খেজুর গাছির গপ্পো - বিশ্বজিৎ সেন
খেজুর গাছির গপ্পো - বিশ্বজিৎ সেন

চারিদিকে কুয়াশায় ঢাকা।

বিক্রম তার বাবার সাথে বাড়ি এসেছে। বোয়ালখালী উপজেলার উত্তর ভূর্ষি গ্রামের পূর্ব প্রান্তেই তাদের বাড়ি।

কাঠের দোতলা ঘর। মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বিভুতি রঞ্জন সেন বড় সখ করেই ঘরটা তৈরী করিয়েছিলেন জৈষ্ঠপুরার খ্যাতিমান কাঠমিস্ত্রি মদন কারিগরকে দিয়ে। বাড়ির পূর্বদিকে ধূ ধূ বিল। তারপরেই করলডাঙ্গার পাহাড়। বয়োবৃদ্ধরা একে সন্ন্যাসী পাহাড় নামেও উল্লেখ করেন। সেই পাহাড় তরঙ্গেরই একটা চূড়ায় শ্রী শ্রী চণ্ডী গ্রন্থে উল্লেখিত মেধস মুনির সেই আশ্রমটির অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান যেখানে নাকি মর্ত্যরে প্রথম দুর্গা পূজা করেছিলেন রাজা সুরথ ও সমাধি বৈস্য নামের দুইজন দেশহারা ও পরিবারছাড়া মানুষ।

বাবার মুখে বিক্রম বহুবার শুনেছে শীতকালে গ্রামের বাড়িতে রস রসের পিঠা ও খেজুর গাছির গল্প। বিশেষ করে সেই সে খেজুর গাছির কাহিনীটা তার খুব মনে ধরেছে। লোকটা নাকি খুবই ভালো ও সৎ মানুষ ছিল। শান বাঁধানো ঘাটে বসে রোদের অপেক্ষা করছে পিতাপুত্র। পুবের বিল ঢাকা পড়ে আছে ঘন কুয়াশায়। পাহাড় দেখা যাচ্ছেনা। পুকুরের পানি থেকে ধোঁয়া উঠছে। বাবা, চলোনা সেই খেজুর গাছির রস জ্বাল দেবার জায়গাটায়। 

বললো বিক্রম মুখ থেকে ব্রাশটা বের করে নিয়ে। দাঁত ব্রাশ করতে থাকা বাবা অট্টহাসি দিয়ে বলে ওঠেঃ সেই খাজুর্গ্যা কবে মরে গেছে বাবা। তার সেই বাসাটা ছিল ওই যে বড় পুকুরের পাড় দেখা যাচ্ছে ওই ওইখানটায়। বিক্রম হা করে পূর্ব দিকের কুয়াশায় আবছা দৃশ্যমান বড় পুকুরের উঁচু পাড়ের দিকে চেয়ে থাকে দাঁত ব্রাশ বন্ধ রেখে। তারপর প্রশ্ন করেঃ বাবা, খাজুর্গ্যা কি?

তাছাড়া এই গ্রামে তো বাড়ি থাকারই কথা, বাসা বলছো কেন? বাবা মুখ থেকে কিছু ফেনা ফেলে দিয়ে বলতে লাগলোঃ খাজুর্গ্যা হচ্ছে খেজুর গাছির চাটগাঁইয়া ভার্সন। হা হা হা হা হা ! বাহ্ মানে বাসা। তোমরা তো জন্মসূত্রে চাটগাঁইয়া হলেও ভাষাসূত্রে প্রমিতবাঙালি। বাসা শব্দটা ব্যবহার করেছি আমি শহরের বাসা বলতে যা বোঝায় সে অর্থে না। এখানে খাজুর্গ্যার বাহ্ বলে একটা নির্দিষ্ট ঠিকানাকে চিহ্নিত করা হয় যেখানে খেজুর গাছি তার খাজনার আওতার সবগাছ থেকে রসের হাঁড়িগুলো পেড়ে এনে জড়ো করে। বিশেষ ধরনের বিশাল একটা চুলা থাকে সেখানে আর থাকে রস জ্বাল দেবার জন্য আয়তাকার চেপ্টা চারদিকে পাড়তোলা বিশেষ ধরনের দু’চারটা পাত্র।

শুকনো ডাল পাতা স্তুপাকারে রাখা হয় সেখানে জ্বালাবার জন্য। মোটামুটি এটাকেই খাজুর্গ্যার বাহ্ বলা যায়। এখন ওই খাজুর্গ্যার বাহ্টা নেই কেন বাবা?

প্রশ্ন করে বিক্রম। কারণ এই এলাকার প্রায় অধিকাংশ খেজুর গাছই নুরুল হক মানে খাজুর্গ্যার মৃত্যুর পরে কোন এক অজ্ঞাত কারণে মারা যায়। কালেভদ্রে যাও দু’চারটা এখানে ওখানে চোখে পড়ে একজন খাজুর্গ্যার পক্ষে ওগুলোর রস বেচে বা গুড় বানিয়ে লাভ তোলা সম্ভব না। তবে ওই যে করলডাঙ্গা ওখানে নাকি এখনো একটা খাজুর্গ্যার বাহ্ টিকে আছে।

পরম আগ্রহে বলে গেল বাবা। বাবা, বলোনা, তোমরা ছোটবেলায় এমন শীত সকালে ওখানে মানে খাজুর্গ্যার বাহ্ গিয়ে কি করতে? এরই মধ্যে বাবা মুখ ধূয়ে নিচের ধাপ থেকে উপরের ধাপে উঠে এসেছে। ছেলের প্রশ্নে আবারো একটা কুকুরের তন্দ্রার ব্যাঘাৎ ঘটানো হাসি দিয়ে বলতে থাকে বাপঃ বাসায় যখন বলি তোমরা তো তখন মনে করো বানিয়ে গল্প বলছি। আসলে কিন্তু ব্যাপারটা তা না। আমার বলা কাহিনীগুলো বানানো গল্প না। আমার জীবন থেকে সযতেœ তুলে আনা সত্যিকারের নিরেট গপ্পো! এই যেমন যখন আমরা ক্লাশ ফোর ফাইভের ছাত্র ছিলাম তখন ওই নুরুল হক মানে খাজুর্গ্যার সাথে আমাদের দারুন এক টক মিষ্টি ঝাল সম্পর্ক ছিল। টক মিষ্টি ঝাল সম্পর্ক মানে? তার মানে সম্পর্কটা কখনো ভালো কিংবা খারাপে স্থির বা স্থায়ি থাকতো না। দিন ভেদে ভালো খারাপে ওঠা নামা করতো।

বড় পুকুরের পাড়ের দিকে তাকিয়ে বলে গেল বাবা। হা করে তাকিয়ে থাকে পুত বাপের মুখের দিকে। হাসিমুখে বলতে থাকে বাপঃ এত্ত বড় বাড়িতে এখন মানুষ আছে সাতজন। ঢাকা চট্টগ্রাম শহরে কম করে হলেও এ বাড়ির শতাধিক বাসিন্দা বাস করছে। তপ্ত রসের মৌ মৌ গন্ধ কি নাকে লাগছে? লাগছে না। অথচ আমাদের ছোট বেলায় কিন্তু এই বাড়িতেই প্রায় প্রতিদিনই বার ঘরের কোনটিতে না কোনটিতে রসের ডেক চুলোয় চড়তোই।

কিন্তু তাতে কি? আমরা কয়েকজন মিলে মা ঠাকু’মারা যাতে জানতে না পারে সেই ভাবে নাকে মুখে চাদর জড়িয়ে চলে যেতাম ওই যে ওই বড় পুকুরের পাড়ের সেই খাজুর্গ্যার বাহ্টায়। জ্বলন্ত চুলোর পাশে দাঁড়াতেই হাঁড় কাঁপানো শীত বাপ বাপ বলে কোথায় যে পালিয়ে যেত। মন ভালো থাকলে তেমন কিছু বলতো না কিন্তু কোন কারণে মনটা যদি তেতিয়ে থাকতো তো কী যে বিশ্রী ব্যবহার উপহার দিতে নুরুল হক! রেগে গিয়ে তোমরাও উল্টা পাল্টা কিছু বলতে না বাবা? কেনরে বাপ? ওটাতো তার জীবন জীবিকার উৎস। আমরা সেখানে অনধিকার আবদার খাটাতে যেতাম। অমন এক আধটু বিশ্রী ব্যবহার করলে আমাদের তেমন কিছুই যেত আসতো না। পাশেই ছিল একাধিক ছোট বড় কাঁঠাল গাছ। ও যখন গালমন্দ করতে থাকতো ততক্ষণ আমরা কাঁঠাল গাছের দাগমুক্ত পরিচ্ছন্ন বড় বড় পাতা খোঁজার কাছে ব্যস্ত থাকতাম! কাঁঠাল পাতা তো ছাগলের খাবার, তোমরা তা দিয়ে কি করতে বাবা?

বিস্মিত ছেলে প্রশ্ন করে। হো হো হো হো হো। বাবু, তখন তো ওইখানে আমাদের একমাত্র সম্বল ওই কাঁঠাল পাতাই। ওটাকে পানের খিলির মতো করে বানিয়ে হাতে নিয়ে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে যেতাম বড় কোন মাজারের প্রাঙ্গনের সিঁড়িতে দাঁড়ানো ফকিরদের মতো! ততক্ষণে অবশ্য নুরুল হকের মেজাজটা কেন জানি স্নেহে নাকি নিজের ছেলেদের কথা মনে করে ভিজে এক্কেবারে কোমল গান্ধার হয়ে যেত। তারপর লম্বা এক লাঠির আগায় গাথা নারিকেলের মালায় করে আমাদের প্রত্যেকের কাঁঠাল পাতার খিলিতে তপ্ত গুড়ের ফেনা ঢেলে দিয়ে যেত । গুড় কে চায়, ওই টুকু ফেনাই আমাদেরকে পরিতৃপ্ত ছাগলছানার মতো নাচিয়ে দিত। কুকুরের এঁটো চাটার মতো সেই কাঁঠাল পাতার খিলির গুড়ের ফেনা চেটে খেতে কী যে আনন্দ পেতাম বাপ্ কি করে তোকে বোঝাই। তখন হাঁড় কাঁপানো শীত আমাদের ছেড়ে নিজেই ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে শুরু করতো, হ্যাঁ।

বিক্রম হঠাৎ খেয়াল করলো যে, বাবার চোখে জল ছল ছল করছে। বাবা, তুমি কাঁদছো কেন?

না কই কাঁদছি নাতো। ভাবছিলাম ওই নুরুল হকের মানে খাজুর্গ্যার কথা। সেই কবে মরে গেছে। আর কী এক আশ্চর্য কাণ্ড সে মারা যাবার পরপরই কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমাদের এখানকার প্রায় সব খেজুর গাছই মরে গেল! যদি ওই খাজুর্গ্যার বাসাটায় এখনো কেউ রস জ্বাল দিয়ে গুড় বানাতো সত্যি করে বলো তো বাবা তুমি কি আমাকে এই মুহূর্তে ওখানে যেতে দিতে? ছেলের প্রশ্নের জবাবে বলতে থাকে বাবাঃ এখন যে যুগ তোমাকে যেতে দিলেও খাজুর্গ্যা যে এক ফোটাও গুড়ের ফেনা খেতে দিতো না তা আমি হলফ করে বলতে পারি বাবাজি। কেন তুমি ও কথা বলছো বাবা?

কৌতুহল নেভাতে চায় ছেলে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে থাকে বাবাঃ কারণ এখন সবখানে চলছে রাতারাতি ধনীলোক হওয়ার প্রতিযোগিতা। অবৈধ পথের আয় ছাড়া রাতারাতি কেউ ধনীলোক হতে পারেনা বা’জি। নুরুল হকের মতো বড় ও উদার মনের মানুষ এখন তেমন কোথাও আর নেই। ঠিক সেই মুহূর্তেই বাবার এক জ্ঞাতিকাকিমা ঘাটে এসে বললেনঃ বাপে পুতে এত কি কথা? ওদিকে গরম রসে চিতই পিঠা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।

অ নাতি, তাড়াতাড়ি মুখ ধূয়ে উঠে এসো। তোমার জন্য তোমার রাঙাকাকা সেই রাতভোরে করলডাঙ্গা গিয়ে দুই ঘড়া গাছ থেকে পাড়িয়ে রস নিয়ে এসেছে। অ ভাই তাড়াতাড়ি এসো। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে রসের পিঠার কোন মজাই পাবেনা নাতি। কথাগুলো বলেই অতি দ্রুত বিক্রমের এই জ্ঞাতিঠাকু’মা ঘাট ছেড়ে আবারও বাড়িরে ভিতরে চলে গেলেন। বাবাকে উদ্দেশ্য করে বিক্রম সিঁড়ির জলছোঁয়া ধাপে নেমে বলতে থাকেঃ না বাবা, এখনো বড় মনের সব মানুষই শেষ হয়ে যায়নি। নুরুল হক খাজুর্গ্যা মরে গেলেও এই এলাকার অনেক খেজুর গাছ তারই জন্য মরে গেছে আমার মনে হয় তাও ঠিক না।

আমাদের বাড়ির প্রায় সব ঘরই তালাবদ্ধ। তাই বলে মনে করা ঠিক হবেনা যে, বাংলাদেশের প্রত্যেক বাড়িরই ঠিক একই অবস্থা বাবা। নিভৃত পল্লীর পান্তা পিঠা রস গুড় এখন ঢাকা চট্টগ্রাম সহ দেশের সব ক’টি বড় বড় শহরে দাপটের সাথে ঠাঁই করে নিয়েছে। অভিজাত এলাকাগুলোতে পান্তা উৎসব পিঠা উৎসব হচ্ছে। আমার বিশ্বাস,বাংলাদেশের বুক থেকে কোন ঐতিয্যই কখনো হারিয়ে যাবেনা। জানো বাবা, গরম রস আর পিঠার কথা শুনে আমার শরীর থেকে সব শীত উড়ে গেছে। ইস্ এক ঘড়া রস যদি বাসায় নিয়ে যেতে পারতাম। পূর্বা আর মা দুজনেই বহুদিন পর রস খেতে পেয়ে আনন্দে নেচে উঠতো।

ঠিক সেই মুহূর্তেই কুয়াশার সামিয়ানা ভেদ করে রোদের প্রথম রশ্মিটা শান বাঁধানো ঘাটে এসে পড়লো! আনন্দের আতিশয্যে বলে ওঠে বাবাঃ শুভ রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকাল। মুখ ধোয়া বন্ধ রেখে বিক্রম সোজা দাঁড়িয়ে ক’ মুহূর্ত বাবাকে দেখে আবারও মুখ ধোয়ায় মন দিল। ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে সেই ঠাকু’মা উচ্চস্বরে ডাকলেনঃ অ নাতি সব ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে। তাড়াতাড়ি আয় অ ভাই। বিক্রম ততোধিক উচ্চস্বরে ঘোষণা করলোঃ ঠাম্মা, আসছি...


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান