কবি ও সংগঠক অনিকেত শামীমের জন্মদিন আজ
কবি ও সংগঠক অনিকেত শামীমের জন্মদিন আজ

কবি ও সংগঠক অনিকেত শামীম

ফরিদ আহমদ দুলাল: নব্বই দশকের স্বনামখ্যাত কবি ও সংগঠক অনিকেত শামীমের আজ জন্মদিন।

অনিকেত শামীম, একসময়ের মেধাবী ছাত্রনেতা, পরবর্তী সময় কবিতাকর্মী ও সংগঠক। তার গ্রন্থ ‘অনিকেত শামীমের কবিতা’র ফ্ল্যাপে বলা হয়েছে, ‘এই গ্রন্থ তার সামগ্রিক কাব্যযাত্রার উজ্জ্বল সারাৎসার।’ এ গ্রন্থের দ্বিতীয় ফ্ল্যাপে তার প্রকাশিত গ্রন্থ তালিকায় বর্ণিত ‘তপোবনে তোপধ্বনি’ এবং ‘দূরাগত পাহাড়ের গান’ কাব্য দুটিসহ বর্তমান আলোচনাটিকে আমি ‘উজ্জ্বল সারাৎসার’ হিসেবে বর্ণিত পাঁচকাব্যেই সীমাবদ্ধ রাখব এবং ‘অনিকেত শামীমের কবিতা’ গ্রন্থের কাব্যক্রমকে তার প্রকাশিত কাব্যক্রম হিসেবে উল্লেখ করব।
‘নব্বইয়ের দশকের কাব্য-অভিযাত্রায় কবি অনিকেত শামীম নিমগ্নচিত্ত পরিব্রাজক। তার উচ্চারণে এমন এক ঘনীভূত সুর ও স্বর আছে, যা কবিতাকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়-যেখানে প্রকৃত সত্য ও সৌন্দর্য উদ্ভাসিত। তার কবিতার আঙ্গিক এতটাই নিজস্ব যে, তিনি যে-কোনো ভাবনাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করতে পারেন- কখনো প্রতীকবাদী শৈলীতে, কখনোবা বিকল্প-সংবেদনায়। এভাবেই কবিতাকে তিনি শিল্প-সৌকর্যের নান্দনিক আভায় প্রতিসরিত করে তোলেন।
তার কাব্যশরীর প্রেম ও বিপ্লবে লীন। যে নোতুন সভ্যতার আবাসভূমিতে তিনি পৌঁছোতে চান, সেখানে একটিকে বাদ দিলে অন্যটি অর্থহীন হয়ে পড়ে; সে সভ্যতা এমনই প্রেমময় ও অধিবাস্তব যে, ওই যাপনে ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য থাকে না। যেখানে দ্রাবিড় নারী গেয়ে ওঠে ভালোবাসার গান, কালের যুবক চালিয়ে যায় বেগবান অশ্ব।
স্বপ্নের দোলাচলে ফসকে-যাওয়া মহাকালকে আনন্দ-আস্বাদে ছুঁয়ে দেখা শুধু নয়, শিল্পের আশ্রয়ে সুনিপুণ চর্যায় তাকে আগলে রাখার কৌশলও জানতে হয়; অনিকেত শামীম আমাদের সময়ের সেই কুশলী কাব্যকার।’ (প্রথম ফ্ল্যাপ : অনিকেত শামীমের কবিতা)। ফ্ল্যাপের এ কথাগুলো কে লিখেছেন আমাদের জানা নেই; জানা থাকলে আমরা সহজেই এটিকে শামীমের কবিতার একটি কুশলী মূল্যায়ন হিসেবে বিবেচনা করতে পারতাম; কিন্তু তা যেহেতু পারছি না, অগত্যা নিজেকেই নিজের মতো করে আবিষ্কার করে নিতে হবে তার কবিতার সৌন্দর্য এবং শিল্পরূপকে, আবিষ্কার করে নিতে হবে তার প্রকরণ প্রবণতা আর শিল্পদ্যুতির মুন্সিয়ানাকে।
এ সংকলনের প্রথম কাব্য ‘শব্দ-নৈঃশব্দ্যের অনুরণন’। প্রথম কাব্য থেকে একটি কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি উচ্চারণের মাধ্যমে এ কাব্য সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত করতে চাই :
মাথায় অগ্নিপি-
চুপচাপ বসে আছি পিনপতন স্তব্ধতায়
আলোর ফেরিওয়ালা
সবকিছু ধরা পড়ে আমার এন্টেনায়
তোমাদের সমূহজীবন
দূরে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করি
অশরীরী ছায়া হয়ে তোমাদের মাঝে ঘুরে বেড়াই
আমাকে দেখে না কেউ, দেখতে পায় না
ত্রিকালদর্শী অন্ধদেবতা তোমাদের মাঝে আলো ছড়াই
তোমাদের ক্লেদাক্ত জীবন
তোমাদের হাসি-তামাশা আনন্দ-বেদনা
অন্ধকারে হারায় হাহাকার
আর আমি কষ্ট পুষে পুষে গুটিয়ে থাকি
তোমাদের আলোকিত করে বসে থাকি অন্ধকারে
-পিলসুজ
কবিতাটি পড়তে পড়তে আমরা যেন আস্বাদন করলাম পরাবাস্তবতা; জাদুবাস্তবতার আবর্তে তার কাব্য-অভিযাত্রা শুরু। ত্রিকালদর্শী অন্ধের চোখের আলোয় উন্মোচিত হচ্ছে অন্ধকার। প্রথম কাব্যের বেশ কিছু কবিতায় আমরা তেমন আবহের সন্ধান করতে পারি। আমরা পড়তে পারি ‘বিন্দুবৃত্ত’, ‘মহাবৃত্ত’, ‘প্রচ্ছায়া’, ‘ভোর’, ‘ক্ষরণ’, ‘স্বপ্নিল অন্ধকার’ ইত্যাদি কবিতা। এসব কবিতা পড়ে প্রতীয়মান হয় সচেতনভাবে হোক আর অবচেতনে হোক অনিকেত শামীম বিমূর্ততার আশ্রয়ে জাদুবাস্তবতার পরিচর্যা করতে চেয়েছেন তার কবিতায়।
ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত দিশেহারা এক পরিব্রাজক কবির সন্ধান পাই আমরা দ্বিতীয় কাব্য ‘ও মন তুই কদ্দূর যাবি’তে। প্রথম কাব্যের গাঁটছড়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নয়, বরং সে মেজাজ অটুট রেখেই শামীম তার দ্বিতীয় কাব্যে উদয়াস্তকে সঞ্জীবনী সুধায় রসসিক্ত করতে চেয়েছেন তার পরিব্রাজক মননে। আমার কথার সত্যতা যাচাইয়ে এ-কাব্যের ‘প্রতিবেদনের ভাষ্য’, ‘মাহেন্দ্রক্ষণ’, ‘কচুপাতা জীবন’, ‘যুগসন্ধিক্ষণে মনোবিকলন’, ‘অসমাপনী ক্রিয়া’, ‘রূপান্তর’, ‘সান্ধ্যভাষ্য’, ‘জন্ম-জন্মান্তর’, ‘প্রিজমবৃত্ত’ ইত্যাদি কবিতা পড়ে দেখতে অনুরোধ করব। আর এখানে ‘সোমপুর বিহারের বালিকা’ এবং ‘সিসিফাস’ কবিতা দুটি থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি উচ্চারণ করে শোনাব :
… হাজার বছরের বালিকা-শরীর স্পর্শাকাক্সক্ষায় আমরা উন্মুখ, অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না ভাবনা বাতিল করে আলো দেখার উৎফুল্লতায় মেতে উঠি
মনে পড়ে বিদর্ভ নগরের কথা
হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর বোন আমাদের এই সোমপুর
ঐ তো বৌদ্ধভিক্ষুরা করিতেছে জ্ঞানবিতরণ
আমরা শিশুগণ মন দিই নিজ নিজ পাঠে
পাঠ নিই সভ্যতার
পাঠ নিই বিমানবিকীকরণের

তুমুল ভাঙনের শব্দে নিদ্রাসমগ্র থেকে পুনর্বার জেগে উঠি আমরা… আমাদের অস্তিত্বে খেলা করে বোবা সময় আর বোবা সময়ের সুতো বেয়ে মনে পড়ে নীল উপাখ্যান…
-সোমপুর বিহারের বালিকা
দ্বিতীয় কাব্য ‘ও মন তুই কদ্দূর যাবি’ সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছি গোড়াতেই, তার পক্ষে উচ্চারণ দেখতে পাই এ-কাব্যের ‘সিসিফাস’ কবিতায়। কবির অবচেতন মন অথবা গভীর আত্মদর্শনই হয়তো তাকে দিয়ে এ কবিতাটি লিখিয়ে নিয়েছে। আমরা জানি গ্রিকপুরাণের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সিসিফাস-এর কথা। দেবতার অভিশাপে দণ্ডিত বীর সিসিফাসের দণ্ড; তাকে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পাথরের এক বিশাল চাঁই ঠেলে পাহাড়চূড়ায় তুলতে হবে। পাহাড়চূড়ায় পাথরের চাঁই তুলতে পারলেই সে শাপমুক্ত হবে; কিন্তু বীর সিসিফাসের নিয়তি হচ্ছে চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছতেই পাথরের চাঁই গড়িয়ে পড়ে যাবে নিচে, পুনর্বার তাকে ঠেলতে হবে পাথর। উদয়াস্ত নিরন্তর সংগ্রামের কথা স্মরণে রেখেই কি অনিকেত শামীম ‘সিসিফাস’ নামের নিত্য সংগ্রামী সেই বীরের নামে লিখেছেন এ কবিতা-
প্রতিদিন নিজের কাছেই ফিরে আসি বারবার
আমাকেই আমি পাঠ করে কাটিয়ে দিই সারাবেলা
জীবনের নিরর্থকতায় মোহগ্রস্ততার অবসাদ
প্রতিনিয়ত ঘূর্ণায়মান
তবুও মেনে নিই
নিরর্থকতার মাঝেই ফিরে আসি বারবার
……………
ভালো থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা আমাদের প্রাপ্তিতে বাথা হয়ে দাঁড়ায়
ভালো থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা
চোরাবালি চোরাবালি
তবুও অলিগলি ভুলপথ হেঁটে হেঁটে চোরাবালিতে রাখি পা
-সিসিফাস
যাদুবাস্তবতার ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত পরিব্রাজক কবি যেন পথের দিশা খুঁজতে চেয়েছেন তৃতীয় কাব্য ‘ছুঁয়ে দিই কিংবা স্পর্শের অতীত’-এ। কবির কাব্যযাত্রায় এই যে ধারাবাহিকতা কিংবা অগ্রসরমানতা সেটাকেই কবির শক্তি বলে চিহ্নিত করতে চাই। শামীম-এর এই তৃতীয় কাব্যকে আমি অধিক গুরুত্ব দিতে চাই। এ কাব্য যেন অনিকেত শামীমের বাঁকবদলের কাব্য। এ কাব্যে শামীম জাদুবাস্তবতার খোলস ভেঙে বেরিয়ে এসে বাস্তবানুগ মানবিকতায় অবগাহন করতে চান; অন্যদিকে আছে তার পরিব্রাজক-স্বভাবের পিছুটান। টানাপড়নের সেই দ্বন্দ্বও পাঠক খুঁজে পাবেন তার তৃতীয় কাব্য ‘ছুঁয়ে দিই কিংবা স্পর্শের অতীত’-এ।
একদিকে ‘কত বিনিদ্র রাত্রি’, ‘নান্দনিক আত্মজ’, ‘ফ্রিজ হয়ে যাই বোবা হয়ে যাই’, ‘হেরোইন সময়’, ‘আকুপাংচার’, ‘সুখদুঃখের কড়চা’, ‘চোখ’, ‘হৃদয়ঘুড়ি’, ‘পঙ্ক্তিমালা : তোমার জন্য’, ‘অনন্য প্রজন্ম’, ইত্যাদি কবিতা অন্যদিকে ‘সজল পৃথিবীর বুকে’, ‘ফাঁদ’, ‘ঈশ্বর, মানুষ ও কবি’, ‘অর্ফিয়ুস সুর’, ‘অনঙ্গ শূন্যতায় ওড়াউড়ি’, ‘যাত্রা’ ইত্যাদি। দুই চেতনার টানাপড়নের বাঁকে ‘অনির্বাণ দাহ’, অনির্বাণ দাহে কি কবি পুড়ে ফেলতে চেয়েছেন দ্বন্দ্বের পাঠশালা? যেখানে তিনি উচ্চারণ করছেন :
জ্বালাতে জ্বালাতে কতটুকু পোড়াবে তুমি
আমি তো পুড়ে পুড়ে বিষনীল ছাই

এই বুকে হাত রেখে দেখো
পিলসুজের মতো কতটা কষ্ট পুষেছি সংবর্তিকা আমি
কষ্ট-উত্তাপে গলে গলে যাবে তোমার সাগ্নিক হৃদয়
তোমার যত কষ্ট
জমা দাও আমার হৃদয়ের কষ্টব্যাংকে
সুদে আসলে ফেরত দেবো সুখের কড়কড়ে চেক
পোড়াতে পোড়াতে কতটুকু জ্বালাবে তুমি
আমি তো পুড়ে পুড়ে বিষনীল ছাই
-অনির্বাণ দাহ
বাঁক থেকে শামীমের কাব্যডিঙা কোনদিকে যাবে তার ইশারা অনিকেত শামীম নিজেই দিয়ে যান তৃতীয় কাব্যের নাম কবিতায়:
হায় ব্যর্থতা! ঘায় গ্লানিবোধ!
রাত্রির নিস্তব্ধতা কুরে কুরে খায় বুকের কর্ষিত বাগান
এতটা কাছে থেকেও তুমি বিদেশ হয়ে যাও
কবিতা কি ঈশ্বরী নাকি অপ্সরী
ধরা দিয়েও চলে যায় নাগালের বাইরে
এতটা কাছে থেকেও ছোঁয়া যায় না তোমাকে
স্বচ্ছ কাচের দেয়ালের ওপারে তোমার বসবাস
দেখা যায় অথচ ধরা যায় না
ছুঁয়ে দিলেই সর্বনাশ ছুঁয়ে দিলেই কেয়ামত
তোমাকে ছোঁব বলে দীর্ঘ দীর্ঘ প্রস্তুতি
-ছুঁয়ে দিই কিংবা স্পর্শের অতীত
যে বাঁক পেরিয়ে শামীমের নতুন দিগন্তে যাত্রা, সেই নতুন দিগন্তের হাতছানি যেন দেখতে পান শামীম তার চতুর্থ কাব্য ‘অদ্ভুত আলোয় হেসে ওঠো’-তে। চতুর্থ এ কাব্যের কবিতায় মনোযোগী হলে দেখি অনিকেত শামীম যেন নিকেতন সন্ধানী, পরিপার্শ্বের প্রতি মনোযোগী, সমকালের অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। এ সেই তারুণ্যদীপ্ত শামীমুল হক শামীম, যিনি সম্পাদনা করেছিলেন, ‘আবার একটা ঝড় উঠুক’, যেন পুনর্জাগরিত হয়েছেন তার চতুর্থ কাব্যে। শামীমের এ-প্রত্যাবর্তনকে আমি পশ্চাদপদতা হিসেবে দেখছি না; আমি বরং দেখছি তার শেকড়ের কাছে ফেরা। জীবনের সঞ্চিত পরিব্রাজকীয় অভিজ্ঞতাকে যৌবনের দীপ্তির সাথে সংযুক্ত হবার সম্ভাবনা হিসেবে দেখছি আমি তার চতুর্থ কাব্য ‘অদ্ভুত আলোয় হেসে ওঠো’কে।

অনিকেত শামীমের চতুর্থ কাব্যের কবিতা পাঠ করে জাদুবাস্তবতার আবেশমুক্ত হয়ে উঠি সহজেই! পাশাপাশি গভীর একটা প্রশ্ন মনকে আন্দোলিত করে; শামীম কি তার কবিতায় পূর্ণতার বিষয়টি নিয়ে সচেতন। পরিণত বয়সে কবিতায়ও যে প্রত্যাশিত পরিণতি, বিদগ্ধ-সচেতন পাঠকের প্রত্যাশা শামীম কি পূর্ণ করলেন তার এ চতুর্থ কাব্যে? দশকের সীমাবদ্ধ গণ্ডি পেরিয়ে অনিকেত শামীম কি মহাকালের যাত্রী হবার জন্য প্রস্তুত হলেন? নাকি তিনি আরও কিছু সময় নিতে চান সে প্রস্তুতির জন্য? যাপিত জীবনের পঞ্চাশ বসন্ত অতিক্রমণের পর কালের ঘড়ি তার কণ্ঠে নিশ্চয়ই সেই প্রশ্নের উত্তর-ধ্বনি শুনতে চাইবে।
শামীমের চতুর্থ কাব্য নিয়ে আলোচনার শুরুতেই আমি সামান্য বিচলিত হয়ে দিগ্ভ্রান্ত হইনি, আমি বরং ইচ্ছাকৃতভাবেই ভিন্ন একটি জরুরি প্রসঙ্গের অবতারণা করে অগ্রজ হিসেবে নিজেকে দায়মুক্ত করে নিতে চাইলাম। আমি বিশ্বাস করি বাঁকপরিবর্তনের মাধ্যমে শামীম নতুন যে পথের দিশা আবিষ্কার করেছেন, তার সাথে মনন-মনীষা, প্রজ্ঞা আর ঋদ্ধি দিয়ে তিনি যদি নিজের কাব্যাঙিনাকে রাঙিয়ে নিতে পারেন, তবে তার বহুমাত্রিকতার সর্বত্রই আলো বিচ্ছুরিত হবে। যে সম্ভাবনার ইঙ্গিত শামীম দিয়েছেন তার চতুর্থ কাব্য ‘অদ্ভুত আলোয় হেসে ওঠো’-তে। সংক্ষিপ্ত এ আলোচনায় আমি চতুর্থ কাব্য থেকে একটিমাত্র কবিতাই উদ্ধৃত করছি, আশা করি একটি কবিতা পাঠেই পাঠক কবির সম্ভাবনার দিকটি প্রসঙ্গে নিশ্চিত হবেন :
সবাই যে যার পথে চলে যায়
অচল মুদ্রার মতো পড়ে থাকে তেজি যুবক
প্রচণ্ড ক্রোধে তাড়িত হতে হতে
নিঃশব্দ হুঙ্কার ছাড়ে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে
ছিঁড়েখুঁড়ে খায় অসভ্য কারুকাজ প্রবল তৃষ্ণায়
ছাইভস্মে চাপা পড়ে আছে অচল মুদ্রা
ঝেড়ে-মুছে সাফ করলেই হয়ে যায়
তকতকে ঝকঝকে সচল মুদ্রার চেয়ে দামি
বিষঘুমে শায়িত অভিমানী যুবক
অচল মুদ্রার মতো বার্ধক্যের পলেস্তারা হৃদয়জুড়ে
ভেতরে শাণিত ঘৃণা দাউদাউ আগুন
ফোঁস করে জ্বলে উঠতে পারে যে কোনো সময়
অচল মুদ্রা জ্বলে পুড়ে হবে সচল- অমিত তেজে
-অচল মুদ্রা
অনিকেত শামীমের পঞ্চম কাব্য ‘অন্ধ বালকের প্রতি ঈর্ষা’। মানুষের চর্মচক্ষু যা দেখে অন্তর্দৃষ্টি দেখে তার অধিক। শামীমের যেন বোধোদয় ঘটে যায় হঠাৎ, তাই তিনি ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েন অন্ধ বালকের প্রতি। যে অনিকেত শামীম তার প্রথম কাব্য ‘শব্দ-নৈঃশব্দ্যের অনুরণন’-এ ত্রিকালদর্শী অন্ধের দিব্য আলোয় মানুষের অন্ধকার দূর করতে চেয়েছিলেন, সেই শামীম তার পঞ্চম কাব্য ‘অন্ধ বালকের প্রতি ঈর্ষা’য় খুঁজতে চেয়েছেন নতুনের চোখে রঙ। আমি একজন নিষ্ঠ পাঠক হিসেবে প্রার্থনা করি, কবি অনিকেত শামীমের অন্তর্দৃষ্টি খুলে যাক; কবিতাকর্মী হিসেবেও শামীম পূর্ণ হয়ে উঠুন। পঞ্চম কাব্য থেকে একটি কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি উচ্চারণের মাধ্যমে অনিকেত শামীমকে নিয়ে আমার এ অপরিসর আলোচনা শেষ করতে চাই।
‘চারদিকে দেখো কেমন অন্ধকার নেমে আসছে… এরকম অন্ধকারে সারি সারি কালোরঙের পাগলা ঘোড়া কালোপট্টি মাথায় ক্রসফায়ার খেলা খেলছে… আর ঘনঘোর অন্ধকারে যাবতীয় সুন্দর এসে লুটিয়ে পড়ছে এবং কী আশ্চর্য দেখো, অন্ধ বালকটির চোখেই কিনা এ খেলাটি সবার আগে নজরে এলো এবং প্রতিনিয়ত এ খেলা দেখতে দেখতে অন্ধ বালকটি একদিন বাজারে এলে বাজারের ঝোড়ো হাওয়ার গতিবেগে অন্ধ বালকটির চোখ ভালো হয়ে গেল- বাঃ কী ফকফকা!

অন্ধ বালকটিকে আমার খুব ঈর্ষা হয়’
-অন্ধ বালকের প্রতি ঈর্ষা ২

জাদুবাস্তবতা থেকে মানবিকতায় উত্তরণের কথা বলে আমি জাদুবাস্তবতাকে পশ্চাৎপদ বলতে চাইনি; আমি বলতে চেয়েছি অনিকেত শামীমের কাব্যযাত্রার কথা; অন্য কোনো কবি হয়তো মানবিকতার আবেগাশ্রিত আঙিনা থেকে নিজের কাব্যতরীকে যাদুবাস্তবতার উচ্চতায় নিয়ে সমাপ্তি টানতে পারেন। শামীমের কাব্য-পরম্পরা পাঠে আমার মনে হলো তিনি যেন জাদুবাস্তবতার আঙিনা থেকেই যাত্রা শুরু করে মানবিকতার বিশ্বশ্রুত প্রণয়-আঙিনায় তার তরী ভেড়াতে চলেছেন।
দক্ষ সংগঠক শামীম, সাহিত্যের ছোটোকাগজ নিয়ে সীমাহীন কর্মযজ্ঞ দিয়ে আমাদের ঋদ্ধ করেছেন; কেবল নিজের দশক ‘নব্বই’ নিয়েই নয়, বিভিন্ন দশকের কবিদের নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে চলেছেন তিনি। তাকে নিয়ে মুহুর্মুহু ধ্বনি প্রায়শ কানে আসে। শামীম সম্পাদিত ‘লোক’ নানান বিবেচনায় সমকালের উজ্জ্বল প্রকাশনা হিসেবে স্বীকৃত; কবি-সাহিত্যিক-শিল্পস্রষ্টাদের অধিকার এবং সামাজিক মর্যাদা নিয়ে অনিকেত শামীমের অদম্য আগ্রহ বারবার আমাদের আশান্বিত করে; অনেকেই বিশ্বাস করেন বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময়তায় শামীম ইতিহাসে অনিকেত থাকবেন না; পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে বাংলাদেশ অধ্যায়ে তার নাম সম্ভ্রমের সাথে উচ্চারিত হবে।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান