
শব্দেরা
শব্দেরা জেগে থাকে সারাক্ষণ।
দিনক্ষণ ঘন্টা নেই শব্দের
ক্লান্তি ক্লেদজ ভাবনা নেই শব্দের ;
সদা সচল শরীরে ভ্রাম্যমান থাকে তারা।
কখনো কাঠুরের কুঠারে
কখনো কবির কলমে উঠে আসে
সাগর মন্থিত মানিকের রূপে
আলোরোদ হাওয়ায় হাওয়ায়।
সুদূর সাইবেরিয়ার বরফ শরীরে শব্দেরা জেগে ওঠে
তুষারের হিম ভাঁজ থেকে
মরুতপ্ত ধুসরলোকে জেগে ওঠে ;
কথা কয়।
নরোম কর্দমাক্ত মাটিতে জেগে ওঠে শব্দের সংঘাত
আকাশ মেঘলোকে কথা কয় তারা
মিলিত হয় মৈত্রীবন্ধনে।
হন্ডুরাস থেকে ছুটে যায় হিমালয় গিরিশৃঙ্গে
গরিবের ঘরে যায় লালনের পরশি হয়ে
বিত্তেবিভাসিত দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকে ভিখারির কাঠমুখ নিয়ে ঘুরে
সংসারসাগরে: ঘর থেকে ঘরে।
সে এবং তাহারা
তুমি তুমি করে শেষ হয়ে যাচ্ছ তুমি
আসলে তুমি বলে কিছু নেই;
কেউ নেই।
আছে সে এবং তাহারা
আছে অযুত-নিযুত মানুষেরা
তুমি বলে কিছু নেই-
কেউ নেই।
একদিকে পঙ্গপাল সদৃশ অগুনতি মানুষের ঢল
পুব আকাশে লক্ষ পরিযায়ী পাখির ঝাঁক
নদীদের নিরন্তর বয়ে চলা আছে;
আছে মেহনতি মানুষের মিছিল
মহাজন আর অবিবেকী পণ্য-পসার।
তুমি বলে কিছু নেই-
আছে শুধু সে এবং তাহারা।
সম্ভব,সম্ভব
সম্ভব,সম্ভব
এখনো সাঁতরে সমুদ্র পার হওয়া
ভরা গাঙে নৌকা বাওয়া
সম্ভব, সম্ভব।
গাছ বাওয়া দুরন্ত বালকের মতো
বুকের ক্ষত নিয়ে নিচে নামা
কাঁটা ছাড়িয়ে বিধবা দুলু দি'র গাছ থেকে করমচা পাড়া
তার চোখে অবাক সন্ধ্যা দেখা
সম্ভব,সম্ভব।
সোনালি মাঠে কাস্তে হাতে কিশোরী কিষাণীর সাথে খুনসুটি করা-
ভরা জ্যোৎস্নায় পলাশতলার
কুমিরা খালে জলের বুকে
নিজের প্রতিকৃতি দেখে আত্মপ্রেমী নার্সিসাসের মতো চমকে ওঠা;
কাছারিঘরে একা চৌকির উপর দাঁড়িয়ে
যাত্রার বিবেকের অভিনয় করা:
একবার রাজা হওয়া
আরেকবার জল্লাদ হওয়া;
সম্ভব, সম্ভব-
এই সেই আরও কত কি!
সম্ভব, সম্ভব।
শব্দ-নৈ:শব্দের নীল বেদনা
তোমার গল্প লেখা কদ্দূর এগুলো?
শব্দ-কথার তারে কোন তরঙ্গ খেলছে এখন?
নৌকা তো ভাসিয়েছো বহুদিন হলো--
রবি ঠাকুরের অমল ধবল হাওয়া লাগলো কি পালে?
ঐ যে করাতি নিজের করাতে নিজের গলা কাটলো কর্মহীন অভাবে, তার গল্প লিখতে চেয়েছিলে একদিন।
কী হলো তোমার গাঁয়ের ফর্সা দুধে-আলতা ইরানি নামের মেয়েটির যে এখন অচিন অন্ধকারে! পাশের ফ্ল্যাটের ষাটোর্ধ্ব সুভদ্র শরীফ চাচার
ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলে থাকা লাশ নিয়ে লিখতে চেয়েছিলে
তার কী হলো?
মোড়ের মোহন পাগলার যুদ্ধবিরোধী অনর্গল ইংরেজি বাক্যেরই বা কী হলো?
তোমার প্রতিবন্ধী কনিষ্ঠ ভ্রাতার?
কোথায় গেলো তোমার কলম-কথন শব্দ- নৈ:শব্দের নীল বেদনা!
বইয়ের পাতার মতো
আজিকার এইকালে খাতার পাতায় ফেরার স্বপ্ন দেখি কেন?
কেন ভাবি
পায়ে পায়ে পথ মাড়িয়ে,
পথের পারে দাঁড়ানো দিন
দেখতে হবে আমাকে:
দিনের আলোতে তাকাতে হবে।
মোবাইল ল্যাপটপ ধাতব বাতি নিয়ে, খাতা কলমের যে সখ্যতা থেকে খুব দূরে চলে এসেছি আমরা--
সে সখ্য-সম্প্রীতি ফিরিবে কি আর!
মোমের ম্লান জ্যোতি জেগে ওঠে বুকে চোখে কেন?
ইঁট সুরকির মফস্বল সড়কের
কিনারে সিঁড়ি বেয়ে আলো জ্বালা নিঃসঙ্গ বাতিওয়ালার মতো হারানো শৈশব;
শ্লেট-পেনসিলের খসখস শব্দে
শব্দিত সুদূর ডাকে বারে বারে।
মন্ত্রতাড়িত বালকের মতো বলি কেন--
আহা ফেরা যেতো যদি খাতার পাতায়!
পায়ে পায়ে পথ মাড়ানো দিনে!
বইয়ের পাতার মতো খুলে দেওয়া যেতো যদি হৃতসর্বস্ব সংস্কৃতি সবুজের গান!
শব্দ- পাখিরা
শব্দ পাখিদের নিঃশব্দ চলাচল,
অচঞ্চল উদাসীনতা আমাকে
কিছু একটা বলতে চায়--
ইশারা মৃদু ইঙ্গিতময়তায়।
শব্দ পাখিরা এমন ছিল না একদিন;
নদী-তরঙ্গে কল্লোলিত হতো।
সাদা মেঘের তুলোরাশি ছড়িয়ে--
ডাক দিত দিনের হাসিমাখা মুখটারে।
উদার ঊষালোক তমিস্রার চাদর চিরে,
মানুষের উঠোন আঙিনায় একদা একদিন সাগর বিভঙ্গে
ভেঙে পড়তো শব্দ-পাখিরা।
চোখে চোখে চেতনার চৌহদ্দি জুড়ে,
কথা হতো বাপ দাদার জবানে;
সাতপুরুষের ভিটে মাটির গালগল্প কতো!
ঘুম থেকে উঠেছো রূপালি?
ঘুম থেকে উঠেছো রূপালি?
বাইরে সোনাঝড়া রোদ্দুর আছড়ে পড়েছে, প্রচন্ড আহ্লাদে।
পৃথিবী রূপালি মুদ্রার মতো চকচক করছে, অঘ্রাণের আনন্দ উৎসবে;
পৃথিবীর গগনপাড়ে সব গান প্রতিধ্বনি তুলে গাইছে, জীবনের জয়গান।
শূণ্য নদীর পাড়ে বেদনার বাঁশি হাতে
বসে আছে, বিনাশী সভ্যতার ভাঙন;
কোনো জাগরণ নেই-
কোনো রোদ নেই তাদের উঠোনে।
গরিব বাতিওয়ালার মতো হাত গুটিয়ে,
নতজানু হয়ে নিসর্গনিমগ্ন হয় তারা;
তাদের ভূবনে কোনো গান বাজে না।
ঘুম থেকে উঠেছো রূপালি?
শেয়ালের ঠ্যাং
আকাশের হাত নিয়ে নাচছে ভোঁদর;
খিলখিল হাসিতে মেঘের টুকরো ছড়িয়ে দিয়ে আকাশ বলে,
এই নাও মেঘ আরো
নাচো উন্মাতাল তালে যতো পারো।
মেঘের একটি হাত নিলে কী আসে যায়?
নদীর বুক কেটে কুমিরের সম্মেলন বসেছে বহুদিন হলো।
শেয়ালের ঠ্যাং ঠাউর করে বোকা কুমির লম্বা লাঠিতে জবরদস্ত কামড় বসিয়ে ভ্রম করে টানতে থাকে শেয়ালের ঠ্যাং,
নৃত্যপর নদীর জল বলে--
রাখো রাখো জনাব!
কুম্ভীরাশ্রু দাঁতের দম্ভটুকু।
ভেসে যাবে জনমের মতো বানের বমিতে বমিতে।
ফিরে যাও নদীর উঠোনে;
আপন কুলায়।
ভালোই করেছো আম্মা
ভালোই করেছো আম্মা
চলে গিয়ে--
ভালোই করেছো।
এতো জরা,ব্যাধি,দুঃখ-শোক
অশান্তি তোমাকে দেখতে হলো না;
তোমার সন্তানেরাও অস্তগামী আজ।
সবার ঘরের কড়িকাঠে ঝুল
মাকড়সার জালে জরাজীর্ণ দরোজা;
ঘরের অভ্যন্তরে কালো অন্ধকার।
চিকন কঞ্চিতে ভর দিয়ে
হাটছে সবাই এই সন্ধ্যেবেলা;
শেষ হয়, হয় খেলা।
চাঁদ ডুবে নেমেছে আঁধার কখন
বইপড়া বাবাও চলে গেছে ওপারে;
সাধের ঘরবাড়ি থুয়ে।
ভালোই করেছো 'আম্মা'
চলে গিয়ে--
ভালোই করেছো।
দেখে আসি দশ দিগন্ত
দেখে আসি দশ দিগন্ত;
দুনিয়ার খোলা খুব চারদিক।
আম্মার জায়নামাজ জলচৌকি;
পাড়ার পুরনো ডোবায় পানকৌড়ি।
শৈশবের শৈবাল ঘাট পরিত্যক্ত পুকুর;
মনাদের মন্দির-ঘর।
দুলুদি'র ছায়া স্নিগ্ধ করমচা গাছ,
নানাবাড়ির দহলিজ আশপাশ।
দেখে আসি বুবুনি'র মায়াবতী শাড়ি;
দেখে আসি বাস্তুভিটা বাড়ি।
ফিরে যা জীবনপুরে
তুই যা তোর গন্তব্যে গ্রামীণ গ্রহে
ওখানে সমিল প্রহর পাবি প্রাণ আরও;
ওখানে নদীতট নীলিমা সাধ দেবে
পাড়ার পোলাদের সাথে গলাগলি হবে।
আকাশের মেঘসকল মেলে দেবে ডানা
করিম রহিম যদু মধু দৌড়ে আসবে;
কাঁধে করে শৈশব রোদ নিয়ে
পাহাড়ি মেয়েদল নাচবে ঘুরেফিরে।
তুই যা ফিরে যা জীবনপুরে
সুদূর সান্ধ্য জোনাকির কাছে;
কালের কোলাহল ছেড়ে
যা নিরিবিলি নিশ্চিন্তিপুরে।
প্রভু! মানুষময় করো ভূবণেরে
প্রভু! মানুষময় করো তুমি এই ভূবণেরে;
ভরাডুবি ভবতরী পারে নাও
তড়িৎ তরঙ্গে।
অমানুষ অমানুষ খেলা
বন্ধ হোক এইবেলা;
মাভৈ মন্ত্রে আনন্দময় ধ্বনি সুরে
মানুষের গীত বন্দনা হোক চারিদিকে:
প্রভু! মানুষময় করো তুমি অমানুষ ভূবনেরে।
গাজার সীমানা ছাড়িয়ে
গ্রাম গ্রামান্তরে বঙ্গ জনপদে ছড়িয়ে যাক শান্তিবার্তা;
মানুষের আনন্দ মিছিল।
মানুষময় করো তুমি
এই ভূবনেরে প্রভু!
মানুষময় করো।
শান্তি
শান্তি! তোমার কোনো আলাদা নামের দরকার নেই;
তোমার নামের কোনো সীমা সংখ্যা নেই।
সুন্দরের আনন্দ সংগীত তোমার নাম
কচি ঘাসের ডগায় শিশির তুমি
পাখিদের পেলব বুকের পালক তুমি
রক্তে ধুয়ে যাওয়া কুরুক্ষেত্রের ক্ষীপ্রতার পর সুবাতাস তুমি।
তোমার কোনো নাম থাকতে নেই
কোনো ঠিকানার দরকার নেই;
অমরা নদীময় মাধুরী তুমি!
সূর্যধোয়া সকালময় মুখ তুমি!
শান্তি! তুমি
অশান্তির বিপরীত গোলার্ধে ফোটাতে থাকো গোলাপের গান।
বৃক্ষ বন্ধু
তোমাকে অনুভব করছি
হে আমার প্রিয়তম বৃক্ষ!
বড়ো মনে পড়ছে তোমাকে
পড়ন্ত এই প্রহরে হে বৃক্ষ বন্ধু!
মা'র হাতে রোপিত হয়েছিলে একদিন তুমি
বাবা দিনানুদিন জল ঢেলে
মাটি নিংড়ে পরিচর্যা করেছিলেন
নিজহাতে আপন সন্তানের মতো তোমাকে।
সূর্য উত্তাপ আর আলো
ছড়িয়ে স্নিগ্ধ উদ্ভাস এনেছিল
তোমার শরীরে শিরায় শিরায়:
ঋতুসব সুরে সুরে তোমাকে সংকীর্তন করেছিলো
ঋদ্ধ করেছিল প্রাকৃতিক প্রেমে এতোকাল।
ঝড়-ঝঞ্ঝায় তুমি রবার্ট ফ্রস্টের
জানালার পাশে গাছটির মতো সয়েছো
শত বেদনা নিয়তির নির্যাতন--
তুমি টলোনি; মানোনি হার।
ফেনায়িত হয়না ফসলের সমুদ্র আর
এবং আমি খরা পীড়িত মাঠ
এবং আমি পরিত্যাক্ত পুকুরের মতো;
শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে যাচ্ছি দিনদিন।
আমার উল্লেখযোগ্য জমির অংশ :
বহুদিন পায়না বৃষ্টি ও বাতাস;
কংকর কালিমায় কংকালের মতো
নিঃশেষ হচ্ছে একটু একটু করে আমার জমি
আবাদযোগ্য ভূমি হচ্ছে অনাবাদি ঊষর।
শীতে শিশিরের শূণ্যতায়
কাঁদতে থাকে মরা মাটি;
কাতর কবুতরের মতো--
অবিবেকী বালামুসিবতে।
যেহেতু জমির উর্বরা শক্তি ক্রম ক্ষীয়মান
পোড়ো পরিত্যক্ত জিরজিরে হাড়;
মাঠের শরীর ছুঁয়ে তাই
ফেনায়িত হয়না ফসলের সমুদ্র আর।