সরদার মোহম্মদ রাজ্জাকের তিনটি কবিতা
সরদার মোহম্মদ রাজ্জাকের তিনটি কবিতা
পূর্ণিমা 

 

হে অনন্ত অসীম স্বপ্ন-ভাঙ্গা উচ্ছল তরুণী কন্যা

তুমি কি দেখেছো তোমার নিটোল চোখের তারায় গেঁথে যাওয়া

নিঃসীম সাঁঝের আকাশ

তোমার চোখেই তো গেঁথে আছে সে-

তারপরেও কি তুমি দেখেছো ওকে??

যে হৃদয়ের কাদা মাটি জলে বসবাস করে

তাকে কি দেখা যায়?

সে তো জেনে গেছে মৃত্যুর অভ্রান্ত সিংহনখে

ছিঁড়ে ফেলা হবে তোমার সব ত্বক

কুটি কুটি করা হবে সব মাংস আর অস্থি মজ্জা;

তোমার চারদিক ঘিরে নৃত্য করবে শুধু

'অনাদ্য কালের' নীল বাতাসের দল--

তুমি যাবে মহিমা ধারণকারী মহামান্য বুদ্ধের কুটিরে

বুদ্ধের মুখে ফাল্গুনী পুর্ণিমার জ্যোৎস্নার আলো পতিত হবে

সাঁঝের আকাশ থেকেই-

কেউ কি বলতে পারে পূর্ণচন্দ্র পূর্ণিমার আলো

সাঁঝ বেলাতেই বিকশিত হয়?

কেউ না জালেও তুমি তো জানো--বিকশিত হয়;;

তোমার সুমুখেই তোমার পুত্রের মৃতদেহ শায়িত

অথচ সে আলো তোমার মৃত পুত্রের মুখে পতিত হয় না

'লে নিশ্চয়ই বেঁচে উঠতে পারতো তোমার পুত্র অর্নব

তোমার কান্নার প্রয়োজন হতো না

কান্না ভেঙ্গে পড়তো ওই নীল বাতাস দলের চোখে মুখে

তোমার কাছেই ওরা ভিক্ষে চাইতো ওদের জীবন

তুমি দান না করলে মহান বুদ্ধও পারতো না ওদের জীবন দান করতে

অক্ষম 'য়ে যেতো ওদের করুণার কাছে

শিরীষ বৃক্ষের ফুটন্ত পুস্প-বৃষ্টি ঝরতো

তোমার পুত্র অর্নবে বুকে

বেঁচে উঠতো অর্নব।

কিন্তু তা হবে না--বুদ্ধের আদেশ নেই

তোমার নিজের নামটিই তো পূর্ণিমা

অথচ পূর্ণিমা 'য়ে পৃথিবাকে আলোকিত করেও তুমি

কাঙ্গালিনীর মতো শ্রান্তিহীন শষ্য প্রার্থণা করো

রাত্রি দিবস ব্যপী; কী অসামন্য দুর্ভাগ্য তোমার!!

মৃত পুত্রকে কোলে নিয়ে প্রবেশ করে পূর্ণিমা বুদ্ধের কুটিরে

পুত্রকে উপঢৌকন দেয় বুদ্ধের পদতলে--

হে মহামতি বুদ্ধ- জীবিত করো আমার পুত্রকে

অথবা তোমার ধ্বর্মবাণীকে অস্বীকার করো

মিথ্যের চাদর গায়ে জড়িয়ে তুমি ভগবান সেজে 'সে আছো

কোনো ক্ষমতাই নেই তোমার

কিসের আদেশ প্রদান করো তুমি আমাদেরকে??

যদি সামান্যতম হলেও তোমার ক্ষমতা থাকে

সে ক্ষমতা হস্তান্তর করো আর কাউকে

যে আমার পুত্রকে জীবিত করতে পারবে--

আমি মহাপ্রস্থানে চললাম- আশির্বাদ করি তোমরা সুখী হও

বুদ্ধের উত্তর;

আমি জীবিত--কথা 'লে উঠলো অর্নব;

আমি মৃত নই, কখনই মৃত ছিলাম না

সবাই আমার মাতাকে বুঝিয়েছে- আমি মৃত 'য়ে গেছি

তুমিও সে কথাই বিশ্বাস করেছো--

তাহলে কেনো ভগবান বুদ্ধ হবে তুমি??

আমার মাতা পৃথিবীকে আলোকিত করেন

সেই আলোকের কোলেই আমি জীবিত ছিলাম

এখনও আছি--

চলুন মাতা আমরা আমাদের কুটিরে ফিরে যাই।

পথ চলতে শুরু করলো মাতা পুত্র--

এবার পুত্রের ললাটে চুম্বন করবার পর

পূর্ণিমার পূর্ণ-চন্দ্র বিভা আলোকিত করলো

পুত্র অর্নবের গোটা মুখোমণ্ডল।

ফিরে গেলো ওরা আপন কুটিরে।

 

 

লীলাবতী

 

মঙ্গলদ্বীপ আর কত দূর...............

বিচিত্র উষ্ট্রের সারি চলেছে

লক্ষ মঙ্গলদ্বীপ-

এসেছে চন্দ্রদ্বীপ থেকে, চন্দ্রদ্বীপে প্রবল আকাল

সবগুলি পকেট ভর্তি শূন্যতা নিয়ে চলেছে উষ্ট্রারোহীরা

অন্তহীন মরুভূমিতে ভাঙ্গা জাহাজের দিক হারানো

পাল ছেড়া বিমর্ষ নাবিকের মতো।

সুইসাইড নোট লিখবার জন্যে পস্তুতি নিয়েছিলো নাকি অনেক আগেই

সইসাইড আর করা হয়নি;

সে নাবিক আর এখানে নেই

উষ্ট্ররোহীরা ওর কথা ভেবে বিব্রত হয়ে

লাল খামের কথা ভাবছে এখন

কখন যে চিঠিটি আসবে............

সময় ফুরিয়ে যাবার আগে বাতাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে

হেঁটে হেঁটে উড়ে যায় দেবদুত;

কি বাণী পৌঁছে দিয়ে গেলো সে??

তাহলে মৃত্যু কি অনিবার্য;

লাল খাম তো মৃত্যু পরোয়ানাই জারি করে 'লে শুনেছে ওরা

মঙ্গলদ্বীপের ক্রন্দন উপত্যকায় কি

অনিবার্য মৃত্যু প্রহরায় নিয়োজিত এখন

ওদেরই প্রতীক্ষায়??

পৃথিবীর পথ খোলা নেই

দরোজা নেই

জানালাও নেই

ভেন্টিলেটার গুলিকে সব রুদ্ধ করা হয়েছে

পৃথিবীর শ্বাস প্রশ্বাস এখন

বন্ধ ঘড়ির দাঁড়িয় থাকা কাটার মতো স্থবির হয়ে গেছে

ডানেও ঘোরে না বামেও ফেরে না।

তবুও মঙ্গলদ্বীপে ওদেরকে পৌঁছুতেই হবে

পৃথিবীতে যে আর জায়গা নেই- পোকা মাকড় দিয়ে ঠাসা

একে অপরের অঙ্গচ্ছেদ করতে ভীষণ ব্যস্ত ওরা

একজনের মাংস খেয়ে আর একজন বাঁচবার

আহ্লাদে মত্ত হচ্ছে।

মঙ্গলদ্বীপে পৌঁছুতেই হবে ওদেরকে;

অন্ততঃ বেঁচে তো থাকা যাবে!!

থেমে গেলো উটের চলমান সারি

বিশ্রামের নির্দেশ এলো ওদের নেতা

বৃদ্ধ কলিমুল্লাহর কাছ থেকে।

থেমে গেলো সামান্য কিছু সময়ের জন্যে জীবন চলার গতি

লীলাবতী কাছে এলো নেতার--

হে মহান, আমরা আনন্দ করতে চাই-

না, আগে মঙ্গলদ্বীপ তারপর ওসব।

বিশ্রাম শেষে আবার সচল হলো উষ্ট্রের বহর।

পূণরায় একজন অশ্বারহী সৈনিক এসে

একটি লাল খাম নেতার হাতে দিয়ে বললো--

আমি মঙ্গলদ্বীপের সৈনিক- চিঠিটি আপনার

অদৃশ্য 'য়ে গেলো সৈনিকটি--

লীলীবতী  চিঠিটি পাঠ করলো--

লেখা রয়েছে...............

মঙ্গলদ্বীপে যুদ্ধ শুরু হয়েছে চন্দ্রদ্বীপের সাথে- তোমরা

ওই দু'দেশের যে কোনো একটিতে গেলে নির্ঘাৎ মৃত্যু।

নেতা সবার মতামত চাইলো--

লীলাবতী খুবই দৃঢ়তার সাথে বললো--

আমরা যুদ্ধ করেই বেঁচে থাকতে  চাই;

কীট পতঙ্গের মতো মরতে চাইনা

মঙ্গলদ্বীপ অধিকারের পর আমরা পৃথিবীকে জয় করবো

মঙ্গলদ্বীপ এবং চন্দ্রদ্বীপের সৈনিকদেরকে নিয়েই--

আমরা পৃথিবীর সব দরোজা খুলে দেবো

সব জানালা খুলে দেবো

আলোকিত হবে আবার পৃথিবী-

সবাই একমত হলো

চলতে শুরু  করলো উষ্ট্রের সারি

সামনেই এখন মঙ্গলদ্বীপ।

০৩.(এই কবিতাটিতে কুড়িগ্রামের দীন দুখি অসহায় মানুষদের বিশেষতঃ কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের অতি দুখি মানুষদের দৈনন্দিন জীবন প্রবাহের একটি বাস্তব চিত্রকে অঙ্কন করবার চেষ্টা করা হয়েছে। কবিতাটি পাঠ করুন। ভালো লাগবে)



শৃঙ্গার

 

শৃঙ্গার।

ল্যাপটপের স্ক্রীনে লেখা প্রথম শব্দ এটি।

এরপরে লেখা কতগুলি মানুষ জাতিয় প্রাণী

নারী পুরুষ;

কিলবিল করছে একটি বড় আকারের পিপের ভেতরে

পুরুষ প্রাণী গুলি নারী গুলির ঠোঁটে শৃঙ্গার করছে

আবার কখনও বা সারা শরীরে;

কিছুতেই পতন হচ্ছে না ওদের শৃঙ্গারের।

একজন মধ্যবয়সী শীর্ণদেহী লোক

ল্যাপটপটির সামনে 'সে লিখছে।

অকস্মাৎ স্ক্রীন জুড়ে একটি গ্লোব এসে স্থির 'য়ে রইলো;

কীবোর্ডের কয়েকটি বাটনে

এলোমেলো চাপ দেবার পরেও কোনো রেজাল্ট আসলো না;

আধা মিনিট স্থিত থেকে গ্লোবটি অদৃশ্য 'য়ে গেলো--

লোকটি জানে মাঝে মাঝে আপনা আপনি বিভিন্ন ধরণের চিত্র এসে আবার 'লে যায়।

লোকটি এবার ওই গ্লোবের চিত্রটিকে অনুসরণ করে

ল্যাপটপে একটি বৃত্তের ছবি আঁকলো

এবং পরপরই মগ্ন হয়ে আমাদের পৃথিবী নামীয় গ্রহটির

আয়তনের মাপ জোঁক করতে শুরু করলো সে-

বিভিন্ন রেখাচিত্র অঙ্কন করতে করতে;

বোঝা গেলো লোকটির জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কেও

যথেষ্ঠ জ্ঞান রয়েছে;

কিন্তু কাজটি সে বেশীক্ষণ করলো না,

ফিরে গেলো তার পূর্বের লেখায়--

পিপের ভেতরের  শৃঙ্গার রত প্রাণী গুলি দেশেরই শ্রমিক মজুর শ্রেণীভুক্ত অসহায় দীন দুখি মানুষ নামে অভিহিত-

তাদের চলিষ্ণু জীবনের ধারাই তার সব লেখার মূল সাবজেক্ট;

আমি উত্তরবঙ্গবাসী কুড়িগ্রামের কথা বলছি--

জেলা শহর কুড়িগ্রামেই তার বাস; এখান থেকেই সে জাতিয় পর্যায়ের

সাহিত্য চর্চা করে।

ভাঙ্গা ভাঙ্গা নদীরা যখন নারীর আঁচলে মুখ লুকোয়

তখন সে তার ভাঙ্গা প্রাণ নিয়  নদী গুলিকে বাঁচাতে চায়।

'হাঙ্গার' 'লে যে একটি কথা রয়েছে সে কথাটিই

নদীকুলের এই মানুষ গুলির প্রাত্যহিক সহচর।

এই লোক গুলিই শত শত হাজার হাজার

পিপের ভেতরে থেকে শৃঙ্গার করছে;

শৃঙ্গার পর্যন্তই এদের সীমা--

পূর্ণাঙ্গ সুখ এরা কখনই উপভোগ করতে পারে না;

বিধির বিধান মনে 'রে বিধির কাছেই ওদের সুখ অর্পন  করে।

সবার রক্তে আগুন জ্বলে; এদের রক্তে জ্বলে না--

এদেরকে ক্লীব করে রাখা হয়েছে-

এরা সন্তান উৎপাদন করতে পারে না

প্রজন্মও আর নির্মিত হয় না--

এরা ক্রীতদাস!!

এরা জীবনের কোনো বাঁঁক থেকে সূর্যকে দেখে না,

নারীতে এরা প্রলুব্ধ হলেও সক্ষমতা রাখে না,

নারীরাও তাই- করাগারের কনডেম সেলের বন্দীরা যেমন--

কামনার আগুনে এরা পোড় না,

পোড়ে কেবল উপবাসের তীব্র আগুন-শিখার দহনে।

কুড়িগ্রামের নিচু এলাকা- চরাঞ্চলে এদের মূল বসত--

সবই ভাঙ্গাচোরা; বসবাসের উপযুক্ত নয়।

কখনও বানের পানিত ডুবে যায়

আবার কখনও বা নিদারুণ খরায় পুড়ে যায়

এরাই ধার করা সার্টপ্যান্ট 'রে আর

কালারফুল সানগ্লাস চোখে দিয়ে

শহর নামের মাতাল পানশালায় গিয়ে ঢুকে যায় শেষ অব্দি

সুখের মুখ দেখবার স্বাপ্নিক রংধনু সুখের মতোই

'বিলীন বিশ্বাস'- 'য়ে যায় সানগ্লাসের ভাঙ্গা কাচের টুকরোর মতো।

এই পর্যন্ত  লিখে লেখাটিকে পাঠ করতে শুরু করলো সাহিত্যিক--

কক্ষে প্রবেশ  করলো মনজুরুল ইসলাম নামের একজন মানুষ;

মানুষটি সাহিত্যিকের চেনা; বড় কাছের,

এখানকার একটি কলেজের সহকারি অধ্যাপক,

মাঝে মাঝে সাহিত্যিকের কাছে আসে--

সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করে।

ওকে দেখে সাহিত্যিককে একটু খুশি 'লেই মনে হলো-

বললো--দেখোতো কেমন হলো??

লেখাটি পাঠ 'রে মনজুরুলের উত্তর--

কী লিখেছেন কুড়িগ্রামের দুখি মানুষদেরকে নিয়ে!!

অসাধারণ!!

তুমি আমার সঙ্গে থেকো-

আমরাই যুদ্ধটি শুরু করবো--

এই অসহায়, নিরাশ্রয় মানুষ গুলিকে ক্লীবত্বের পিপে থেকে

বের করে আনতে  হবে;

শুধু শৃঙ্গার-বৃত্তেই ওদেরকে ব্যপৃত রাখা যাবে না;

ওদেরকে উৎপাদনক্ষম 'রে তুলতে হবে--

ওদের মাধ্যমেই  নতুন  প্রজন্মের  নির্মান সিদ্ধ করতে  হবে,

ওদেরকে পূর্ণ আস্বাদনের তৃপ্ততা দান  করতে হবে।

কী থাকবে তো??

অবশ্যই।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান