সালাহউদ্দিন সালমান এর কবিতা
সালাহউদ্দিন সালমান এর কবিতা
জীবন, এক নিঃশব্দ উচ্চারণ

 

আমি কখনো জীবনকে বলিনি

তুমি আমাকে ব্যাখ্যা করে দাও,

আমি শুধু বসে থেকেছি জানালার ধারে,

যেখানে সময় নিজেই ভুলে যায়

সে আসলে চলছে, না থেমে আছে।

 

জীবন

তুমি কি গন্তব্যের মানচিত্র?

না কি শুধু চলার ছায়া,

যেখানে পথেই থাকে প্রশ্ন,

আর উত্তররা জমে থাকে কেবল

অপেক্ষার গোপন চিলেকোঠায়?

 

আমি যাকে ছুঁতে গিয়েছি, সে ছিল ধোঁয়া,

যাকে এড়িয়ে চলেছি,

সে- ছিল আমার একমাত্র প্রমাণ।

এভাবেই বুঝেছি

জীবন মানে সবসময় পেতে নয়,

অনেকসময় হারানোর গভীরতাও এক সম্পদ।

 

আমার মুখস্থ জীবনদর্শনে লেখা নেই ঈশ্বর,

তবুও বিশ্বাস করেছি

কোনো এক অলৌকিক হাত

আমার ভাঙা কথাগুলো সেলাই করে দেয় নিঃশব্দে।

সেই সেলাইয়ের রেখায় আমি পড়ে নিই

আমার না-বলা শব্দের আত্মজীবনী।

 

জীবনকে আমি এখন দেখি

একটা উল্টো ঘড়ির মতো,

যার প্রতিটি টিকটিক শব্দে

আমার ফেলে আসা ভুলগুলোর কণ্ঠস্বর বাজে,

আর প্রতিটি ভবিষ্যৎ

নিজেই ফিরে আসে নিজের ছায়া হয়ে।

 

তোমার মতো আমিও বলি

কবিতার দিকে চেয়ে থাকি যতক্ষণ না

আমার মস্তিষ্কে আবার ঝরে পড়ে

নির্জন এক বৃষ্টিময় আমি,

যেখানে নিজেকেই চিনতে পারি না,

তবুও জানিআমি আছি।

 

 

চেতনাগ্রস্ত ভূমিপুরের ঠিকানা

 

আমি লিখিনি, লেখা হয়ে গেছে

নীরব এক নিঃশ্বাসে উড়ে গেছে শব্দের ভেতরকার ভাষা।

চেতনাগ্রস্ত ভূমিপুরে যেই বীজ পুঁতেছিলাম,

তা আজ গোপন ইতিহাসে

ফসল নয়, প্রতিচ্ছায়া ফলিয়েছে।

 

যন্ত্রণার জ্যামিতি আঁকা ছিলো হাতে,

বেদনার ব্যাকরণ মুখস্থ

আর আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম

দুপায়ের নিচে জন্মের মাটিচাপা স্পন্দন নিয়ে।

 

হয়তো কোনো দহনঢলের জানালায়

আবছা এক দুপুর এসেছিলো

যেখানে কবিতা নিজে লিখে গেছে আমাকে,

খুঁড়ে এনেছে গোপন এক কেন্দ্রবিন্দু,

যা কখনোই পৃথিবীর মানচিত্রে ছিল না।

 

নিঃস্ব নিঃশব্দে সেই শব্দ উঠেছে,

শিকড় ছিঁড়ে, আয়নার কাঁচে, সমুদ্রের লবণে

এক অলঙ্ঘনীয় প্রচ্ছদে,

যেখানে অনির্দেশ্য অপূর্ণতাই

আমার একমাত্র ঠিকানা।

 

আমি এখন কবিতার দিকে চেয়ে বলি

লিখে যাও, যতক্ষণ পর্যন্ত

আমার মাথার গোপনে নির্জনতা ফোটে,

আর চেতনগড়ের আঙিনায়

বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে আমার সমস্ত আমি।

 

পুরান ঢাকা

 

তুমি জানতে চেয়েছিলে

পুরান ঢাকা মানে কি শুধু ভিড় আর বিরিয়ানির গন্ধ?

আমি বলেছিলাম

এটা সেই শহর, যেখানে মসজিদের মিনার আর মন্দিরের ঘণ্টা

একই আকাশে বাজে

আর মোহাম্মদপুরের অলি-গলিতে

বেঁচে থাকে একটা সহাবস্থানের ম্লান কবিতা।

 

তুমি শুনতে চেয়েছিলে

কেমন হয় বুড়িগঙ্গার রাত?

আমি বলেছিলাম

ওই নদী তো শুধু জল না,

ওখানে ডুবেছে এক সুলতানি বিকেল,

আর উঠে এসেছে হাজারো অজানা নামের ভাসমান সংসার।

 

তুমি জানতে চেয়েছিলে

শহরের ইতিহাস কি শুধুই পাঠ্যবইয়ের তারিখ?

আমি বলেছিলাম

না, এখানে প্রতিটি জানালায় লুকিয়ে আছে

একটা পরাধীনতার গল্প,

আর প্রতিটি পুরনো দেয়ালে

লেপটে আছে এক খণ্ড স্বাধীনতার গন্ধ।

 

পুরান ঢাকা

এখানে রিকশাওয়ালার হেঁকে ওঠা গানে

মিশে যায় উর্দু, বাংলা আর হিন্দির টান,

এখানে ধুপখোলা মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে

এক বৃদ্ধ এখনো বলে— “আমি নবাবপুরের ছেলে…”

 

এখানে প্রেম মানে

আজিমপুর কবরস্থানের দেয়ালে লেখা শেষ চিঠি,

আর ইসলামপুরে এক শাড়িওয়ালা দোকানির চোখে

রয়ে যাওয়া নরম একটি সালামের প্রতিধ্বনি।

 

তুমি যদি কখনো হাঁটো শাঁখারীবাজারের সরু গলিতে,

আমি দেখাবো তোমাকে

একটা উনুনে ফুটতে থাকা পুরোনো সংসার,

একটা গলিতে হারিয়ে যাওয়া কালীপূজার উৎসব,

আর চকবাজারের এক ঠোঙায় বাঁধা

একটি শহরের স্মৃতি আর স্বপ্নের সন্ধি।

 

নির্বিকার ঈশ্বর

 

আমি ঈশ্বরকে খুঁজিনি মন্দিরে,

সেজদার ফাঁকে কিংবা প্রার্থনার পঙক্তিতে

আমি তাকে খুঁজেছি

একজন পিতার শূন্য থালায়,

একজন ধর্ষিতার আদালতচাপা কণ্ঠে,

আর একজন কবির ছেঁড়া খাতায়

যেখানে লিখা ছিল— “ক্ষমা করো না।

 

ঈশ্বর

তুমি যদি থেকেও থাকো, তবে কেন এতটা নির্বিকার?

তুমি কি দেখোনি

ছেলেটা স্কুল ড্রেস পরে বেরিয়ে

পাঁচ ঘণ্টা ধরে পিঠে রক্ত বয়ে ফিরেছে?

 

তুমি কি শুনোনি

এক মা প্রতিদিন তার নিখোঁজ সন্তানের নাম ধরে ডাক দেয়,

আর প্রতিধ্বনি শুধু ফিরে আসে

নীরবতার গর্ভে?

 

তোমার আকাশ কি কেবল আকাশই থাকে,

যখন নিচে পোড়ে মানুষের শরীর?

তুমি কি শুধু মৌন চন্দ্রবিন্দু,

নাকি এক গোপন কর্তৃত্ব,

যে প্রতিটি অন্যায়ের সময়

ঘুমিয়ে পড়ার অভিনয় করে?

 

আমি এখন তোমার দিকে আর তাকাই না

তোমার কোনো মুখ নেই আমার কাছে,

তোমার কোনো হাতে আর ভরসা রাখি না আমি।

তোমার আয়ুর চেয়ে দীর্ঘ এখন মানুষের কান্না,

আর তোমার নীরবতার চেয়ে প্রবল

আমাদের অনিচ্ছাকৃত প্রার্থনা।

 

তবুও

প্রতিদিন আমি এক গভীর সন্ধ্যায়

আকাশের দিকে চেয়ে থাকি,

কারণ আমি জানি

নির্বিকার ঈশ্বরেরা নয়,

মানুষই মানুষকে বাঁচায়।

 

 

মানুষের ধর্ম

 

নিশ্ছিদ্র রাতের আঁধারে আমি মানুষ খুঁজেছি,

ধর্মের পোশাকে নয়চোখের জলের ভাষায় বুঝেছি।

আমি রুটি দিয়ে মুখ ঢেকেছি, লজ্জা নয়, ক্ষুধা লুকাতে,

আমি নামাজ ভেঙেছি শিশুর কান্নায়, ঈশ্বরকে কাছে পেতে।

 

আমি কাঁধে নিয়েছি মৃতদেহ

সে হোক মন্দিরের পুরোহিত কিংবা মসজিদের ইমাম,

আমি জানিনি তার পরিচয়, প্রয়োজনও হয়নি

কারণ হৃদয়ের ভাষা সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে নাম।

 

আমি হেঁটেছি শ্মশান থেকে কবর পর্যন্ত দীর্ঘ পথ,

আমি জেনেছিমানুষ মরলে শুধু নিঃশ্বাস থামে,

তার বিশ্বাস নয়, তার প্রেম নয়, তার আর্তনাদ নয়

তা থেকে উঠে আসে সেই একটাই নাম—“মানবতা

 

আজান আর গীতার সুরে আমি একই আর্তি শুনি,

একই মমতা, একই আশ্বাস, একই আলোর ধুনি।

আমি জেনেছিযে ধর্ম ভালোবাসা শেখায় না,

সে ধর্ম নয়, তা কেবলই এক বিভেদের ছায়া।

 

তাই আমি বলিপ্রেম ভাঙে না জাতের কারাগারে,

মানবতাই শেষ ঠিকানা, আমাদের সবার অভ্যন্তরে।

ধর্ম থাক, কিন্তু বিভেদ নয়

থাক বিশ্বাস, কিন্তু থাকুক ভালোবাসার পরিচয়।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান