ভবঘুরেদের জীবন-ভাবনার মূল্য আমার কাছে অনেক ।
ভবঘুরেদের জীবন-ভাবনার মূল্য আমার কাছে অনেক ।

আলেকজান্দ্রা ডি’অ্যাব্বাদি: আপনার উপন্যাস ফ্লাইটস ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার ২০১৮-এর জন্য সর্বশেষ বাছাই তালিকায় স্থান পেয়েছে? উপন্যাসটির কোন দিকটি এমন একটি জায়গায় আসতে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন আপনি?

ওগলা তোকারচুক: ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কারের নাতিদীর্ঘ তালিকায় এ উপন্যাসটি জায়গা করে নেওয়ায় অভিভূত আমি। এখন এটি বিশ্বব্যাপী পাঠকদের কাছে পৌঁছাবে। এ বইটি আমি ১০ বছর আগে লিখেছিলাম। অথচ দেখুন, কত সময় লেগে গেল অনুবাদ হতে! যা হোক, আপনার প্রশ্নের উত্তরে আসি। আমি তো মনে করি, এ উপন্যাসটির ফর্ম বা ধারার কারণেই বিচারকেরা একে বেশি পছন্দ করেছেন। পুরো উপন্যাস খণ্ড খণ্ড অংশ, গল্প বলায় কোনো ধারাবাহিকতা নেই, চরিত্রগুলোর সবারই একটা তাড়া নিজ নিজ অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করার বিষয়ে। বোধ করি, এগুলো জুরিবোর্ডের কাছে ভালো ও ব্যতিক্রমী মনে হয়েছে। তবে শেষ বিচারের ভার কিন্তু পাঠকের কাছে।

ডি’আব্বাদি: উপন্যাসটি পড়ার জন্য পাঠক নিজেকে প্রস্তুত করবেন কীভাবে?

তোকারচুক: ভালো প্রশ্ন। এই উপন্যাসের গল্পগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগে পাঠকদের কিছু কথা জেনে নেওয়া দরকার। ফ্লাইটস উপন্যাসের জন্ম হয়েছিল এমন কিছু সময়ে, যখন আমি পৃথিবীর নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। খেয়াল করে দেখবেন, উপন্যাসের গল্পগুলো গতি ভালোবাসে, স্থিতি নয়। চরিত্রগুলো জীবন ও কাজের তাগিদে নানা স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ ছাড়া গল্পগুলোতে আমি সময়ের গণ্ডিকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছি। কোনো চরিত্রই সময়ের কাছে বাধা না। এতে আঠারো শতকের কথাও আছে, আবার একুশ শতকেরও রয়েছে। কিন্তু সময়ের হেরফের হলেও জীবনের সংকটগুলো একই থেকে যায়। তাই আমি ফ্লাইটসকে বলি ‘নক্ষত্রমণ্ডল উপন্যাস’। এতে আমি বিভিন্ন জনের ভিন্ন ভিন্ন গল্প একটি কক্ষপথে ছুড়ে দিয়েছি। এবং সেগুলো কুণ্ডলী পেকে একটা উপন্যাসে রূপ নিয়েছে। তা ছাড়া গল্পগুলোতে আমি জাতিগত ও ব্যক্তিগত আবেগ এবং কালিক সীমানাকে পুরোপুরি পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছি।

ডি’আব্বাদি: এত গল্প নিয়ে কি এটি উপন্যাস না হয়ে ছোটগল্পের সংকলন হতে পারত না?

তোকারচুক: একই কথা অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন আমাকে। ওই যে বলেছি, ‘নক্ষত্রমণ্ডল উপন্যাস’-এ কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। গল্পগুলো আলাদা আলাদা; কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না চরিত্রদের সবাই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে বদ্ধপরিকর। এই একমাত্র মিল গল্পগুলোকে উপন্যাসে পরিণত করেছে।

ডি’আব্বাদি: এবার কি উপন্যাসের গল্পগুলো সম্পর্কে একটু প্রাথমিক ধারণা পেতে পারি?

তোকারচুক: অবশ্যই। আগেই বলে নিই, গল্পগুলোতে বাস্তবতা ও কল্পনার মিশ্রণ রয়েছে। তবে কল্পনাগুলোর সূত্রপাত বাস্তবতা থেকেই। মোটাদাগে চারটি গল্পকে নানা অধ্যায়ে বর্ণনা করেছি। কথিত আছে, সতেরো শ শতকে ফিলিপ ভেরহিয়েন নামের এক ওলন্দাজ শারীরস্থানবিদ (এনাটোমিস্ট) নিজের পা ব্যবচ্ছেদ করেন এবং সেই কাটা পায়ের ছবি আঁকেন। উদ্দেশ্য ছিল মহাবীর অ্যাকেইলিসের পেশিতন্তু-রহস্য উদ্‌ঘাটন করা। আঠারো শ শতকের এক গল্পে আছে, লুদভিকা তার ভাই চপিনের আত্মা সতর্কতার সঙ্গে লুকিয়ে বয়ামে ভরে প্যারিস থেকে পোল্যান্ডের ওয়ারস শহরে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ, তার ভাই এই ওয়ারসতে সমাহিত হতে চেয়েছিলেন। আরেকটা গল্পে বলেছি, একজন মাঝবয়সী নারীর বাবা, যিনি একজন রাজপর্ষদ ও কূটনীতিক ছিলেন, কালো হওয়ার কারণে মৃত্যুর পর তাঁকে সমাহিত করার পরিবর্তে গুম করা হয়। ফলে সে অস্ট্রীয় এক সম্রাটের সঙ্গে একতরফা যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিচারের আশায়। আবার বর্তমান সময়ের এক গল্প বলেছি, কীভাবে একজন নারী অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে দুর্দশার মধ্যে তার চেয়ে বয়সে বেশ বড় শিক্ষক স্বামীর সঙ্গে সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া বলেছি, একজন পোলিশ নারীর নিউজিল্যান্ড থেকে নিজ দেশ পোল্যান্ডে ফেরার গল্প, যে কি না জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা তার এক বন্ধুর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে তাকে বিষ খাইয়ে মারতে চায়। বর্ণনা করেছি, ক্রোয়েশিয়াতে বেড়াতে গিয়ে কীভাবে একজন স্বামী তার স্ত্রী ও বাচ্চাকে রহস্যজনকভাবে হারিয়ে ফেলে মানসিক ভারসাম্য হারায়—এসব নানা ঘটনা। পাঠক যখন এই খণ্ডগল্পকে ব্যাখ্যা করবেন, তখন খুঁজে পাবেন আধুনিকতার নানা মাত্রা ও মানবজাতির স্বভাবসুলভ প্রকৃত রূপটি।

ডি’আব্বাদি: দেখা যাচ্ছে, আপনার গল্পগুলো ঠিক গতানুগতিক ইউরোপীয় ধারায় লেখা না। যদি তা-ই হয়, তবে এর কী ব্যাখ্যা দেবেন আপনি?

তোকারচুক: ঠিক বলেছেন। মধ্য ইউরোপের অনেক লেখকই একতরফা গল্প বলাতে বিশ্বাস করেন না। বলতে পারেন, অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রকৃত বাস্তব ও কল্পনার মধ্যে একটা দেয়াল টেনেছি আমি। তা ছাড়া শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা একমাত্রিক গল্প বলার মতো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও নেই আমাদের। পোলিশদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। পোল্যান্ড একসময় শক্তিশালী উপনিবেশী দেশ ছিল। সেই অবস্থানের অবসান হয়েছে এক শ বছর হতে চলল। আমরা নাৎসি ও রাশিয়ার দখলে থেকেছি। এখন আর আমরা আগের মতো সবকিছুতে বিশ্বাস করতে পারি না। এখন সময় এসেছে পোল্যান্ডের সঙ্গে ইহুদিদের সম্পর্কের দিকে তাকানোর। মেনে নিতেই হবে, আমাদের মধ্যে ইহুদিদের রক্ত ও পোলিশীয় সংস্কৃতির মিশ্রণ রয়েছে। জাতীয়তাবাদের পুরোনো ধারণার দিন শেষ। এখন মানুষ অনেক বেশি অভিবাসন ও ভ্রমণে বিশ্বাসী। আজকের যুগে অর্থনীতি ও অন্তর্জাল ভৌগোলিক সীমানার তোয়াক্কা করে না। আপনি ফ্লাইটসকে পুরোনো ইউরোপের জন্য লেখা একটি শোকগাথা হিসেবে পড়তে পারেন।

ডি’আব্বাদি: আপনার বলা গল্পগুলো কী কী ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে?

তোকারচুক: থিম জানতে চাইছেন তো! আমার বলা গল্পগুলো নানা শতকে, নানা স্থানে বিচরণ করছে। ফলে স্থান ও সময়কে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না সেসব। তবে ‘হোম’ বলতে আমরা কী বুঝি? এটি যে খুবই ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধারণা তা আমি বলতে চেয়েছি। বিশ্বায়নের যুগে ‘হোম’-এর প্রচলিত ধারণা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা কঠিন। মানুষ বলে না পাকাপোক্ত জীবন—আসলে সেটেল্ড লাইফ বলতে কিছু নেই। আমার উপন্যাসের চরিত্রগুলো এর প্রমাণ বহন করে। আবার, গল্পগুলোতে পাবেন গতিময়তাই জীবনের আসল শক্তি, স্থিতিতে মৃত্যু। ভবঘুরেদের জীবন-ভাবনার মূল্য আমার কাছে অনেক। এককথায়, আমার গল্পগুলোর কথক দেখবেন খানিকটা অসম্পূর্ণ, কিছুটা ভঙ্গুরও বটে। কারণ, মানুষের জীবন যেকোনোভাবেই পরিপূর্ণ না।

ডি’আব্বাদি: মৃত্যুর পর দেহ-সংরক্ষণ বিদ্যা আপনার উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রয়েছে। এ সম্পর্কে কিছু জানাবেন?

তোকারচুক: হ্যাঁ। আমরা কিন্তু সবচেয়ে কম জানি আমাদের দেহ সম্পর্কে। আমরা বিশ্ব জয় করেছি, চাঁদে গিয়েছি কিন্তু আমরা কি জানি আমাদের পাকস্থলী দেখতে কেমন? জানলেও কতজন জানে? আমাদের দেহ সবচেয়ে রহস্যময় বস্তু, যা ভঙ্গুর। অথচ এর ওপর নির্ভর করেই আমরা জীবন বয়ে নিয়ে চলি। বলতে পারেন, শারীরবিদ্যা বা দেহ ব্যবচ্ছেদবিদ্যা নিয়ে আমার প্রবল আগ্রহ অনেক আগে থেকেই। এ উপন্যাসে শারীরবিদ্যা নিয়ে যে অধ্যায় আমি লিখেছি, তার জন্য আমাকে নেদারল্যান্ডের নানা জাদুঘরে যেতে হয়েছে। সেখানকার দেহের ‘তন্তু সংরক্ষণ কলা’ খুবই প্রভাবিত করেছে আমাকে। মৃত্যুকে জয় করার জন্য মানুষের যে আকুল চেষ্টা, তার একটি প্রতিফলন হিসেবে দেখি এই শিল্পটিকে।

ডি’আব্বাদি: আপনার এ উপন্যাসটি অনুবাদ করেছেন জেনিফার ক্রফট। কী মনে হয়, অনুবাদে আপনার পোলিশ ভাষা ও সংস্কৃতির যথার্থ প্রতিফলন হয়েছে?

তোকারচুক: ক্রফটের অসামান্য অনুবাদে আমি অভিভূত। আমার ‘নক্ষত্রমণ্ডল উপন্যাস’ ধারণাটিকে চমৎকারভাবে ধরতে পেরেছেন তিনি। নানা গল্প, নানা স্বর, নানা ভাব, নানা ধারণা প্রায় সবকিছুরই একটি সুন্দর মেলবন্ধন তাঁর ইংরেজি অনুবাদে ফুটে উঠেছে।

ডি’আব্বাদি: এ উপন্যাস নিয়ে আর কিছু কি আপনি বলতে আগ্রহী?

তোকারচুক: আমরা একটা উন্মত্ত পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে উপন্যাস নামক সাহিত্য শাখাটিকে পুনঃসজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ চিন্তা থেকেই ফ্লাইটস একেবারে নতুন ধারায় লেখা। দেখা যাক, আপনাদের কাছে টানে কি না!

...................................................................................................................................................

ওগলা তোকারচুক

বর্তমান সময়ে পোল্যান্ডের সবচেয়ে বহুল পঠিত নারীবাদী লেখিকা ওগলা তোকারচুকের জন্ম ১৯৬২ সালে। কিশোরী বয়স থেকেই ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়ে লেখালেখি শুরু করেন তিনি। জ্যোতির্বিদ্যা ও শারীরবিদ্যা বরাবরই কাছে টানে তাঁকে। ফলে তাঁর প্রায় সব উপন্যাস ও গল্পে রয়েছে এ দুই বিষয়ের উপস্থিতি। একজন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে পেশাজীবন শুরু করলেও এখন তিনি পুরোদস্তুর লেখক। মিলান কুন্ডেরা, ডানিলো কিস্ ও দুব্রাভকা উগ্রেসিকের লেখা দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়া জাগানো মহাকাব্যিক উপন্যাস দ্য বুকস অব জ্যাকব। ২০০৮ ও ২০১৫ সালে দুই দফায় পেয়েছেন পোল্যান্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার নাইক অ্যাওয়ার্ড। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা আট। এ ছাড়া আছে দুটি ছোটগল্প সংকলন। তাঁর নতুন উপন্যাস জ্যাকব’স স্ক্রিপচারস প্রকাশিত হবে ২০১৯ সালে। ম্যান বুকারজয়ী ফ্লাইটস উপন্যাসটি ২০০৮ সালে পোলিশ ভাষায় প্রকাশিত হলেও এর ইংরেজি অনুবাদ বের হয় ২০১৭ সালে। বইটি অনুবাদ করেন মার্কিন অনুবাদক জেনিফার ক্রফট।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান