প্রদীপ আচা‌র্য'র তিনটি অণুগল্প
প্রদীপ আচা‌র্য'র  তিনটি অণুগল্প
সুর মু‌ছে দি‌তে এক‌টি তির

প্রভাতের প্রথম আলো পুরোনো বটগাছটার মাথায় ছড়িয়ে পড়ে ধী‌রে। কিচির মিচির সুর তু‌লে কুমুদ্বতী, ছন্দোবতী, রক্তিকা, প্রীতিসহ আরো অনেকে উড়ে এসে বসে বটগাছের একেকটি ডালে। রোহিনী খেয়াল করে তা‌দের কারও চোখে-মুখেই আজ উচ্ছলতা নেই। রোহিনী ক'দিন স্কুলে আসেনি। সবার ম‌লিন মুখ কেন, জিজ্ঞেস করতেই প্রীতি বলে, গতকাল এখানে একদল লোক এ‌সে‌ছিল। কী সব মাপ‌জোক করছিল আর বলছিল, জঙ্গল কেটে সাফ করা হবে। কাটা হবে গাছ। এ পথে নাকি বড় পাকা এক রাস্তা হবে।
করুণা বলে, আমাদের কথা কেউ ভাব‌তে চায় না, ভা‌বে না!
এমন সময় উঠে এসে গাছের ডালে বসে মুসিকার। বয়সের ভারে ক্লান্ত। আগের মতো পাখায় জোর নেই । উড়তে কষ্ট হয়। তবু শেষ ক্ষণ পর্যন্ত অসংখ‌্য বাধা ডিঙিয়ে সে শিষ্যদের কা‌ছে ছ‌ড়ি‌য়ে দেয় সংগীতের একেকটি পাঠ। এই তো ক’দিন আগে কেউ জঙ্গ‌লের ভেতর এ‌সে তাদের স্কুলটি ভেঙে দি‌য়ে‌ছিল। মুসিকার গি‌য়ে সদার্রের কাছে নালিশ জানা‌লেও লাভ হয়নি কিছুই। জীবনের অভিজ্ঞতা মুসিকারকে শঙ্কা লুকি‌য়ে কৌশলী হ‌তে শি‌খি‌য়ে‌ছে। কিন্তু আজ শিষ্যদের চোখে-মুখে যে শঙ্কা দেখছে তাকে কীভাবে দূর করবে সে! প্রভাতের আলো ক্রমশ উজ্জ্বল হতে থাকে, চারপাশের গুনগুনানি কমে স্থির নিরবতা ভর করে বটগাটের চারপাশে। মুসিকার শুরু করে সংগীতের পাঠ। আজ সে শেখাবে পঞ্চম স্বর। মুসিকার শিষ্যদের বলে, এটি শুদ্ধ অর্থে পবিত্র স্বর। এ স্বরকে তার নি‌র্দিষ্ট স্থান থেকে কখনো বিচ্যুত বা বিকৃত করা যায় না।
শিষ্যদের চোখ মুসিকারের মুখের দিকে। সূর্যের জ্যোতি বটবৃক্ষের পাতা ভেদ করে মুসিকারের মুখে এসে পড়ে। কী এক নির্মলতা ভর ক‌রে সেখা‌নে। হঠাৎ একটি তির এসে তীব্রভাবে গেঁথে যায় মুসিকারের বুকে। গাছের উঁচু ডাল থেকে মুসিকার মূহুর্তে শূন্যে ভা‌সে, নিচে না‌ম‌তে থা‌কে হাওয়ার পা‌লে ভর ক‌রে। মুসিকারের বুক থেকে ঝরা রক্ত শক্ত মাটিকে কোমল করে তো‌লে। প্রাণটুকু বেরিয়ে যাওয়ার আগে মুসিকার শিষ্যদের বলে, তোমাদের যে সুর দিয়ে গেলাম তাকে জা‌গি‌য়ে রেখ জীবনময়...
দূর থেকে ট্র্যাক্ট‌রের শব্দ ক্রমশ এ‌গি‌য়ে অা‌সে। মুসিকার এর নিথর দেহকে ঘিরে থাকা শিষ্যরা খেয়াল করে, বুকে গেঁথে যাওয়া তিরে একটি পশম লেগে আছে, শেয়ালের...

অনাহুত আগামী

সুরুজের মুখ, নাক, কান, চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরে। পরিষ্কার, টলট‌লে পানি। চৌ‌কি ভিজে টপটপ করে মা‌টির মেঝেতে পড়ে পুরো ঘর পানিতে ভেসে যায়। হাসনা কাপড় দিয়ে দু’হাতে শক্ত করে সুরুজের মুখ, নাক,কান চেপে ধরে। তবু পানি বের হওয়া বন্ধ হয় না। সুরুজ নিস্তেজ হয়ে আসে। বলে, আম্মা দেখ, কত পানি। পানির লাইগ্যা তোমারে আর বাপজা‌নের মাইর খাইতে হইব না।
হাসনা বলে, চুপ কর ছ্যাড়া, চুপ কর!
হাসনার গোঙানিতে সুরুজের ঘুম ভাঙে।
ব‌লে, আম্মা, কী হইছে তোমার? খোয়াব দেখছ? ও আম্মা!
সুরুজের ডাকে ধড়মড় ক‌রে উ‌ঠে ব‌সে হাসনা। চোখ মেলে সকালের আলো দেখে বলে, হায় আল্লাহ, কলে তো আইজ পানি পামু না। মরার স্বপন দেহি বিপদেই ফ্যালাইলো অাইজ।
তাড়াহুড়ো করে পরনের কাপড়টা ঠিকঠাক করে খালি কলসি আর প্লাস্টিকের বড় কন্টেইনার নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে সরু পথ ধরে দ্রুত ছুটে যায় ওয়াসার কলের দিকে। কলতলা শূন্য। কলে পানি দেয়ার সময় শেষ। মনে মনে পড়‌শি‌দের গালি দেয় হাসনা। কেউ একজন তাকে ডাকলও না! কেনই বা ডাকবে! লাইনের মাপা পানি। পানি নিয়ে কোনো পিরিত নাই।    
ফিরে এসে দরজার কাছে বসে পড়ে হাসনা। ঘরে একটুও জমানো পানি নেই। কলে আবার পানি আসবে দুপুরের দিকে। দুঃস্বপ্নের কথা মনে পড়ে। বস্তির ব্যস্ততায় ঘোর ভাঙ্গে তার। এক‌টি দীর্ঘশ্বাস বুকের ভেতর থেকে বের হয়ে শূন্যে মি‌লি‌য়ে যায়। ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখে। সুরুজ তখনও ঘুমে। গলির দিকে চোখ গেলে বশিরকে দেখতে পায়। সারারাত হোলসেল মার্কেটে কুলির কাজ সেরে সকালে এ সময় ফেরে বশির।
কী রে, আইজও পানি ধরতে পারস নাই? - বলতে বলতে ঘরের ভেতর ঢোকে বশির। শুরু হয় হাসনা আর বশিরের ঝগড়া। সুরুজের ঘুম ভাঙে। বিছানা থেকে নেমে দড়িতে ঝোলানো গেঞ্জি নিয়ে বাইরে আসে। চোখ মুছতে মুছতে খালি কন্টেনারের দিকে তাকিয়ে একমুহূর্ত ভা‌বে। বস্তি থেকে বের হওয়ার সরু গলি দিয়ে হাঁটতে থাকে খালি পায়ে।
বেলা বাড়ে। হাসনার চোখের পানিতে মাটি ভিজে আবার শুকিয়ে যায়। সারারাতের ঘুমহীনতার অার হাসনা‌কে মারার ক্লান্তি‌তে নড়ব‌ড়ে চৌ‌কি‌তে শু‌য়ে মরার মতো ঘুমায় বশির। হাসনা মে‌ঝে‌র মা‌টিতে পড়ে থা‌কে। উঠতে গিয়ে ডানহা‌তে ব্যথা টের পায়। বাইরে এসে সুরুজকে খোঁজে। বস্তির কেউ কিছু বলতে পারে না। হাসনা খেয়াল করে পানির কন্টেইনারটা নেই। তাহলে সুরুজ! আট বছরের সুরুজ এত বড় কন্টেইনার নিয়ে পানির জন্য কোথায় যাবে! পুরো বস্তিতে কোথাও দেখা যায় না সুরুজকে। ভো‌রের দুঃস্বপ্নের কথা মনে পড়ে হাসনার। আরেকটু বেলা গড়ালে বস্তিতে শোরগোল পড়ে। পাশেই নি‌র্মিয়মান বিল্ডিং‌য়ের ঢাকনাহীন রিজার্ভ ট‌্যাং‌কি‌র মধ্যে একটি শিশু-শরীর ভাসে। ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়া হয়। সুরুজ হতে পারে, ফিসফাস ক‌রে ব‌স্তিবা‌সিরা। ‌সেটা হাসনার কানে আসতেই পাগলের মতো বশিরকে ডাকে সে, এই হুনছ, বস্তির লোকজন কী কইতাছে, আমাগো সুরুজ আর নাই!
হাসনার চিৎকার বশিরের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। বড় ক্লান্ত সে। নি‌শ্চি‌ন্তে হাত-পা ছ‌ড়ি‌য়ে ঘুমায়। ক্লা‌ন্তিনা‌শি ঘু‌ম লে‌প্টে থা‌কে তার চো‌খের পাতায়।

আতঙ্ক

কবিরাজের প্রাণহীন শরীর বাড়ির উঠোনে রাখা। উঠোনজুড়ে ছায়া বি‌ছি‌য়ে দি‌য়েছে চারপাশের গাছপালা। কবিরাজের বয়স ছিয়াত্তরের কিছু বে‌শি। মৃতদেহের মাথার কাছে তুলসী গাছ, বাড়িময় আগরবাতির গন্ধ, বন্ধ চোখের পাতার ওপর তুলসী পাতা, শরীরে রামাবলী জড়ানো, বুকের ওপর গীতা। খবর পেয়ে রক্ত সম্পর্কের প্রায় সবাই নানান প্রান্ত থেকে সমবেত। কবিরাজের মেয়েরা মৃতদেহের চারপাশে বসে বিলাপ করে কাঁদছে। বাড়িময় শোক, ব্যস্ততা। কেউ কেউ ব্যস্ত শোকগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিতে। এতক্ষণ শশীবালাকে দেখা যায়নি কোথাও। কঙ্কালসার শরীর, পরনে সবুজ রঙের হালকা পাড়ের ময়লা সাদা শাড়ী। শশীবালা হাতে চাল ধোয়ার কড়াই নিয়ে বাড়ির ভেতর থেকে বের হন, গন্তব্য পুকুর পাড়। তাকে দেখে উঠোনে জমে ওঠা বিলাপে মূহুর্তে ধাক্কা লা‌গে।
দিদা, তুমি চাল নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?
তোর দাদুকে ভাত দেয়ার সময় হয়ে এল। সময়মত ভাত না দিলে উনি রেগে গিয়ে আর ভাতই খাবেন না। -শশীবালা উত্তর দেন।
দিদা, এই দেখ, উঠোনে কে শুয়ে আছে। দাদু আর বেঁচে নেই, তুমি কার জন্য ভাত রান্না করবে?
শশীবালার মেজো মেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলে চেতনা ফেরে তার।
কবিরাজের দেহ সামাজিক শ্মশানে দাহ না করে পুকুর পারেই দাহ করা হবে, অা‌গেই নির্ধা‌রিত ছিল। ক’দিন পরই ‌সেখা‌নে পাকা শ্মশান উঠবে চকমকিয়ে। ‌বোলহরি, হ‌রিবোল ধ্বনিতে রাজার বেশে কবিরাজের মৃতদেহ সা‌জি‌য়ে কাঁধে তুলে স্বজ‌নেরা নিয়ে যায় পুকুর পারের দিকে। 
সম‌বেত‌দের হিসেব না রাখলে পরে ক্রিয়ানুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করার সময়ে কেউ বাদ পড়তে পারে, তাই কো‌নো একজন লিষ্ট করতে থা‌কে, কে কোথা থেকে এল। দাহ কাজ শেষে সবাই বাড়িতে ফিরতে ‌ফির‌তে ঘন অন্ধকার না‌মে। ভাদ্রের রোদের তে‌জে পোড়া মা‌টির কড়া গন্ধ তখনও নাকে লাগে। শুধু পড়ে থাকা খাটটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন শশীবালা । মনেই করতে পারেন না কত যুগ পর এ খাট আজ শূন্য পড়ে আছে। শশীবালা আবার স্মৃ‌তি হারান, কুপি বাতি নিয়ে সদর দরজার দিকে যেতে দে‌খে ছোট মেয়ে থামায় তা‌কে। শশীবালা বলেন, তোদের বাবার আজ হাট থেকে ফিরতে এত দেরি কেন রে!
রাতে ঘুমে শশীবালা স্বপ্ন দেখেন। কবিরাজ ভাতের থালা ছুড়ে মারে আর বলে, এই চোদানী, ভাত দিতে এত দেরি কেন? খাব না ভাত।
কিশোরী শশীবালা এ বাড়ির বধু হ‌য়ে অাসার পর থে‌কে গত চুয়ান্ন বছর ধরে তার জীবন কা‌ট‌ছে আতঙ্কে। ক‌বিরা‌জের মৃত‌্যু‌তেও সে অাতঙ্ক কা‌টে‌ না তার। হঠাৎ হঠাৎ স্মৃ‌তি হারাচ্ছেন কবিরাজের বউ শশীবালা।  আজ কি তবে  সিঁথির সিঁদুর মুছে গিয়ে আত‌ঙ্কের অবসান হবে তার! শশীবালার স্মৃ‌তি ফেরার ক্ষণে অন্তত এ প্রশ্ন কি ‌তি‌নি করবেন নিজেকে যে, মৃত স্বামীর জন্য তি‌নি বিলাপ করবেন নাকি বা‌কি সময়টুকু আতঙ্কহীন কাটাবেন?
রাত ক্রমশ বাড়তে থাকে, ভেতর-বাহির সবখানে ঘোর অমাবস্যা নামে। কবিরাজের বাজখাঁই গলা অাছ‌ড়ে প‌ড়ে শশীবালার কা‌নে, কই গেলি, শুন‌তে পাস না, ওই খান‌কি?

সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান