অনিরুদ্ধকে - কাঙ্ক্ষিতা কায়েম সাইকি
অনিরুদ্ধকে - কাঙ্ক্ষিতা কায়েম সাইকি

অনিরুদ্ধ,

রাত এখন ২ টা বেজে ৩০ মিনিট। আমার বয়সী একটা মেয়ের এই সময় রাত জেগে একান্ত নিজের কাউকে চিঠি লেখার কথা। কিন্তু সেই সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনটাই আমার কখনো হয় নি। আমি কখনো ভাবিনি যে ভাগ্যের দোলাচলে এ রকম একটা মুহূর্তও আমার তোর সাথে ভাগ করে নিতে হবে। যাক সে কথা...

এটা তোকে লেখা আমার প্রথম চিঠি। প্রথম সব কিছুই নাকি জীবনে স্মরণীয় এবং যত্নপ্রাপ্য। কিন্তু হায়!! বড় হাহাকারের সঙ্গে আমার বলতে হচ্ছে যে এটাকে স্মরণীয় করে যদিও বা রাখিস যত্ন করে কখনো রাখিস না, পুড়িয়ে দিস। কারণ এই চিঠিটা বোঝার মত যোগ্যতা তুই ছাড়া কারো না থাকলেও ভুল বুঝে বাজে বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা এ পৃথিবীর সবারই আছে বলে আমার বিশ্বাস এবং এর দায়ভার টুকু শুধু আমার বয়ে বেড়াতে হলেও সহ্য টুকু তোকেই করতে হবে। আর তোর এ সহ্য করাটা সহ্য করার মত শক্তি আমার বোধয় হবে না...

ভূমিকা বেশি হয়ে যাচ্ছে। এবার মূল কথায় আসা যাক। জীবনের সমস্ত ভালোবাসা এবং ঘৃণার হিসেব যদি কাউকে কখনো দিয়ে থাকি সে শুধু তুই। সবার কথাই তোকে বলেছি। শুধু তোর কথা কখনো তোকে বলা হয় নি। আজ তোকে তোর গল্প শোনাব...

পৃথিবীতে একটা মেয়ে তার প্রেমিকের জন্য কতদিন অপেক্ষা করে থাকে তার জরিপ যদি কখনো করা হয় তবে তার হিসেবের পরিধি কত বড় হবে আমি জানিনা। শুধু এটুকু জানি আমার ১৯ বছর ৩ মাসের ক্লান্তিহীন অপেক্ষার ফসল তুই। তোকে আমার প্রথম বরণ ছিল বন্ধুত্বের কোনও অমোঘ দাবীতে এটা ঠিক। কিন্তু দিনের বেহিসেবি পথ চলায় এবং আমার বেহিসেবি নির্ভরতার সুখ ফাঁদে আটকে পড়ে একদিন খেয়াল করলাম তুই আর আমি সবকিছুকে ছাপিয়ে বহু দূরের অচেনা কোনও পথে পাড়ি জমিয়েছি যে পথের সন্ধান কেউ কখনো পায় নি, কেউ কখনো পায় না... সমুদ্রের স্রোত যেমন আটকে রাখা যায় না ঠিক তেমনি তোকে কোনও নির্দিষ্ট সম্পর্কের গণ্ডিতে আটকে রাখার মত কোনও শক্তি আমার ছিল না।  তুই কখনো বাবার মত শাসন করেছিস, কখনো মায়ের মত কান্না থামিয়েছিস, কখনো ভাইয়ের মত রক্ষা করেছিস, কখনো বন্ধুর মত হাত বাড়িয়েছিস, কখনো প্রেমিকের মত সান্নিধ্য দিয়েছিস আবার কখনো সন্তানের মত আশ্রয় খুঁজেছিস!!

এই অদ্ভুত সম্পর্কের কোনও নাম হয় না। শুধু এটুকু বলা যায় এ এক ঐশ্বরিক বাঁধন যেখানে পৃথিবীর ক্ষুদ্র, তুচ্ছ চাহিদা গুলো আরও বেশি তুচ্ছ!! তাই পৃথিবীর নগণ্যতা, বা পৃথিবীতে বাস করা সাধারণ মানুষের মত করা সাধারণ চিন্তা যে এ সম্পর্ককে স্পর্শ করতে পারে,  সে অর্থহীন বিশ্বাস টা আমার কখনো হয়নি। পৃথিবীতে অর্জন করা সম্পর্ককে বহু যত্নে রক্ষা করতে হয় জানি কিন্তু স্বয়ং ঈশ্বর প্রদত্ত ঐশ্বরিক সম্পর্ককে যে পৃথিবীর সাধারণ মানুষের মত প্রতিনিয়ত যত্ন করে রক্ষা করতে হবে সেটা সত্যি ভাবিনি। আর ভাবিনি বলেই এ সম্পর্ককে শুধু পরম স্বাধীনতায় উপভোগ ই করেছি, কখনো অতি সাবধানতায় রক্ষার চেষ্টা করিনি। অনেক সময় মনের বেখেয়ালে, অনেক সময় ক্লান্তিতে আবার অনেক সময় অজ্ঞতার বশে হয়তো তোর আবেগ বা চাহিদা গুলোকে যথাযথ ভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি। কিন্তু স্বয়ং ঈশ্বরের নামে বলছি, অবহেলার বশে কখনো কিছু করিনি......

ভাইফোঁটা নিয়ে তোর সাথে আমার একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিলো এটা মানি এবং স্বীকারও করি। তার জন্য আমি বারবার অনুতপ্তও হয়েছি তোর কাছে। কিন্তু এর বাইরেও যে আমার দোষের অন্ত ছিল না এটা আমি সত্যি ই জানতাম নারে!! সেদিন রিকশায় বসে প্রথম জানলাম যে আমি দোষের পর দোষ করে গিয়েছি এবং তুই সেটা সহ্য করে বারবার আমাকে একটা করে দাগ দিয়ে গিয়েছিস দক্ষ বিচারকের আসনে বসে। শুধু এক বার আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করিসনি। শুধু তাই না, নিজেও জানার চেষ্টা করিসনি যে তুই যা জানিস তার বাইরেও আরও কিছু থাকতে পারে। একটা ফাঁসির দন্ড প্রাপ্ত আসামীরও নিজ অপরাধ জানার অধিকার টুকু থাকে। কিন্তু আমি বোধয় তারো চেয়ে বড় অপরাধী। তাই আমার সে সৌভাগ্য টুকুও হল না......

তবুও আমি তোকে নির্বোধের মত প্রশ্ন করেছিলাম। তুই নিরুত্তাপ গলায় উত্তর দিলি, “ঈশ্বর জানেন”...

আমার তখন শুধু এটুকুই মনে হোল, যে ঈশ্বরকে তুই কখনো দেখিসনি তাঁকে তুই সবটা মনের কথা বলতে পারলি, আর যে আমাকে তুই ছুঁয়ে দেখতেও কখনো দ্বিধাবোধ করিস নি সে আমাকে তুই এত টুকু বলারও প্রয়োজন বোধ করলি না। হোক না সেটা আমারই অপরাধ!! একটা বারও তোর মনে হোল না যে তোর আরও কিছু জানার থাকতে পারে বা আমারও কিছু বলার থাকতে পারে!!

সেদিন চৈতালির কথা বলাতে তোর মনে হোল তোকে আক্রমণ করে বা চৈতালিকে  হিংসে করে আমি বলেছি!!! অনি, আমি ভেবেছিলাম পৃথিবীতে আমার একটি মাত্র অভিমানের জায়গা আছে যেখানে কোনও প্রকার হিসেব ছাড়াই অভিমান করা যায়, বিশ্বাস করা যায় যে এ অভিমান বিফলে যাবে না, কেউ সেটা ঠিক ভাঙাবে। এ লোভ টুকু যে আমার বড় বেশি চাওয়া ছিল যা এমন কাউকে আক্রমণ করবে যাকে আমি শুধু ভালবাসতেই শিখেছি এটা সত্যি ই বুঝতে পারিনি রে!! আমায় ক্ষমা করিস... আর আমার বেখেয়াল, ক্লান্তি, অজ্ঞতা এ সব কিছুর অসীম ক্ষমার স্থানটুকুও যে তোর কাছে আমার প্রাপ্য ছিল না, এবং তার জন্যও যে আমাকে হিসেবের খাতায় নাম লেখাতে হবে, সে বোধহীনতার জন্যও আমায় ক্ষমা করিস...

তুই কিছুক্ষণ আগে ফোনে সরি বললি। কিন্তু তোর মুখে সরি শব্দটা যে আমার কাছে কতটা অবান্তর এবং বেমানান এটা হয়তো তুই কখনোই বুঝবি না। এর কারণ তুই আজীবন ই আমার কাছে প্রাধান্য  ছিলি, কোনও বিকল্প  না। তাই তোকে নিয়ে হিসেব করার মত ইচ্ছা, শক্তি বা সাহস কোনটাই আমার কখনো হয় নি।

হ্যা, তুই বলতে পারিস যে তোর সাথে আমার বহুবার ঝগড়া হয়েছে। কিন্তু ঝগড়া মিটে যাবার পর আমি আবার আগের মত সবটা দিয়ে মিশেছি। মাঝখানে ভালো মন্দের হিসেবের পাহাড় দিয়ে কখনো দেয়াল তুলিনি...

আজ আমার নিজেকে বড় ফাঁকা মনে হয়রে!! বড় অপ্রাসঙ্গিক এবং অপাংক্তেয় মনে হয়!! যতবার ভাবি তুই আমার অপরাধ গুলো মনের মাঝে জমিয়ে রেখে প্রতিটা মুহূর্ত আমার সাথে মিশেছিস আর আমি কোনও কিছু টের না পেয়ে নির্লজ্জের মত হাত পেতে কেবল ভালোবাসা কুড়িয়ে বেড়িয়েছি তখন আমার সত্যিই বড় গ্লানিবোধ হয়!! নিজেকে বড় অর্থহীন মনে হয়...

এখন তোকে আমার সম্পর্কে কিছু কথা বলি যা হয়তো কখনো তোকে বলবনা বলে ভেবেছিলাম। কারণ এ কথাগুলো কখনো তোকে ঘটা করে জানাতে হবে এ অদ্ভুত বোধই আমার কখনো হয় নি। কিন্তু তোর সাথে থাকা পুরোটা সময়ে ভিখিরির মত তিলতিল করে ভালবাসা জমিয়ে আজ সে পাত্র খুলে যখন দেখলাম পুরোটাই ফাঁকা, পুরোটাই আমার দোষে, আমার বেখেয়ালে পথের মাঝে কোথাও পড়ে গিয়েছে তখন হঠাৎ মনে হোল প্রদীপ নিভে যাবার আগে দপ করে জ্বলে উঠে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা টুকু করে। আর কোথায় যেন পড়েছিলাম কোনও কিছু শেষ হয়ে যাবার সময় তার কোনও কিছু অজানা রাখতে নেই। তাই এ কথা গুলো আজ বলা...

তোর যেদিন রিলেশন হোল সেদিন তোর সব কাছের মানুষই নির্ভেজাল খুশি হয়েছিলো তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আমিও তাই ভেবেছিলাম যে এ আমারও বড় সুখের দিন হবে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হোল তোর সাথে সেদিন ফোনে কথা বলে ফোনে রাখার পরই খেয়াল করলাম, “কোথায় যেন ব্যথা!!” হঠাৎ আমার মনে হোল “আজ আমি একাধারে সুখী এবং দুঃখী, তোর খুব কাছে হয়তো আর কখনোই যাওয়া হবে না!!”। কতটা স্বার্থপর এবং নির্লজ্জের মত সেদিন তোকে ভালবেসেছিলাম সে একমাত্র আমার ঈশ্বর জানে...

তোর কপালে ভাইফোঁটা দিয়ে সে ছবি আপলোড করব ভেবেছিলাম। তার সাথে কিছু কথাও লিখে রেখেছিলাম। আজ তোর আমার হাতে ভাইফোঁটা নিতে এত কুণ্ঠাবোধ!! কি করে তোকে এ কষ্ট দি বলতো!! তাই ভাবলাম ছবি আর লেখা তো আর কখনো আপলোড করা হবে না। অন্তত লেখা গুলো তোকে জানাই। কারণ এসব তোকেই লেখা। আর ওটা নষ্ট করার আগে একবার অন্তত তার আসল ঠিকানায় পৌঁছে দেয়া উচিৎ...

“দাদাভাই,

প্রকৃতির মাঝে পরিপূর্ণ প্রাপ্তি এবং পরিপূর্ণ অপ্রাপ্তি বলে বোধয় কিছু নেই!!  এ সবুজ ক্যাম্পাস আমাকে ধূসর একটি পৃথিবী দিয়েছে। কিন্তু সে ধূসর পৃথিবীতে পথ চলার জন্য আমাকে তোর মত চিরসবুজ একটি দাদাভাই দিয়েছে!! তুই আমাকে হয়তো হোঁচট খাওয়া থেকে বাঁচাতে পারিসনি কিন্তু সেখান থেকে উঠে আবার নতুন করে হাঁটতে শিখিয়েছিস!! আমাকে লোকের গঞ্জনা থেকে হয়তো বাঁচাতে পারিসনি কিন্তু আমার জন্য অনেক গঞ্জনা সয়েছিস!! আমার ফাঁকা পৃথিবী কোনও কিছু দিয়ে পূর্ণ করতে পারিসনি কিন্তু তুই নিজেই পুরোটা দখল করেছিস!! যুগে যুগে তোর মত দাদাভাইকেই আমি দাদাভাই হিসেবে পেতে চাই। আমার যত বার জন্ম হবে ততবারই আমার সমস্ত জন্ম সার্থক করে আমার দাদাভাই হবি তো!!”

 

আমি অনেক ভেবে দেখলাম রে............!! আমি যতদিন তোর সাথে থাকবো আমি ভুলে যাব যে তুই আমার ভুলের পাহাড়টা মাঝখানে রেখে আমার দাবীর পাহাড়টা ঢেকে আমার সাথে মিশছিস। বোকার মত বারবার তোর কাছে দাবী করব এবং বারবার সেই ভুলের পাহাড়েই আবার ধাক্কা খাব। আবার তোর সাথে গুটিয়ে মেশাও আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। পাশাপাশি থেকেও দূরত্ব আমি রাখতে পারি, কিন্তু সেটা তোর সাথে না!! তোর লোভ সংবরণ করার শক্তি আমার নেই রে!! তাই নিঃশব্দে তোর জীবন থেকে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনও পথ খোলা দেখছি না...

 

এই ফাঁকা হাত দুটোতে কখনো কোনও কিছু ধরে রাখতে পারিনি এটা ঠিক। কিন্তু কখনোই নিজেকে এত নিঃস্ব অবস্থায় দেখিনি। আজ আমার মত দরিদ্র বোধয় কেউ নেই। কিন্তু ঐ যে বললাম!! পরিপূর্ণ অপ্রাপ্তি বলে কিছু নেই!! তোকে জীবনে স্থির অবস্থায় দেখে যেতে পারছি। অন্তত এই শান্তিটুকু আমি সাথে নিয়ে যেতে পারছি তোর কোনও অনুমতি ছাড়াই!!

 

এই শেষ বেলায় তোকে একটা অনুরোধ করব। জানিনা ঠিক হবে কিনা!! আর তা হোল, “ভালোবাসা জিনিসটা বড় অভিমানি এবং অন্ধ!! তাই ভালোবাসার মানুষ কে বিশ্লেষণ করলেও তার ভালবাসাকে কখনো বিশ্লেষণ করতে যাস না। তাতে মানুষ টা থাকলেও ভালবাসাটা থাকবে না। আর জীবনে একজন ভালোবাসার মানুষকে হারালে আরেকজনকে পাবি এটা সত্য কিন্তু জীবনে ভালোবাসা হারালে সেটা আর পাবি না। তাই অন্ধ ভালবাসাকে অন্ধত্বের পূর্ণ দাবী নিয়েই বিশ্বাস করিস। ভালবাসাকে ভালবাসার মতই ভালবাসিস......”

 

মৃন্ময়ী বড় ভালো মেয়ে!! ওকে সুখী করিস। ওর নারীত্বে কখনো আঘাত করিস না। এ বড় যন্ত্রণার!! কখনো কোনও কঠিন পরিস্থিতি এলে নিজেকে পুড়িয়ে হলেও ওকে বাঁচিয়ে রাখিস। ওকে আমার আদর জানাস। শুধু আমার এ হেরে যাবার গল্পটুকু ওকে শোনাস না!! আমার অশুভ জীবনের এক কণাও যেন এ নিষ্পাপ মেয়েটিকে স্পর্শ না করে!! শুধু বলিস ওর এক দিদি ওকে দূর থেকে অনেক ভালবাসে......

তোরা সুখী হ। এ জগতে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু মহান, যা কিছু সত্য এবং যা কিছু চিরকল্যাণকর সব তোদের হোক এই শুভ কামনায়...





সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান