ভালোবাসি চিরদিন Loving Forever - ড. কাজী ইকবাল জামান
ভালোবাসি চিরদিন Loving Forever -  ড. কাজী ইকবাল জামান

ভালোবাসি চিরদিন


 

মে মাস, গরম এর ছুটিটা শুরু হয়েছিলো। সকাল দশটা বাজতে না বাজতেই ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতাম, আড্ডা মারার জন্যে। গলির প্রান্তে পুকুর ধারের আম গাছটার তলায় সিঁড়িটাতেই আড্ডার বন্ধুদের জন্যে অপেক্ষা করতাম।

 

সাধারনতঃ মেসবাহই সিঁড়িটা দখল করে নেয় আগে ভাগে। পড়ালেখা পুরুপুরিই ছেড়ে দিয়েছে মেসবাহ। নাস্তাটা শেষ হতে না হতেই ছুটে চলে দোকানে। কয়েকটা সিগারেট কিনে, সিঁড়িতে বসে আয়েশ করে সিগারেট টানতে টানতেই সবার জন্যে অপেক্ষা করে।

 

সেদিন আমিও একটু আগেই বেড়িয়ে পরেছিলাম। পুকুর পারের সিঁড়িটার ধারে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম, অপরিচিত একটা লোকই বসে আছে। এলাকায় আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হলো না। নাকের ডগায় ঘন কালো গোফ, স্বাস্থ্যও ভালো। অনেকটা সিনেমার ভিলেনদের মতোই চেহারা। আমি বিরক্তই হলাম। এদিক সেদিক একবার তাকিয়ে, লোকটার সামনা সামনি সিঁড়িটার উপর বসলাম। আর আঁড় চোখেই লোকটার দিকে তাকাচ্ছিলাম।

 

মেসবাহ এলো খানিক পরই। এসেই সিগারেটে আগুন ধরালো। তারপর, আমার পাশেই পা তুলে আরাম করে বসলো। মেসবাহর দেখাদেখি, লোকটাও পকেট থেকে সিগারেট বেড় করে, আগুন ধরালো। আমি মেসবাহকে ইশারা করেই বললাম, চেনো নাকি?

 

মেসবাহ সব কিছুতেই সবজান্তার ভান করে। সে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতেই বললো, , রনির মামা।

আমি বললাম, রনি কে?

লোকটাই নিজ থেকে আঙুলী ইশারা করে বললো, ওই বাসায় এসেছি। বাদল সাহেব আমার ছোট বোন এর হাসব্যাণ্ড। আমার নাম শফি।

 

লোকটার ইশার কারনেই, ওদিকটায় তাকিয়েছিলাম। সেই সাথেই চোখে পরলো, চমৎকার একটি যুবতী পায়চারী করছে। দীর্ঘাঙ্গী, চমৎকার দেহের গড়ন। পরনে জলপাই রং এর একটা কামিজ।

মেয়েটিকে দেখেও অবাক হলাম। দূর থেকে দেখে অসম্ভব সুন্দরীই মনে হলো। অথচ, এই এলাকায় সেই মেয়েটিকে কখনো দেখেছি বলে মনে হলো না। আমি নিজেকেও কিছু বুঝতে পারলাম না। এলাকায় কখন কারা আসছে, যাচ্ছে, কিছুই তো দেখছি না, জানিনা। যতদূর বুঝলাম, ওদিকটায় সরাকারী অডিটদের দুটি বাসা আছে। নুতন কোন অডিটর সাহেবই বুঝি এসেছে। 

 

আমি সেই মেয়েটির দিকেই গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম। বয়সে আমার চাইতে বড় হবে বলেই মনে হলো। তারপরও, চেহারা, দেহের গড়ন আমার দৃষ্টি শুধু বার বার কেঁড়ে নিয়ে চলছিলো।

দূর থেকে আমার দৃষ্টিও বোধ হয় মেয়েটি অনুমান করতে পারছিলো। সেও বার বার ঘাড় কাৎ করে এদিকেই তাকাচ্ছিলো। একটা সময়ে পায়চারী করার ভান করে আমাদের দিকেই এগুতে থাকলো। কাছাকাছি এসে সামনে বসা শফি নামের লোকটাকে লক্ষ্য করেই বললো, কি করছেন?

লোকটা সিগারেটে টান দিয়েই বললো, না, এমনিতেই বসে রইলাম আর কি?

 

আমি মেয়েটির দিকেই তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। অপূর্ব চেহারা। চমৎকার সরু ঠোট। কামিজটার উপর দিয়ে উঁচু উঁচু দুটি বুকই যেনো উঁকি দিয়ে আছে। বয়স আঠারো কি উনিশ।

 

চমৎকার চমৎকার মেয়ে গুলো বয়সে বড় হয় কেনো? আর তাদের দেখে এত ভালো লাগে কেনো? আমি মেয়েটির দিকেই শুধু তাকিয়ে রইলাম। অথচ, মেয়েটি আমার দিকে একটিবারও তাকালো না। শফি নাম এর লোকটার দিকে তাকিয়েই বললো, যা গরম, ঘরে থাকাই তো দায়। ঠিক আছে, বন্ধুদের সাথে গল্প করেন।

এই বলে মেয়েটি আবারো নিজের পথেই এগুলো।

 

আমার কি হলো বুঝলাম না। কে এই মেয়েটি? পাশে বসা শফির সাথে মেয়েটির সম্পর্কই বা কি? যেই লোকটিকে দেখে প্রথমে বিরক্তই হয়েছিলাম, তার প্রতি হঠাৎই কেমন যেনো আগ্রহ জমে উঠলো। আমি আগ্রহ করেই বললাম, মামা, কি করেন আপনি?

শফি নামের লোকটা লজ্জিত গলাতেই বললো, তেমন কিছু করি না। বেকার।

আমি বললাম, , মাত্র লেখাপড়া শেষ করেছেন বুঝি?

শফি একটা নিঃশ্বাস ফেলেই বললো, আর লেখাপড়া! ডিগ্রীতে ভর্তি হয়েছিলাম, ওখানেই শেষ।

শফি বেকারই থাকুক, আর ডিগ্রীতে ভর্তি হয়েই থাকুক, তাতে আমার কোন মাথা ব্যাথা ছিলো না। মেয়েটির সাথে তার কি সম্পর্ক, সেটাই শুধু জানতে ইচ্ছে করছিলো।

 

খোঁজ খবর নিয়ে যতদূর জানতে পারলাম, বাদল সাহেব এই এলাকায় নুতন অডিটর হিসেবে এসেছে। রনি নামে দু তিন বছর এর একটি ছেলে আছে। আর সেই মেয়েটি হলো, সেই বাদল সাহেবেরই ছোট বোন। নাম, নীলু। রনির ফুফু বলে, সবাই নীলু ফুফু বলেই ডাকে।

 

কে কাকে কি নামে ডাকে, তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। আমি কেমন যেনো মেয়েটির প্রেমে পরে গিয়েছিলাম। শুধু বোধ হয় আমিই না। এমনি প্রেমে পরে গিয়েছিলো শৈবালও।

 

শৈবাল কবিতা লিখে। সে দুপুর তিনটার দিকে আমাদের বাড়ীতে এসে হাজির। একটা কাগজ দেখিয়ে বললো, অনিকেত, কবিতাটা কেমন হয়েছে বল তো?

কবিতাটা আমি পড়লাম। শুধু নীল নিয়ে লিখা। উদ্দেশ্যটা বুঝলাম। আমি গায়ে শার্ট জড়িয়ে বললাম, চল।

শৈবাল বললো, কোথায়?

আমি বললাম, নীল দেখতে যাবো।

 

আমি শৈবালকে নিয়ে অডিটর সাহেবের বাড়ীর দিকেই এগিয়ে চললাম। কাছাকাছি আসতেই দেখলাম, বাগানের সবুজ ঘাসের উপরই হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে নীলু। গাঢ় সবুজ আর কালো ডোরার কামিজ পরনে। আমরা দুজনেই এক নজর তাকালাম সেদিকে। তারপর, বাগানটার সামনে দিয়েই অন্যত্র চলে যাবারই উদ্যোগ করছিলাম।

 

নীলু হলদে ফুল গাছটা থেকে একটা ডাল ছিড়ে নিয়ে, এগিয়ে এলো আমাদের দিকেই। খুব সহজ ভাবেই আমাদের ডাকলো, এই শুনো?

আমি আর শৈবাল দুজনেই ঘুরে দাঁড়ালাম। শৈবালই আগ্রহ করে বললো, কিছু বলবেন ফুফু?

নীলু আমার দিকেই তাকালো। বললো, তোমার নাম কি অনি?

 

আমার বুকের ভেতরটায় হঠাৎই কেমন যেনো এক স্পন্দনে ভরে উঠলো। কাঁপা কাঁপা গলাতেই বললাম, জী। কি করে জানলেন?

নীলু ফুল এর ডালটা দু হাতে চেপে ধরে, খুব সহজ ভাবেই বললো, রনির মামা বললো। 

আমি কি বলবো কিছু বুঝতে পারলাম না। লাজুক চেহারা করেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। শৈবাল আমার ঘাড় এর উপর হাত রেখে নীলুর আপাদ মস্তক একবার দেখে নিলো। তারপর, নীলুর হাতের ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো, ফুল কাকে দেবেন, নীলু ফুফু?

নীলু মুচকি হাসলো। বললো, না, কাউকে দেবার জন্যে নয়। এমনিতেই ছিড়ে নিলাম। ফুল ছিড়তে খুব ভালো লাগে।

 

আমিও নীলুর দিকে গভীর দৃষ্টি মেলেই তাকালাম। কি অপরূপ চেহারা, আর কি আপরূপ দেহের গড়ন! চুলগুলোও গুছিয়ে রেখেছে আপরূপ করেই। আমি বললাম, বলেন কি? ফুল তো গাছেই শোভা পায়। 

নীলু অপ্রস্তুত হয়েই বললো, না মানে, কেনো ছিড়ে নিলাম, নিজেও বুঝি নি। না মানে হঠাৎ করেই। তোমরা ওদিকে চলে যাচ্ছিলে, তাই আর কি?

 

শৈবাল এর কবি কবি ভাব আছে। কথাও একটু বেশী বলে। সে আমার ঘাড় এর উপর হাত রেখেই নাক চুলকাতে চুলকাতে বললো, নীলু ফুফু, ভাব সাব তো খুব ভালো মনে হচ্ছে না। মনে তো হচ্ছে প্রেমের লক্ষণ।

নীলু শৈবালকে থামিয়ে বললো, আহ, তুমি থামো তো? কই যাও ওদিকে?

শৈবাল বললো, কই আর যাবো? সাহিত্য বাবুই জানে!

নীলু অবাক হয়ে বললো, সাহিত্য বাবুটা আবার কে?

শৈবাল আমাকে ইশারা করেই বললো, এই যে, আপনার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। আপনিও কবিতা লিখেন, আমিও কবিতা লিখি। তাই একটা কবিতা লিখেছিলাম। আপনাকে দেখানোর আগে এই অনিকেতকেই দেখিয়েছিলাম। কবিতা পড়ে সাহিত্য বাবুর মনে কি ভাব জমলো বুঝলাম না। বললো, চল। কোথায় কোনদিকে যাবে, কিছুই তো বলেনি। হয়তো কোন পাহাড়ের ঢালে, অথবা সেই নদীর ধারে।

 

নীলু আমার দিকে খুব আগ্রহ করেই তাকালো। বললো, গল্প লিখো বুঝি? আমারও কিন্তু গল্প পড়তে খুব ভালো লাগে। ইদানীং হুমায়ুন আহমেদ এর গল্পগুলো খুব ভালো লাগে। হোটেল গ্রেভারীন পড়েছো?

আমি বললাম, না। গল্প পড়তে খুব ভালো লাগে না। ধৈর্য্য ধরে না।

নীলু বললো, আমার খুব ভালো লাগে। সারা দিন রাতই তো শুধু অবসর। তাই শুধু গল্পের বই পড়ি।

আমি বললাম, বলেন কি? আপনি পড়ালেখা করেন না?

 

নীলু হঠাৎই খুব অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। তারপর, নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, না মানে, কলেজে খুব যেতে ইচ্ছে করে। বাসায় একা একা খুব বোর লাগে।

আমি কোন কিছু না বুঝেই, খুব সহজভাবে বললাম, যান না কেনো?

নীলু আমার দিকে খুব তীক্ষ্ম দৃষ্টিতেই তাকালো। বললো, ভাইয়ার সংসারে থাকি। ভাইয়ার বদলীর চাকুরী। দু বছর এখানে, দু বছর ওখানে। আমাকেও কলেজ বদলী করতে হয়। ওই কলেজ বদলী করতে গিয়েই আর কলেজে যাওয়াটা হয়ে উঠলো না।

আমি বললাম, এখানকার কলেজটা কিন্তু খুবই নামকরা। এই কলেজ থেকে যারা পাশ করেছে, তারা শুধু সারা দেশেই নয়, সারা বিশ্বে খুব নাম করে আছে।

নীলু বললো, হুম, শুনেছি। আসলে গত বছর এইচ, এস, সি, ফাইনাল দেবার কথা ছিলো। ভাইয়ার বদলীর কারনে পড়ালেখায় খুব একটা মন দিতে পারিনি। ভাবছি, নুতন করেই কলেজে ভর্তি হবো।

 

আমি নীলুর মিষ্টি চেহারাটার দিকেই তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। এত সুন্দর কারো চেহারা হয় নাকি? শান্ত চোখ, সরু ঠোট, ডিম্বাকার চেহারা! শৈবাল তারই মাঝে বলে উঠলো, এক বছর পর কিন্তু আমরাও কলেজে ভর্তি হবো। তখন কি ফুফু বলে ডাকবো, নাকি আপা?

নীলু রাগ করেই বললো, নাম ধরে ডেকো। হলো?

শৈবাল মন খারাপ করেই বললো, ফুফু কি রাগ করেছেন?

নীলু শান্ত গলাতেই বললো, নাহ, রাগ করিনি। আসলে জায়গা বদলাতে আর ভালো লাগে না।

 

নীলুর মনের অবস্থা তখন আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। আমি বললাম, ফুফু, আপনি ভালো থাকুন। আমরা যাই তাহলে।

নীলু অসহায় একটা চেহারা করেই বললো, চলে যাবে? ঠিক আছে!

 

আমি আর শৈবাল খুব সহজভাবেই নীলুর সামনে থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। কিন্তু, মনের পর্দায় নীলুর আপরূপ চেহারাটা এমন করে বাসা বেঁধে রেখেছিলো যে, একটি মুহুর্তের জন্যেও তাকে মন থেকে সরাতে পারলাম না। শৈবাল এর সাথে পাহাড়ী ঢালে বসেই সময় কাটিয়েছিলাম। অথচ, মনের মাঝে আনা গুনা করেছিলো শুধু নীলু।

 

 

মেসবাহদের বাড়ীতে যেতে হলে, অডিটর সাহেবের বাড়ীর পাশ দিয়েই যেতে হয়। সেদিন দিপুরের পর বাড়ীতে একাকী শুধু ছটফটই করছিলাম। এমন ভর দুপুরে শুধু মেসবাহকেই কাছে পাওয়া যায়। খুবই অন্য রকম ছেলে। আড্ডা, গল্প গুজব এসবই শুধু পছন্দ করে।

 

আমি মেসবাহদের বাড়ীর পথেই ছুটছিলাম। অডিটর সাহেবের বাড়ীটার পাশ কেটে যেতেই, মিষ্টি মেয়েলী কন্ঠই ভেসে এলো, অনি?

আমি ফিরে তাকালাম। রোদেলা দুপুর। বেনী করা চুলের মাথায় বেতের টুপি। পরনে সাদা রং এর হাত কাটা ঘরোয়া পোশাক। নীলু, বাড়ীটার পেছনে দাঁড়িয়ে দু হাত তুলে খিল খিল করে হাসছে। ঝক ঝক করা সাদা দাঁতগুলোই বুঝি সবচেয়ে আগে চোখে পরে। আমি মুচকি হেসেই বললাম, , নীলু ফুফু? কি করছেন?

নীলু খিল খিল হাসিতেই বললো, কিছুই করছি না। শফি ভাই চলে গেলো। নুতন বাসা, একটু গুছগাছ করছি। তুমি কই যাও?

 

শফি ভাই চলে গেছে বলাতে, আমি কেমন যেনো একটু খুশীই হলাম মনে মনে। লোকটাকে কেমন যেনো একটু ঝামেলারই মনে হয়েছিলো। আমি বললাম, একটু মেসবাহর কাছে।

নীলু বললো, বাসায় আসো না কেনো?

আমি বললাম, আসবো। দেখি।

 

আমার প্রতি নীলু এমন আগ্রহী হয়ে পরলো কেনো, কারন বুঝলাম না। সেদিন প্রথম দেখার পর, খুব তীক্ষ্ম চোখে তার দিকে তাকিয়েছিলাম বলে নাকি? নিঃসন্দেহে নীলু খুব চমৎকার মেয়ে। তারপরও আমি কেনো যেনো কথা বাড়াতে পারলাম না। বললাম, আসি ফুফু।  

 নীলু খিল খিল হাসিতেই হাত নাড়লো, ওকে, বাই!

 

সেদিন আনমনেই নিজ বাড়ীর গলি থেকে বড় রাস্তাটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। রাস্তার মোড়ে ছোট খাট একটা জটলাই চোখে পরলো। তার কারন কিছু বুঝলাম না। আমি এড়িয়ে যেতেই চাচ্ছিলাম। অথচ, হঠাৎই জটলাটার মাঝে মেয়েলী একটা কন্ঠই ভেসে এলো, ওই তো অনি!

আমি চোখ তুলে তাকালাম। অবাক হয়ে দেখলাম, নীলু! আনন্দে আত্মহারা হয়ে, ছুটতে ছুটতে আমার দিকেই আসছে। আমি অবাক হয়েই বললাম, নীলু ফুফু, আপনি?

নীলু আমার সামানা সামনি দাঁড়িয়ে প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, তোমাদের বাড়ীটা খোঁজছিলাম। কিন্তু কেউ বলতে পারলো না।

 

আমি চারিদিক তাকালাম। দেখলাম, আশে পাশের রিক্সাওয়ালার সহ, সবার দৃষ্টি আমাদের দিকেই নিবদ্ধ হয়ে আছে। আমি নীলুর দিকেই তাকালাম। বললাম, কেনো? হঠাৎ আমাকে?

নীলুও এদিক সেদিক তাকালো। তারপর শান্ত গলাতেই বললো, বলেছিলে না, তোমাদের এলাকার কলেজটা নাকি নাম করা! আমাকে ওই কলেজটাতে নিয়ে যাবে?

আমি নীলুর কথা কিছু অনুমান করতে পারলাম না। বললাম, বেশ তো। একটু দূরে, একটা রিক্সা নেবো? নাকি বাসে যাবেন?

নীলু বললো, হেঁটে।

 

নীলুর ভাব সাব আমি কিছু বুঝলাম না। নীলুর পাশাপাশিই কলেজ পর্য্যন্ত হাঁটলাম। নীলু কলেজের অফিস ঘরে গিয়েই ঢুকেছিলো।

 

নীলু আমার চাইতে তিন বছর এরই বড় হবে। অথচ, মনটা কেমন যেনো শিশুর মতোই সরল। একটুও অহংকার নেই। প্রথম দর্শনে আমিও যেমনি নীলুকে দেখে অভিভূত হয়ে পরেছিলাম, ঠিক নীলুও কেনো যেনো আমার প্রতি হঠাৎ করেই দুর্বল হয়ে পরেছিলো।

 

কলেজ যাতায়াতের পথে খুব বেশী কথা হয়নি। নীলু নুতন করেই কলেজে ভর্তি হতে চেয়েছিলো। সে ব্যাপারেই ব্যস্ত ছিলো বেশী। ফেরার পথে রিক্সা করেই ফিরেছিলাম। তারপরও খুব বেশী কথা হলো না।

 

কেনো যেনো বুঝলাম না, দুপুরে খাবার রূচিটাও হলো না। ঘুঘু ডাকা দুপুরে বিছানাতে শুয়ে শুয়ে বুকটা শুধু হু হু করে উঠলো। আমি নিজের অজান্তেই ঘর থেকে বেড়িয়ে পরেছিলাম।

মেসবাহদের বাড়ীর পথেই পা বাড়িয়েছিলাম। অডিটর সাহেবের বাড়ীর সামনে আসতেই দেখলাম, উঠানে হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে নীলু। আমার দিকে গম্ভীর চেহারা করেই তাকিয়ে ছিলো। আমি থেমে দাঁড়াতেই গালে হাত ঠেকিয়ে বললো, নিশ্চয়ই মেসবাহর কাছে?

আমি আমতা আমতাই করলাম। বললাম, না মানে, জী।

নীলু বললো, না, আজ মেসবাহার কাছে যাবে না। আমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে।

আমি অবাক হয়েই বললাম, বেড়াতে যাবো? কোথায়?

নীলু বললো, খুব বেশী দূরে না। শুনেছি, ওদিকে একটা নদী আছে। চলো, ওই নদীর ধারে বেড়াতে যাই।

এই বলে উঠে দাঁড়ালো নীলু।

আমি কি করবো, বুঝতে পারলাম না। নিজের আজান্তেই বললাম, ঠিক আছে, চলুন।

 

নীলু বুক ফুলিয়েই এগুতে থাকলো। পরনে হাত কাটা সাদা রং টপস, তার সাথে মিলিয়ে পায়ের গীড়া পর্য্যন্ত দীর্ঘ স্কার্ট। মাথার চুলগুলো উপর করে ব্যাণ্ড দিয়ে বাঁধা। কপালে কাটা চুলগুলো চেহারাটাকে আরো চমৎকার করে রেখেছে। আমি হাঁটতে হাঁটতেই বললাম, হঠাৎ আমার প্রতি আপনার এত আগ্রহ হলো কেনো?

নীলু খুব সহজ ভাবেই বললো, ঐদিন আমার দিকে অমন করে তাকিয়েছিলে কেনো? ওরে বাব্বা! চোখ তো নয়, দেখে মনে হয়েছিলো, রীতীমতো এক্সরে ফেলছিলে।

আমি লজ্জিত হয়েই বললাম, না মানে, আপনি খুব সুন্দর। সুন্দর এর জন্যে এক লাইন এর একটা কবিতাই যথেষ্ট।

নীলু বললো, কি কবিতা? আমিও তো কবিতা লিখি।

আমি বললাম, এটা কবি নজরুল এর। সবাই জানে! তুমি সুন্দর, তাই চেয়ে থাকি, সে কি মোর অপরাধ!

 

নীলু খিল খিল করেই হাসলো। বললো, আমি সুন্দর কিনা জানিনা। তবে, বিয়ের কথা বার্তা চলছে। ভাবীর সংসার, বুঝোই তো! ভাবী হন্যে হয়ে পাত্র খোঁজছে। পারলে, তার বেকার ভাইটার কাছেই গচিয়ে দিতে চাইছে। আমার ভালো লাগে না।

আমি বললাম, ভালোই তো! খুব হ্যাণ্ডসাম দেখতে। শফি ভাই না?

নীলু অভিমান করেই বললো, কচু হ্যাণ্ডসাম। কালো ভূত! জসিম মার্কা চেহারা।

আমি বললাম, জসিম? উনি তো এখন নায়ক!

নীলু বললো, জসিম যত বড় নায়কই হউক না কেনো, পেটলা কালো ভূত! থাক বাদ দাও ওসব। আমি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাইছি না। পড়ালেখায় একটা গ্যাপ পরেছে, তাতে কি? কলেজে ছাত্রী হয়ে নাম লিখিয়ে রাখলেই তো হলো। আজকে নামটাও লিখিয়ে আসলাম।

 

তখন নদীর খুব কাছাকাছিই এসে পরেছিলাম। নদীর ঢেউ তুলা পানি দেখে নীলু আনন্দে উদ্বেলিত হয়েই উঠছিলো। ছুটে ছুটে নদীর পানির দিকেই এগিয়ে গেলো। নদীর শীতল পানিতে পা ডুবিয়ে, আনন্দে আত্মহারা হয়েই বলতে থাকলো, অনি, নদীর পানি এত ঠাণ্ডা? নদীতে যখন সূর্য্যের কিরণ পরে, তখন মনে হতো, নদীর পানি বুঝি খুবই উষ্ণ!

আমি চঞ্চলা নীলুর দিকেই এগিয়ে গেলাম।

 

আনন্দের মুহুর্তগুলো বুঝি খুব তাড়াতাড়িই ফুরিয়ে যায়। নীলুর সাথে এক ধরনের আনন্দ ভরা সময়ই কাটিয়ে দিচ্ছিলাম, নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে ভিজিয়ে। কখন যে সন্ধ্যা গড়িয়ে এলো, টেরও পেলাম না।

পড়ন্ত সন্ধ্যায় নীলুই বললো, এই যা, সন্ধ্যা হয়ে এলো। চলো ফিরে যাই।

এই বলে, মিষ্টি গলাতেই গাইতে থাকলো, আবার এলো যে সন্ধ্যা! শুধু দুজনে! চলো না ঘুরে আসি, আজানাতে! যেখানে নদী এসে, থেমে গেছে! আবার এলো যে সন্ধ্যা! শুধু দুজনে!

গানের গলা এত মিষ্টি হয় নাকি? আমি তন্ময় হয়েই নীলুর গান শুনছিলাম। নীলু ছোট ছোট পা ফেলে গান গাইতে গাইতেই ফিরে চলছিলো।

 

 

আমার একার সংসার। মা শৈশবেই বিদায় নিয়েছে, বাবা থাকে দেশের বাইরে। কাজের মেয়ে একটা খোঁজছিলাম ঠিকই, কপালে জুটছিলো না। রান্না বান্না এসব নিজেই করি তখন।

 

সেদিন দুপুরে কি খাবো, সেই ভাবনাতেই ছিলাম। চালটা আছে, তরকারীর আয়োজনটাই নেই। পুকুর পারে সকালের আড্ডাটা দেবার ফাঁকেই ভাবছিলাম দোকানে যাবো সব্জি কিনতে। এগারোটা বাজতেই আমার আর আড্ডায় মন বসলো না। কারন, বাজার করার অবহেলায় দুদিন ধরে শুধু পারুটি চিবুয়েই যাচ্ছিলাম। আমি বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছুটলাম দোকানগুলোর দিকে।

 

সব্জি কিনছিলাম বেছে বেছে। টাটকা পুই শাক, আর ঢেরশ। পাশের দোকানটা থেকেই মেয়েলী কন্ঠ ভেসে এলো, অনি!

আমি অবাকই হলাম। আজকাল মেয়ে দোকানদারও আছে নাকি? পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম, আর কেউ নয়, নীলু। পাশের সব্জির দোকানে, দু হাত হাঁটুতে চেপে নুয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অপ্রস্তুত হয়েই বললাম, নীলু ফুফু, আপনি?

নীলু খিল খিল হাসিতেই বললো, কেনো? অবাক হলে? আমিও বাজার করি! ভাবীর সংসার তো! কাজের মেয়েদের ভুমিকাটুকুও পালন করি।

নীলু আবারো খিল খিল করে হাসতে থাকলো মিষ্টি সাদা দাঁতগুলোর সব গুলোই বেড় করে। হাসি এত সুন্দর হয় নাকি? দাঁতও কি এত সুন্দর হয়? আমি বললাম, কি কিনছেন?

নীলু বললো, দেখছি! কি কিনবো ভাবছি। গাজর,পটল, যা পাই আর কি! তুমি কি কিনলে?

আমি বললাম, পুই শাক, খুব পছন্দ আমার। আর ঢেরশ।

নীলু আনন্দে আটখানা হয়ে বললো, , পুই শাক? আমারও খুব পছন্দ! চিংড়ী মাছ এর সাথে পুই শাক এর তরকারী! আহ! স্বাদই আলাদা।

আমি বললাম, ঘরে চিংড়ী মাছ নেই। শুধু পুই শাক ভাজি করবো।

 

নীলু এদিক সেদিকই তাকালো। তারপর বললো, এই বাজারে কি মাছ বিক্রি হয় না?

আমি বললাম, হয়, সপ্তাহে দুদিন। মঙ্গলবার আর শনিবার। আজকে বুধবার। পরবর্তী শনিবার ছাড়া চিংড়ী মাছ পাওয়া যাবে না।

নীলু দুঃখ দুঃখ চেহারা করে বললো, , তাহলে পুইশাক কি দিয়ে রান্না হবে?

আমি বললাম, এমনিতেই সিদ্ধ করবো।

নীলু চোখ কপালে তুলেই বললো, সিদ্ধ করবে মানে? তোমার মা নিশ্চয়ই একটা পথ বেড় করে নেবে। ঠিক আছে, বাজার শেষ করো। আমিও গাজর আর পটল কিনে নিচ্ছি।

এই বলে নীলু নিজ বাজারেই মন দিলো।

 

আমি বাজার শেষ করে বাড়ীর পথেই এগুচ্ছিলাম। সম বয়েসী অন্য সব ছেলেদের মতো আমি না। একার সংসার আমার। রান্না বান্না সব নিজেকেই করতে হয়। সেই রান্না বান্নাটাই বোধ হয় সবচেয়ে বিরক্তিকর। তখনই বিরক্তি নিয়ে ভাবি, যদি আমারও সবার মতো একটি মা থাকতো, অথবা বড় একটি বোন বাড়ীতেই থাকতো!

 

সবই বোধ হয় কপাল। শৈশবে মাকেও হারালাম। বুঝার বয়স হবার পর, মা তুল্য কাজের মেয়ে কেয়ারও বিয়ে হয়ে গেলো। অতঃপর পিঠে পিঠি বড় বোনটারও বিয়ে করে বাড়ী ছেড়ে চলে গেলো, আমাকে নিসংগ রেখে।

 

নিজের অজান্তে, নীলু কখন যে আমার পাশাপাশি হাঁটতে থাকলো টেরই পেলাম না। নীল রং এর টপস, বুকে সাদা ইংরেজী হরফের হরেক লেখালেখি। তার সাথে সাদা লং স্কার্ট। নীলু আমার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতেই বললো, অসহ্য! মাঝে মাঝে নিজেকে কাজের মেয়ে বলেই মনে হয়।

আমি বললাম, কেনো?

নীলু বললো, বলিনি তোমাকে? ভাবীর সংসার! বাবা মায়ের কাছে না থকলে যে কি কষ্টের তা যদি তোমাকে বুঝাতে পারতাম! কোন স্বাধীনতা নেই। সারাক্ষণ শুধু ভাবীর আদেশ নির্দেশ। ওটা করো, এটা করো! আমার পড়ালেখাটা কিন্তু তার জন্যেই হয়নি। ভাবী আমাকে তার কাজের মেয়ের মতোই খাটায়। জীবনে কত স্বপ্ন দেখেছিলাম! কিছুই হলো না।

আমি বললাম, , আপনারও বুঝি মা বাবা নেই।

নীলু হঠাৎই থেমে দাঁড়িয়ে বললো, আপনারও বলছো কেনো? আর কারও কি আমার মতো মা বাবা নেই নাকি?

আমি বললাম, , আপনাকে তো কিছু বলাই হয়নি। আসলে আমারও মা নেই। আমার বাবা বিদেশী এক জাহাজের নাবিক। থেকেও নেই। বছরের পর বছর সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়ায়। বছর শেষে একবারই শুধু বাড়ী আসে।

নীলু আমার দিকে কোনাকোনি দাঁড়িয়ে বললো, বলো কি? আমার মা বাবা কিন্তু দুজনেই আছে। বাবা রিটায়ার্ড। ছোট খাট কাজ করতো, তাই খুব বেশী টাকা পয়সা নেই আর কি। ভাইয়াকে পড়ালেখা শিখিয়েছে। এটাই বাবার পূজি বলতে পারো। আর ভাইয়াও সংসার ঠেলতে ঠেলতে বোনদের শুধু বিয়ে দিয়ে বাঁচতে পারলেই ভালো, এসবই ভাবে।

 

কথা বলতে বলতে, হাঁটতে হাঁটতে কখন যে বাড়ীর কাছাকাছি মোড়টাতে চলে এসেছিলাম টেরই পাইনি। আমি নিজ বাড়ীর পথে মুখ করেই বললাম, নীলু ফুফু, আমাদের বাড়ী এই পথে। আবার দেখা হবে।

নীলু হঠাৎই কেমন যেনো অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে, তাদের বাসার যাবার পথে পাবলিক ছাউনিটার দেয়ালটার পাশ ঘেষেই দাঁড়ালো। আমাকে একটা স্যাল্যুট দিয়ে মিষ্টি হেসেই বললো, অফকোর্স দেখা হবে।

 

নীলুকে আমি বুঝতে পারলাম না। সব সময়ই হাসি খুশী। অথচ, বুকের ভেতর কোথায় যেনো একটা বেদনা লুকিয়ে আছে।

 

সেদিন দুপুর এর পর কিছুই ভালো লাগছিলো না। দুপুরবেলায় অংক করতেই খুব ভালো লাগে। অথচ অংকেও মন বসলো না। দূর থেকে ভেসে আসা আকুল করা ঘুঘু পাখির ডাকটা শুধু মন উদাস করে দিচ্ছিলো।

 

তেমনি উদাস করা দুপুরে গল্প লিখতেও খুব ইচ্ছে করে। আমি কাগজ কলম নিয়েই বসলাম। কি গল্প লিখবো কিছুই ঠিক করতে পারলাম না। আমি ঘর থেকে বেড়িয়ে পরলাম। গলিতেই উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে হাঁটছিলাম। ঠিক গলির মোড়েই দেখা নীলুর সাথে। নীল রং এরই আধুনিক একটা টপস পরনে। স্কীন টাইট। হঠাৎ দেখে মনে হলো বড় সাইজের দুটি বেলই বুঝি টপসটার নীচে লুকানো।

আর নিম্নাঙ্গে সাদা রং এর লং স্কার্ট। নীলু প্রায়ই লং স্কার্ট পরে টপস এর সাথে। দীর্ঘাঙ্গী নীলুকে এমন পোশাকে বয়সটা অনেক কম লাগে। চমৎকারও মানায়। উঁচু বুক দুটি, চোখ কেঁড়ে নেয়। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, কি নীলু ফুফু, বাজারে যাচ্ছেন নাকি?

নীলু সাদা দাঁতের মিষ্টি হাসিতেই বললো, না। তুমি চাইলে যেতে পারি।

আমি বললাম, না, বাজারে যাবো না। কি করছেন একা একা?

নীলু বললাম, একা একা আর কি করা যায় বলো? এমনিই হাঁটছি। বাসায় খুব বোর লাগছে। তারপর, মিষ্টি সুরেই গাইতে থাকলো, একা একা কিছু ভালো লাগে না!

 

নীলুর গানের গলা মিষ্টি। শুনতেই ইচ্ছে করছিলো। অথচ, গান থামিয়ে নীলু হঠাৎ করেই বললো, তুমি আমাদের বাসায় আসোনা কেনো? আমি মেয়ে মানুষ! তোমাদের বসায় যাই কি করে বলো? তুমি আসলেই তো পারো।

আমি আমতা আমতা করেই বললাম, যেতে খুব ইচ্ছে করে, কিন্তু?

নীলু বললো, কিন্তু কি?

আমি বললাম, না মানে, কি পরিচয় নিয়ে যাবো?

নীলু খুব সহজ ভাবেই বললো, কেনো, আমার বন্ধু হয়ে যাবে!

আমি বললাম, ঠিক আছে, এক সময়ে যাবো।

 

নীলু হঠাৎই যেনো আমার সাথে বন্ধু সুলভ হয়ে পরেছিলো। সে খুব আহলাদ করেই বললো, এক সময়ে না, প্রতিদিনই আসবে যাবে। বাসায় কি করো সারাদিন?

আমি বললাম, কিছুই করি না। পড়ার টেবিলে বসে বসে অংক করি। যখন অংক করতে ভালো লাগে না, তখন গলপো লিখি।

নীলু বললো, কি গলপো লিখো? প্রেমের? নাকি বিরহের?

আমি হাসলাম, বললাম, দুটুই লিখতে চাই, কোনটাই হয় না।

 

নীলু হঠাৎই খানিক উদাস হয়ে উঠলো। পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে, অন্যত্র তাকিয়ে বললো, আমার বিরহের গল্প ভালো লাগে না।

আমি বললাম, তাহলে কি প্রেমের গলপো?

নীলু বললো, না, তাও না। হাসির গল্প। হুমায়ুন আহমেদ আমার ফ্যাভারিট। তার গল্পে আলাদা একটা ভাব আছে না? হাসি কান্না মিলিয়ে অন্য রকম।

আমি বললাম, হুমায়ুন আহমেদের গল্প আমারও ভালো লাগে। কিন্তু ওরকম লিখতে পারি না। মাঝে মাঝে লিখতে চাই, কেমন যেনো জগা খিচুরী হয়ে যায়।

নীলু খিল খিল করে হাসলো। বললো, তাহলে কি প্রেমের গল্প লিখতে গেলে বিরিয়ানী হয়ে যায়?

আমি বললাম, না, তাও না। প্রেম ভালোবাসার গল্প কিভাবে শুরু করতে হয়, সেটাই ফুটিয়ে তুলতে পারি না। কিছু দূর লিখে শেষও করতে পারি না।

নীলু বললো, প্রেম ভালোবাসার গল্প লিখা তো সহজ! একটি ছেলে আর একটি মেয়ে! পথে যেতে দেখা হলো। চোখে চোখে কথা হলো।

আমি হাসলাম, বললাম, প্রেম করেছেন নাকি?

 

নীলু খানিকক্ষণ অন্য মনস্ক হয়েই ভাবলো। তারপর বললো, থাক ওসব কথা। তোমার গল্প পত্রিকায় ছাপা হয়?

আমি বললাম, না, মাঝে মাঝে স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়।

নীলু বললো, প্রেমের গল্প লিখতে চাইলে আমাকে জিজ্ঞাসা করবে। প্রেমের অনেক গল্প আমি জানি।

আমি বললাম, তাই নাকি?

নীলু বললো, হ্যা, প্রেম করতে হয়, ধরি মাছ, না ছুই পানির মতো করে।

আমি বললাম, সেটা কেমন?

নীলু তার উঁচু বুকটা উঁচিয়ে ধরেই বললো, বিরহের ব্যাপারগুলো আসতে না দেয়া। এবার বলো, বাসায় কবে আসছো?

আমি বললাম, রাস্তাতেই তো প্রতিদিন দেখা হচ্ছে। বাসায় গিয়ে আর কি হবে?

নীলু বললো, রাস্তায় দেখা হওয়া আর কারো বাসায় গিয়ে দেখা করা ভিন্ন। রাস্তা ঘাটে তো কত মানুষের সাথেই দেখা হয়।

আমি বললাম, এত করে যখন বলছেন, একদিন না হয় যাবো।

 

নীলু হঠাৎই কেমন যেনো প্রান চঞ্চলা হয়ে উঠলো। আব্দার এর সুরেই বললো, এক কাজ করো না, বিকেলে নদীর তীরে বেড়াতে চলো। ঐদিন যেখানে গিয়েছিলাম, ঠিক সেইখানে।

আমি বললাম, ঠিক আছে। কখন বেড়োবেন?

নীলু স্বার্থপর এর মতোই বললো, ওসব আমি জানিনা। তুমি আমাকে নিতে আসবে।

আমি বললাম, ঠিক আছে।

 

নীলু গুন গুন করেই গাইতে থাকলো, নদী তোর পানি, তোর মতলব জানি।

তারপর, নিজ পথে ছুটতে ছুটতে বললো, এখন আসি তাহলে। বিকালে নদীর পারে বেড়াতে যাবো। তুমি আসবে কিন্তু।

 

নীলু কি সব এর ইংগিত করছে কিছুই বুঝতে পারলাম না। আহলাদী একটা ভাব নিয়েই বিদায় হয়েছিলো। আমি রোমান্টিক একটা ভাব নিয়েই বাড়ী ফিরলাম। বিছানায় শুয়ে ভাবতে থাকলাম নীলুর কথাই।

 

দুপুরে আমি কখনোই ঘুমাই না। বিছানায় দু হাতের তালুর উপর মাথা রেখেই ভাবছিলাম। ঠিক নীলুর কথাই। কখন যে চোখে রাজ্যের ঘুম এসে জড়ো হলো, টেরই পেলাম না। যখন জেগে উঠলাম, তখন মনে হলো অনেক বিকেল।

 

হঠাৎই মনে হলো, নীলু ফুফু বলেছিলো নদীর ধারে যাবে। আমি বিছনা থেকে লাফিয়েই নামলাম। ছুটতে ছুটতে তাদের বাসাতেই গেলাম। নীলুর ভাবী বললো, অনেক আগেই তো বেড়োলো। বললো তো নদীর তীরে হাঁটতে যাচ্ছে।

 

আমি ছুটতে ছুটতে নদীর ধারেই এগিয়ে গেলাম। গোধুলি লগ্ন, সবাই বাড়ী ফিরছে, আর আমি নদীর পানেই ছুটছি।

ঐদিন নীলু ফুফুকে নিয়ে যে জায়গাটায় গিয়েছিলাম, সেদিকেই এগিয়ে গেলাম। অবাক হয়েই দেখলাম, নীলু ফুফু একাকী দাঁড়িয়ে। পরনে ছিটের হাত কাটা লং সেমিজ। আমি কাছাকাছি গিয়ে দু হাত জড়ো করে ক্ষমা চেয়ে বললাম, স্যরি নীলু ফুফু। দুপুরে ঘুমিয়ে পরেছিলাম। জেগে দেখি সন্ধ্যা।

নীলু অভিমানী ভরা চেহারা করে থাকলো। আমি অসহায় গলাতেই বললাম, প্লীজ, রাগ করবেন না। ইচ্ছে করে দেরী করিনি। আসলে দুপুরে কখনোই ঘুমাই না। একটু বিছানায় শুয়েছিলাম শুধু। হঠাৎ কখন চোখে ঘুম চলে এসেছিলো টেরই পাইনি।

নীলু অভিমানী গলাতেই বললো, রাগ আমি করিনি। রাগ করার মতো কি অধিকারই তোমার কাছে আছে বলো?

 

পড়ন্ত সন্ধ্যা। সূর্য্যটা ডুবতে চলেছে। হালকা আলো নীলুর দেহে এসে পরছে। আপূর্ব লাগছিলো নীলুর চেহারাটা। আমি বললাম, অধিকার এর কথা জানিনা। সময় মতো কোন কিছু করতে না পারলে, নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। এখনো ঠিক তেমনি মনে হচ্ছে। পারলে ক্ষমা করে দেবেন।

 

সূর্য্যটা ধীরে ধীরে দিগন্তেই মিলিয়ে যাচ্ছিলো। চারিদিক অন্ধকার হয়ে পরছিলো। নীলু হাত দুটি পেছনে নিয়ে, নদীর পারে বুক ফুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো, কি সুন্দর বাতাস! আমার বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না।

আমি চারিদিক তাকিয়ে বললাম, অনেক সন্ধ্যা, চারিদিক অন্ধকার। বাসায় ফিরে যাওয়টাই বোধ হয় ভালো।

 

নীলু অট্টহাসিই হাসলো। বললো, কার কাছে ফিরে যাবো? ওই ডাইনীটার কাছে? বাসায় ফিরে গেলেই তো কাজের কথা বলবে। বলবে, রনির জন্যে দুধ বানাও। রাতের খাবার এর কি অবস্থা? রান্না বান্না শেষ হলে রনির ন্যাংটিগুলু ধুয়ে রেখে কিন্তু!

আমি নীলুর পেছনে পেছনেই এগুতে থাকলাম। বললাম, তারপরও পরিবার! অনেক কোলাহল থাকে সেখানে। ঝগড়াঝাটিও হয়, আবার শান্তিও আছে। একা থাকা খুব কষ্টের।

নীলু থেমে দাঁড়ালো। বললো, , স্যরি। তুমিও তো একা থাকো। আমিও খুব একা। পরিবার একটা নয়, দুটুই আছে। বাবা মায়ের সংসার, ভাই ভাবীর সংসার। যে কোন একটা বেছে নিতে হবে। বাবা মায়ের সংসার অথবা ভাই ভাবীর সংসার। বাবা মায়ের সংসারে না খেয়ে না পরে থাকতে হবে। ভাই ভাবীর সংসারে কাজ করে হলেও দুটু অন্ন জুটবে। আচ্ছা, আমি কি এতই পচে গেছি?

আমি বললাম, নীলু ফুফু, কি বলবো বুঝতে পারছিনা। আপনার মন খারাপ। রাত হয়ে যাচ্ছে। চলেন, ফিরতে ফিরতে আলাপ করি।

 

নীলু অভিমান করা গলায় বললো, আলাপ আর কি? সেদিন জসিম এর কথা বলেছিলে। বলেছিলে সেও নাকি নায়ক হয়েছে। ওই সবুজ সাথী সিনেমাটা তো? সিনেমাটাতে চমৎকার একটা গানও আছে!  কি যেনো গানটা? চোখ জুড়ানো মনের মতো ভাবী এনে দাও, আমার ভাইয়ারে! অথচ, আমার ভাবী, একটা ডাইনী! এমন ভাবী না থকলেও হয়।

আমি বললাম, নীলু ফুফু আপনার মন খারাপ। জায়গাটা খুব বেশী ভালো না। সন্ধ্যার পর অনেক বিপদ ঘটতে পারে।

নীলু রাগ করেই বললো, কি বিপদ ঘটবেগ? কি? তুমি আছো কি জন্যে?

 

নীলুর কথায় আমি অপ্রস্তুতই হলাম। আমতা আমতা করেই বললাম, না মানে, আমাকে আর কতটুকুই ভরসা করতে পারেন। ছোট ছেলে, মারামারিও পারি না।

নীলু খিস্তি ছেড়েই বললো, ছোট ছেলে, হ্যা? মেয়েদের দিকে তো ঠিকই তাকাতে পারো।একেবারে এক্স রে ফেলে তাকাও, না?

আমি অপ্রস্তুত হয়েই বললাম, না মানে, আপনি এতই সুন্দর, না চাইলেও চোখ চলে যায়। কি করবো?

নীলু কিছু বললো না। লোকালয় এর দিকেই পা বাড়ালো।

 

 

সেদিনও পুকুর পারে সিঁড়িতে বসে আড্ডা মারছিলাম। আড্ডায় খুব একটা মন বসছিলো না। দুপুর গড়িয়ে আসতেই, একে একে সবাই বিদায় নিলো। আমার বাড়ী ফিরতে ইচ্ছে করলো না। মেসবাহকে বললাম, আরেকটু বস। সে আব্দার করলো, একটা সিগারেট এর দাম দে, তাহলে আরো দু ঘন্টা আড্ডা মারবো।

 

আমার টাকা বলতে, মাসে মাসে বাবার পাঠানো টাকা। ডাক পিওন এসে যদি দিয়ে যায়, তাহলেই বাঁচি। সে মাসের টাকা তখনো আসেনি। আমি বললাম, পকেটের অবস্থা খুবই খারাপ। পোষ্ট অফিস থেকে টাকা পাঠানোর কোন খবর নেই। বাকী দিনগুলো কিভাবে কাটাবো, খুব ভাবনাতেই আছি।

মেসবাহ কাঠ খুট্টার মতোই বললো, তাহলে আমি যাই। খুব ক্ষুধা পেয়েছে। দেখি মা রান্না বান্না কত দূর করলো।

 

শেষ পর্য্যন্ত মেসবাহও চলে গেলো। আমি একাকীই সিঁড়িতে বসে রইলাম। হঠাৎই চোখে পরলো, ওদিক থেকে কলেজ ড্রেসে কে যেনো একটি মেয়ে এদিকেই আসছে। এলাকার কলেজে পড়া সব মেয়েদেরই চিনি। এদিকটায় কলেজে পড়া কোন মেয়ে থাকে বলে জানা ছিলো না। আমি গভীর দৃষ্টিতেই মেয়েটির দিকে চোখ রাখলাম।

কাছাকাছি আসতেই অনুমান করলাম, আর কেউ নয়। নুতন আসা অডিটর সাহেবের ছোট বোন, নীলু। অডিটর সাহেবের বাসায় যেতে হলে, এই পুকুর পার ঘেষেই যেতে হয়। নীলুও এই পথেই এগিয়ে আসছিলো। সিঁড়িটার কাছে আসতেই থেমে দাঁড়ালো। ঝক ঝক করা সাদা দাঁতের মিষ্টি হাসি হেসে বললো, অনি, একা একা কি করছো?

আমি বললাম, না, এমনিই বসে আছি। আপনি? এই পোশাকে? কোথ্থেকে?

নীলু বললো, কোথ্থেকে আবার? ঐদিন কলেজে তো তোমার সাথেই গেলাম। ভর্তির কাজ শেষ। গরমের ছুটির আগে আজকেই শুধু ক্লাশ ছিলো। ভাইয়া কলেজ ড্রেসটাও কিনে দিলো। অনেক দিন পর আবারো ছাত্রী ছাত্রী লাগছে। কি যে ভালো লাগছে, তোমাকে বুঝাতেই পারবো না।

আমি বললাম, কলেজের পোশাক আপনার গায়ে চমৎকার মানায়।

নীলু বললো, বাদ দাও ওসব। চলো, বাসায় চলো।

আমি বললাম, বাসায়?

নীলু সিঁড়িটার উপর পা তুলে দাঁড়িয়ে সহজভাবেই বললো, হুম বাসায়! আপত্তি আছে?

আমি বললাম, না মানে, কখনো যাইনি। কে কি ভাববে!

নীলু বললো, কেউ কিছু ভাববে না। ভাইয়া ভাবী কেউ নেই। কি যে শান্তি লাগছে, তা তোমাকে বুঝাতে পারবো না।

আমি বললাম, কোথায় গেছে আপনার ভাইয়া, ভাবী?  

নীলু মজা করেই বললো, ভাবী গেছে বাপের বাড়ী, ভাইয়া গেছে শ্বশুর বাড়ী, আর রনি গেছে মামার বাড়ী। বাপের বাড়ী মজা ভারী, শ্বশুর বাড়ী রসের হাড়ি, মামার বাড়ী আম এর কাড়ি! হ্যা হ্যা হ্যা!

নীলু খিল খিল করেই হাসতে থাকলো।

আমি বললাম, আপনি খুব মজার মেয়ে। ভালো ছড়া বানাতে পারেন।

নীলু বললো, মুখেই ছড়া কবিতা বলি, কখনো কাগজে কলমে লিখি না। আহা, চলো তো!

অগত্যা আমি নীলুর সাথে তাদের বাসার দিকেই এগুলাম।

 

নীলু বাসায় ফিরে মেঝের উপরই পা ভাঁজ করে বসলো। মিষ্টি হেসে বললো, একটু বিশ্রাম করতে দাও। হেঁটে টায়ার্ড হয়ে গেছি।

আমি বুঝলাম না, নীলুদের বাসায় ঢুকে আমি কেমন যেনো এক অস্থিরতাই অনুভব করতে থাকলাম।  নীলুর সাথে আমার যে রকম সম্পর্ক, তাতে করে এতটা অস্থিরতা অনুভব করার কথা নয়। একে বয়সে বড়, রনির ফুফু বলে এলাকার সবাই ফুফু বলেই ডাকে। আমিও ফুফু বলে ডাকি। বোধ হয় নীলু অত্যাধিক সুন্দরী বলে। আমি ছটফট করা ভাব নিয়েই বললাম, কলেজ থেকে হেঁটে এসেছেন নাকি?

নীলু তার চক চক করা সাদা দাঁত গুলো বেড় করে মিষ্টি হেসে বললো, হুম, ক্লাশ শেস হলো এগারটায়। ভাবলাম সময়টাও কাটবে, পয়সাও বাঁচবে। কিন্তু একা একা হাঁটা যে এত বোরিং বুঝতে পারিনি। আর রোদটাও কি দেখেছো?

 

নীলু হর বর করেই কথা বলে যেতে থাকলো। কেনো যেনো আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারছিলাম না। কিছু একটা বলতে যাবো ভাবতেই, নীলু আবারও বলতে থাকলো, তারপর বলো, নায়িকা খোঁজে পেলে?

আমি অবাক হয়ে বললাম, নায়িকা?

নীলু বললো, কেনো? তোমার গল্পের নায়িকা? নুতন নায়িকা পেলেই তো নুতন গলপো শুরু করা যায়।

 

আমি মনে মনে বললাম, আপনিই তো আমার বর্তমান গল্পের নায়িকা। কিন্তু, কতদূর কি হবে, তাই তো বুঝতে পারছি না।

তবে, মুখে বললাম, হুম, খোঁজছি। নায়িকা মানে বুঝেনই তো, আর কিছু না হউক, চেহারাটা সুন্দর হতে হয়। তেমন মেয়েই তো নেই।

নীলু বললো, কেনো, পেছনের বাড়ীর রূপা, ওই কোনার সীমা, খুবই তো সুন্দরী। আর তোমার বন্ধু মেসবাহ না কি নাম, ওর ছোট বোনটা তো একটা ডানা কাটা পরী!

আমি মনে মনেই বললাম, আপনিও কি কম সুন্দরী? আপনিও কি ডানা কাটা কোন পরীর চাইতে কম? যদি বয়সে ছোট হতেন, তাহলে তো এতক্ষণে প্রেমের প্রস্তাবই দিয়ে দিতাম।

তবে, মুখে বললাম, আপনিও কিন্তু খুবই সুন্দরী।

নীলু লাজুক চেহারা করে বললো, যাহ, আমি আবার একটা মেয়ে হলাম নাকি? ভাইয়া তো আমাকে সেই ছোট্ট একটা মেয়ে বলেই ভাবে। মাঝে মাঝে ভুল করে এখনো হাফ প্যান্ট কিনে আনে আমার জন্যে।

আমি বললাম, আপনি যদি মেয়ে না হন, তাহলে রূপা, সীমা, উর্মি, এরা তো শিশু!

নীলু রাগ করার ভান করেই বললো, তুমি কিন্তু আমাকে বুড়ীদের দলেই ফেলছো। আমি বড় হইনি, তা কি আমি বলেছি? ভাইয়া আমাকে বড় হয়েছি বলে মনে করেনা, আমি কি করবো? ভাবী কিন্তু আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবার জন্যে এক পায়ে খাড়া।

আমি খানিকটা অপ্রস্তুতই হয়ে পরলাম। তাইতো, কাছের মানুষদের কাছে তো কাউকেই কখনো বড় হয়েছে বলে মনে হয় না। বললাম, নীলু ফুফু আজকে আসি। আবার আসবো।

নীলু আব্দার করেই বললো, বিকেলে আবারো আসবে কিন্তু!

আমি বললাম, ঠিক আছে। 

 

 

নীলুর সাথে আমার হঠাৎ করে কেমন সম্পর্ক গড়ে উঠছিলো, নিজেও অনুমান করতে পারছিলাম না। আমি বাড়ী ফিরলাম ঠিকই, তবে এক রকম ছটফটই করতে থাকলাম শুধু। দুপুরের খাবার রেডী করতে হবে, অথচ রান্না বান্নায় মন বসলো না আমার। একটা ডিম ভেঁজেই খাবারটা সারলাম। আর ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে থাকলাম।

 

বিকেল হয় কয়টা থেকে? তিনটা বাজার পর থেকেই আমি বাইরে উঁকি দিতে থাকলাম। প্রচণ্ড খর রোদ। আমি আবারো ভেতরে ফিরে এলাম। সাড়ে তিনটা পর্য্যন্ত নিজেকে অনেক কষ্টেই মানিয়ে রাখলাম। ঘড়ির কাটাটা সাড়ে তিনটার দাগ থেকে সরতেই আমি ছুটে বেড়িয়ে গেলাম বাড়ী থেকে। তারপর, সোজা নীলুদের বাসায়।

 

দরজাটা খুলা। আমি বাইরে দাঁড়িয়েই ছোট গলায় ডাকলাম, নীলু ফুফু?

নীলু ভেতর থেকেই সামান্য উঁকি দিয়ে বললো, অনি? এসেছো? সত্যিই খুব বোর ফিল করছিলাম। ভালো করেছো, এসো।

 

আমি লক্ষ্য করলাম, নীলুর পরনে নীল রং এরই একটা স্পোর্টস জার্সির মতোই হাত কাটা ঢোলা টপস। বুকের দিকে সাদা স্ট্রাইপ রয়েছে। নীল রং নীলুর খুব পছন্দ নাকি? তার পরনে নীল রং এর পোশাকই খুব বেশী দেখি। শুধু ডিজাইন আলাদা। আমি ভেতরে চুপি দিয়ে বললাম, না মানে, আমিও খুব বোর ফিল করছিলাম। জানেনই তো, একার সংসার আমার। দীর্ঘ গরমের ছুটি।

 

নীলু আমাকে অবাক করে, পরনের টপসটা খুলার উদ্যোগই করলো। আমি তার নিম্নাংগের দিকেই লক্ষ্য করলাম। ফর্সা পা দুটি উরু থেকে পুরুপুরিই নগ্ন। নিম্নাঙ্গে প্যান্টি জাতীয় কোন পোশাক ছাড়া অন্য কিছু আর নেই। নীলু বলতে থাকলো, হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলো। গরমের দিনে বিদ্যুৎ চলে গেলে কেমন লাগে বলো তো?

আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। নীলুর পরনের টপসটার নীচে কি আছে খুবই জানতে ইচ্ছে করলো। তাই মাথা নীচু করে আঁড় চোখেই তাকে দেখছিলাম।

 

নীলুও যেনো আমাকে নিয়ে মজা করতে থাকলো। টপসটা খুলতে গিয়েও খুললো না। আমি খানিকটা হতাশ হলাম ঠিকই, তবে এক ধরনের স্বস্তির নিঃশ্বাসই ফেললাম। কারন, চোখের সামনে কোন মেয়ে, পরনের যে কোন পোশাকই খুলার উদ্যোগ করলে, হৃদপিণ্ডের স্পন্দনটা কেমন যেনো অটোমেটিকই বেড়ে যায়।

 

আশ্চর্য্য, নীলু আমাকে খানিকক্ষণ মজা দেখিয়ে, হঠাৎই পরনের টপসটা খুলে ফেললো। আমার হৃদপিণ্ডের স্পন্দনটা হঠাৎই আবারো বেড়ে উঠলো। আমি আবারো মাথা নীচু করে, লুকিয়ে লুকিয়েই নীলুকে দেখতে থাকলাম।

নাহ, বুকটা নগ্ন নয়। মেরুন কালারের সেমিজ এর মতোই একটা পোষাক তার পরনে। উঁচু উঁচু স্তন দুটি চৌকু হয়েই চোখের সামনে ফুটে উঠছিলো।

আমি এক প্রকার ছটফটই করছিলাম। অথচ, নীলু সহজভাবেই বললো, ঘরে অসম্ভব গরম। চলো, বাইরে গাছতলায় বসে গলপো করি।

এই বলে নীলু বাইরে বেড়োনোরই উদ্যোগ করলো।

 

নীলুর চেহারা দেখে কখনোই অনুমান করা যায়না যে, তার মাঝে কামনার ভাব আছে। অথচ, তার আচরন দেখে যতটুকু অনুভব করলাম, তার চেহারাটা যতই মায়াবীই হউক না কেনো, তার চাল চলন অসম্ভব ধরনের যৌন বেদনাময়ী। মায়াবী চেহারার মেয়েগুলো এমন হয় নাকি?

নীলু খুব সহজ ভাবেই উঠানে বেড়িয়ে গেলো। আমিও তার পেছনে পেছনে বেড়োলাম। ছোট বাগানটার পাতা বাহার গাছগুলোর গা ঘেষে পোঁজ মেরে দাঁড়িয়ে মিষ্টি হেসেই বললো, তোমাদের এলাকাটা খুবই চমৎকার! গাছপালায় ভরপুর। বাইরে বেড়োলে ফুর ফরে বাতাসের ছড়াছড়ি। আগে যেখানে থাকতাম, সেখানে ইট পাথরের দেয়াল ছাড়া গাছের কোন ছায়াই চোখে পরতো না।

 

আমার চোখ বার বারই নীলুর বুকের দিকেই চলে যাচ্ছিলো। আমি নিজেকে সহজ করেই নিতে চাইলাম। বললাম, শিমুলপুরে কোন কিছুরই অভাব নেই। ঘর থেকে বেড়িয়ে দু পা বাড়ালেই যা চাইবেন, তাই পাবেন। নদী বলেন, সাগর বলেন, গাছপালা বলেন আর পাহাড় পর্বতই বলেন।

নীলু বললো, ঠিকই বলেছো। ভাইয়া যখন ট্রান্সফার এর কথা বলছিলো, তখন কোন একটা গেয়ো এলাকা বলেই মনে হয়েছিলো। ভাবীও আসতে চাইছিলো না। বাপের বাড়ী থাকার সিদ্ধান্তই নিয়েছিলো। ভাইয়া অনেক বুঝিয়ে শুনিয়েই এনেছিলো। অথচ, দুদিন এখানে থাকতে না থাকতেই ভাবীর দম আটকে আসছিলো। বায়না ধরলো, বাপের বাড়ীই ফিরে যাবে।

আমি অবাক হয়েই বললাম, বলেন কি? ভাবী কি আর ফিরে আসবে না?

নীলু বললো, তা কি করে বলবো? একটু স্বাধীনচেতা। মর্জি হলে ফিরে আসবে, মর্জি না হলে আসবে না। বাদ দাও ওসব কথা। আমার কিন্তু এই জায়গাটা খুবই ভালো লাগছে। এসেই অনেকগুলো কবিতা লিখে ফেলেছি। তোমাকে পরে দেখাবো।

 

নীলু এক মুহুর্ত থেমে বললো, ভালো কথা, তোমার বন্ধু শৈবাল এর খবর কি?

আমি বললাম, কবি মানুষ। হয়তো কোন পাহাড়ের ঢালে বসে, কবিতা রচনা করছে।

নীলু খিল খিল করেই হাসলো। বললো, তোমাদের তিন বন্ধুর ধরনই আলাদা, মেসবাহ ভালো কৌতুক বলতে পারে, শৈবাল খুব ভালো কবিতা লিখে, আর তুমি লিখো গলপো। মেসবাহর কৌতুকও শুনেছি। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। শৈবাল এর কবিতাও পড়েছি। সত্যিই হৃদা ছুয়ে যায়। কিন্তু, তোমার লেখা কোন গল্প পড়িনি।

আমি বললাম, খুব বেশী গল্প আমি লিখিনি। যা লিখি, তা নিজেই ছিড়ে ফেলি। গত বছরই শুধু স্কুল ম্যাগাজিনের জন্যে একটা গল্প জমা দিয়েছিলাম। ছাপা হয়েছিলো। কেমন হয়েছে জানিনা, তবে তার পর থেকেই বন্ধুরা সবাই সাহিত্য বাবু বলে ডাকে।

নীলু বললো, সেই স্কুল ম্যাগাজিনটা থাকলে একবার দেবে? গলপো পড়তে আমার খুব ভালো লাগে।

আমি আনন্দিত হয়েই বললাম, ঠিক আছে।

 

নীলুর সাথে আলাপ শুরু হলে, ভালোই গল্প জমে। কখন কিভাবে সময় কেটে যায় টেরই পাওয়া যায়না। সেদিনও আলাপ চালাতে চালাতে সন্ধ্যাই হয়ে গিয়েছিলো। অবশেষে আমি বললাম, সন্ধ্যা হয়ে এলো, আজকে আসি তাহলে।

নীলু হঠাৎই অন্যমনস্ক হয়ে উঠলো। চেহারার ভাব সাব দেখে মনে হলো, বিদায় জানাতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছের বিরূদ্ধেই বললো, ঠিক আছে, এসো।

আমারও বিদায় নিতে ইচ্ছে করছিলো না। বাস্তবতার খাতিরেই বিদায় নিলাম। ধীর পায়েই বাড়ীর পথে পা বাড়ালাম।

 

সেদিন সকাল বেলা টুক টাক কেনা কাটার জন্যেই বাজার পথে পা বাড়িয়েছিলাম। কিছুদূর এগুতেই ব্যাস্ত রাস্তার পাশে হঠাৎই চোখে পরলো নীলুকে। খুবই আধুনিক সেক্সী পোশাক। চুলগুলোও পরিপাটি করে গুছানো। একটা মটর বাইকের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিক এর লোকজনদের চোখ গুলো তখন নীলুর দিকেই নিবদ্ধ ছিলো। আমাকে দেখা মাত্রই নীলু চিৎকার করেই ডাকলো, অনি? অনি?

 

আমি কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম, কি ব্যাপার নীলু ফুফু?

নীলু খিল খিল হাসিতেই বললো, ভাইয়া নেই বলে, ভাইয়ার বাইকটা নিয়ে বেড়িয়ে এসেছিলাম। সামান্য বাজার করে ফিরছিলাম। হঠাৎই স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেলো।

নীলু আহলাদী গলাতেই বললো, একটু উপকার করো না? আমি সীটে বসছি। তুমি পেছন থেকে একটু ধাক্কা দেবে?

আমি বললাম, ঠিক আছে, আপনি বসুন।

 

নীলু বাইক এর স্টার্টায় পা চেপে সীটে বসলো। ভট ভট শব্দ শুরু হলো, তারপরও স্টার্ট নিচ্ছিলো না। আমি পেছন থেকে ঠেলতে থাকলাম। চারিদকের লোকজন কি ভাবছিলো, সেসব নিয়ে ভাবলাম না। ঠেলে ঠেলে কিছুদূর এগুতেই, হঠাৎই স্টার্ট নিলো বাইকটা। নীলু ব্রেক চেপে বাইক থামিয়ে বললো, ধন্যবাদ অনি। স্টার্ট আসলে কোন সমস্যা ছিলো না। তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। আমার মন বলছিলো, তুমি এই সময়ে দোকানের দিকে আসবে। বিকেলে বাসায় আসছো তো?

নীলুর কথাবার্তা কিছুই বুঝলাম না। নীলু বুঝারও সময় দিলো না। বাইকে আবারও স্টার্ট দিয়ে ছুটতে থাকলো।

 

 

কেউ যদি কারো প্রতি খুব বেশী আগ্রহ দেখায়, তখন কার কেমন লাগে জানিনা। আমি খুব ভাবনাতেই পরে যাই। নীলুকে প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে গিয়েছিলো। কিন্তু, পাশাপাশি আমাকেও নীলুর ভালো লাগাটা একটু ভাবনাতেই ফেলে দিয়েছিলো। যদিও নীলু অনুরোধ করেছিলো, বিকেলে তাদের বাসায় যেতে, আমি গেলাম না।

 

দুপুরের পর অংক করা আমার এক রকম নেশাই বলা চলে। দুপুরের খাবার দাবারটা শেষ করে অংক বইটাই খুলে বসলাম। সুদকষার অংক গুলো একটু বিরক্তিকরই লাগে। সেই চাপ্টার এর অংক গুলোই মিলাতে থাকলাম এক এক করে।

 

পড়ন্ত বিকেল। মৃদু হাওয়া জানালা দিয়ে ভেসে আসছিলো। আমি হঠাৎই জানালা গলিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলাম। ভূত দেখার মতোই অবাক হলাম।

নীলু, আমাদের বাড়ীর উঠানেই হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে। জানালা ভেদ করে আমার দিকেই করুন চোখে তাকিয়ে আছে। পরনে সাধারন স্লীভলেস সাদা রং এর কামিজ। নিম্নাঙ্গে মেরুন কালার এর লং স্কার্ট। নীলুকে দেখা মাত্রই আমি জানালার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, নীলু ফুফু, আপনি?

নীলু অভিমানী চেহারা করে রইলো। এক দৃষ্টিতেই আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু বললো না।

 

আমি উঠানেই বেড়িয়ে এলাম। কাছাকাছি গিয়ে বললাম, স্যরি, অংক করতে বসে ছিলাম। অংক করতে বসলে, দুনিয়া দারীর সব কথা ভুলে যাই।

নীলু বললো, কবি আর লেখকদের মাঝে এটাই পার্থক্য। কবিরা কল্পনা বিলাসী, লেখকরা বস্তুবাদী।

আমি বললাম, বুঝেছি, সত্যিই রাগ করেছেন। আমার উপর রাগ করে লাভ নেই।

নীলু বললো, লাভ নেই কেনো?

আমি হাসতে হাসতেই বললাম, আমি কি একটা ছেলে নাকি? 

নীলু উঠে দাঁড়ালো। অভিমানী গলাতেই বললো, আমারও তাই মনে হয়। ঠিক আছে আসি।

আমি বললাম, আহা, এসেছেন, একটু ভেতরে আসেন। বসুন, চা খান।

নীলু রাগ করেই বললো, এখানে চা খেতে আসিনি। এসেছি একটা কথা বলতে। আমার সাথে যদি দেখা করতে না আসো, তাহলে তোমার সাথে আর কক্ষনো কথা বলবো না। এমন কি মরে গেলেও না।

 

নীলুর কথায় আমি হঠাৎই হতভম্ভ হয়ে গেলাম। এমন ধরনের কথা মানুষ তো তখনই বলে, যখন কেউ কাউকে খুব বেশী ভালোবাসে। নীলুর সাথে আমার বয়সের একটা ব্যাবধান আছে। নীলু আমার চাইতে কমসে কম তিন বছরের বড় হবে। বয়সে ছোট এমন কোন ছেলে কি কোন মেয়ে ভালোবাসে নাকি? আমি চোখ বড় বড় করেই নীলুর দিকে তাকালাম।

নীলুও আমার চোখে চোখে একবার তাকালো। তারপর, ঘুরে দাঁড়ালো। অতঃপর দ্রুত পদেই এগুতে থাকলো নিজের পথে। আমি পেছন থেকেই ডাকলাম, নীলু ফুফু! অথচ, নীলু আমার ডাক শুনার চেষ্টা করলো না। আরো দ্রুত পায়েই এগুতে থাকলো।

 

 

তার পর থেকেই সব কিছু কেমন যেনো ওলট পালট হয়ে গেলো। নীলু যেমনি আমাকে কোন খবর পাঠায় না, আমি নীলুদের বাসায় গেলেও দেখা করে না।

 

এমন করে একটি সপ্তাহই পার হয়ে গেলো। নীলুর সাথে আমি এমন করেই জড়িয়ে গিয়েছিলাম যে, তাকে এক নজর না দেখলেও অসহ্য লাগতো। আমি আর নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারলাম না। অবশেষে উপায় না পেয়ে আমি একটা চিরকুটই লিখলাম, নীলু, যদি দেখা না করো, তাহলে আর কক্ষনো কথা বলবো না। মরে গেলেও না।

চিরকুটটা ছোট্ট ছেলে রনির হাতে দিয়েই বললাম, তোমার ফুফুকে দেবে। আর কাউকে দেবে না কিন্তু!

 

রনি আমাদের বাড়ীতে ফিরে এলো কিছুক্ষণ পরই, আরো একটা চিরকুট নিয়ে। ভাঁজ খুলে পড়লাম। লিখা, ঠিক তিনটায় নদীর পাড়ে থাকবো।

 

তখন বেলা বারোটা। তিনটা বাজতে আরো তিন ঘন্টা বাকী। আমার সময় কাটছিলো না। উঠানে, ঘরে শুধু ছুটাছুটি করতে থাকলাম। আড়াইটা বাজতে না বাজতেই নদীর পারে ছুটলাম।

 

নীলু বোধ হয় অনেক আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলো। একটা পাথরের উপর বসে রয়েছে। মলিন চেহারা। আমি কাছাকাছি যেতেই বললো, কথা বলবে তো?

আমি আবেগ আপ্লুত হয়েই বললাম, তোমার কি হয়েছে বলো তো?

নীলু উঠে দাঁড়ালো। বললো, কথা ছিলো, যদি দেখা না করি, তাহলে আর কথা বলবে না। আমি দেখা করেছি। তুমি কথা বলবে, মরে যাবার সময়ও বলবে। আমি তোমার কথাই রেখেছি।

এই বলে লোকালয় এর দিকেই এগুতে থাকলো দ্রুত পায়ে। আমি পেছন থেকেই ডাকলাম, নীলু, দাঁড়াও! কি হয়েছে তোমার? আমার কি অপরাধ?

 

নীলু আমার কথা কিছুই শুনলো না। দ্রুত পায়েই এগুতে থাকলো। নীলুর ব্যাপারটা আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ এমন বদলে গেলো কেনো? আমিও পেছনে পেছনে ছুটলাম।

একটা মেয়ের সাথে হেঁটে আমার পারার কথা ছিলো। অথচ, নীলুর আচরণে, আমার বুকের ভেতরটা এতই আহত হয়ে উঠলো যে, আমি নদীর বালু চড়ে হাঁটু গেঁড়েই থেমে গেলাম।

 

বাড়ীতে ফিরে এলাম সন্ধ্যার পর। খাবার দাবার কিছুই ভালো লাগলো না। বিছানায় উবু হয়ে পরে রইলাম শুধু।

 

পরদিন সকাল বেলা। ঘুম থেকে উঠলাম। মাথার ভেতরটা অবসন্ন। বিছানা থেকে নেমে এক গ্লাস দুধ বানিয়ে নিলাম। মুখে দেবো, ঠিক তখনই কলিং বেলটা বেজে উঠলো। দরজা খুলে দেখলাম, রনি দাঁড়িয়ে। বললাম, কি ব্যাপার রনি?

রনি কিছু বললো না। একটা চিরকুট বাড়িয়ে ধরলো।

আমি চিরকুটটা হাতে নিয়ে ভাঁজ খুললাম। পড়লাম, লিখা, চলে যাচ্ছি। ট্যাক্সি চলে আসবে কিছুক্ষণের মাঝেই। শেষ বার এর মতো দেখা করতে খুব ইচ্ছে করছে।

 

 

 

নীলু খবর পাঠিয়েছে শুনে, ছুটেই গিয়েছিলাম আমি। বড় রাস্তার মোড়েই অপেক্ষা করছিলো সে। পরনে নীল রং এরই স্কীন টাইট টপস, চোখে সান গ্লাস। খুব গম্ভীর চেহারা করেই আমার দিকে তাকিয়েছিলো, সান গ্লাসের আড়ালে চোখ দুটি লুকিয়ে।  আমি ব্যাস্ত হয়েই বললাম, কি ব্যাপার নীলু?

নীলু গম্ভীর গলাতেই বললো, দেশের বাড়ীতে চলে যাচ্ছি। ভেবেছিলাম, তোমাকে না জানিয়েই চলে যাবো। কিন্তু, মনটা মানলো না।

 

নীলুর কথা শুনে আমার গলা থেকে কথা বেরোতে চাইলো না। তারপরও বললাম, কি ব্যাপার? হঠাৎ! বেড়াতে যাচ্ছো নিশ্চয়ই।

নীলু বললো, না, হয়তো আর ফেরা হবে না। আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।

আমি অপ্রস্তুত গলাতেই বললাম, কখন? কার সাথে?

নীলু বললো, আমিও ভালো জানিনা। ভাবীই সব ঠিক ঠাক করেছে। ভাইয়াকেও ম্যানেজ করে ফেলেছে। ভাইয়ার কথা তো বলেছিই, ভাবীর কথাতেই উঠে বসে। আমার কোন কথাই ভাইয়া শুনলো না।

 

আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না। হয়েই দাঁড়িয়ে রইলাম। নীলু বললো, আর বেশী দেরী করতে পারবো না। ট্যাক্সি অপেক্ষা করছে।

এই বলে হাত নেড়ে বিদায় নিলো নীলু।

আমার হাতটা উঠতে চাইলো না। মাথার ভেতরটা কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগলো। নীলু খানিক দূরে দাঁড়ানো ট্যাক্সিটাতে গিয়েই উঠলো। ট্যাক্সিতে বসে, মাথাটা বেড় করে, আবারো হাত নাড়লো। অবশেষে, আমিও হাতটা উঠালাম। হাতটা নেড়ে বিদায় জানালাম ঠিকই। কেনো যেনো নিজের অজান্তেই চোখ দুটি থেকে জল গড়িয়ে পরতে থাকলো।

 

এই গলপোটা আমি এখানেই শেষ করি। গলপোটা শুনার পর, অনেকেই প্রশ্ন করে, তারপর? তারপর কি হলো?

আমি কিছুই বলি না।

 

(এই গল্প পুরুপুরিই কাল্পনিক। বাস্তব জীবনে কারো সাথে মিল খোঁজে পেলে ক্ষমা করবেন।)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান