নাটক ধ্বংসে চ্যানেলগুলোকে দায়ী করলেন শিল্পীরা
নাটক ধ্বংসে চ্যানেলগুলোকে দায়ী করলেন শিল্পীরা

দেশের টিভি নাটকের মানের অবনতির জন্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দায়ী। মান নিয়ন্ত্রণ না করেই নাটকগুলো চালাচ্ছে তারা। এ অভিযোগ করলেন অভিনয়শিল্পীরা। তাঁরা বলছেন, চ্যানেলগুলো কম পয়সায় পচা আলু কিনে খাওয়াচ্ছে দর্শকদের।

আজ শুক্রবার বিকেলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালা মিলনায়তনে এক সেমিনারে মুক্ত আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। সেমিনারে ‘পেশাদারিত্বের সংকটে দেশের টেলিভিশন নাটক ও অভিনয়শিল্প’ শীর্ষক প্রবন্ধ পড়েন অভিনয় শিল্পী সংঘের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রওনক হাসান। এ নিয়ে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন অভিনয়শিল্পীরা।

শিল্পীরা বলেন, নাটকের মান খারাপ হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ শিল্পী ও নির্মাতাদের অপেশাদারি মনোভাব। দেশে নির্মিত ৮০ শতাংশ নাটক গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। এর ফলে দেশের দর্শক বেশির ভাগ সময় কাটাচ্ছেন ভারতীয় বাংলা চ্যানেলগুলোতে। দেশি টিভিগুলো পরিচালকদের কম বাজেটে নাটক বানাতে বাধ্য করছে। বাজেট কম থাকায় সেসব নাটকে শিল্পী থাকছেন কম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপেশাদার কলাকুশলী দিয়ে করিয়ে নেওয়ার কারণে কাজ খারাপ হচ্ছে। এমনকি যথেষ্ট বাজেট না থাকায় ভালো চিত্রনাট্য দিয়েও নাটক করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় অনেকে এ পেশা থেকে সরে যাচ্ছেন।

প্রবন্ধে টিভি নাটকের আজকের এই অবস্থার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে টেলিভিশন ও টেলিভিশন নাটককে শিল্প ঘোষণা না করা, সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাব, নাটকের মান নিয়ন্ত্রণে চ্যানেলের ব্যর্থতা কিংবা উদাসীনতা, মধ্যস্বত্বভোগীদের হস্তক্ষেপ, নাটকের মূল্য কমে যাওয়া, নাটকে চরিত্রাভিনেতাদের হারিয়ে যাওয়াকে। এ ছাড়া ত্রিপক্ষীয় চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া, নির্মাণে নিম্নমুখী প্রতিযোগিতা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবকেও একইভাবে দায়ী করা হয়েছে।

মুক্ত আলোচনায় অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম বলেন, ‘এতগুলো টেলিভিশন চ্যানেলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, অথচ এগুলোতে কী চলবে আর কী চলবে না, সে বিষয়ে কোনো নীতিমালা নেই। এর দায় কর্তৃপক্ষের। সবাইকে কেন টেলিভিশন চ্যানেল খোলার অনুমতি দিতে হবে? অন্যদিকে আমরা অভিনয়শিল্পীরা নিজেকে দক্ষ করে তোলার বদলে একে অন্যকে দোষারোপ করছি আর ভিখিরির মনোভাব নিয়ে টিভি কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দিচ্ছি। মন্দের ভালো খুঁজতে খুঁজতে আমরা মন্দের ভেতরে ডুবে গেছি।’

অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘চ্যানেল বা এজেন্সির লেজুড়বৃত্তি না করে নিজেদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত একজনও কাজ করব না, সে রকম মনোভাব থাকতে হবে। নিজেদের শিরদাঁড়া টানটান করে কাজ করতে হবে।’

মোশাররফ করিম বলেন, ‘অনেক কাজ করলেও আমি আসলে তৃপ্ত নই। অনেক টাকা রোজগার করি, কিন্তু সেটা একটা ভালো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে করতে চাই। নাটকের পেছনে যারা কাজ করছে, তাদের যথাযথ সম্মানী দিতে হবে। আর এ জন্য নাটকের বাজেট বাড়াতে হবে।’

আফরোজা বানু বলেন, ‘যখনই শুটিংয়ে ডাকবে, তখনই হাজির হওয়া যাবে না। আমাদের কাজের একটি নির্দিষ্ট সময় থাকতে হবে। সাপ্তাহিক ছুটি থাকতে হবে। পরিবারকে সময় না দিলে পরিবার টেকানো সম্ভব নয়।’

নাট্যকার বৃন্দাবন দাস বলেন, ‘আমি শখের অভিনেতা। নাটক লেখাকে পেশা হিসেবে নিয়ে একটা গ্লানিকর অবস্থায় পৌঁছে গেছি। প্রায়ই মনে হয় পেশা বদলাই। সবাইকে ভাবতে হবে যে এ রকম অনুভূতি একদিন সবারই হবে। তাই আমাদের এখনই ঘুরে দাঁড়াতে হবে।’

অভিনয় ছেড়ে অনুষ্ঠান উপস্থাপনাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন শাহরিয়ার নাজিম জয়। তিনি বলেন, ‘অভিনয় করে যে টাকা আয় করতাম, তার থেকে এখন অনেক বেশি টাকা রোজগার করি। কিন্তু মন পড়ে থাকে অভিনয়ে।’ তিনি বলেন, অভিনয়শিল্পীদের আজকের এ অবস্থা বদলাতে টেলিভিশনের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। ভেবে দেখতে হবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের কথা। সেখানে অনেক বাজেট নিয়ে অপেক্ষা করছেন উদ্যোক্তারা।

বিজ্ঞাপন-বাণিজ্য প্রসঙ্গে প্রবন্ধে বলা হয়েছে, পে চ্যানেল না হওয়ায় বিজ্ঞাপন থেকে পাওয়া টাকাই চ্যানেলের আয়ের মূল উত্স। একসময় মান ও জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে চ্যানেলের অনুষ্ঠানগুলোতে নির্দিষ্ট মাত্রায় বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো। এখন অধিকাংশ চ্যানেলে সম্পর্ক এবং যোগাযোগের ভিত্তিতে বিজ্ঞাপন বরাদ্দ হয়। কোনো অনুষ্ঠান জনপ্রিয় হলে সেই অনুষ্ঠানের মাঝখানে অসহনীয় মাত্রায় বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। তখন দর্শক বিরক্ত হয়ে অন্য চ্যানেলে চলে যান।

টিআরপি প্রসঙ্গে বক্তারা বলেন, সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষের রুচির ওপর ভিত্তি করে টেলিভিশনের টিআরপি নির্ধারণ করা হচ্ছে। মাত্র এক থেকে দেড় হাজার টিভি সেটে বসানো বক্স থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে টিআরপি নির্ধারিত হচ্ছে। এক-দেড় হাজার মানুষের রুচির পরিসংখ্যান দিয়ে বিচার করা হচ্ছে ১৭ কোটি মানুষের রুচি। বিষয়টি ভয়াবহ ও হাস্যকর। কিন্তু টিভি চ্যানেলগুলো বিচিত্র কারণে এই পরিসংখ্যানের ওপরই গুরুত্ব দিচ্ছে।

প্রবন্ধে টিভি নাটকের আজকের এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে নাটকের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ, বাজেট বৃদ্ধি, শিল্পী নির্বাচনে পরিচালকদের স্বাধীনতা, পে চ্যানেল বাস্তবায়ন, বিদেশি অনুষ্ঠান আমদানি ও প্রচারের নীতিমালা সংস্কারসহ বেশ কিছু প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।

সেমিনারে অভিনয়শিল্পীরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সংশ্লিষ্ট চারটি সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন জ্যেষ্ঠ অভিনেতা আবুল হায়াত ও এনামুল হক, টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মামুনুর রশীদ, নাট্যকার সংঘের সভাপতি মাসুম রেজা, সেক্রেটারি জেনারেল এজাজ মুন্না, ডিরেক্টরস গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক এস এ হক অলিক, অভিনয় শিল্পী সংঘের সভাপতি শহিদুল আলম সাচ্চু, সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবীব নাসিম প্রমুখ।

আহসান হাবীব নাসিম জানান, সেমিনার থেকে পাওয়া প্রস্তাবগুলো নিয়ে ১৫ দিনের মধ্যে আবারও আলোচনায় বসবেন তাঁরা। উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, সেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সূত্র: প্রথম আলো ।

সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান