জটলা - রঘুনাথ লনকার ।। অনুবাদ: রতন বাঙালি
জটলা - রঘুনাথ লনকার ।। অনুবাদ: রতন বাঙালি

 

ঠাকুরমা বয়স পেয়েছেন তিনি একান্ত অর্থেই অতি বয়সী বৃদ্ধা ইতোপূর্বে কোন ব্যক্তিই একটুকু দীর্ঘায়ু পাননি তাঁহার জন্ম ঘটনাটিই একটি পুরাতন ঐতিহাসিক মিতের মত-যাহা কিনা সঠিকভাবে কেহই জানেন না তার এই জন্মতত্ত্বের কুষ্টি- ঠিকুজি কোথাও লিপিবদ্ধ নাই

ঠাকুরমা এখন অন্ধ! দুচোখের আলো নিবে গেছে দুকানেরও শ্রবনক্ষমতা লোপ পেয়েছে শরীরের মাংশপেষিগুলো পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যন্ত্রনায় একাকার তার শারীরিক অক্ষমতাগুলো যেন ধারাবাহিকভাবে হৃদয়বিদারক বাধাহীন জটিলতম সমস্যায় পরিণত হয়েছে আপনি যদি তাকে এক কাপ চা খাওয়াতে চান; তাহলে, তার নিত্যদিনের কষ্টের চিহ্ণ চোখ বেয়ে পড়া জল আর চা মিশে বালিশ ভিজে যাবে

প্রত্যেকেই তার আশা ছেড়ে দিয়েছেন তাদের দৃষ্টিতে ঠাকুরমা অচল- মৃত প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহে ডাক্তার এসে জানান দেন তিনি এখনও বেঁচে আছেন তিনি একই সাথে ঠাকুরমার সমূহ গুণকীর্তনও গেয়ে আম্বস্ত করে বিদায় নেন

নিচতলার সিঁড়ির কাছের এক স্থানে আমার ছোট কাকা বসে ছিলেন বসে বিড় বিড় করে কী যেন একটা বলতেন নিজে নিজে বগ বগ করতে করতে এক সময় অন্যদের চোখে হাবলা- হাবাগবা মতিভ্রম লোক বনে গেলেন এই ভাবে সামান্য অসঙ্গতি থেকে কীসের একটা যেন আবেষে আবিষ্ট হলেন তিনি একই ভাবে নিয়মিত চলতে বলতে বিশেষ উচ্চমানের মধ্যাহ্ণ ভোজ এবং নৈশ ভোজে অভ্যস্ত হওয়া সহ বিশেষ অদ্ভুৎ সাজে সজ্জিত হলেন তিনি সেই পরিবেশে বিষয়টি তাকে যেন সত্যই এক ধরণের হাবা-গবা বোকা লোকে পরিণত করল

যখন আমার ঠাকুরমার সহায়-সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টণ করা হলো,  আমার বাবার ভাগে তাদের থাকার ঘর, ছোট অঙ্কের নগদ অর্থ, অচল দৃদ্ধা ঠাকুর মা এবং হাবা-গবা এক কাকার ভারও পড়লো!

কোন এক দিন বেলা প্রায় দুপুর আমরা একজন কাকাকে হাত ধরে টেনে ঠাকুরমার কাছে নিয়ে গেলাম তখন সে তার পুত্রকে আগলে ধরে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলেন তার মুখের কষ্টের রেখা সামান্য সময়ের জন্য চলে গেলো এই ঘটনাটি তার দিনটিকে সুখময় করে তুলেছিলো আমরা যদি কাকাকে ঠাকুরমার কাছে নিতে ভুলে যাই, তার চাপা আর্তনাদের আহাজারি ধীরে ধীরে অনুচ্চারিত ক্রোধের ধ্বনিতে পরিণত হতো তখন আমার মা বলতো যাও; তোমরা কেহ তোমাদের কাকাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাও এবং ঠাকুরমার হাবা-গবা পুত্রের স্পর্স অনুভব করার বিষয়টি নিয়মিত পরিদর্শনে পরিণত হলো সুতরাং তুমি দেখবে, আমরা কদাচিৎ তাকে যদি পাগলা গারদে পাঠালাম আমি বলতে চাচ্ছি -্এরকম ঘটনা ঘটলে ঠাকুরমার প্রথম মৃত্যু হবে তাই নয় কি? তার পর আমরা আমাদেরকে তার থেকে মুক্ত করতে হবে এবং নিজ গৃহে বিরাজমান বিয়োগাত্বক শোক-ছায়া থেকে নিজেদেরকে আড়াল করতে হবে তখন হয়তো এটি একটি শান্তসুন্দর পরিবারে পরিণত হবে কিন্তু ঠাকুরমার আতঙ্কশক্তি ক্রমেই বিপদজনক হয়ে উঠলো  সে তার ঔষধ-পথ্য, নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে নিস্প্রান দেহের ন্যায় জীবমৃত অবস্থায় পরিণত হলো তার মধ্যে প্রতিদিনের আতঙ্ক কাজ করছে; - এই বুঝি হাবাগবা ছেলেটি কোথাও চলে গেলো!

 আমার বাবা মনস্থির করেছেন, যখন ঠাকুরমা মারা যাবেন, তখন তিনি ময়ের অতৃপ্ত আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে অনেক কিছু করবেন তার অভূক্ত আত্মার সদ্্গতি কামনায় অন্নপি- উৎসর্গ করে প্রার্থনা করবেন দৃষ্টান্তরূপে উল্লেখ করে বললেন, আমি এই হাবলা উর্ন¥াদ ভাইটিকে ভরণপোষণ দেবো তাকে কখনোই পাগলা গারদে পাঠাবো না তখন থেকে পরবর্তি দিনগুলোতে তার দেখভাল করব বাবা শুনেছিলো  -এরকম আকুতি কাককে পরলৌকিক কিংবা প্রায়চিত্তের অন্নপি- স্পর্স করতে অলৌকিকভাবে অনুপ্রাণিত  করে

কিন্তু একদিন যে কী একটা ঘটনা ঘটে গেলো! হাবাগবা কাকাটি সমস্ত রাস্তা দাপিয়ে পাড় হয়ে এসে একটি ট্রাকের চাপায় মৃত্যুবরণ করলো ঠাকুরমা শ্রবন দৃষ্টিহীন অনুভূতিতে পুত্রের অমোঙ্গল বুঝতে পারলেন এবং বিরামহীনভাবে চিৎকার দিয়ে গো -   গো-   শব্দ করে কেদে চলেছেন মৃত ভাই এর রক্তপিন্ড বিকৃত মাংশল দেহটি তার প্রতি শেষ অনুভূতি এবং করনীয় সমাপ্তের জন্য বহন করে আনা হলো এই কাজের অবশেষ প্রক্রিয়া সমাপ্ত পর্যন্ত আমরা সকলে উৎসর্গকৃত অন্নপি- উৎসর্গে কাকের অপেক্ষা করতে থাকলাম আমরা অনেক প্রক্রিয়ায় বিদেহী আত্মার অতৃপ্ত বাসনা পূরণের জন্য আহ্বান করে চললাম কিন্তু কোন কাক আসলো না তার পর আমার বাবা কৃতার্থ স্বরে বললেন, তিনি তার মার সেবা যতœ করবেন এবং তার জন্য প্রয়োজনিয় ঔষধের ব্যবস্থা করবেন এর সাথে সাথেই মুহূর্তের মধ্যে উৎসর্গকৃত অন্নপি-ের কাছে কাঙ্খিত কাক এসে হাজির হলো

 

 একটি মারাঠী গল্প মারাঠী ভাষায় রঘুনাথ লনকর এর লেখা থেকে গৌরি দেশপান্ডে কর্তৃক ইংরেজি তরজমা নিসিম ইজিকাইশ এবং   মিনাক্ষী মুখার্জি সম্পাদিতঅন্য এক ইন্ডিয়া নামক বই- পেঙুইন বুক, দিল্লি কর্তৃক- ১৯৯০ সালে প্রকাশিত মারাঠী সমাজের বিশ্বাস মিতভিত্তিক এই গল্পটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন রতন বাঙালি ইসলামপুর ০১//১৮

 


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান