কন্ঠশিল্পী সুমন হাফিজের সাথে একান্ত আলাপন
কন্ঠশিল্পী সুমন হাফিজের সাথে একান্ত আলাপন

সাহিত্য বার্তা : আপনার জীবনে সঙ্গীতের শুরুটা কেমন ভাবে হয়েছিল?

সুমন হাফিজ : সঙ্গীতে হাতেখড়ি সেই ছোট্টবেলায়। আমার বাবার কাছেই সঙ্গীতে সারেগামা দিয়ে হাতেখড়ি হয়েছে আমার। তখন আমার বয়স হবে ৫ বা ৬ বছর। আমার বাবার নাম আবুল কালাম মুহাম্মদ শামসুদ্দিন। তিনি ছিলেন বড়গাছী উচ্চ বিদ্যালয়ের (বর্তমানে সরকারি) প্রধান শিক্ষক। তিনি অত্রাঞ্চলের একজন মূলধারার সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব। পেশা হিসেবে সংগীত গ্রহন না করলেও শিল্পী হিসেবে তিনি ছিলেন অনন্য। অসম্ভব ভাল গাইতেন তিনি।

সাহিত্য বার্তা : ছোটবেলায় আপনার বেড়ে ওঠা ও শিক্ষা জীবন সম্পর্কে একটু বলেন।

সুমন হাফিজ : প্রকৃতপক্ষে আমি গ্রামের একজন মানুষ। গ্রামীণ জনপদ আমায় ভীষণ টানে। আমি যেখানেই থাকি আমার গ্রামের শিশু-কিশোরদের সাংস্কৃতিক বিকাশে সাধ্যমত কাজ করে যাই। আমার গ্রামের নাম বড়গাছী, যা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট উপজেলার অন্তর্গত ছোট সুন্দর একটি অঞ্চল। আমার নানার বাড়ি পাশেই রহনপুরে, যেখানে আমার জন্ম, ১৯৭৯ খৃস্টাব্দের ১১ আগস্টে। বড়গাছী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পেরিয়ে বড়গাছী উচ্চ বিদ্যালয়ে (বর্তমানে সরকারি) অস্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ি। তারপর রহনপুর এ.বি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি পাশ করে রহনপুর ইউসুফ আলী কলেজ যা বর্তমানে সরকারি, সেখান থেকে এইচ.এস.সি পাশ করি। এরপর সরকারি সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় (বর্তমানে বিশ^বিদ্যালয়) ঢাকা হতে বি.মিউজ এবং নজরুল সঙ্গীতে বি.মিউজ (সম্মান) ও এম.মিউজ সম্পন্ন করি শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি হতে। এছাড়াও দ্যা পিপুলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে আমি এম.বি.এ সম্পন্ন করি।

সাহিত্য বার্তা : পরিবারে কে কে আছেন? তাঁদের সম্পর্কে একটু বলুন।

সুমন হাফিজ : পরিবারে আছেন আমার মা মোসাঃ আনোয়ারা খাতুন। তিনি একজন গৃহিনী, আমার সাথেই থাকেন। মাঝে মাঝে আম্মা গ্রামের বাড়িতে যাতায়াত করেন। আমার একমাত্র সহোদর লিখন আবেদিন। সে বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। আমার সহধর্মিনী নাসরীন আফরোজা, সে একজন স্কুল শিক্ষক। আর আমার বাবা প্রয়াত হয়েছেন ২০১৫ সালে। তিনি ফুসফুস ক্যান্সারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। আমাদের ছোট্ট পরিবার বলতে পারেন।

সাহিত্য বার্তা : আপনার জীবনে সঙ্গীত ওস্তাদ বা শিক্ষক কে কে ছিলেন?

সুমন হাফিজ : একটু ছোট্ট করে বলি। ছোটবেলায় বাবার কাছে শুরু। রহনপুরে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখা শুরু করি মুকুল চন্দ্র শীল মতি দাদার কাছে। তারপর, ঢাকায় শিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন সময়ে যাঁদের পেয়েছি তাঁরা হলেন জনাব খালিদ হোসেন, শামীমা পারভীন, সাদী মহম্মদ, ড. মুশাররাত শবনম, লিলি ইসলাম, ড. হারুন অর রশীদ, রুবীনা আহমেদ মিলি, সুজিত মোস্তফা, মঙ্গল চন্দ্র, ড. লীনা তাপসী খান, ড. প্রদীপ নন্দী প্রমূখ। আমি সত্যিই গর্বিত আমার পরম শ্রদ্ধেয় এমন গুনী সকল শিক্ষকদের সান্নিধ্য পেয়ে।

সাহিত্য বার্তা : আপনি তো ছোটদের গান শেখান? সঙ্গীতে এদের আগ্রহ কেমন পাচ্ছেন?

সুমন হাফিজ : আসলে প্রতিটি শিশুই কোন না কোন প্রতিভা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। আমরা অভিভাবকরা অনেক সময় পড়ার চাপ বা অন্যান্য কারণে তাদের সেখান থেকে বঞ্চিত করি। আমরা অনেকে মনে করি ওগুলোর প্রয়োজন নেই। শুধু গান শেখা নয়, পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের কবিতা আবৃত্তি, অভিনয়, চিত্রাঙ্কন, বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখা, নৃত্যকলা ইত্যাদি শেখাটা জীবনের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। নিয়মিত খেলাধুলা করাও এর বাইরে নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। তাদের সাধ্যমত মানুষের মত মানুষ রূপে বড় করে তুলতে হবে আমাদের। তবেই আমরা জাতি হিসেবে আরো এগিয়ে যাব।

সাহিত্য বার্তা : যতটুকু জানি, গান গাওয়ার পাশাপাশি আপনি গান লেখেন ও সুর করেন। এ প্রসঙ্গে কিছু বলুন।

সুমন হাফিজ : আমি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে নজরুল সঙ্গীত ও আধুনিক গানের তালিকাভুক্ত ও নিয়মিত শিল্পী। প্রকৃতপক্ষে ছাত্রাবস্থায় থেকে আমি অনিয়মিতভাবে শখে গান লিখি ও সুর করি। ঘনিষ্ঠশিল্পীরা কেউ পছন্দ করলে আমার গান গেয়ে থাকেন। অনেক সময় আমি নিজেই সেগুলো গাই। এটা তেমন কিছু নয়। অনেক শিল্পীই এটা করে থাকেন। আশার কথা, আমার লেখা ও সুরের কিছু গান আছে যা বিভিন্ন শিল্পীর কন্ঠে রেকর্ড ও প্রকাশিত হয়েছে। এটা সত্যিই আমার জন্য আনন্দের বিষয়। উল্লেখ্য, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে কন্ঠশিল্পী শিমু দে’র কন্ঠে আমার লেখা ও সুরের দুটো গান প্রকাশিত হয়। ‘বাজুক প্রাণে বাংলা গান’ অ্যালবামটির সঙ্গীত আয়োজন করেন, প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক দূর্বাদল চট্টোপাধ্যায়। এ আমার এক পরম পাওয়া।

সাহিত্য বার্তা : আপনার কর্মজীবন সম্পর্কে জানতে চাই।

সুমন হাফিজ : সঙ্গীতের বাইরে আমার জীবন, এটা ভাবতেই পারিনা। আমি বর্তমানে শান্ত-মারিয়াম একাডেমি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’তে সঙ্গীত বিভাগের সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। পাশাপাশি গান শেখানো, গান লেখা, সুর সৃষ্টি করা, গান গাওয়া, মিউজিক ভিডিও নিয়ে কাজ করা, সঙ্গীতানুুষ্ঠান করা ইত্যাদি তো আছেই। আমি আসলে গানের সাথেই আছি, এর বাইরে তেমন কিছু করা হয়ে ওঠেনা।

সাহিত্য বার্তা : বর্তমানে আপনি কী নিয়ে ব্যাস্ত রয়েছেন?

সুমন হাফিজ : আমার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমি বর্তমানে শিশু-কিশোরসহ আগ্রহী সকলের জন্য সঙ্গীত শিক্ষামূলক অনলাইন স্কুল নিয়ে কাজ করছি। যেখান থেকে সঙ্গীত শিক্ষাগ্রহনে ইচ্ছুক সকলেই ফ্রি ভিডিও লেসন পাবে এবং ধারাবাহিকভাবে গান শিখতে পারবে।

সাহিত্য বার্তা : একটু বিস্তারিত বলুন।

সুমন হাফিজ : ভিডিওগুলো দেখে শিক্ষার্থীদের জন্য খুব সহজ হবে গান শেখা। শুধু তাদের ইউটিউবে যেতে হবে, ‘গানের পাঠশালা’ চ্যানেলটি সাবসক্রাইব করতে হবে। গানের পাঠশালায় আমরা সঙ্গীতের শুরু থেকে ক্রমান্বয়ে সরগম, ঠাট-রাগ, ছড়াগান, দেশগান, নজরুল সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত ইত্যাদি বিস্তারিত পরিবেশন করছি। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমরা শেখানে হাতে বাজিয়েও দেখাচ্ছি। এজন্য ফেসবুকে আমরা ‘গানের পাঠশালা’ নামে পেজ ও গ্রুপ করে রেখেছি। যেখানে শিক্ষার্থীরা সঙ্গীত বিষয়ক বিভিন্ন আলোচনা করতে পারবে। আমরা সেখানে আমাদের ধারাবাহিক লেকচারের লিংকও দিয়ে থাকি।

সাহিত্য বার্তা : আপনার প্রকাশনা সম্পর্কে বলুন।

সুমন হাফিজ : আমার প্রকাশনা তেমন বেশী নয়, একেবারে সামান্য। ১৯৯৪ এ প্রথম অডিও ক্যাসেট বাজারে আসে আমার কন্ঠে। যা ছিল ‘নজরুলের ইসলামী গান’ অডিও অ্যালবাম। চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের নিবেদন অ্যালবামটি বাজারে নিয়ে আসে। দ্বিতীয় অ্যালবামের নাম ছিল ‘যত স্বপ্ন ছিল’। ১৯৯৯ এর দিকে প্রকাশিত হয়। এটিও ক্যাসেট আকারে ছিল, একটি মিক্সড অ্যালবাম। ২০০৯ এ জলতরঙ্গ অডিও ভিজ্যুয়াল প্রকাশ করে নজরুলের হামদ ও নাতের অডিও অ্যালবাম ‘এলো রমজানেরই চাঁদ’। ২০১১ তে জলতরঙ্গ অডিও ভিজ্যুয়াল আবার প্রকাশ করে আধুনিক মৌলিক গানের অডিও অ্যালবাম ‘কোন একদিন’। সঙ্গীত পরিচালনা করেন আর, আজিজ টিটো ভাই। ২০১২ খৃস্টাব্দে ‘সপ্তসুর প্রডাকশন হাউজ’ প্রকাশ করে নজরুল সঙ্গীতের অডিও অ্যালবাম ‘আমারে দেবনা ভুলিতে’। সঙ্গীত পরিচালনা করেন তমাল হাসান। তারপর, ধিরেধিরে অডিও ইন্ডাস্ট্রি ডিজিটালাইজেশন হয়েছে। এখন গান প্রকাশ পায় ইউটিউব চ্যানেলে। আমিও তাই করি। নতুন নতুন গান হয়। আমার নিজের চ্যানেল বা অন্য চ্যানেলে প্রকাশিত হয়। এভাবেই চলছে...।

সাহিত্য বার্তা : আর লেখালেখি?

সুমন হাফিজ : আমি তেমন একটা লেখালেখি করিনা। একটা উপন্যাস লিখতে গিয়েছিলাম। সময়ের অভাবে শেষ করা যায়নি। শখে কবিতা লিখি অনিয়মিতভাবে। সেগুলো বিভিন্ন প্রত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তবে হ্যাঁ, ‘সঙ্গীতের সৃজনশীল ধারা ও অনুশীলন’ নামে আমার সম্পাদিত একটি সঙ্গীত শিক্ষামূলক গ্রন্থ ২০১২ তে বনলতা প্রকাশনি প্রকাশ করে, যা বেশ সমাদ্রিত এবং প্রথম সংস্করণ বাজারে শেষ হয়েছে। ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেয় দ্বিতীয় সংস্করণ করা হয়ে ওঠেনি এখনও। আর, গান তো লিখছিই।

সাহিত্য বার্তা : সাহিত্য বার্তার জন্য কিছু বলুন?

সুমন হাফিজ : সাহিত্য বার্তার কর্ণধার জনাব আরিফুল ইসলাম আমার ঘনিষ্ঠ জন, আত্মার আত্মিয়। সাহিত্যের বন্ধু। খুব সাহসী এক পছন্দনীয় ব্যাক্তিত্ব। সাহিত্য বার্তার পাঠকও নিশ্চয় বেশ নান্দনিকতায় বিশ্বাসী। আমি সর্বদা সাহিত্য বার্তার পাশে আছি ও থাকবো। সাহিত্যের প্রভাবে জীবন গান বেজে উঠুক প্রতিটি মানব কন্ঠে। ধন্যবাদ সাহিত্যবার্তার সকল পাঠককে।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান