গল্পঃ কানু হারামজাদা - অরণ্য আপন
গল্পঃ কানু হারামজাদা - অরণ্য আপন

কবি ও গল্পকার : অরণ্য আপন

ঝড়া বৃষ্টিতে ঘরবাড়ি কাক ভেজা হয়ে যায়নি শুধু কুকুর হয়ে গেছে। চায়ের টং দোকানে স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় ধূসর রঙের পুরনো এক বেঞ্চে পায়ে পা ঠেসে বসে আছি। গাছের ডালে এক জোড়া কাক খিস্তি দিয়ে যাচ্ছে। বিনেপয়সায় বিনোদন আর কি! ঝড়বাউড় হচ্ছে, আর মদ্দাটার হদিশ নেই, এত বকি তবু আক্কেল হিঞ্জেল হল না। চোখে লাজলজ্জা না থাকলে যা হয়, আরে বাবা! আকাশে মেঘ করে আসছে, বাড়িতে সুড়সুড় করে চলে আসবে, তা না, উনি ঘাউ মেরে বসে থেকে পাড়ার বউঝির চুল ঝাড়া দেখছে। ঘাড়টা কাত করে কাকের দিকে তাকাতেই চোখ পড়ল কানু হারামজাদার দিকে। কানু লোকটা ভালোই, তবু লোকজন কেন যে কানু হারামজাদা নামে ডাকে সেই রহস্যের প্যাঁচ আমি এখনো খুলতে পারিনি। বয়স ত্রিশের কাছে, তাগড়া জোয়ান একটা মানুষ। আমার সামনের বেঞ্চের ওপর পা দুটো হাঁটু ভাঙা দ করে ফস করে বসল। একটা পাতল হাসি দুগালের চোয়ালের ফাঁক বেয়ে ঠোঁটের ঘেঁষা খেয়ে ফিক করে বের করে দিয়ে বলল, কেমন আছ? লোকটার চোয়াল বসে গেছে, মাথাত ঝাঁকড়া চুল বাঁশবাগান হয়ে আছে। খুব বেশিদূর পড়াশোনা নেই, তবে স্কুলে তার চেয়ে বেশি নম্বর কেউ তুলতে পারেনি। নারী যে শুধু সৃষ্টির না, নাশেরও তার একমাত্র দৃষ্টান্ত এই কানু হারামজাদা। দুনিয়ার আর মেয়ে পেল না, প্রেমে পড়ল এক হিন্দু মেয়ের, তারপর যা হবার তাই হল, ধর্ম এসে প্রেমে বাধ সাধল। প্রথম প্রেম, মন থেকে উগলাতে পারল না।
বললাল, ভালো আছি। আপনাকে তো অনেকদিন চোখে পড়ে না, ভাবীকে তো মাঝেমধ্যে দেখি এবাড়ি ও বাড়ি কাজ করতে। আপনার মেয়েটা তো দিনদিন বড় হচ্ছে, পড়াশুনা করান লাগবে না? মেয়েটার মাথা নাকি খুব পরিষ্কার। আপনি থাকেন কোথায় বলেন তো?
বাড়িতেই থাকি, মাঝখানে ঢাকা গেছিলাম রিকশা চালাতে। এলাকায় তো কামকাজ নেই। শোনো, তোমাকে একটা গল্প বলি। আমাদের বাড়িতে একটা বিড়াল আছে। যখনই ওর ক্ষুধা লাগে, আমার কাছে এসে আমার পা চাটতে শুরু করে। আমার বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ওর ক্ষুধা লেগেছে, তাই এই সেবার অবতারণা। আমি ওকে খেতে দিই। আমি একদিন চিন্তা করলাম, আমার চেয়ে আমার বিড়াল উত্তম। তার ঈমান খুব মজবুত। সে বিশ্বাস করে যে তার মালিক তার জরুরত মিটাবে কিন্তু মানুষের কোনো বিশ্বাস নেই তার মালিকের প্রতি। আর তাই সে সমস্তকিছুর দায় দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়, সমস্ত ফিকির তার। সেসমস্ত ব্যাপারেও সে জিম্মাদার হয় যা তার ইখতিয়ারের বাইরে। মানুষ কেন যে এত হলদিল আমি বুঝি না।
মানুষের জরুরতের কথা তার প্রভুর কাছে মাগা উচিত, ঈমান শক্ত রাখা যে প্রভু কবুল করবেন।
আমি যে উদ্দেশ্যে এই চায়ের দোকানে বসেছিলাম তা ভেস্তে গেল, কানুর গল্পের মধ্যে এমনভাবে ডুবে গেছিলাম যে বুঝতেই পারিনি কখন খুশবু চলে গেছে। এক পলক না দেখলে কি হয়! রাত পার হতে চাইবে নানি! নাকটা দুঅাঙুল দিয়ে চ্যাপ্টা করে ধরল। কই না তো! সর্দিও তো লাগেনি। তাহলে নাকে খুশবুর গায়ের গন্ধ তো লাগার কথা, লাগল না কেন? সব দোষ এই কানু হারামজাদার। লোকে কি সাধে কানু হারামজাদা বলে! এমন একটা গল্প পেতে বসল যার ভেতর থেকে বের হতে পাচ্ছি না। বুদ্ধি লাগাতে পাচ্ছি না, খুশবুকে দেখার রাস্তা বের করতে হবে।
কী ব্যাপার তুমি বোবাকালা হয়ে গেলে যে? আমাকে উঠতে হবে।
তাড়া আছে?
হ্যাঁ।
কোথায় যাবেন?
খুশবুদের বাড়ি। ওর বাপে যেতে বলেছে। তুমিও সাথে যেতে পার। দুজন গল্পগুজব করতে করতে যাওয়া যাবেনি!
আমি আবার এই লোকটার কথা শুনে চমকে গেলাম। মানুষ কেন এত হলদিল হয়! কানুর এই কথাটা আমার মাথার মধ্যে ভনভন করে মাছির হল্লার মতো ঘুরতে লাগল। এ কেমন সাধুসন্ত লোক রে বাবা!


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান