দীর্ঘ সাক্ষাৎকার । মহিবুল আলম
দীর্ঘ সাক্ষাৎকার । মহিবুল আলম

মহিবুল আলম  একজন বহুমাত্রিক কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও প্রবাসী বাঙালি লেখক। তিনি ১৯৭০ সালের ১ জুলাই (সার্টিফিকেট অনুযায়ী) কুমিল্লার মুরাদনগরের কাজীবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত জন্ম তারিখ ১৯৬৯ সালের ১৯ জানুয়ারি। তাঁর পিতা ছিলেন বিশিষ্ট কবি ও কথাসাহিত্যিক কাজী এম. নুরুল আলম এবং মাতা বেগম কাজী সকিনা আলম।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাজীবন কুমিল্লাতেই সম্পন্ন করে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকালীন সময় ডিপ্লোমা ইন বিজনেস, কম্পিউটিং ও নার্সিং–এ উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন।

পেশাগত জীবনে তিনি সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি কুইন্সল্যান্ডে এনডিআইএস-এ কো-অর্ডিনেটর ও টিম লিডার হিসেবে কর্মরত।

মহিবুল আলমের লেখালেখির শুরু কলেজ ম্যাগাজিনে গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময় থেকেই তাঁর সাহিত্যচর্চার গতি বাড়ে। বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এরপর প্রবাসজীবনের নানা ঘাতপ্রতিঘাতে কিছু সময় লেখালেখি থেকে বিরত থাকলেও ২০১২ সালে ‘দীঘল মেঘের দেশে’ উপন্যাস দিয়ে সাহিত্যে পুনরাগমন ঘটান।

তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প, কিশোর সাহিত্য, কবিতা ও প্রবন্ধসহ সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় তাঁর বিচরণ ঘটিয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের সংখ্যা ২০টিরও বেশি। এর মধ্যে রয়েছে ‘তালপাতার পুথি’, ‘মায়াগন্ধা’, ‘ঈশ্বর’, ‘মানুষঘুড়ি’, ‘জোড়া সিঁথি নদীর তীরে’ ইত্যাদি। তাঁর রচনাবলি শুধু বাংলাদেশেই নয়, পশ্চিমবঙ্গেও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছে।

তিনি বাংলা একাডেমি তরুণ লেখক প্রকল্প পুরস্কার (১৯৯৮), প্রবাসী সাহিত্য সম্মাননা (নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া), এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠন থেকে একাধিক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

লেখালেখির পাশাপাশি তাঁর অন্যতম শখ হলো ভ্রমণ ও বাগান করা। বর্তমানে তিনি গোল্ড কোস্ট, অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন এবং নিজ হাতে গড়া দেশীয় গাছ-গাছালিতে ভরা বাগান তাঁর প্রিয় সময় কাটানোর জায়গা।

 

মহিবুল আলমের এর সাক্ষাকার গ্রহণে সাহিত্যবার্তার সম্পাদক আরিফুল ইসলাম ।

 

 

আরিফুল ইসলাম: প্রথমেই জানতে চাই কেমন আছেন প্রবাস জীবনে ?

মহিবুল আলমঃ প্রবাসজীবন হলো স্বপ্নপূরণ ও হাহাকারের গল্প। ভালো আছি। বেশ ভালো আছি। আবার পাশাপাশি হাহাকারও আছে। হাহাকার কী? ওই যে দেশের মাটি, অস্তিত্বের টান।

 

আরিফুল ইসলাম: আপনি মূলত গল্পের মানুষ। আপনার কাছ থেকে গল্পের কথা জানতে চাই। গল্প আসলে কী?

মহিবুল আলমঃ গল্প হলো একজন গল্পকারের বাস্তব ও কল্পনার মিশেল। এতে চরিত্র থাকবে। পটভূমি থাকবে। লেখকের দৃষ্টিকোণ থাকবে। একটা মেসেজও থাকবে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান যাই বলুন, গল্পে একটা মেসেজ বা বার্তা না থাকলে গল্পটা ফিকে হয়ে যায়। 

  

আরিফুল ইসলাম : আপনার গল্পকার হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছেন?

মহিবুল আলমঃ আমার বাবার কাছ থেকে। আমার বাবা কাজী এম নুরুল আলম কথাসাহিত্যিক, কবি ও নাট্যকার ছিলেন। তাঁর অনেকগুলো নাটক সেই ষাট-সত্তর দশকে তাঁর কর্মস্থল পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মঞ্চস্থ হয়েছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত সংসারের অভিভাবক হওয়া, নিজের ভাইবোন ও পাঁচটি সন্তানকে মানুষ করাতে গিয়ে তিনি নিজের প্রতিভাকে বেশিদূর টেনে নিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু বাবার সেই ছায়াটিই আমার মধ্যে এসে পড়েছে।

  

আরিফুল ইসলাম: প্রথম কোন গল্প লিখে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন?

মহিবুল আলমঃ আসলে সাহিত্যের জগতে আমার আসাটা হঠা করে। এটা সত্য, আমার বাবা যেহেতু সাহিত্যিক ছিলেন, ছোটবেলা থেকে একটা সাহিত্যের পরিমণ্ডলে বড় হয়েছি। শুধু বাবার লেখাই নয়, ছোটবেলা থেকেই গল্প-উপন্যাস প্রচুর পড়তাম। কিন্তু লেখক হবো, সেই চিন্তা কলেজ পড়া অব্ধি মাথায় আসেনি। কলেজে যখন পড়ি হঠা করেই একদিন আমার বন্ধু বলল, ‘মহিবুল, তুই গল্প লিখ’। সেই বন্ধু কলেজে পড়াকালীন কুমিল্লার সবুজ বাংলা পত্রিকায় লেখালেখি করত, মানে রিপোর্টার ছিল। সেই বন্ধুর নাম ছিল নোমানুল হক শহীদ। তাঁর অনুপ্ররণায় একদিন একটা গল্প লিখে ফেলি। গল্পটার নাম ছিল- ‘নিরুত্তর অবশেষ’।  সেই গল্প পড়ে নোমানের সে কী উচ্ছ্বাস! পরে গল্পটি আমাদের মুরাদনগর উপজেলার সবুজ সংঘ ক্লাবের বিজয় দিবসের বিশেষ সংখ্যা ‘রক্ত পলাশ’ ম্যাগাজিনে দিই। গল্পটি ছাপা হওয়ার পর সবাই খুব প্রশংসা করে। আমার বাবা তখন মৌলবীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের মনু নদী প্রোজেক্টে চাকরি করেন। তিনি বাড়িতে এসে গল্পটি পড়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে বলেন, ‘তোকে দিয়ে হবে...!’

  

আরিফুল ইসলাম: প্রথম গল্প ও সম্প্রতি লেখা গল্পের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান কী? একটু খুলে বলুন।

মহিবুল আলমঃ অবশ্যই পার্থক্য খুঁজে পাই। নিজেকে ভাঙচুরের মধ্যেই তো গল্পের সৃষ্টি হয়। অভিজ্ঞতা ও পরিপক্কতা তো আছেই। আছে দৃষ্টিভঙ্গি ও নির্মাণকৌশল। আবেগ ও আবেগের নিয়ন্ত্রণ। আমার প্রথমদিকের গল্পগুলো ছিল ভালোবাসা ও আবেগে ভরপুর। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেই আবার গল্পে ভাঙচুর শুরু হয়। সেই ভাঙচুর ও নির্মাণ নিয়ে সৃষ্টি করি পরপর কয়েকটি গল্প। যেমন- ‘উত্তর দুয়ারি, জলভাঙার পুরুষ, বর্ষাবান বা ভাঙাবাঁক। তারপরই তো প্রবাসজীবন। প্রথমে নিউজিল্যান্ডে প্রায় দেড়যুগ, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াতে প্রায় একযুগ। বর্তমানের লেখায় আবার আবেগ ভিড় করে বেশ। তবে টইটম্বুর আবেগ নয়, নিয়ন্ত্রিত আবেগ।  

 

আরিফুল ইসলাম: আপনার মতে, আজকের দুনিয়ায় একজন গল্পকারের জন্য বিশ্বসাহিত্য জানা কতটা জরুরি?

মহিবুল আলমঃ আমার মতে অনেক জরুরি। একজন লেখক লিখতে এসে বিশ্বসাহিত্য জানবে না, সেটা কীভাবে হয়? নিজের সমাজ বা নিজস্ব গণ্ডিটাই তো গণ্ডি নয়। বিশ্বসাহিত্য না জানলে লাটিন আমেরিকার ম্যাজিক রিয়েলিজম জানব কীভাবে? জাপানের মিনিমালিজম? আফ্রিকার গল্পগুলো আমাদের জানতে হবে না? খোদ ভারতবর্ষের এত ভাষা এত সংস্কৃতি, তাদের গল্পগুলো জানতে হবে না? হেমিংওয়ের সরল ও ছোট্ট পরিসরের বর্ণনা, মার্কেসের স্বপ্নঘেরা চিত্রকল্প, হারুকির বর্ণনায় কঠিন বান্তবতা, আরও কত কী! বিশ্বসাহিত্য পড়লেই তো একজন লেখক সচেতন হয়ে ওঠে। নিজেকে বোঝার জন্য হলেও একজন লেখককে বিশ্বসাহিত্য পড়তে হবে। 

 

আরিফুল ইসলামঃ আপনার লেখায় ‘ভূগোল’ কি শুধুই পটভূমি, নাকি তা চরিত্র ও কাহিনির বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো গঠন করে?

মহিবুল আলমঃ না, অবশ্যই না। বরং চরিত্র ও কাহিনির বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমার সবচেয়ে প্রিয় কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় গল্প ও উপন্যাসে নিম্নবিত্ত গ্রামবাংলার মানুষ যেভাবে উঠে এসেছে, যেমন হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, কবি বা চাঁপাডাঙার বউ। অপরাজেয় কথাশিল্পী শরচন্দ্রের গল্পের বর্ণনায় গ্রামবাংলার সহজাত আত্মীয়তা। এমনকি সমকালীন ইমদাদুল হক মিলনের ‘নূরজাহান’ উপন্যাসে যে গ্রামবাংলার মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টা উঠে এসেছে, এগুলো ভূগোলেরই অংশ। মার্কেস কি ভৌগোলিক বাস্তবতার মনস্তত্ত্বের চালক নন? এবার আমার কথা বলি। আমার লেখায়ও ভূগোল বাস্তবতার আলোকে প্রতীক হয়ে ওঠে। একটি দৃশ্যপট ও জীবন্ত জগত থাকে।   

 

আরিফুল ইসলামঃ প্রবাসে থেকে বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা—এটা কি এক ধরনের প্রতিরোধ? নাকি আত্মরক্ষার প্রয়াস?

মহিবুল আলমঃ নির্ভর করে পরিস্থিতি। এটা সত্য, প্রবাসে বাংলা সাহিত্য রচনা অনেক সময় একটি সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত প্রতিরোধ হয়ে ওঠে। যদিও এটা নিজের শেকড় ও পরিচয়ের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রকাশ। অন্যদিকে সাহিত্যচর্চা প্রবাসী মানুষের একান্ত মানসিক ও আত্মিক প্রতিফলন। নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংযোগ বজায়ে রাখার প্রয়োজনে আমরা প্রবাসে সাহিত্যকে আশ্রয় বা আত্মরক্ষা হিসেবে বেছে নিই। তবে আমার একান্তই অভিমত, প্রবাসে বসে বাংলা সাহিত্য রচনা একযোগে প্রতিরোধ ও আত্মরক্ষা। বলা যায় নতুন পরিবেশে নিজের পরিচয় হারিয়ে না ফেলার নিরলস প্রয়াস।

 

আরিফুল ইসলামঃ আপনি কি মনে করেন, প্রবাসী লেখকের সাহিত্য সবসময় “nostalgia- driven” হয়ে ওঠে? কীভাবে আপনি সেটি এড়িয়ে চলেন?

মহিবুল আলমঃ প্রবাসে বসবাস করে সাহিত্য রচনা অনেকসময় নস্টালজিয়া থেকে উদ্ভূত হলেও তা কেবলমাত্র সেই আবেগে আবদ্ধ থাকে না। একজনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, পরিচয় ও উপলব্ধির বহুমাত্রিকতা প্রকাশ পায়। সেখানে নস্টালজিয়া একটি অংশ মাত্র। এটাকে মানসিক আশ্রয়ও বলা যায়। আমি এটাকে পরিস্থিতি অনুযায়ী এড়িয়ে চলি, আবার পরিস্থিতি অনুযায়ী আগলে নিই।

 

আরিফুল ইসলামঃ ভাষার দুই খণ্ড—বাংলা ও আপনার প্রাত্যহিক বিদেশি ভাষা—এই দ্বৈততায় লেখার সময় কোনটি আপনাকে পরিচালিত করে?

মহিবুল আলমঃ দুটোই। ভাষাগত বাস্তবতা ও ভাষাগত আবেগ। অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের ভাষাগত বাস্তবতা হলো ইংরেজি। যেটা কার্যকরী ভাষা। আর আমাদের ভাষাগত আবেগ হলো বাংলা। আত্মিক ভাষা বা স্মৃতির ভাষা। আমার লেখায় বরাবর সেই প্রাত্যহিক ভাষা ও আত্মিক ভাষার সেতু তৈরি হয়। 

 

আরিফুল ইসলামঃ আপনার গল্পের চরিত্রদের কি দ্বিচারিত্রিক সংকট থাকে—একটা সংস্কৃতিতে বেঁচে থাকা, আরেকটার দিকে তাকিয়ে থাকা?

মহিবুল আলমঃ হ্যাঁ, গল্পের চরিত্রদের দ্বিচারিত্রিক সংকট তো থাকবেই। মানসিক ও নৈতিক টানপোড়েন, সামাজিক পরিচয়ের দ্বন্দ্ব ও চরিত্রের বিপরীতমুখী অবস্থান। একটি বাস্তব উদাহরণ, আমরা যেমন প্রবাসে বা পশ্চিমা সমাজে উদার, আবার একই ব্যক্তি নিজের ঘরে রক্ষণশীল। আমরা আসলে একটা বিদেশি সমাজে নিজের সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করি। একটা ধারণ করে আরেকটার দিকে তাকিয়ে থাকি।

  

আরিফুল ইসলামঃ প্রবাসজীবনের ‘অদৃশ্য বেদনা’ সাহিত্যে অনুবাদযোগ্য কি না, এ নিয়ে আপনি কী ভাবেন?

মহিবুল আলমঃ অবশ্যই, কেন না? শেকড় থেকে ছিন্ন হওয়া, নতুন সমাজে মানিয়ে নেওয়ার ক্লান্তি ও নিজের সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার ভয়, এগুলোই তো আমাদের আভ্যন্তরীণ স্বগত সংলাপ ও নিঃশব্দ আর্তির অনুবাদ।

 

আরিফুল ইসলামঃ আপনার উপন্যাস বা গল্পে ‘পরিচয়’—একটি ভাষিক, সামাজিক না রাজনৈতিক ধারণা?

মহিবুল আলমঃ তিনটাই। গল্প শুধু যোগাযোগ মাধ্যম নয়। এটি সংস্কৃতি, সমাজ, রাজনীতি ও সময়ের প্রতিফলন। গল্পের জন্য ভাষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি সাধারণ কাহিনিকেও ভাষা বুনন, শব্দ চয়ন ও শৈলীর গুণে অনন্য হয়ে ওঠে। আর গল্প সমাজেরই ছবি আঁকে। গল্পকার সমাজের সৌন্দর্য ও অসংগতি নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অনায়েসেই তুলে ধরতে পারে। আর একটা বিষয় মনে রেখো, প্রতিটি গল্পে সচেতনভাবে হোক আর অচেতনভাবেই হোক কোনো না কোনো রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করে।    

 

আরিফুল ইসলামঃ আপনি কি সচেতনভাবে নিজের লেখায় প্রবাসী ‘ট্যাগ’ এড়িয়ে চলেন, নাকি সেটাকে গ্রহণ করে এগিয়ে যান? কেন?

মহিবুল আলমঃ একটা কথা বলি, প্রবাসী হওয়া মানে শুধু ভৌগলিক স্থানান্তর নয়, বরং তা একধরনের মনস্তাত্ত্বিক অভিযাত্রা। আমি দুটি জগতকে ধারণ করেই এগিয়ে যাই। তুমি জিজ্ঞেস করছ, কেন? আমি বলি, আমি লেখক। বাদ দাও, লেখক। আমি মানুষ হিসেবেই নিজেকে প্রবাসী হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছি। জীবনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছি। আবার প্রবাসে থেকে মন পড়ে থাকে দেশে। নিজের সন্তানদের ভবিষ্য গড়তে অস্ট্রেলিয়া এসেছি, কিন্তু দেশে গেলে, গ্রামের বাড়িতে পা ফেললে মাটির গন্ধে ভেতরটা কেঁপে ওঠে। নিজেকে নিয়ে হয়তো মাঝেমধ্যে মনের ভেতর দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। কিন্তু বিচ্ছিন্নতা ও সংযুক্তি তো জীবনেরই প্রতিটা মানুষের জীবনেরই অংশ যে…! 

 

আরিফুল ইসলামঃ দেশের পাঠক ও প্রবাসী পাঠকের গ্রহণক্ষমতা ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আপনি কী মৌলিক পার্থক্য দেখেন?

মহিবুল আলমঃ হ্যাঁ, দেখি। দেশের পাঠক সরাসরি সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি- এ সবকিছুর মধ্যে বসবাস করে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবকেন্দ্রিক। আর প্রবাসী পাঠক নস্টালজিক, আবেগতাড়িত ও দূরদৃষ্টিকেন্দ্রিক। যেমন একটি উদাহরণ দিই। একটি গ্রামের ডোবায় বা জলায় পাটগাছ পচার গন্ধের বর্ণনা দিলে দেশের পাঠক পাশ থেকেই তা অনুভব করবে। অনেক সময় নাক সিটকাবে। কিন্তু প্রবাসী পাঠক হাহাকার নিয়ে বলবে, ‘আহা, কতকাল সেই পাটগাছ পচার গন্ধ পাই না…!’  

 

আরিফুল ইসলামঃ প্রবাসী লেখকদের মধ্যে কি এক ধরনের ‘অন্তর্মুখী একাকীত্ব’ কাজ করে সাহিত্য নির্মাণে?

মহিবুল আলমঃ অবশ্যই করে। এটাই স্বাভাবিক, তাই না? ভাষার দূরত্ব, সাংস্কৃতিক টানপোড়েন, চেনা জগতের অভাব ও নিজের শেকড়ের সন্ধান। তবে এই একাকীত্ব থেকেই লেখকের দুর্দান্ত সাহিত্য সৃষ্টি হয় ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি তৈরি করে।   

 

আরিফুল ইসলামঃ আপনি যখন বিদেশে জন্ম নেওয়া বা বড় হওয়া বাঙালিদের চরিত্র লেখেন, তখন ভাষা ও মননের টানাপড়েন কীভাবে নির্মাণ করেন?

মহিবুল আলমঃ শোনো, প্রবাস হলো দ্বৈতজীবনের প্রতিফলন। একটি ব্যক্তির ভেতর দুটো সত্তা পাশাপাশি হেঁটে যায়। তাই তাদের নিয়ে লিখতে গেলে ভাষাটা হয়ে ওঠে মনন ও স্মৃতির টানপোড়েন। তবে এই ভাষা ও মননের টানপোড়েনে বিদেশি বাঙালি চরিত্রটা হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক।  

 

আরিফুল ইসলামঃ আপনার মতে, প্রবাসী সাহিত্য কি জাতীয় সাহিত্যের অংশ নাকি একটি স্বাধীন ক্যানন তৈরি করছে?

মহিবুল আলমঃ সুন্দর প্রশ্ন করেছ। উত্তরটা একরৈখিক নয়। এক অর্থে আমি বলব, ভাষাগত সংযোগ, স্মৃতি ও শেকড়ের টান, সংস্কৃতি ও পরিচয় প্রবাসী সাহিত্য জাতীয় সাহিত্যেরই নিরবিচ্ছিন্ন প্রবাহ। আবার অন্য অর্থে স্বাধীন ক্যানন। কারণ, ডায়াস্পোরিক বোধ ভাষা, সংস্কৃতি, পরিচয় ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় সংমিশ্রণ তৈরি করে। তবে এ দুটোকে যদি একত্রে করতে চাও তাহলে বলব, প্রবাসী সাহিত্য একদিকে জাতীয়তার ছায়া, অন্যদিকে বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতার আলোক।

 

আরিফুল ইসলামঃ আপনার লেখায় স্থানান্তর (displacement) কেবল ভৌগোলিক না কি অস্তিত্বগতও?

মহিবুল আলমঃ দুটোই। স্থানান্তরটা শুরু হয় ভৌগলিক, কিন্তু শেষপর্যন্ত গভীর অস্তিত্বগত হয়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই নিজের দ্বৈত সত্তার সাহিত্যিক পরিচয় গড়ে উঠে।

 

আরিফুল ইসলামঃ দেশের রাজনীতি ও ইতিহাস আপনার লেখায় কতটা ঢুকে পড়ে, আপনি প্রবাসে থাকলেও?

মহিবুল আলমঃ হ্যাঁ, খুবই, শক্তিশালীভাবে ঢুকে পড়ে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ইতিহাসের গ্লানি বা মুক্তিযুদ্ধের বীরগাথা। পাশাপাশি শেকড়ের টান তো আছেই। একটা কথা বলি, দেশের ভেতর থেকে রাজনীতি দেখা আর প্রবাসে বসে দেশের রাজনীতি দেখা এক নয়। এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রবাসে বসে আমরা নিরপেক্ষ ও নির্মোহভাবে দেশের রাজনীতি ও ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করতে পারি। 

 

আরিফুল ইসলামঃ আপনার গল্পে যেসব দেশীয় স্মৃতি ফিরে আসে, সেগুলো কি একধরনের নির্মিত স্মৃতি (constructed memory)?

মহিবুল আলমঃ হ্যাঁ, অনেকাংশেই। তবে সেই স্মৃতিগুলো পুনর্গঠিত ও নতুন রং করা স্মৃতি। এই রঙগুলো আবেগের রং। এই রঙগুলো জীবনের আলোছায়ার। এই রঙগুলো শেকড়কে জাগিয়ে তোলার। তোমাকে একটা কথা বলব। ডায়াস্পোরিক আলোকে। স্মৃতি কোনো একক মুহূর্ত নয়, সময়ের সঙ্গে ভেসে ওঠা বাস্তবের বহু অভিজ্ঞতা। স্মৃতি হলো সত্য হয়ে ওঠা নির্মাণ।  

 

আরিফুল ইসলামঃ প্রবাসে থেকে বাংলা সাহিত্যে ‘লোকজ’ উপাদান ব্যবহার কি কৃত্রিম হয়ে পড়ে বলে আপনার মনে হয়?

মহিবুল আলমঃ তা নির্ভর করে কীভাবে ব্যবহার করছি আমি। লোকজ উপাদান কি আমি এক্সোটিক দেখানোর জন্য ব্যবহার করছি? নাকি নস্টালজিক অলংকার হিসেবে? নাকি আত্মপরিচয়ের খোঁজে? তবে আমি বলব, প্রবাসে থেকে লেখায় লোকজ উপাদান ব্যবহার করা কৃত্রিম নয়, আরো গভীরতর হতে পারে। লেখকের ভেতর লোকজ যত জীবিত, লেখাও তত মৌলিক হয়। আত্মার দরকারি হয়ে ওঠে।   

 

আরিফুল ইসলামঃ আপনার সাহিত্যিক চিন্তায় ‘ঘর’ মানে কী? তা কি একটি স্থান, একটি সময় না একটি মানসিক অবস্থা?

মহিবুল আলমঃ ‘ঘর’ মানে হলো শারীরিক বসবাস নয়, মানসিক অবস্থান। হারিয়ে ফেলা শিশুকালের পথ, মায়ের হাতের পিটুনি ও সোঁদা মাটির গন্ধ। ঘর মানে আভ্যন্তরীণ ঠিকানা। একটি কল্পনার নির্মিত আশ্রয়। ঘর মানে ফেলে আসা প্রথম প্রেমিকার প্রথম হাসি।

 

আরিফুল ইসলামঃ একজন লেখক যখন দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকেন, তখন কি তাঁর লেখায় আত্মজৈবনিকতা বেড়ে যায়? আপনি নিজে কী অনুভব করেন?

মহিবুল আলমঃ হ্যাঁ, তবে সরাসরি আত্মজীবনী নয়, স্মৃতিমূলক সাহিত্য বা পরিচয় অন্বেষার সাহিত্য হয়ে ওঠে। সেটা পরিচয় সংকটে লেখককে নিজের ভেতর টেনে নেয়। আমার মধ্যেও তা ব্যতিক্রম নয়। ওই যে খানিকক্ষণ আগে বলছিলাম, লেখার স্থানান্তর? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে নিজের জীবনের আয়না।

 

আরিফুল ইসলামঃ আপনার মতে, প্রবাসী সাহিত্য ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্যের কাঠামো কতটা বদলে দিতে পারে?

মহিবুল আলমঃ অনেকটাই। নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, ভূগোল বিস্তার ও নতুন আত্মপরিচয়। বাংলা ভাষা পায় বিশ্বজনীন বহুস্তরীয় স্বর। অনুভবের বিস্তর বহুভাষিক অনুবাদ হয়। নতুন ক্যানন গঠন করে তোলে।  

 

আরিফুল ইসলামঃ আপনার উপন্যাসে রাজনীতি যখন আসে, সেটা কি কাহিনির দাবি থেকে আসে, না আপনার ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে?

মহিবুল আলমঃ আমি বলব, দুটোই। কাহিনির অন্তর্গত দাবি থেকে। আমাদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক চেতনা, অবস্থান ও অভিজ্ঞতা থেকেও। একটা কথা বলি তোমাকে, রাজনীতি ও ইতিহাস গল্প বা উপন্যাসে ঢোকে, কারণ সমাজ ও সমাজের বাস্তবতা আর ইতিহাস লেখককে কখনই ছাড়ে না। বরং অবিচ্ছেদ্য করে তোলে। 

 

আরিফুল ইসলামঃ রাজনীতি কি কেবল ক্ষমতার প্রশ্ন, না কি ভাষা, ইতিহাস, পরিচয়—সব কিছুর ভেতরে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে?

মহিবুল আলমঃ রাজনীতি ক্ষমতার প্রশ্ন তো বটেই, কিন্তু সেটা দখল বা কর্তৃত্বের প্রশ্ন নয়। রাজনীতি অবশ্যই গভীরভাবে ভাষা, ইতিহাস ও পরিচয়ের সঙ্গে জড়িত। রাজনীতি মানে শুধু ভোট নয়। রাজনীতি মানে ভাষার ভেতর লড়াই। ইতিহাসের ভেতর লড়াই। প্রতিটি নাগরিকের পরিচয়কে নতুন করে নির্মাণের লড়াই।   

 

আরিফুল ইসলামঃ আপনি কি আদর্শগত রাজনীতিকে সাহিত্যে আনার পক্ষপাতী, না বিমূর্ত রাজনৈতিক সংকটকে তুলে ধরেন বেশি? কেন?

মহিবুল আলমঃ সাহিত্যে আদর্শগত রাজনীতি ও বিমূর্ত রাজনৈতিক সংকট- দুটোই গুরুত্বপুর্ণ। দুটোই তুলে ধরি। আদর্শগত রাজনীতি আমাকে দিক নির্দেশ দেয়। আমার অবস্থান জানায়। আমাকে ভাবায়, আমি কাদের পাশে আছি ও কোন মতাদর্শ অবলম্বন করছি। সমাজ বা রাষ্ট্রকে কেন চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি। আর বিমূর্ত রাজনৈতিক সংকট আমার লেখাকে গভীরতার দিকে নিয়ে যায়। যা পাঠককে ভাবায়। ইতিহাসের ছায়া হয়। লেখায় আদর্শকে মৌলক রূপ দেয় ও গভীর সংকট চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। 

 

আরিফুল ইসলামঃ একটি গল্প বা উপন্যাসে রাজনৈতিক সময় ও ইতিহাস কীভাবে চরিত্রের মনস্তত্ত্ব গড়ে তোলে বলে আপনি মনে করেন?

মহিবুল আলমঃ সুন্দর প্রশ্ন। গল্প বা উপন্যাসের চরিত্র সৃষ্টি তো কেবল যুক্তি নির্ভর নয়, সেটা ইতিহাসে ছায়া ও সময়ের প্রতিনিধি। কীভাবে মানুষ একটি জাতি, ধর্ম, ভাষা ও শ্রেণীতে নিজেকে আবিষ্কার করে। কীভাবে একটি চরিত্র সময়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। রাজনীতি ও ইতিহাস কি কোনো বাইরের বিষয়? নাহ, মোটেও না। একটি চরিত্রের ভেতরেই ভালোবাসা ও প্রতিবাদের নিঃশাব্দিক ভাষা সৃষ্টি করে।

 

আরিফুল ইসলামঃ আপনি কি বিশ্বাস করেন, সাহিত্য মানুষের রাজনৈতিক চেতনায় কার্যকর কোনো পরিবর্তন আনতে পারে?

মহিবুল আলমঃ তোমার এই প্রশ্নটা কিন্তু বহু বিতর্কের। তবে এক কথায় বললে, সাহিত্য মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনায় তাক্ষণিক বিপ্লব না আনলেও মানুষকে প্রশ্ন করে শেখায়। ভাবতে বাধ্য করে। মানুষের অবচেতন মনে চেতনা ঢুকিয়ে দেয়। আমি মনে করি সাহিত্য হলো রাজনীতিতে ভাষাহীনদের ভাষা, রূপক চ্যালেঞ্জ, পরিবর্তনের ছায়াবৃক্ষ।

 

আরিফুল ইসলামঃ আপনি কি মনে করেন, বাংলা কথাসাহিত্য এখনো বিশ্বসাহিত্যের প্রধান প্রবণতাগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে? না কিছুটা পিছিয়ে আছে?

মহিবুল আলমঃ আমি বলব, বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের প্রবনতার সঙ্গে খুব একটা পিছিয়ে নেই, আবার পুরোপুরি তাল মিলিয়েও চলছে না। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বসাহিত্যের ধারায় সমান শক্তিশালী। কিছু প্রবনতায় আত্মগর্ভ ও বৃত্তবন্দী। তবে বাংলা সাহিত্যের নিজস্ব একটা স্বর আছে।  

 

আরিফুল ইসলামঃ আপনার অনেক ধন্যবাদ সাহিত্যবার্তাকে সময় দেবার জন্য ।

মহিবুল আলমঃ তোমাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান