আর কোথাও যাবো নাকো - ড. কাজী ইকবাল জামান
আর কোথাও যাবো নাকো - ড. কাজী ইকবাল জামান

সবাই বুঝি চায় শ্রেষ্ঠত্ব, এমন কি বন্ধুদের আড্ডাতেও। আড্ডা খুব একটা ভালো লাগে না কামালের। বন্ধুদের আড্ডা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আড্ডা দেবার মতো অফুরন্ত সময় তার নেই। তাতেও অনেকে দোষ ধরে। জীবনটা বুঝি শাখের করাতের মতো। এদিকে টানলেও কাটে, আবার ওদিকে টানলেও কাটে।

 

টিউশনিটা সন্ধ্যার পর। কামাল একটু আগে ভাগেই সুমনদের বাড়ীতে যায়। দরজা খুলে দাঁড়ায় তার বড় বোন শম্পা। নীল ওড়নাটা গলার দিকে টেনে বললো, স্যার, এই অসময়ে? সুমন তো ঘরে নেই, মাঠে খেলতে গেছে।

কামাল আমতা আমতাই করে। হাতে ঘড়িও নেই। বললো, স্যরি! তাহলে সন্ধ্যার পর আসবো।

 

শম্পা কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতেই তাকিয়ে থাকে। তারপর বললো, যাবেন কেনো? আসুন, চা খান। চা খেতে খেতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।

 

কামাল খানিকটা ছটফটই করে। খুব বেশী সুন্দরী মেয়েদের সাথে কথা বলতে পারে না। শুধু তোতলামী করতে থাকে। সুন্দরী মেয়েদের এসব কোন বাড়তি গুন নাকি?

 

শম্পা ভেতরের দিকেই এগিয়ে যায়। কামাল দরজাতেই দাড়িয়ে থাকে। শম্পা পেছন ফিরে বললো, কি হলো? আসুন!

 

সুমনকে পড়াতে হয় এই বসার ঘরটা অতিক্রম করেই পাশের একটা ঘরে। একই ঘর, অথচ ঢুকতে কেনো জানি সংকোচ করে। শম্পা আবারো বললো, কি হলো?

 

অগত্যা কামাল ভেতরে ঢুকে। সোফাটায় বসে, মাথাটা নীচু করে রাখে। শম্পা ভেতরের ঘরে ঢুকে যায়। মিনিট সাতেক পর ট্রে ভর্তি নাস্তা আর চা নিয়ে আসে। নীচু হয়ে টেবিলটাতে রাখে। নীল ওড়নাটার একটা পার্শ্ব খসে পরে। মুচকি হেসে ওড়নাটা আবারো ঠিক করে নেয়।

এসবও কি সুন্দরী মেয়েদের বাড়তি গুন নাকি?

কামাল চায়ের কাপটাই শুধু হাতে টেনে নেয়।

 

শম্পা ওপাশের লম্বা সোফাটায় বসে। রিনি ঝিনি গলায় বলে, নাস্তাগুলোও নিন! আমার নিজ হাতে বানানো।

কামাল কেমন জানি ছটফট করে। মাথাটা ঠিক মতো কাজ করে না। বললো, না, ঠিক আছে। আমি বিকেলে কিছু খাই না।

শম্পা বললো, নিয়ম কি ভাঙ্গতে নেই?

কামাল বললো, আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন।

শম্পা বললো, আপনি নয়, আমি আপনার অনেক জুনিয়র!

কামাল বললো, ও, কি পড়ো?

শম্পা বললো, ও! জানতেন না বুঝি? এই বছর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন।

কামাল বললো, গুড! খুব ভালো সাবজেক্ট।

শম্পা খিল খিল করে হাসলো। বললো, আমার জন্যে সবই ভালো। সময় কাটানো।

কামাল শুধু চায়ে চুমুক দিলো। কিছু বললো না। শম্পা বললো, কই, নাস্তাগুলোও খান!

অগত্যা কামাল নুডোলস এর বাটিটা হাতে নেয়।

 

লেখাপড়া, ইউনিভার্সিটি, আড্ডারও বোধ হয় প্রয়োজন আছে। অধিকাংশরাই শুধু বলতে চায়। শ্রোতারও তো দরকার আছে! বন্ধুদের আড্ডায় কামাল শ্রেষ্ঠ শ্রোতা হয়েই থাকে।

 

সেদিন নুতন করেই মনে হলো, মেয়েরাও অনেক কথা বলতে চায়। কোন প্রসংগ লাগে না। শম্পা বলতে থাকে হরবর করে, কলেজ পর্যন্ত কিন্তু সায়েন্সেই ছিলাম। বাব্বা! ফিজিক্স কি কঠিন লাগতো! আপনি ওসব মনে রাখেন কি করে?

 

কামাল নুডোলস চিবুতে থাকে। বললো, আমার কাছে গল্পের মতো লাগে।

শম্পা বললো, আমার কাছেও সব কাল্পনিক গল্পের মতোই লাগে। নিজ চোখেই তো দেখি, সূর্য্যটা ঘুরতেছে। অথচ, পদার্থবিদ্যায় বলে, না, পৃথিবীটা ঘুরতেছে! সূর্য্য নাকি স্থির!

 

কামাল হাসলো শুধু। শম্পা খিল খিল করে হাসতে থাকে। বললো, বাহ! আপনি হাসতে পারেন?

কামাল বললো, হাসতে তো সবারই পারার কথা! হাসি কান্না নিয়েই আমাদের জীবন!

শম্পা বললো, কিন্তু, আপনাকে দেখলে খুউব কঠিন মানুষ মনে হয়! মনে হয়, হাসি খুশী এসব আপনার জন্যে নয়। সারাক্ষণ কেমন যেনো একটা ম্যূড নিয়ে থাকেন।

কামাল বললো, ম্যূড ঠিক নয়, আমার চেহারাটাই এমন।

শম্পা বললো, আপনি দেখতে খুব হ্যাণ্ডসাম! বাট?

কামাল বললো, বাট?

শম্পা বললো, বাট, একটা কঠিন মানুষ বলেই মনে হয়।

কামাল আবারো হাসলো। কিছু বললো না।

 

শম্পা তার গলায় ঠেকিয়ে রাখা নীল ওড়নাটা সরিয়ে নিয়ে পেছন থেকে আবারো ঘাড়ে চেপে নিলো। বললো, প্রেম করেন?

কামাল বললো, না।

শম্পা বললো, আমিও না।

 

কামাল খানিকটা অন্যমনস্কই থাকে। ভাবলো, শম্পা কি আবার তাকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবছে নাকি? কামাল বললো, না মানে, আগে একটা মেয়েকে ভালোবাসতাম। পুরুটাই এক তরফা ছিলো।

শম্পা বললো, রাজনীতী করেন?

কামাল বললো, তুমি কি আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছো?

শম্পা খিল খিল করেই হাসলো। বললো, না, এমনিতেই জিজ্ঞাসা করলাম।

কামাল বললো, একসময়ে করতাম, কলেজ জীবনে। পুরুটাই শুধু সমর্থন ছিলো।

শম্পা বললো, আপানার সব কিছুই ছিলো! কোনটা এক তরফা, কোনটা সমর্থন! আপনার কি বর্তমান বলতে কিছুই নেই?

কামাল বললো, নুডোলসটা খুব মজা হয়েছে! এমন মজার নুডোলস কখনো জীবনে খাইনি।

 

শম্পা খিল খিল করেই হাসলো। বললো, আরেক বাটি দেবো?

 

পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুঝি, আপনি কেমন আছেন?

সেদিন সন্ধ্যার পরও বন্ধুদের আড্ডাটা চলছিলো। কামাল উঠে দাঁড়ালো। রিজভী টিটকারীর সুরে বললো, ও! শম্পারে দেখার সময় বুঝি হয়ে গেলো?

আতাউর বললো, কপাল! কপাল! টিউশনি কইরা ট্যাকাও পায়, আবার একটা সুন্দরীর ভালোবাসাও পায়!

 

কামাল কিছুই বলে না। সম্রাট বলে উঠে, ঐ কামাইল্যা কথা কস না কেন! টিউশনি করস আর যাই করস, আমাগো ভ্যাট দিয়া যা।

কামাল বললো, দোস্ত পকেট খালি।

সম্রাট খ্যাক খ্যাক করেই হাসে। বললো, হ্যা কয় পকেট বলে খালি। হারুনের দোকানে গেলে চা বাকীতে দেবে না! চল! আগে ভ্যাট, তারপর টিউশনি!

অগত্যা কামাল বন্ধুদের নিয়ে হারুনের চায়ের দোকানেই যায়।

 

শম্পার সাথে কামালের আসলে কোন প্রকার সম্পর্কই ছিলো না। এমন কি ভালো করে চিনতোও না। সুমনকে পড়াতো ঠিক এতটুকুই।

 

সন্ধ্যার অনেক পরই পড়াতে যায় সুমনকে। কামাল অংকগুলো বুঝিয়ে দিতে থাকে। হাতে ঘড়ি নাই, অথচ ঠিক এক ঘন্টা পরই উঠে দাঁড়ায়। সুমন বললো, স্যার, আপু খেয়ে যেতে বলেছে।

কামাল খানিকটা ছটফট করে। বললো, না হলে গিয়েই খাবো।

 

শম্পা ঢুকে সুমনের পড়ার ঘরে। বললো, স্যার! আপনার হাতে তো কোন ঘড়ি নাই, সময় মাপেন কি করে?

কামাল বললো, মানে?

শম্পা বললো, না মানে, আপনি যতটাতেই আসেন, এক ঘন্টার বেশী এক মিনিটও কিন্তু সুমনকে পড়ান না!

কামাল বললো, ও অভ্যাস হয়ে গেছে। ক্লাশগুলো পয়তাল্লিশ মিনিটের জন্যে থাকে। তার সাথে পনেরো মিনিট যোগ করলে, কতটা সময় হয় অনুমান করতে পারি।

শম্পা বললো, আপনি আসলেই অদ্ভুত মানুষ। সুমন কি বলেছে, শুনেছেন?

কামাল বললো, ও! খেয়েই যেতে হবে?

শম্পা বললো, হলে গিয়ে কি খাবেন জানি তো! এক টুকরা মাছ, আর ডাল! যে ডালে ডাল খোঁজতে অনুবীক্ষণ যন্ত্রও লাগতে পারে!

কামাল বললো, আমাদের মতো সাধারন ছাত্রদের জন্যে ওটাই অনেক মেওয়া! অভ্যাস হয়ে গেছে!

শম্পা হাসলো। বললো, গুড! মাঝে মাঝে অভ্যাস চেইঞ্জ করতে হয়! আমি নিজ হাতে রান্না করেছি।

 

কামাল আর শম্পার মুখের উপর কথা বলতে পারে না।

কামাল বসার ঘরে সোফাটাতে গিয়ে বসে। শম্পা খাবারের আয়োজন করতে থাকে এটাচ্ড ডাইনিং স্পেসে। ও ঘর থেকে শম্পার মাও এগিয়ে আসে। বললো, মাস্টার সাহেবকে খাওয়াবে আগে বলবে না! আমি ভালো কিছু বাজার করিয়ে রাখতাম!

কামাল উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। বললো, না আন্টি, খুব বেশী ভালো খাবার আমার পেটে হজম হয় না!

শম্পার মা বললো, বসো বাবা। আমি দেখছি।

তারপর শম্পাকে ডেকে বললো, এই শম্পা ফ্রীজে হাসের মাংস আছে। ওটা গরম পানিতে ভিজতে দাও।

শম্পা বললো, না মা, তোমাকে বলতে হবে না। আমি ওটাই রান্না করেছি।

শম্পা ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে ডাকতে থাকে, স্যার আসেন! সামান্য কিছু!

 

কামাল ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে। পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষরা এমন ভালো হয় কি করে?

অতঃপর এগিয়ে যায় খাবার এর টেবিলটাতে।

 

মানুষের জীবনে প্রেম ভালোবাসা কেমন করে গড়ে, কে জানে? কামালের মন প্রেম ভালোবাসাকে টানে না। শুধু মনে হতে থাকে, তাকেও কোন একদিন শ্রেষ্ঠই হতে হবে!

 

সকাল থেকে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাশ। বিকেলে বন্ধুদের আড্ডা। তারপর পড়তে বসা।

সেদিনও বিকেলে আড্ডা চলছিলো। সন্ধ্যাটা হতেই উঠে দাঁড়ায় কামাল। আতাউর বললো, তুই আমাদের আড্ডাতে আসিস কেন? একটা কথাও তো বলিস না।

কামাল বললো, কথা জানলেই না বলবো!

সম্রাট বললো, না! তুই কথা জানস না! তারপরও মাইয়াগো মধ্যমণি!

কামাল বললো। মেয়েদের মধ্যমণি মানে?

সম্রাট অন্য বন্ধুদের লক্ষ্য করে বললো, হ্যারে তরা বুঝাইয়া ক! হ্যা বলে কিছু বুঝে না!

 

কামাল অনুমান করতে পারে, সবই হিংসা! কিন্তু টিউশনিটা তার খুবই দরকার! সে কথা বাড়ায় না। বললো, দোস্ত, এখন আসি।

 

কামাল সুমনদের বাড়ী গিয়ে পৌঁছে, সন্ধ্যার কিছু পর। শম্পা বসার ঘরে অলস সময়ই কাটাচ্ছিলো।

কিছু কিছু রংই বুঝি আছে, মেয়েদের আরো সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলে। শম্পার পরনে সাধারন এক রং এর একটা কামিজ, হালকা গোলাপী। ঠোটে লিপিস্টিকও লাগিয়েছে, টকটকে লাল। মনে হলো স্বয়ং আকাশ থেকে নেমে আসা এক পরী! কামালের দিকে প্রণয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, আজ সুমন পড়বে না।

 

কামাল তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলতে পারে না। খানিকটা আমতা আমতাই করে। তারপর বললো, কেনো?

শম্পা বললো, নিয়ম ভাঙ্গতে চাইছি।

কামাল বিড় বিড় করলো, নিয়ম? ভাঙ্গতে চাইছো? কেনো?

শম্পা বললো, আপনাকে যতটা কঠিন ভাবতাম, বোধ হয় ততটা কঠিন মানুষ আপনি না।

কামাল বললো, আমি কঠিন মানুষ?

শম্পা বললো, এতদিন আমার মনে হতো!

কামাল বললো, এখন মনে হয় না কেনো?

শম্পা বললো, আপনার ভেতরের মনটা খুব রোমান্টিক!

 

কামাল হঠাৎই হাসলো। শম্পাও হাসলো। বললো, হাসলে কিন্তু সত্যিই আপনাকে খুব রোমান্টিক লাগে। আপনি সব সময় হাসেন না কেনো? কি এত ভাবেন?

কামাল বললো, কিছুই না। আমার নিজস্ব একটা ভুবন আছে।

শম্পা বললো, নিজস্ব ভুবন? কেমন?

কামাল বললো, আমিও জানি না।

শম্পা বললো, আপনি আসলেই অদ্ভুত!

কামাল বললো, অনেকটা তেমনই।

শম্পা খানিকটা রাগ করেই বললো, ঠিক আছে যান! সুমন ওর পড়ার ঘরেই আছে। গিয়ে পড়ান! 

 

সেদিনও শম্পা বসার ঘরে বসে ছিলো। সোফায় নয়, কোনের দিকে একটা চেয়ারে। সাদা রং এর কুশ কাটা ধরনের কামিজ। কোন ওড়না নেই, উঁচু বুকটা চোখে লাগে।

 

কামাল দেখেও না দেখার ভান করে, সুমনের পড়ার ঘরেই এগুতে থাকে। শম্পা খানিকটা হতাশ গলাতেই বলে, আপনার সমস্যা কি?

 

কামাল থেমে দাঁড়ায়। আমার আবার সমস্যা কি? কোন ভুল করেছি?

শম্পা বললো, ওটাই তো বড় সমস্যা! আপনি মানুষকে খুব এড়িয়ে যেতে পারেন!

কামাল বললো, অভ্যাস হয়ে গেছে।

শম্পা বললো, কেনো?

কামাল বললো, শৈশব থেকেই সবাই আমাকে খুব অবহেলা করতো! এখনো করে!

শম্পা বললো, আমি তো আপনাকে অবহেলা করছি না!

কামাল বললো, জানি।

 

শম্পা খানিকটা রাগই করে। বললো, জানেন! তারপরও আমার মনটা বুঝেন না?

কামাল বললো, বুঝি! আমার পাথুরে মন। প্রেম ভালোবাসা ওসব আমার জন্যে নয়।

শম্পা মুখ বাঁকিয়ে বললো, ও! আপনি হলেন মুণি ঋষি!

কামাল বললো, স্যরি! ওদের সাথে মেলাবে না।

শম্পা অভিমানী গলায় বললো, আমাকে আপনি কতটা জানেন? সেই ক্লাশ ফাইভে যখন পড়তাম, ঠিক তখন থেকেই দিনে দশটা লাভ লেটার পেতাম! আমি কাউকেই পাত্তা দিতাম না! আপনাকে নিজ হাতে রান্না করিয়ে খাওয়ানাটাই আমার ভুল হয়েছিলো!

 

কামাল কোন কথা বলে না। খানিকটা ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। শম্পা বললো, আমি তোমারই, আর কোথাও যাবো নাকো।

কামাল বললো, কবিতার কথা, গানের কলি। আমি ওসবে বিশ্বাসী না।

শম্পা বললো, তাহলে কি বিশ্বাস করো?

কামাল বললো, নিশ্চিত করে খাদ্য, বস্ত্র আর বাসস্থান।

শম্পা বললো, চিকিৎসারও দরকার আছে!

কামাল বললো, আমার দরকার নেই। আমি ডাক্তারদের প্রচণ্ড ঘৃণা করি।

শম্পা বললো, তুমি আসলেই অদ্ভুত! ডাক্তাররা অনেক মানুষের যানও বাঁচায়! আর তুমি ডাক্তারদের প্রচণ্ড ঘৃণা করো! তুমি কি সত্যিই কোন মানুষ?

কামাল বললো, সেই মানুষটাকেই তুমি খুব ভালোবাসো!

শম্পা বললো, হ্যা! বাসি বাসি! আমাকে একটিবার বুকে টেনে নেবে না?

 

শম্পার সেদিন কি হয় বুঝা যায় না। সে চেয়ারটা থেকে উঠে এসে কামালকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

কামাল বিড় বিড় করলো শুধু, না শম্পা! তুমি অবুঝ! আমার জন্যে এসব নয়।

শম্পা শুধু হু হু করে কাঁদতে থাকে।

কামাল শম্পার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, প্লীজ! আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না।

শম্পা কামাল এর বুক থেকে সরে গিয়ে বললো, না! কি নেই আমার?

 

পরদিন।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ঠিক রুটিনের মতোই ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলো, অন্যদের মতোই কামালও।

 

সকাল দশটার দিকে, হঠাৎই চারুকলা বিভাগের সামনে কেমন যেনো হৈ চৈ শুনতে পেলো। আশ্চর্য্য! রিজভীকে দুইটা ছেলে মিলে এক সংগে মারছে। ছেলে দুইটাকে খুব অপরিচিতই মনে হলো। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের সব ছাত্রছাত্রীদেরই তার চেনা। কামাল সেদিকটাতেই এগিয়ে গেলো। ছেলে দুইটাকে দুই দিকে চেপে বললো, এই! তোমরা কারা? ওকে মারছো কেনো?

 

একটা ছেলে কামালের কলার চেপে ধরে বললো, এই ব্যাটা! তুই কে?

অপর ছেলেটা বললো, যেই হউক, মার হালারে!

আর অমনিই মারতে থাকে দুজনেই কামালকে।

রিজভী চিৎকার করে উঠে, না ভাই! ওকে মেরো না! ও খুব সাধারন ছাত্র! ও কখনো রাজনীতী করে নাই! মারলে আমাকেই মারো!

 

কিছুক্ষণ পর আরো দুইটা ছেলে ছুটে আসে। বলতে থাকে, সব চালাকী! আগে মাইরা লা! তারপর বুঝা যাইবো, কোনটা সাধারন ছাত্র!

 

রিজভী পালাতে থাকে নিজ যান নিয়ে।

কলা ভবনের কোনা থেকে মিছিল বেড়োতে থাকে, ক্যাম্পাসে রক্ত কেনো? ভিসি তোমার জবাব চাই!

 

শম্পা মিছিলের শব্দ শুনে চারতলা থেকে উঁকি দেয়। অন্য বান্ধবীদের বলতে থাকলো, আবারো মারামারি? কে কাকে মারছে?

অঞ্জনা বললো, ওদিক থেকেও পাল্টা মিছিল আসছে। বোধ হয় একটা কিছু, চল আগে যে যার মতো করেই পালাই! একটা লাশ নাকি অলরেডী পরে গেছে!

শম্পা আহত হয়ে বললো, কার লাশ?

হোসনে আরা বললো, ওসব জেনে কাজ কি?

 

তারও পরদিন।

পত্রিকাতে ছোট্ট একটা সংবাদ আসে। বন্ধুদের বচসার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে মারামারি। একজন সাধারন ছাত্র নিহত।

 

ভোরে পত্রিকাটা আসতেই, হাতে তুলে নেয়। ইজী চেয়ারটায় বসে শম্পা পত্রিকাটা পড়ছিলো। পত্রিকাটা আর পড়তে ইচ্ছে করে না। ভাঁজ করে টিপয়ের উপর রাখে। তারপর দোলতে থাকে ইজী চেয়ারে। বিড় বিড় করেই শুধু বলে, নাহ! তুমি কোন সাধারন ছাত্র ছিলে না!

তারপর হু হু করে কাঁদতে থাকে শুধু।

শম্পার মা ডাকতে থাকে, কিরে শম্পা, নাস্তা রেডী করলাম তো!

শম্পা ইজী চেয়ারটা থামিয়ে কিছুক্ষণ পাথরের মূর্তির মতোই বসে থাকে। বিড় বিড় করতে থাকে শুধু, নাস্তা! অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান! সত্যিই তো! একজন ডাক্তার এর কত ক্ষমতা! স্বয়ং উপরওয়ালা যদি কারো জীবন নিয়ে যায়, পৃথিবীর কোন ডাক্তার কি তাকে বাঁচাতে পারে?

 

শম্পার মা আবারো ডাকতে থাকে, কিরে মা! ইউনিভার্সিটি যাবার সময় হয়ে এলো তো! আমারও সব জ্বালা! একটাও কথা শুনে না!

(সমাপ্ত)     

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান