মোঃ সাইফুল ইসলাম মাসুম । গুচ্ছ কবিতা
মোঃ সাইফুল ইসলাম মাসুম । গুচ্ছ কবিতা

কবরনামা: এক ভয়াল জাগরণ

 

. অন্তিম যাত্রা

 

আজ রাত্রি কাঁদে, চাঁদ মুখ ঢাকে,

ঘুম পাড়ায় গগন, বাতাসও থমকে থাকে।

হঠাৎ ডাকেসেই ঘোড়সওয়ার ফেরেশতা,

"সময় হলো, এসো, বন্ধ করো মোহের কথা।"

 

নামাজ-ব্যস্ত নয়, হিসাব-অন্ধ হৃদয়,

বুকের ভিতরে বাজে মৃত্যুর ভয়।

হাঁটছে জান্নাত? না নরক গহ্বরে?

এই প্রশ্নের উত্তর মেলে কবরের অন্তঃপুরে।

 

. কাফনের ছায়া

 

কাফনের সাদা চাদরতবু শুভ্র নয়,

পাপের দাগে গাঢ়, ভেতরে কাঁদে ভয়।

গোসল শেষে জড়ানো সেই নীরব দেহ,

জীবনের নাটকের শেষ দৃশ্য... নিঃশেষ শেষ কাহিনী।

 

নামাজ ছিল না, ছিল না যাকাত,

সৌন্দর্য খুঁজতো শুধু বাহ্যিক প্রাকৃতিক রাত।

বুকে আজ সেই অনুতাপের পাহাড়,

কবরের গর্ভে রচে নিঃশ্বাসহীন সংসার।

 

 

. মুনকার-নাকীরের মুখোমুখি

 

শুভ্র নয়, তারা কঠোর অগ্নিতুল্য,

মাটির তলদেশে তাদের চোখে শুধুই শূল।

প্রথম প্রশ্ন — "কে তোর রব?"

কাঁপে হৃদয়, স্মৃতি বেহুঁশ, ছুটে শুধু নিরব।

 

"তোর দ্বীন কী?" — উত্তর হয় না খুঁজে,

যার আমল শূন্য, তার কবর রাত যেন আগুনে রুজে।

"তোর নবী কে?" — চোখে আঁধার, মুখে তালা,

শুরু হয় গোরে সেই চিরন্তন জ্বালা।

 

. কবরে পাপীর দৃশ্য

 

পাক-পবিত্রদের কবর হয় বাগান,

জান্নাতের সুবাসে ভরে ওঠে প্রাণ।

কিন্তু যারা পাপী, দম্ভে ছিল মাতোয়ারা,

তাদের কবর গর্জে উঠেআগুনের ধারা।

 

মাটি চেপে ধরে, হাড় চূর্ণ হয় শব্দে,

জ্বলে আগুন, নেই কোনো প্রশান্তির বদ্ধে।

রাত্রির পর রাত, যুগের পর যুগ,

চাপা পড়ে চিৎকার, দম বন্ধ করে ভুগ।

 

. কেয়ামতের অপেক্ষা

 

কবর শুধুই বিশ্রাম নয়

এক ঘুম, যে ঘুমের শেষে জাগরণে ভয়।

সোর্দর বাঁশির ধ্বনি, হবে সকলের জাগরণ,

নাঙ্গা পায়ে দাঁড়াবে সবাই, হবে না কোনো বরণ।

 

হিসাব হবেআমলের খাতা খুলবে,

প্রত্যেকটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি পাপ, খুঁটিয়ে দেখা হবে।

জান্নাত না জাহান্নাম

আজকের জীবনই গড়ে তোলে সেই পয়গাম।

কবরের আর্তনাদ

 

কাফনে জড়ানো কুঞ্জবিহীন প্রাণ,

নিভে যাওয়া চোখে বিস্ময়ের ঘন সন্ধান।

নির্বাসনের প্রান্তে কাতর শরীর,

কোথায় আজ গৌরব, কোথায় সেই গীতের ধ্বনির?

 

নীরবতা চুষে নেয় আত্মার সুর,

কান পাতলে শোনা যায় গগনের নূর।

তবু মাটির নিচে নেই আলো, নেই ভোর,

আছে কেবল কৃমি আর হাড্ডির কঙ্কাল-চোর।

 

নবম স্তরে জমে থাকা কাঁদা,

জীবনের হিসেব আজ মাটির সাদা খাতা।

ধ্বংসের মেঘে নিঃশ্বাস আটকে থাকে,

ফেরেশতার কর্কশ জেরা হৃদয়ে বাজে।

 

রৌদ্রহীন চাঁদের মতো শীতল কবর,

তপ্ত পাপ-জ্বালায় পোড়ে নীরব অন্তর।

জীবনের দম্ভ, যশ, সম্পদের উল্লাস,

সব নিঃশেষ, শুধু কবরের নিঃসাড় প্রতিবাস।

 

আরও শোনো

মুনকার-নাকীর সেই কণ্ঠ ভয়াল,

"কে তোর রব?", জিজ্ঞাসার ভয়ানক খেয়াল।

জবান জড়ায়, স্মৃতি লুপ্ত,

যে জবাব না পারে, তার শাস্তি অমোঘ, কঠিন, কুপ্ত।

 

পাক সারাংশে যারা করেছে ভ্রষ্ট,

তাদের জন্য কবর হয় গর্জনময় নরক-দপ্তর।

শুরু হয় চাপের তীব্র বর্ষণ,

হাড় ভাঙা আর্তনাদে ফেটে পড়ে মাটির গর্ভধরণ।

শ্রাবণ দিনের গাথা

 

কাজলকালো মেঘের আড়াল, আকাশ আনমনা,

শ্রাবণধারায় নামে বিষাদ, থামে আনাগোনা।

অলস দ্বিপ্রহরে ভেজে শহরের পথঘাট,

চঞ্চলতা ভুলে প্রকৃতি পরেছে বিষণ্ণতার সাজ।

 

আর্দ্র পবনে দোলে ভেজা তরুশাখা,

জানালার কাচে জলবিন্দুর আলপনা আঁকা।

মাটির সোঁদা গন্ধে ভরে ওঠে চরাচর,

প্রতিটি পাতায় যেন জীবনের নতুন অক্ষর।

 

এমন দিনে হৃদয়ের গভীরে ওঠে হাহাকার,

স্মৃতির দুয়ার খুলে কে যেন করে বারবার সৎকার।

ফেলে আসা পথ, ভুলে যাওয়া মুখ, হারানো দিনের সুর,

বৃষ্টির সাথে মিশে গিয়ে মনকে করে বিধুর।

 

উষ্ণ চায়ের পেয়ালায় ওঠে ধোঁয়ার কুণ্ডলী,

পুরনো বইয়ের ভাঁজে মন খোঁজে বিস্মৃত বর্ণালী।

ঘরের কোণে জমে নিবিড় কষ্টের আবেশ,

বাইরের পৃথিবীতে বৃষ্টির অবিরাম সমাবেশ।

 

বৃষ্টি শুধু জল নয়, যেন বিরহের গাথা,

প্রতিটি ফোঁটায় লেখা না বলা কত কথা।

কে যেন দূরে বসে ভিজছে আমারই মতো,

এই অঝোর বর্ষণে আমাদের ব্যবধান হয়েছে শত।

 

অঝোর ধারায় যাক মুছে যাক সকল ক্লান্তি,

হৃদয়ে নামুক এই বর্ষণের শীতল প্রশান্তি।

দিন গড়িয়ে রাত নামবে, বৃষ্টি থামবে না জানি,

এই বৃষ্টিমুখর দিন আমার একাকীত্বের রাজধানী।

অতল বর্ষণ

 

মেঘমল্লারের সুরে কাঁদে অশ্রুসজল অম্বর,

দিগন্তরেখায় নামে বিষণ্ণতার চাদর।

পথভোলা পথিক শহর, স্তব্ধ কোলাহল,

তরল আঁধারে ডোবে অতীতের চলাচল।

 

ভেজা মাটির আর্দ্র মদিরতা মেশে কদম্বরেণুতে,

পাতায় পাতায় কাঁপে জীবনের কম্পিত অনুভূতি।

জানালার কাচে শ্রাবণ গড়ে তোলে জলীয় কারাগার,

ভেতরে আমার অবরুদ্ধ মন খোঁজে মুক্তির দ্বার।

 

চেতনার গভীরে নামে স্মৃতির অতল প্লাবন,

বিস্মৃতির পর্দা সরে, জেগে ওঠে হারানো ভুবন।

কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে যায় ফেলে আসা কথা,

প্রতিটি বর্ষণবিন্দুতে ঝরে পড়ে নীরব ব্যথা।

 

উষ্ণ পেয়ালার বাষ্পে ভাসে অস্ফুট কোনো মুখ,

পুরনো বইয়ের ভাঁজে জমে থাকে ভুলে যাওয়া সুখ।

নির্জনতার গাঢ় আলিঙ্গনে খুঁজি শব্দের আশ্রয়,

আমার এই একক মহাবিশ্বে বৃষ্টিই যেন তন্ময়।

 

বৃষ্টি নয় শুধু নিসর্গের খামখেয়ালি খেলা,

আমার আত্মার সাথে প্রকৃতির নিবিড় কথকতা।

অন্য কোনোখানে, কোনো বিরহী আকাশতলে,

আমারই মতো কেউ কি আজ ভিজছে আঁখিজলে?

 

দিনান্তের কিনারায় নামে সন্ধ্যার ধূসর ছায়া,

তবু থামে না এই জলবিন্দুদের আশ্চর্য মায়া।

এই বৃষ্টিমুখর দিন এক অতল শূন্যতা যেন,

আমার নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকে অবিরত।

একটি অন্তঃস্থ বিষাদের প্রতিচিত্র

 

একাকীত্ব আসলে কোনো শব্দ নয়

এক অব্যক্ত প্রপঞ্চ,

যার গায়ে মেখে থাকে কালের নীল বিষণ্নতা।

এটা নিছক নিঃসঙ্গতা নয়,

এক ঘনজমা ঘুম,

যেখানে স্বপ্নেরা মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়

ধীর পায়ে, নিঃশব্দে।

 

রাত্রির ফিকে আলোয় যখন দেয়ালটাও কথা বলে না,

ঠিক তখনি সে এসে বসে

হৃদয়ের চৌকাঠে, অবলীলায়।

তার চোখে কোনো জল নেই,

তবু তাকালেই বুক ভিজে যায়,

এক অদ্ভুত নীরব কান্নায়।

 

তাকে তাড়ানো যায় না দরজা বন্ধ করে,

সে বাতাসের মতো

অদৃশ্য, অথচ সর্বত্র

তার স্পর্শে জীবনের সবচেয়ে চেনা মানুষগুলোও

বেমানান লাগে

আর নিজের ছায়াটাও

অপরিচিত মনে হয় আয়নায়।

 

একাকীত্ব জানে

কীভাবে পুরোনো চিঠির গন্ধে কান্না চেপে রাখা যায়,

কীভাবে সারারাত জেগে

নিজেকেই শোনানো যায় নিঃশব্দ সান্ত্বনা।

সে শেখায়

কথা না বলে অনুভব করতে,

ভিড়ের মাঝেও নিঃস্বভাবে নিঃশেষ হতে।

 

তবু, অদ্ভুত এক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তার সাথে

সে আর আমি, পাশাপাশি হাঁটি

এক বিষন্ন ভোরের দিকে,

যেখানে আলো ফোটে না,

তবু প্রহর গোনার কষ্টটা একটু কম লাগে।

 

একাকীত্ব

তুই কি নিঃশেষ করিস?

নাকি নিঃসঙ্গতাকে রূপ দিস এক নতুন শিল্পে?

তুই কি আমার কষ্টের কবি?

নাকি নিঃশব্দের শ্রষ্টা?

 

আমি জানি না

শুধু জানি

তুই আছিস

অদৃশ্য অথচ অপরিহার্য

আমার ছায়ার চেয়েও বেশি সত্য,

আমার থেকে বেশিআমি।

বাবা, তুমি না ফেরার দেশে চলে গেলে যেদিন

(এক শোকস্নাত সন্তানের অন্তর্গত চিৎকার)

 


তোমার অনুপস্থিতি আজকাল নিঃশব্দে কামড়ায়

ঘুম ভেঙে দেখি, শ্বাসে কেবল বিষাদের ভার।

তুমি নেইএই দুটো শব্দ

সমস্ত অভিধানকে নিঃস্ব করে দেয়।

 

তুমি চলে গেলে

না কোনো পূর্বাভাস, না কোনো বিদায়বাক্য,

এক নির্মম নিষ্কৃতি নিলে

আর আমার পৃথিবীটা তখনই ছিন্নভিন্ন হলো,

যেন হৃদয়ের গ্রন্থিতে বিস্ফোরিত হলো নীরব গ্রেনেড।

 

বাবা

তোমার নিস্পন্দ মুখখানা এখনো হানা দেয়

আমার চোখের পাতায়, প্রতিটি ঘুমহীন রাত্রির দরজায়।

তোমার চোয়ালের শক্ত রেখা,

তোমার হাতে মুঠোবাঁধা সাহস

সবকিছু এখন কেবল স্মৃতির রেখাচিত্র,

ছুঁতে গেলেই ফসকে যায়

কেমন জানি মরিচিকার মতো।

 

তুমি তো ছিলে আমার মহাকাব্যের নায়ক,

যার নীরবতাই ছিল সবচেয়ে গর্জনময় বর্ণনা।

আজ, সেই নায়ক

নামহীন এক শবাধারে রূপ নিল,

আর আমি

একজন শোকপিষ্ট প্রত্যক্ষদর্শী,

নিঃসঙ্গ কাফনের কবি।

 

তোমার চায়ের কাপ,

তোমার পুরনো পাঞ্জাবি,

তোমার স্লিপারের শব্দ

সবই রয়ে গেছে এখানে

শুধু তুমি নেই, বাবা।

তোমার না-থাকাটাই এখন

আমার ঘরের সবচেয়ে ভারী জিনিস।

 

আমার প্রার্থনায় এখন ঈশ্বরও ক্লান্ত,

কারণ আমি প্রতিদিন শুধু একটিই প্রশ্ন করি

"কেন?"

কেন এমন অসমাপ্ত বিদায়?

কেন একটিবার ডাকলে না?

কেন আমাকে প্রস্তুতির সুযোগ দিলে না?

 

বাবা,

তোমাকে ছাড়া আমি শুধু একটি খসড়া মানুষ

অসম্পূর্ণ, অসাড়

এমনকি জীবনের প্রতিটি বিজয়ও আজ

তোমার অনুপস্থিত দৃষ্টির কাছে পরাজিত।

তুমি ছিলে আমার ছায়া

এখন সেই ছায়াই আমাকে গ্রাস করে

নিঃশেষ করে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।

 

তুমি কি আছো, বাবাকোথাও?

একবার, অন্তত একবার যদি ফেরো স্বপ্নে

আমি শুধু কাঁদব না,

আমি তোমার হাত ধরবো

আর বলবো— ‘আর কোথাও যেও না, বাবা

এই বার আমি একা চলতে পারি না।

বাবা, তুমি কি শুনতে পাও?

(একটি ছিন্ন হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাস)

 


তুমি নেই

এই কথাটা বললেই বুকের ভেতর

কেমন জানি শব্দ করে ভেঙে পড়ে কিছু

হয়তো বুক

হয়তো আশ্রয়

হয়তো সেই না-বলাভালোবাসিটা,

যেটা বলতে গিয়ে গলার কাছে জমাট বাঁধত।

 

বাবা, তুমি কি মনে রেখো

সেইসব ভোর,

একবার ঢাকায় শাহবাগে তোমার ডরমিটরী তে

 যখন তুমি আমার জন্য

রুটি সেঁকতে সেঁকতে হেসে বলতে

তুই বড় মানুষ হবি, দেখিস…”

আমি হাসতামমাথা নিচু করতাম

আজও সেই গন্ধ পাই, বাবার ঘামের,

কিন্তু মানুষ তো হয়েই উঠলাম না, বাবা

তোমার অভাবেই অচেনা হয়ে গেল নিজেকেই।

 

বাবা, তুমি যখন ছিলে

সব ভয় যেন আমার ছায়া দেখে পালাতো।

তোমার নীরব উপস্থিতি

ছিল আমার পৃথিবীর ভরকেন্দ্র,

আর এখন?

পৃথিবী ঘুরছে ঠিকই

কিন্তু আমি বারে বারে ছিটকে পড়ি বিষণ্নতার দিকে।

 

তোমার ব্যবহৃত চশমাটা এখনও টেবিলে,

ঘড়িটা থেমে আছে যেই মুহূর্তে তুমি থেমেছিলে,

আর আমিআমি থামতে পারি না,

কারণ কান্নারও তো একটা দায়িত্ব থাকে

মা যাতে না কাঁদে,

তোমার ছবিটার সামনে যাতে কেউ না দেখে

আমার লুকিয়ে রাখা অশ্রুবিন্দু।

 

বাবা, তোমাকে হারানোটা হারানো নয় শুধু,

এটা এক অব্যক্ত জন্ম

এক অসীম শূন্যতার জন্ম,

যার ভিতর আমি প্রতিদিন নতুন করে হারিয়ে যাই।

তুমি কি এখনো আমাকে দেখো আকাশ থেকে?

তুমি কি এখনো রাতে আমার ঘুম না হলে পাশে বসে থাকো?

তুমি কি এখনো চুপিচুপি বলো

ভয় পাস নাআমি আছি…”?

 

আছো তো, বাবা?

একবার, শুধু একবার যদি উত্তর দিতে

তাহলেই বুকটা একটু হালকা হতো।

 


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান