মায়াবন বিহারিণী - দীলতাজ রহমান
মায়াবন বিহারিণী - দীলতাজ রহমান

ইউনিভার্সিটির হলের একরুমে থাকা কাসেম কামালের মধ্যে নামের প্রথমে ওই একটি কএ আকারে কাএর মিল ছাড়া আর কোনো মিল ছিল না। কাসেমকে রুমমেট হিসাবে পেয়ে কামাল খুব একটা পছন্দ করেনি এটা বোঝে কাসেম। কারণ কাউকে কারো ভালো লাগা না লাগা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লুকিয়ে রাখা যায় না। কিন্তু কামাল যখন বোঝে তার ভালোলাগা মন্দলাগাকে বিন্দুমাত্র মূল্য কাসেম দিচ্ছে না। তখন থেকে কামাল নিজেকে কাসেমের কাছে পরাজিত ভাবতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে কাসেমের প্রতি তার নিজের আচরণ পাল্টাতে থাকে। তবু কামাল কাসেমকে আর তার নিজের প্রতি মনোযোগী করতে পারছিল না! কামালের প্রতি কাসেমের সেই অমনোযোগিতা কামালের মনে শুধু কাঁটা হয়ে ফোটা নয়, যন্ত্রণাও দিচ্ছিল। তারমানে কামালের ভেতরের কেউ কাসেমের চারিত্রিক দৃঢ়তাকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য করেছে। কামালের বাবা বড় চাকরি করেন। আপাতত বদলি হয়ে ঢাকার বাইরে আছেন। তাই সে সহজে হলে সিট জুটিয়ে নিয়েছে। ফরিদপুরের একটি গ্রামে বসবাস করা, সেখানকার স্কুল থেকে পাস করে সেই গ্রাম থেকেই প্রতিদিন ফরিদপুর কলেজে যাওয়া-আসা করেছে কাসেম। তাই রুমমেট কামালের বিরূপ আচরণের প্রতি কাসেম মনোভাব এমন দৃঢ় করে রেখেছে, ‘আমিও সরাসরি স্কুল থেকে এখানে আসিনি!’ তাদের বাখুণ্ডা গ্রামের পাশে আরেকটি গ্রামের একটি সরকারি হাইস্কুলে মাস্টারি করা তার বাবার হাত অত লম্বা ছিল না। থাকলেও বাবা আদেল উদ্দিন মাস্টার তা ব্যবহারও করতেন না, তা জানে কাসেম। তবে ভাগ্যক্রমে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিকেই সিটটি এমনি জুটেছিল। আর দুর্ভাগ্যক্রমে পেয়েছিল কামালের মতো এক রুমমেট।

কামালের স্ট্যাটাস যে তার থেকে হাই, সেটা বুঝেই সব বিষয়ে কামাল তাকে দমিয়ে রাখতে চায়, এটা বোঝে কাসেম। তবে নিজের পারিবারিক এর উত্তর তার জানা আছে। তার পারিবারিক আদর্শ ঐতিহ্য নিয়েও সে গর্বিত। আর যা কিছু গৌরবের-আনন্দের, তা নিয়ে আস্ফালন চলে না। তবে যে কারো আস্ফালনের জবাব সে বাকি রাখে না! শিক্ষা তার সময়ের সাথে সাথে পরিবার-পরিবেশ থেকে শিখে আসা।

একরুমে বসবাস করা দুটি মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ের একটা অংশ একটা নীরব দ্বন্দ্বের ভেতর কেটে যাচ্ছে নিয়ে কাসেমেরও একটা যন্ত্রণা ছিল। কামাল ছুটিতে তার প্রভাবশালী বাবার কর্মস্থল বা অন্য কোথাও যেতে সে অন্য রুমের সহপাঠীদের উৎসাহিত করত।অনেক সময় সে সব আলোচনা-যাওয়া নিয়ে পরিকল্পনা কাসেমের সামনেই হতো। তাদের রুমে আলোচনা হলে কেউ কেউ বলে বসত,‘কাসেম যাবে না?’ কাসেম মুখ খোলার আগে কামালই বলে দিত, ওর টিউশানি আছে...কাসেম তখন রুম থেকে বেরোতে শার্টের ভেতর শরীর গলাতে গলাতে বলত, সে তো আছেই। কিন্তু মনে মনে বলত, তোমার খরচ করার ধরণ দেখলেই তো বুঝা যায়, তোমার বাপের টাকার গাছ আছে। তাই তোমাকে ছাত্রাবস্থায় নিজের খরচ চালানোর কথা ভাবতে হয় না! বরং নিজের খরচে ধামাধরা স্বভাবের ছাত্রদের জুটিয়ে আনন্দ করতে পার। আনন্দভ্রমণে বেরোতে পার! দামি টিকেট কেটে নাটক-সিনেমা দেখতে পার! মেয়েদের মন পাওয়ার জন্য তাদের খাওয়ার বিলও তুমি উপযাচক হয়ে দিতে পার!

স্বভাবে বিপরীত ধাঁচের দুজন রুমমেটের এমন সম্পর্ক অবশ্য স্থায়ী হয়নি। একটা সময় থেকে সবকিছুতে কামাল কাসেমকে সহযোগী করতে চাইত। আর কাসেম সে সব প্রস্তাব খুব স্বাভাবিকভাবে প্রত্যাখ্যান করত। কিন্তু তার সাথে কথা বলতে বা অন্যসব বিষয়ে, যেমন কামালের প্রতি কাসেমের যদি কিছু করণীয় থাকত, সে সব সে বেশিই দিলখোলাভাবে করত।কামালের কাছে তাই হয়ে উঠত জোঁকের মুখে নুনের ছিঁটার মতো। কিন্তু কাসেমের কথাবার্তা- আচরণে বুঝার উপায় ছিল না, কামালের দিকে তাক করা তার সতর্ক এক ঢাল আছে। তার সবকটাক্ষ-অবহেলার তীর বুমেরাং হয়ে তার দিকেই তাফিরিয়ে দেয়।

একবার ইউনিভার্সিটি কদিন বন্ধ থাকায় কাসেম তার গ্রামে যাবে এটা জানতে পেরে কামালের কী মনে হলো, সে কাসেমকে বলল, আমার সেভাবে কখনো গ্রাম দেখা হয়নি। আমাকে নেবে তোমাদের গ্রামে? পদ্মাসেতু হওয়ার পর মূলত সেতু দেখা পার হওয়া উপলক্ষে আমরা সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর মাজার দেখতে ওদিকটায় গিয়েছিলাম। দুদিন রেস্ট হাউজে ছিলাম। গোপালগঞ্জেরডিসির পক্ষ থেকে তাঁর লোকেরা আমাদের জন্য যা করার করেছেন। কিন্তু কোনো গ্রামে তারা নেননি...!

 

কাসেমের মনে হলো, কামালের কন্ঠে আকুলতা ঝরছে। সে তাই সুযোগ বুঝে উত্তর দিল তুমি যেমন গ্রাম দেখোনি, আমিও এই শহরে ঢুকে এখনো এমন ড্রয়িংরুম দেখিনি যা কোনো মিউজিয়ামের সাথে তুলনা করা যায়। অথচ এই শহরে অগণিত বাড়ির ড্রয়িংরুমই না কি তেমন। যা দেখে বিদেশি রাষ্ট্রদূতেরাও ভড়কে যান, যেমন আমাদের এই দরিদ্র দেশেররাস্তার দামি গাড়িগুলোও তাদেরকে অবাক করে! আমাদের স্ট্যাটাসটা আসলে এতটুকুই, ওসব না দেখার... সত্যিকথা বলতে কি, তোমাকে নিয়ে রাখবার জায়গা আমাদের নেই। গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার আমাদের...

: আমি জানি...

: আমাদের দারিদ্র বলব না, আমাদের সীমবদ্ধতা অন্য কারো জন্য অসহনীয় হোক, তা আমরা কেউ চাই না! মানে আমাদের পরিবারের কেউ চায় না।

: কে কে আছেন তোমাদের পরিবারে?

: একহাঁড়িতে রান্না না হলেও আমাদের তিনজন চাচার পরিবারসহই আমরা এক পরিবার বলি। কারণ আমার দাদি বেঁচে আছেন। দুজন ফুপুর বিয়ে হয়ে তারা তাদের স্বামীর সাথে বিদেশে বসত গেড়েছেন...

কাসেমের কথা ফুরানোর আগেই কামাল বলে ওঠে, তাহলে আমাকে তোমার সাথে জোর করে হলেও যেতেই হবে! বন্ধুর বাড়ি বন্ধু জোর করেও যেতে পারে, কী বলো!

: সেটা বন্ধুর বাড়ি বন্ধু যেতে পারে, অবন্ধুর বাড়ি অবন্ধু পারে না!

: তোমার সাথে যাচ্ছি আমি। অতএব তোমার অবন্ধু থেকে তুলে নাও!

 একরুমে থেকেও একটি নীরব দূরত্ব বজায় রেখে যে অনুশোচনায় ভুগছিল, কামাল আসলে সেই দূরত্বটা ঘোচাতেই কাসেমের এতটুকু নৈকট্য বাসনা করেছিল। একই গন্তব্যে পৌঁছুতে দুজন একসাথে হল থেকে বেরিয়ে সত্যিই একেবারে ভিন্নরকম আনন্দ হচ্ছিল কামালের। একেবারে নির্ভার লাগছিল এতদিন পাশাপাশি থাকা রুমমেটের ওপর নিজের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে। তা ছাড়া দেরিতে হলেও সে বুঝে গেছে কাসেমের মতো বন্ধুর ওপর নির্ভর করা যায়! চলন্ত বাসে মাঝপথে একবার কামাল কাসেমকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি যে যাচ্ছি, তোমাদের বাড়িতে জানিয়েছ?

: না!

: কেন?

: যদি মাঝপথে নেমে যাও! তা নাহলে তুমি গেলেই তো ওরা দেখতে পাবে!

কামাল মনে মনে দমে যায়। ভাবে, ওর যাওয়াটা তাহলে ওদের জন্য কিছুই না! শহর থেকে একজন যুগ্ম সচিবের ছেলে যাবে, একজন সাধারণ স্কুল শিক্ষকের বাড়ি, আর বাড়ির মানুষকে তা জানানো হবে না! কামালের এমন অনেক বন্ধু আছে, যাদের বাড়ি সে গেলে, তাকে সবার থেকে আলাদাভাবে আদর আপ্যায়ণে ভরিয়ে তোলে। তার বাবার কাছে বলার জন্য কতজনের কত সুপারিশ তার কানে গুঁজে দেয়। অথচ সে নিজে উপযাচক হয়ে রুমমেটের বাড়ি যাচ্ছে, তবু কাসেম তার বাড়িতে জানানোর দরকার মনে করল না! নাকি জানিয়েছে, কিন্তু বরাবরের মতো ওর অদৃশ্য ঢালখানা ওর দিকে এভাবে তাক করে রেখেছে, বুঝতে পারছে না। কামাল দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল, কাসেমের সাথে এভাবে আসাটা ঠিক হল কিনা! সে তো রুমমেটের প্রতি এমন কিছু অপরাধ করেনি যে উঠেপড়ে তার মন জোগাতে হবে!

বাস থেকে নেমে একখানা অটোরিকশা নিল কাসেম। বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছুতে গ্রামের রাস্তায় ঢুকে মুগ্ধ হয়ে গেল কামাল। এখন গ্রাম আর গ্রামের মতো না থাকলেও সে তো এই প্রথম দেখছে! কাসেমদের একারই বিরাট চৌহদ্দির একটি বাড়ি। চারপাশে একই রকম চারখানা মাঝারি আয়তনের বাংলো টাইপ ঘর। আর মাঝখানে যে একখণ্ড খালি জায়গা, কামাল বুঝল, এটাকেই উঠোন বলে। ইতিউতি দুতিনটি উঁচু খড়ের পালা, তারা বাড়ির বাইরের মানুষের নজর থেকে উঠোনের আব্রু রক্ষার কাজ যেমন করছে, তেমনি গাম্ভীর্য মণ্ডিত সৌন্দর্যও ঠিকরোচ্ছে। আরো কয়েক পা যেতে বাড়ির শেষ কোনায়কয়েকটি দুধের গরুসহ গোয়ালও চোখে পড়ল! উঠতি বয়সী সুঠাম রাখালের সফেদ দন্তের সুবিস্তৃত হাসিই তাকে বুঝিয়ে দিল, কোথায় এদের সমৃদ্ধির উৎস!

মজবুত কাঠের গেটখানা খোলার পরপরই তার প্রতি তাকানো বাড়ির মানুষের চোখের তারা দেখে কামাল বুঝেছিল, কাসেম সত্যিই বাড়িতে জানায়নি, তার সাথে অন্য কেউ আসবে। আর তখনি সে কুণ্ঠিত হয়, পাশাপাশি থাকা একজন মানুষের মনে সে নিজের সম্পর্কে এই ধারণা তৈরি করেছে, সে মাঝপথে নেমেও যেতে পারত! অবশ্য এর জন্য সে কাউকে দায়ী করার কথা ভাবতে পারল না। বরং নিজেকে টেনেটুনে সবার বিশ্বস্ততার জায়গায় পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নিল।

বাড়ির অন্য তিনখানা ঘর কাসেমের তিন চাচার। বাড়িতে ঢুকে কাসেমকে কামালের মনে হলো হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। অটোরিকশা থেকে নামার পর থেকে যে তাকে দেখছে, কিশোর-তরুণ, সবাই পিছু নিয়েছে। পাশ দিয়ে যেতে আসতে বয়স্করা সমীহ করে কুশল জানতে চাইছেন। বাড়ির সব ঘর থেকেও ছেলেমেয়েরা নেমে এল। সবাই একসাথে সামান্য পায়চারির পর কাসেম কামালকে নিজেদের ঘর দেখিয়ে দিল। কাসেমের আগেই ইটের তৈরি কয়েক ধাপ সিঁড়ি টপকে কামাল বারান্দায় পা রেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ওই যে দেখা যায়, ওই তবে তোমাদের কুমার নদ?

 

কাসেম বলল, হ্যাঁ ওই আমাদের কুমার নদ! ওটাকে দেখার মতো দেখতে হলে তোমাকে বর্ষাকালে আসতে হবে!

: বর্ষায় আমি আবার আসব। কিন্তু আজই বিকেলে আমরা ওটার কূল ধরে হাঁটব। অনেক শুনেছি এই নদের কথা!

: শুনেছ বলে মনে আছে। দেখলে ভুলে যেতে!

: কেন, বলো তো? দেখলে ভুলে যেতাম কেন?

: আচ্ছা কুমার নদ পদ্মা নদীর একটি শাখা। সেই পদ্মা পার হয়ে এসে তার এতটুকু এক নদকে তোমার কেন মনে থাকবে? বর্ষা চলে গেলেই যে হেজেমজে যায়! আমাদের সাথে না হয় এর নাড়ির সংযোগ, তাই আমরা ভুলতে চাইলে নদ আমাদের করোটি ছেয়ে থাকে। কারণ আমাদের পূর্বপুরুষের জীবনকে ওটা প্রবাহমান রেখেছিল। আর আমরা তো সেই পূর্বপুরুষেরই অংশ, তাদের জিন বহন করছি! চলো, আগে খাও। বিশ্রাম নাও। বাড়ির সবার সাথে পরিচিত হও। তারপর তো নদ দেখতে যাবে!

: হ্যাঁ, চলো। আচ্ছা, পদ্মাসেতু হওয়ার আগে তোমাদের ঘন্টা সময় লাগত, মানে তোমাদের এই বাখুণ্ডা গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছুতে?

: কখন গাড়ি ফেরিতে উঠতে পারবে তার ওপর নির্ভর করত। পাঁচ/ছঘন্টা তো লেগেই যেত!

শেষের কয়েকটি মুহূর্তে কামালের মন ভালো হয়ে উঠছিল কাসেম ঘনিষ্ঠ সুরে কথা বলায়। ঢুকতেই প্রথম রুমে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামাতে বলে কাসেম কামালকে নিয়ে ভেতরে যে রুমে ঢুকল, দেখল সেখানে একজন বয়স্ক নারী বসে আছেন। কাসেম তার পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল, দাদিমা, আপনার রেডিওতে ব্যাটারি আছে তো? এই দেখেন এবার এক ডজন নিয়ে এসেছি, যেন সহজে না ফুরায়!

 

কাসেমের দেখাদেখি কামালও বৃদ্ধাকে সালাম করল এবং আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইল, এই বিদ্যুতের যুগে ব্যাটারি দিয়ে কী হবে?

কাসেম বলল, শুনতে পাচ্ছ না, রেডিও বাজছে? শুধু নামাজের সময়টুকু বাদে সবসময় দাদিমা রেডিও শোনেন। শুধু বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করলে ঘরে বসে থাকতে হবে তাঁকে। আর আমাদের খোদ রাজধানী শহরে বিদ্যুৎব্যবস্থার কথা জানা থাকলেও গ্রামের ব্যবস্থা তো তুমি জানো না!

দাদিমার বয়স হলেও ভারে নূব্জ হননি। বুঝা যায় মেরুদণ্ড টান রাখার ইচ্ছেশক্তি তিনি উদগ্র করে রাখেন। আর সেটাই তার জন্য টনিকের মতো কাজ দেয় শুধু তাই নয়, তার বিকিরণ যেন বংশধরের ভেতর ছড়িয়ে দিচ্ছেন। বৃদ্ধার রুমে তখন নানান বয়সী চারজন নারী কিশোরী ছিল। বৃদ্ধা আগে কামালের পরিচয় জানতে চেয়ে তারপর কাসেমকে বললেন এদের সাথে অতিথির পরিচয় করিয়ে দাও!

: , অবশ্যই! বলে কাসেম কামালের দিকে চেয়ে বলল, এই আমার ছোট চাচি। এই দুজন আমার মেজ চাচার মেয়ে। এটা মিলি, ওটা লিলি। ওরা দুজন এক বছরের ছোট-বড় তাই ওরা একজন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার, আরেকজন সেকেন্ড ইয়ারে। দুজনেই আমাদের এখানকার কলেজে পড়ে। আর এটা আমার পিঠোপিঠি বোন বিদিশা। এবারই খুলনা ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্সে ভর্তি হয়েছে! কাসেম তারপর কামালের দিকে তাকিয়ে বলল, আর ওর পরিচয় তো তোমরা আগেই জেনেছ, দাদিমাকে বললাম। আবারও বলি, আমার রুমমেট। বন্ধু। নাম কামাল।

প্রতিটি রুমের সাথে এটাচ বাথরুম থাকলেও কাসেম কামালকে নিয়ে তাদের পুকুরে শান বাঁধানো ঘাটে হাতমুখ ধুতে গেল। কিন্তু কামালের উচ্ছ্বাসে একেবারে দুজনই গোসল করে ফিরে এল। খাবার টেবিলে যে কটা পদ পেল, সে কাসেমের মাকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিল। তার সবচেয়ে ভালো লাগল, কাসেমের বাবা নিজে তার মা নূরবানুকে হাত ধরে এনে নিজের পাশের চেয়ারটিতে বসালেন। খেতে খেতে যে গল্প হলো, দেখা গেল বৃদ্ধা না থামলে কেউ কথা বলেন না। এটুকু সময়ের ভেতর কাসেমের মায়ের সাথে কাসেমের দাদিমার সম্পর্কের রসায়ণ অনেক কথা মনে করিয়ে দিল কামালকে। আর তারা খেতে বসার আগেই নূরবানুর অন্য তিন ছেলের ঘর থেকে তিন বউ নিজেরা বাটি ভরে তরকারি নিয়ে আসছেন। তিনজনই কাসেমের মায়ের উদ্দেশ্যে রকমফেরে একই কথা বললেন, বড় আপা, আজ শুধু আম্মার জন্য নয়, একটু বেশি করে এনেছি। কাসেম এসেছে ওর বন্ধুসহ তাই।

 

কাসেমের তিন চাচির কথা শুনে কামাল বুঝল, এরা প্রতিদিনই শাশুড়ির জন্য তরকারি দিয়ে যায়। নূরবানু থাকেন কাসেমদের ঘরের একরুমে। আর সেটা দায়সারা থাকা নয়। একেবারে খানদানি হালে থাকেন। তার থাকার ধরণটাই তার প্রতি কামালের মতো যে কাউকে সমীহ এনে দেয়। তাই তার মনে হল, তাহলে থাকাটাও একটা বিষয়। বাড়ির লাইব্রেরিটিওনূরবানুর ঘরে। কে কোন বই নিল, ফেরত দিল, সব হিসাব তার কাছে। বাড়ির শিশুশ্রেণিকে নাকি তিনি নিজের ঘরে আটকে বই পড়তে দেন এবং তারা কে কি বুঝল, সে মতামতও আদায় করে রাখেন।কামালকে বৃদ্ধা প্রথমেই চমকিত করেছিল, নিজের নাম বলে। কাসেম যখন বলেছিল, দাদিমা, আমার বন্ধু কামাল। বৃদ্ধা তখনি বলেছিলেন, ‘আমি নূরবানু!’ এই বয়সেও নিজের নামের প্রতি তার অনুরাগ বা শ্রদ্ধা দেখে কামাল চমকালেও মনে মনে ভাবতে লাগল, এই আমিত্বের তেজই কাসেমের ভেতর স্থায়ীভাবে সঞ্চারিত! যার আঘাতে ভেতরে ভেতরে ভেঙে নিজেই সে এই পর্যন্ত একরকম গড়িয়েই এসেছে তার সাথে, অনুশোচনার আগুন নিভাতে। অবশ্য এসে তার ভালোই লাগছে! না এলে একটি কঠিন শিক্ষা থেকে সে বঞ্চিত হতো। যে শিক্ষা পৃথিবীর কোনো প্রতিষ্ঠান দিতে পারে না, পরিবার ছাড়া!

কাসেমের বাবা খেতে খেতেই তার সম্পর্কে জানলেন। বাবা যুগ্মসচিব। মা একটি সরকারি কলেজের প্রফেসার। বাবার বদলির সুবাদে তিনিও সেখানে বদলি নিয়েছেন। তবে রিসেন্টলি বাবার প্রমোশন হয়েছে বলে এখন ঢাকায় চলে আসতে হবে। সে জন্য মাও ঢাকার কোনো একটি কলেজে আসবেন, কথা চলছে। আর বড়বোন বিয়ে হয়ে দুবাই থাকে। ভগ্নিপতি সেখানে ফার্স্ট সচিব। ছোটবোন ডাক্তারি পড়ে।

কামালের থেকে কাসেমের বাবা আদেল মাস্টার এসবই জিজ্ঞেস করে করে জানলেন। কিন্তু আদেল উদ্দিন মাস্টারের মুখাবয়বে কোনো ভাবান্তর দেখল না কামাল! বরং মায়ের ক্ষমতার অপব্যবহারটুকু যেন তাকে ব্যথিত করেছে।

খাওয়া শেষ করে কামাল বিশ্রাম নিতে রাজি নয়। সে নদ দেখতে যাবে। কিন্তু কাসেমের মা মৃদুস্বরে কাসেমকে বললেন, দুজনে একা যাবে কি? তোমার অন্য ভাইবোনদের ডাকো! তারা তোমার নৈকট্যের আশা করে। আর তাদের সাথে সম্মিলনটা ওরকম সব জায়গায় হলে তা তোমার প্রতি ওদেরকে আরো শ্রদ্ধাশীল করে রাখবে। তোমাকে নিয়ে ওরা বলার প্রসঙ্গ পাবে। না হলে ওরা তোমার কথা কেন বলবে বলো তো! যে কারো ঘটনা মানুষের নিজের সাথে যেটুকু জড়িত, সেটুকুই সে স্বাভাবিকভাবে মনে রাখে। আর আজ তো তোমার বন্ধু আছে সাথে। একটা অটো রিকশা ডেকে তোমার দাদিমাকে নিয়ে যাও, উনি খুব খুশি হবেন! তোমারওএকটা জমজমাট স্মৃতি তৈরি হবে। এমন অবসর আর কবে কার কখন হবে! তারপর কাল থেকে তোমরা দুবন্ধু ঘুরো!

 

কাসেমের মায়ের কথায় এবার হতাশ হলো কামাল। সে দেখল তার আনন্দের কথা কেউ ভাবছেন না! নাকি এদের আনন্দের ধরণ এরকমই! কিন্তু তারহতাশ মুখের দিকে তাকিয়ে কে- বা দেখছে, সে কি ভাবছে! সে নতুন অতিথি, তাকে কেন্দ্র করে নয়, বরং এরা নিজেদের আনন্দে তাকে পাশে রাখছে!

চেনা এক অটোরিকশার ড্রাইভারকে ফোনে ডাকা হলো। কাসেম কিছু না বলেই তার দাদিমার পাশে উঠে বসল। আর নিজের পাশে বসতে বলল কামালকে। ড্রাইভারের দুপাশে আরো দুই কিশোর উঠল। বেশ কজন কিশোরী যে যার মতো ছুটতে ছুটতে সামনে এগোলো। যেতে যেতে তারা কাসেমের উদ্দেশ্যে বলে গেল তোমাদের আগে আমরাই পৌঁছে যাব, দেখো দাদাভাই।

নূরবানুকে হাত ধরে নামাতে হলো না। তিনি অটো থেকে ধীরে ধীরে নিজেই নামলেন। কামালের মনে হলো, বাড়িতে তাকে যেমন দেখেছে, বাইরে তিনি আরো ঋজু! আর তার এই ঋজুতা, মানে আত্মবিশ্বাসের গোড়ায় মাটি হয়ে আছে তার প্রতি পরিবারের সবার সম্মান। ভালোবাসা।বয়সের কারণে তাকে গৌণ না করে এখনো তাকে প্রধান করে রাখা।

কামাল ভেবেছিল নূরবানুকে কিশোরী মহলে কূলে রেখে সে কাসেমকে নিয়ে কুমার নদের কূল ধরে বহু বহুদূর হেঁটে আসবে। সুযোগ পেলে কোনো পণ্যবাহী নৌকা ডেকে তাতে উঠে পড়বে এবং বহুদূরে গিয়ে নামবে। অথবা নামবে না। নিরুদ্দেশে ভেসে যাবে।

কামালের হঠাৎ মনে পড়ে, এই কুমার নদীর কূলেই তো সোজন বাদিয়ার ঘাট! কামাল কাসেমকে বাদ দিয়ে এবার মনে মনে পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের বাড়ি খুঁজতে শুরু করে। ভাবে, কতদূরে সে বাড়ি! কালই যাওয়া যায় কি না। পড়ন্ত বিকেলে চোখের সামনে দিয়ে নৌকা ভাসতে দেখে, সেও ভাসতে ভাসতে দেখতে চায়, যারা পরিবার-পরিজন সবাইকে ফেলে একজায়গার জিনিসপত্র কমদামে কিনে বেশি লাভে অন্যখানে বিক্রি করতে দিনের পর দিন নৌকায় কাটায়, খাল- বিল পেরিয়ে এরকম সরু নদীতে উঠে বড় নদী তারপর সাগর পাড়ি দেয়। সাগরে দুপাশ থেকে বড় বড় ঢেউ এসে নৌকা ঢেকে দেয়, ঝড়ের কবলে পড়েও তবু মাঝি নির্ভীক হাল ধরে থাকে। আবার তারা নিজেরা রেঁধেবেড়েও খায়, সেই তারা বাস্তবে কেমন হয়, তাদের মুখেই তাদের গল্প শোনার ইচ্ছে জেগেছিল কামালের! মূলত সে আর কাসেম তারা দুজনই তো সোসিওলজির ছাত্র।

 ড্রাইভারের দুইপাশে বসা দুই কিশোর রাহুল তমাল অটোরিকশা কুমার নদের কূলে ভেড়ামাত্র কোথায় ছুটে চলে গেছে। আসতে আসতে তাদের কথায় বোঝা যাচ্ছিল, তারা জেলের নৌকা থেকে মাছ কেনার পরিকল্পনায় এসেছে।

 

কামালের নিজস্ব ভাবনাগুলো মগজজুড়ে বিদ্যুতের মতো চমকাচ্ছে কাসেমকে বলার জন্য। এরি ভেতর নূরবানু বললেন, মেয়েগুলোকে তো একা ছাড়া হয় না। বড় দেখে একটা নৌকা ডাকো। আমরা সবাই নৌকা চড়ি। আগে তো সবখানে নৌকায়ই যেতাম! সেইসব স্মৃতি আজো মনে শিহরন তোলে। তোমার দাদা আর আমি কোথাও যাওয়া ছাড়াও এমনি নৌকা চড়তাম। আগে আমাদের বাড়ির ঘাটে নিজেদের নাও বাঁধা থাকত। আহা, মনে হচ্ছে সেদিনের কথা। কিন্তু সময়টা কমও হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে দ্রুত শহর বড় হতে থাকে। তোমাদের বাবা-চাচাদের শৈশব-কৈশরেই মাঠ- ঘাট ভরাট হয়েসব জায়গায় বাড়ি তৈরি হয়েছে। রাস্তা তৈরি হয়েছে। আমার বউকালে জোছনা রাতের অনেকটা কেটে যেত নৌকায়। বাড়িতে যে বাধা মজুর থাকত, তারাই বাইত।

কাসেম বলে উঠল, দাদিমা, পরিবর্তনটা দ্রুত হয়েছে বলেই এর অনেক কিছুই অপরিকল্পিত। আরো লেক, আরো খেলার মাঠ, পার্ক থাকার দরকার ছিল শহরজুড়ে। তখন হয়ত সেই লেক বেয়ে আমরা নদে এসে উঠতাম। সেরকম পরিবেশে শিশুরা বেড়ে উঠলে তাদের মানসিকতাও সুস্থ হয়!

 

নূরবানুর বাক্যের প্রতিটি শব্দ কামালের মাথায় বজ্রপাতের মতো ঠেকছে। আবার শেষের কথাগুলোতে সে সেই সময় চলে গেল, যখন নূরবানুদের ঘাটে নৌকা বাঁধা থাকত এবং নূরবানুর সেই বয়সটাতেও সে পৌঁছে গেল কিছুক্ষণের জন্য। উগ্র দাপট নয়, একটা নম্র তেজ ধারণ করে আছেন বৃদ্ধা। কথাও বলেন ধীরে ধীরে এবং কোনো কথাই খাপছাড়া বা জোড়াতালি দেওয়া নয়! তবু কামাল কিছুটা উসখুস নিয়ে নৌকায় বসেই মাথা উঁচু করে কামালদের বাড়িটা খুঁজছিল। কারণ দুপুরে বাড়িতে পৌঁছে বারান্দায় দাঁড়িয়েই সে এই কুমার নদ দেখতে পেয়েছিল। তাই নূরবানুর চারিত স্মৃতি ধরে মাথাটা জাগিয়েছিল। কিন্তু সরু নদীর পাড়টা পাহাড়ের মতো আড়াল করেরাখল তার দৃষ্টি। তবু ভালো লাগল জেনে, একসময় এরকম নৌকা ওই বাড়ির দরজায় ভেড়ানো যেত।তখন বর্ষাকালে বাড়িগুলোকে নাকি সোলার মতো ভাসমান মনে হতো!

নৌকায় উঠে সাথে আসা মেয়েগুলোর নাম জানা হলো। তমালিকা, বাঁধন, সুরভি পান্না। এরাও কাসেমের চাচাতো বোন। বড়দের কথা শোনার চেয়ে নিজেরা নিজেরা বেজায় খুনসুটি করছিল মেয়েগুলো। অথচ বাড়িতে থাকতে এদের কাউকে সে দেখেনি। বেলা কখন ডুবে গেছে। এখন আর কেউ কারো মুখ দেখতে পাচ্ছে না। এর ভেতর নূরবানু জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশে নদ মোট চারটি। কপোতাক্ষ, আড়িঁয়াল খাঁ, ব্রহ্মপুত্র, কুমার। যখন কোনো নদী থেকে কোনো শাখা তৈরি হয় না, তখন তাকে নদ বলা হয়। নদগুলো শুকনো মরশুমে এমনি হাজামজা হয়ে যায়। অথচ, বর্ষা এলে নদীর সাথে একাকার হয়ে যেন তাদের যৌবন ফিরে পায়।

 বাঁধন নামের মেয়েটি মুখ ফিরিয়ে বলল, দাদিমা, সমাজে পুরুষের ক্ষমতা বেশি। তাই যার ক্ষমতা বেশি তাকে আমরা পুরুষ ভাবি। কিন্তু নদী থেকে যা উৎপন্ন, আবার নদীর সংযোগ হারালে যা এমনি মরে থাকে,  সেই নদী নির্ভর শাখাগুলোকে কেন নদ বলা হয়? এটা কুমার নদ না হয়ে কুমারী নদী কেন হলো না?

নূরবানু বললেন, এই বিতর্কের শেষ নেই।নদীর সাথে নারীর যদি মিল থাকে, তাহলে নারীকেই বুঝতে হবে, তার ক্ষমতা কতখানি। আর ক্ষমতা বলতে শুধু পেশিশক্তিকে বুঝায় না! তাহলে আমাদের বাড়ির সবচেয়ে  ক্ষমতাবান আমাদের গরু চরানো রাখাল, কুদ্দুস!

কাসেম বলল, দাদিমা নদের কোনো শাখা নেই এটা ঠিক নয়। বলা হয় যে নদীর শাখা নেই, তাকে নদ বলে। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের প্রধান শাখা যমুনা। আসলে নামগুলো পুরুষের নামের মতো শোনায়, তাই নাকি নদ বলে!

নূরবানু বললেন, আমিও আর কতটুকু জানি বলো! অধ্যয়ন ছাড়া বয়স হলেই যদি সব জানা যায়, তাহলে তরুণ ডাক্তারের কাছে বৃদ্ধ রোগী আসবে কেন? তোমরা বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য নিয়ে পড়ে বিস্তারিত জানবে, অন্যদের জানাবে।

অটোড্রাইভার বলেছিল, তাকে ফোন করলে সে এসে নিয়ে যাবে। তাই যার যেভাবে যাওয়া হয়েছিল, সেভাবেই বাড়ি ফেরা হলো। তারপর ওরা উঠোনে থাকতে থাকতে কামাল ঘরে ঢুকল। ঘর থেকে শোনা যাচ্ছিল ওদের কলরব। যারা যেতে পারেনি বা যায়নি, তাদের একের পর এক প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছিল যারা গিয়েছিল, তারা। এতক্ষণ তারা কী করল। কী আড্ডা হলো। পাড়ে ফুচকা-চটপটি-বাদাম এসবের কিছু খাওয়া হলো কি না! কামালের কাছে খারাপ লাগছিল না ওখানে ওদের কোলাহলের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকতে। যেন এক অন্য জীবন মনে হচ্ছিল তার কাছে। কিন্তু মাঝে মাঝে সে এরকম মেয়ে মহল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে। অবশ্য মনে মনে বিদ্রুপ কাটছিল, এই একটুতে ওদের কত আনন্দ!

 

নূরবানু উঠোন পর্যন্ত আসতে না আসতে কাশেমের আম্মা এগিয়ে গেলেন তাকে ধরে আনতে। আসতে আসতে বললেন, আম্মা ভাত বসানোর সময় হয়েছে, কতগুলো চাল দেবো?

নূরবানু একটু ভেবে বললেন, দেড়সের দিতে বলো!’ কাসেমের আম্মা শাশুড়িকে তার নিজের রুমে পৌঁছে দিয়ে রান্নার মহিলাকে বললেন, দুইসের চালের ভাত বসাও হাসনা! তরকারি লাগলে তাও দেখে নিজের মতো কিছু একটা করো!’ কামাল এতক্ষণ কিছুতে মুখ খোলার স্কোপ পায়নি। এবার কিছুটা মেয়েলি কৌতূহল নিয়ে কাশেমের আম্মাকে বলল, কাকিমা, এই বয়সে এসে আপনি দাদিমার কাছে জানতে চাইলেন, ভাত রাঁধতে চাল কতগুলো দেবেন? আবার তিনি যা বললেন, আপনি তো তারচেয়ে বেশি রান্না করতে বললেন! আমি খুব মজা পেয়েছি কাকিমা...

 

: দেখো ছেলের কাণ্ড! তুমি আমাদের কথার গেরো ধরে বসে আছো? আসলে বয়স্ক মানুষকে গুরুত্ব না দিলে বেঁচে থাকাটা তার কাছে অর্থহীন মনে হয়। কিছুই না, দিনে দুইবার এটুকু প্রশ্ন করলে তার সাথে আমার একটা সংযোগ তৈরি হয়। তিনিও সম্মানীত বোধ করেন। আমি বাড়ির বড় বউ। আমার ওপর নির্ভর করছে, আর তিন বউ কী করবে! যিনি বয়স্ক, সংসারে তার প্রয়োজন আছে, এই বোধটাকে আমাদের তার ভেতর বাঁচিয়ে রাখতে হবে! বড়দের এমন আচরণ দেখলে পরবর্তী প্রজন্মের পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরিবারের ভেতর যারা যথার্থ গুরুত্ব পায়, তারা অন্যের অবহেলা গায়ে মাখে না! বাড়ির বয়স্কজনকে আমরা গুরুত্ব না দিলে আমরাও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে গুরুত্ব পাবো না। আমার শাশুড়ি এখনো নিজের বিষয়ে খুব সচেতন। আশি ছুঁই ছুঁই তার বয়স। অথচ, নিয়মিত রেডিও শোনেন। খবরের কাগজ পড়েন। বলেন, মস্তিষ্ক সচল রাখতে তাকে তথ্য জোগান দিতে হবে। দেখলে তো, তিনিই নাকি তোমাদের নৌকায় চড়িয়ে এনেছেন!’

 

কামাল বলল, হ্যাঁ! আমি যে সাঁতার জানি না তা ভুলে গিয়েছিলাম!

: তাতে কি? তোমাকে তো সাঁতরে নৌকায় উঠতে হয়নি!

: তা নয়। আমার মা-বাবার নিষেধ আছে। যেহেতু সাঁতার জানি না, তাই যেন কোথাও পানিতে না নামি এবং নৌকায়ও না চড়ি।

: তোমরা নাকি একসপ্তাহ থাকবে? এই দিনে সাঁতারটা শিখে ফেলো। মা-বাবাকে সারপ্রাইজ দেবে খবরটা দিয়ে!

: তাহলে তো ভালোই হবে! দিনে পারব কাকিমা?

: আমি ব্যবস্থা করব!

: সেই তো ঢাকা গিয়ে আবার ভুলে যাব।

: সাঁতার আর বকা কেউ ভোলে না। খারাপ কথা উচ্চারণ করা মানুষেরা রাগলেই মুখ ফসকে সেসব বেরিয়ে যায়। সাঁতারও তেমন এক কৌশল। বিপদে পড়লে নিজেই হাত-পা সক্রিয় করে তোলে!

কাসেমের সাথে দূরত্বটা এখন আর টের না পেলেও রাতে তাকে একা একরুমে থাকতে দেওয়ায় মনে হচ্ছিল, আবারও বুঝি সে নিজেকে টেনে সরিয়ে নিল। তবে একটি বিষয় তার জন্য ভালো হয়েছে। এই অন্য একটি পরিবারে ঢুকে একবেলা আর আধারাত তাদের জীবন যাপনের ধরণ দেখা-শোনায় এই প্রথম তার দাদির জন্য তার কান্না পেয়েছে। দাদির প্রতি তার মায়ের  যে নীরব অবহেলা, তা তার দাদি কেন, কামালের নিজেরও নজর এড়ায় না। কারো নীরব অবহেলার অভিযোগ কারো কাছে উত্থাপণ করা যায় না, কেবল দূরে সরে গা বাঁচানো যায়। তাই তার মনে হয় ভদ্রতার খোলস ছাড়া মানুষই একপ্রকার ভালো থাকে। যাদের প্রতি ইট মারা হলে তারা পাটকেল ছুঁড়তে পারে। অথচ তার মা মানুষ গড়ার কারিগর! মাঝে মাঝে কামালের মনে হয়, ছাত্রছাত্রীদের কী শিক্ষা দিচ্ছেন মায়ের মতো শিক্ষকেরা! এতদিন সে ভেবেছিল সব মায়েদের সাথে সব দাদিদের বুঝি এমনই সম্পর্ক! কিন্তু তার এত বছরের জীবনে এই প্রথম তার ভুল ভাঙল। সবাই তো সব অভ্যাস নিয়ে জন্মে না। শেখার জন্যও অনেকে কোনো আদর্শ খুঁজে পায় না। তাই তো বাড়িতে কেউ এলে তার দাদিকে নিজের থেকে সরে যেতে হয়। কামাল তার বাবাকেও দেখেনি দাদিকে ডেকে কারো সাথে পরিচয় করিয়েছে! অথচ তার দাদি যাদেরকে জন্ম দিয়েছেন, কাসেমের বাবা-চাচাদের সবার থেকে তাদের কেরিয়ার আরো উজ্জ্বল! শুধু মানুষ হিসাবে গঠিত হবার কৌশলটা নিশ্চয় ঠিক ছিল না।

শুধু কামালের মা নন, তার দাদির আরো যে ছেলেরা আছে, কেউই উপযুক্ত সম্মান করে না তাকে, কেউ কেউ যা একটু করেন, তা সহানুভূতিমাত্র, শ্রদ্ধা কিছুতেই নয়! নূরবানু যেভাবে অনর্গল কথা বলতে পারেন, তার দাদি একটি প্রসঙ্গ কখনো শেষ করতে পারেন না, বাবা-চাচারা বলেন, বুঝেছি! বুঝেছি, বাদ দেন।এই অশিক্ষাটাকে দূর করার শিক্ষা নিশ্চয় কামালের দাদি নিজেই পাননি! তার দাদি অকাল বিধবা না হলেও, ছাপোষা সংসারে সংগ্রাম তো তাকে করতে হয়েছে এবং প্রতিটি সন্তানের জন্য প্রতিটি মায়ের যে অবদান, সেই হিসাবেও তার দানে তাকে বন্দনা করা যায়। নূরবানুর অনর্গল কথার পিঠে সে নিজের দাদিকে নিয়ে বলার মতো একটি কথাও খুঁজে পায়নি। খুঁজতে গিয়ে কেবলি দাদির কুণ্ঠিত মুখখানা বারবার মনে পড়েছে! আর সেই কুণ্ঠার সাথে যেন পেঁচিয়ে গেছে সে নিজে।

অভিজাত এলাকায় নিজস্ব বাড়ি। আর সেবাড়িভরা দামি ফার্নিচার, তৈজসপত্র, দামি সব জিনিসপত্রে সাজানো ড্রয়িংরুম। দামি গাড়ি, এতদিন এগুলোকেই সে জেনে এসেছে আভিজাত্যের মূল উপাদান। কিন্তু তার এই একটি যাত্রা কেমন করে সব মূল্যবোধ ওলট-পালট করে দিচ্ছে! তার বাবার নামে বিস্তর কলঙ্ক আছে। সেটা কেবল নারী ঘটিত হলে মায়ের বাকবিতণ্ডা থেকে সে জানতে পারে। কিন্তু ঘুষ বা অর্থ আত্মসাতের বিষয় হলে সেটা জানা যায় বাইরের মানুষের কাছ থেকে! কখনো খবরের কাগজ থেকে।

কামালের মনে হয়, দুজন মানুষের সমঝোতার মাধ্যমে যদি তাদের শারীরিক সম্পর্ক হয়ই, তাতে চরিত্র নষ্ট হয় না। চরিত্র নষ্ট হয়, মানুষ গড়ার কারিগর, মা বাবার থেকে বাড়তি যেটা পেয়ে চেপে থাকেন। অসদুপায়ে উপার্জিত টাকা!

 

কামাল একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছিল। জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল, উঠোনজুড়ে মহাযজ্ঞ! এদের অনেককেই সে কাল দেখেনি! এরা কোথায় ছিল? কে এরা? এতবেলা হলো তাকে কেউ ডাকেনি বলে ক্ষুন্নই হলো। কামাল তার রুমের সাথে লাগোয়া বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে নিজেই উঠোনে নেমে কালকের দেখা কজন ছাড়া আরো যে কজন তরুণ-তরুণী, কিশোর- কিশোরী ছিল, তাদের পরিচয় জেনে নিল এবং বুঝল ভোর থেকে এদের কয়েকদফা ব্যাডমিন্টন খেলা হয়ে গেছে। সে কাসেমকে বলল, আয় এবার তুই আমি খেলি।

কাসেম বলল, আমি আর খেললে এবার বেহুঁশ হয়ে যাব। তুই নাস্তা খেয়ে নে। ঘুমোচ্ছিলি বলে মা ডাকতে নিষেধ করলেন। তুই আমি কাল খেলব। এই বিপাশা, দিকে আয়! আমার বন্ধু, নাস্তার জন্য হাসনা আপা পিঠা বানিয়েছে, তুই এর জন্য চাটা খুব ভালো করে বানাবি! আমাদের বাড়িতে বিপাশা সবচেয়ে ভাল চা বানায় বুঝলি!’ কাসেমের কথা শেষ না হতে বিপাশা ঘরের দিকে পা বাড়াল। আর কামাল বলল, আমার সাথে ওর পরিচয় তো কাল করালি। দুইবেলা একটেবিলে বসে খেলাম... কাল নাম বললি, বিদিশা, আজ বলছিস বিপাশা... মাথা তোর গোলমাল হলো, না কি আমার, বুঝতে পারছি না!

কাসেম বলল, বিদিশার যমজ। ফরিদপুর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হল। জাহাঙ্গীরনগরে চান্স পেয়েছিল, যায়নি। আম্মার একটা কিন্ডার গার্টেন আছে, লেখাপড়ার ফাঁকে চালায়। ওর ওটাতেই ঝোঁক। মানে শিশুদেরকে ভালো করে তৈরি করার ঝোঁক! ঝোঁক মানে জানিস তো? ঝুঁকে থাকা!

: কিন্তু কালকে ছিল কোথায়?

: আরে বাবা, ওর কাছেই তো যাচ্ছিস, ওকেই জিজ্ঞেস করগে না! এতগুলো মানুষ বাড়িতে, আমার কি সাধ্যি খোঁজ রাখার?

ঘরে ঢুকেই যাকে সামনে পেল, কামাল বলে ফেলল, এই যে কাল আপনি কোথায় ছিলেন, বলেন তো?

 

সামনের জনকে গম্ভীর মুখে চোখ বড় করে নীরবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কামাল আবার বলল, আপনাকেই তো বলতে বলল কাসেম। আপনি বিপাশা নন?

: আমি বিদিশা! বিপাশা আপনার জন্য নাস্তা আনতে রান্না ঘরে গেছে!

কামাল হকচকিয়ে শেষে গতরাতে যে রুমে ছিল সেখানটায় ঢুকে পড়ল।

বিপাশার আসতে একটু দেরিই হলো। কারণ চা-সমেতই সে আসতে চেয়েছে। নাস্তার ট্রে হাতে বিপাশা রুমে ঢুকতেই কামাল উঠে দাঁড়িয়ে এমনভাবে তাকে প্রশ্ন করল, ‘কাল থেকে আপনি কোথায় ছিলেন, বলেন তো?’ কামালের আচমকা এমন প্রশ্নে ঘাবড়ে গেল বিপাশা। প্রশ্ন তো নয়, যেন অভিযোগের তীর ছুঁড়েছে। বিপাশার মনে হলো তার কাছে কামালের দরকার ছিল। সে তাই ভাঙা ভাঙা স্বরে বলল, আমার কাছে আপনার কোনো দরকার ছিল?

 

কামাল হো হো করে হেসে বলল, আরে না, তা নয়। আপনারা যমজ দুবোন। আমাকে দেরিতে জানতে হলো তাই!

বিপাশাকে কেন্দ্র করে কামালের হো হো হাসিটা অনেকটা সিনেমায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের হাসির মতো লাগল বিপাশার কানে। অবয়বটাও অনেকটা সেরকম কি না, বিপাশা একটু লজ্জাই পেতে লাগল সে জন্যে। সে রক্তিম মুখে সেখান থেকে সরতে উদ্যত হলেই কামাল বিচলিত কন্ঠে বলল, চলে যাচ্ছ কেন? তোমাদের বাড়িটা এত মুখর, বসো না গল্প করি!

এবারও বিপাশার মনে হলো এও সিনেমায় বেজেওঠা সৌমিত্রের কোনো সংলাপ! তাও আবার এককথায় আপনি থেকে তুমিতে নেমে!

কয়েকটা মুহূর্ত কোনো নাটক নয়, একেবারে সিনেমা সিনেমা ভাব লাগছিল বিপাশার মনে। তাই সেটুকু পানসে হতে না দিয়ে বিপাশা একটু নাটকীয়ভাবে বোকা বোকা কণ্ঠে বলল, চা...

কামাল বলল, চা তো কি? সব তো একসাথে এনেছ। নাস্তা শেষ করে ওটা খেতে খেতে গরম সরবতের মতো লাগবে আর কি! এরপর থেকে কিন্তু চা পরের বার আনবে! তাতে একসকালে দুবার দেখা হবে তোমার সাথে!

: বলছিলাম কি, চা বেশি বানিয়ে ফেলেছি! দেখি কাউকে পাই কি না ওটার সদ্ব্যবহার করাতে, তারপর আসি?

: আচ্ছা!’ বলে বিপাশা সরে পড়ল।

 

মিনিট পাঁচেক পরে এককাপ চা হাতে যে রুমে ঢুকল, তার দিকে তাকিয়ে কামাল বলল, এই যে আমিও চা নিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি! বাহ, এর ভেতর শাড়িও পাল্টে এসেছ! টিপটা দারুণ ম্যাচ করেছে!

বিদিশা তার স্বভাব সুলভ গাম্ভীর্যে বলল, আমি বিদিশা। আমরা যে যখন সময় পাই আম্মার স্কুলে কিছু কাজ করি। গতকাল বিপাশা অনেক রাত পর্যন্ত স্কুলে ছিল। ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রশ্নপত্র তৈরি করেছে। আজ আমি যাচ্ছি। আপনি নাকি আমাকে ডেকেছেন?

এবার কামাল খাঁটি বোকা বোকা স্বরে বলল, বিপাশা তাই বলেছি বুঝি, আমি আপনাকে ডেকেছি! বিষয়টা কেমন হয়ে যাচ্ছে নিজেই বুঝতে পেরে মুহূর্তে কণ্ঠ স্বাভাবিক করে বলল, নাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছিল। তাই আমি ওকে বলেছিলাম, বসো গল্প করি! দেখেন তো কী কাণ্ড আমাকে বোকা বানানোর চাল চালছে!

বিদিশা কিছুটা হেসে বলল, আমি তবে যাই? বিপাশাকে বলব, আপনি ওর সাথেই গল্প করতে চান!

বিদিশার এই কথার পরে কামাল মুখ ফসকে বলে দিল, হ্যাঁ, তাই বলবেন, আমি বিপাশার সাথেই গল্প করতে চাই। ওহ, আমি তাই বললাম নাকি, আমি বিপাশার সাথেই গল্প করতে চাই!

কামালের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ভাব দেখে বিদিশার গম্ভীর মুখ আকর্ণ হাসিতে ভরে গেল। সেভাবেই সে বিপাশাকে খুঁজতে বেরিয়ে গেল।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান