় ইদের কিশোরী মেলায়
শহিদী মাতম কালো তাজিয়ায় হোসেনের শব যাত্রায়
পুঁথি পাঠ, শনি আখড়ায়
বিরহী রাধার অকুলান জ্বরে যাত্রাপালার উচ্চাবচ স্বরে।
তোমাকে রেখে এসেছি
কলা ভবন বকুল তলা রমনায়
মঙ্গল শোভাযাত্রায়, মাদলের তালে দোলের রঙ বাহারে
শ্যামলীর চার তলায়
তড়পানো হৃদয় ঝুলে থাকা মালতির সলজ্জ পাতায়।
ওগো শ্যামল মা’টি
তোমাকে পথের মোড়ে
রাঙা চিহ্নের মত ছেড়ে আসতে আসতে
যে দুটো ছলছল নদী পাঁজরে গেঁথে এনেছি
তাদের জল কল্লোল রোজ ঘুম ভাঙিয়ে বলে
ভোর হল, চোখ মেলো……………..