হেলাল হাফিজের গুচ্ছকবিতা
হেলাল হাফিজের গুচ্ছকবিতা

কবি হেলাল হাফিজ

বাংলাদেশের স্বাধীনতোত্তর কালে সামরিক পট পরিবর্তনের অস্থির সময়ে প্রতিবাদী লেখনী নিয়ে রুখে দাড়ানো কবিদের এক জন হেলাল হাফিজ । তার কাব্যের প্রধান উপকরণ যৌবন এবং বিদ্রোহ। যে জলে আগুন জ্বলে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় আশির দশকে। দুই যুগের বেশি সময় পরে প্রযুক্তির সহস্র আবিস্কার আর জ্ঞান বিজ্ঞানের চরম উত্‍কর্ষতা সত্ত্বেও মানব সভ্যতা যেন প্রশ্নের সম্মুখিন । অর্থলোভী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের হাতে বিশ্বের মানবতা বিপন্ন, মারণাস্ত্রের নির্লজ্জ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় ধনী দেশ গুলো অধিকতর ব্যস্ত , নৈতিকতা এবং বিবেক বোধ ক্ষতবিক্ষত । হেলাল হাফিজের যুদ্ধমিশ্রিত প্রেমের কবিতাগুলোকে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এখনও সমানভাবে প্রযোজ্য মনে হয়। এখানে এক পাতায় যে জলে আগুন জ্বলে কাব্যগ্রন্হের কিছু সংকলিত হ'ল ।

শামুক

‘অদ্ভুত, অদ্ভুত’ বলে

সমস্বরে চিৎকার করে উঠলেন লোক।

আমি নগরের জ্যেষ্ঠ শামুক

একবার একটু নড়েই নতুন ভঙ্গিতে ঠিক গুটিয়ে গেলাম,

জলের দ্রাঘিমাজুড়ে

যে-রমক গুটানো ছিলাম,

ছিমছাম একা একা ভেতরে ছিলাম,

মানুষের কাছে এসে

নতুন মুদ্রায় আমি নির্জন হলাম,

মিলনের নামে যেন আলাদা হলাম,

একাই ছিলাম আমি পুনরায় একলা হলাম

অগ্ন্যুৎসব


ছিল তা এক অগ্ন্যুৎসব, সেদিন আমি
সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে
জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে
রক্ত ঋণে স্বদেশ হলো,
তোমার দিকে চোখ ছিলো না
জন্মভূমি সেদিন তোমার সতীন ছিলো।

আজকে আবার জীবন আমার ভিন্ন স্বপ্নে অংকুরিত অগ্ন্যুৎসবে
তোমাকে চায় শুধুই তোমায়।

রঙিন শাড়ির হলুদ পাড়ে ঋতুর প্লাবন নষ্ট করে
ভর দুপুরে শুধুই কেন হাত বেঁধেছো বুক ঢেকেছো
যুঁই চামেলী বেলীর মালায়,
আমার বুকে সেদিন যেমন আগুন ছিলো
ভিন্নভাবে জ্বলছে আজও,
তবু সবই ব্যর্থ হবে
তুমি কেবল যুঁই চামেলী বেলী ফুলেই মগ্ন হলে।

তার চেয়ে আজ এসো দু’জন জাহিদুরের গানের মতন
হৃদয় দিয়ে বোশেখ ডাকি, দু’জীবনেই বোশেখ আনি।
জানো হেলেন, আগুন দিয়ে হোলি খেলায় দারুন আরাম
খেলবো দু’জন এই শপথে
এসো স্ব-কাল শুদ্ধ করি দুর্বিনীত যৌবনেরে।



অনির্ণীত নারী


নারী কি নদীর মতো
নারী কি পুতুল,
নারী কি নীড়ের নাম
টবে ভুল ফুল।

নারী কি বৃক্ষ কোনো
না কোমল শিলা,
নারী কি চৈত্রের চিতা
নিমীলিত নীলা।




 অন্যরকম সংসার



এই তো আবার যুদ্ধে যাবার সময় এলো
আবার আমার যুদ্ধে খেলার সময় হলো
এবার রানা তোমায় নিয়ে আবার আমি যুদ্ধে যাবো
এবার যুদ্ধে জয়ী হলে গোলাপ বাগান তৈরী হবে।

হয় তো দু’জন হারিয়ে যাবো ফুরিয়ে যাবো
তবুও আমি যুদ্ধে যাবো তবু তোমায় যুদ্ধে নেবো
অন্যরকম সংসারেতে গোলাপ বাগান তৈরী করে
হারিয়ে যাবো আমরা দু’জন ফুরিয়ে যাবো।

স্বদেশ জুড়ে গোলাপ বাগান তৈরী করে
লাল গোলাপে রক্ত রেখে গোলাপ কাঁটায় আগুন রেখে
আমরা দু’জন হয় তো রানা মিশেই যাবো মাটির সাথে।

মাটির সথে মিশে গিয়ে জৈবসারে গাছ বাড়াবো
ফুল ফোটাবো, গোলাপ গোলাপ স্বদেশ হবে
তোমার আমার জৈবসারে। তুমি আমি থাকবো তখন
অনেক দূরে অন্ধকারে, অন্যরকম সংসারেতে।

অশ্লীল সভ্যতা


নিউট্রন বোমা বোঝ
মানুষ বোঝ না !



অস্ত্র সমর্পণ



মারণাস্ত্র মনে রেখো ভালোবাসা তোমার আমার।
নয় মাস বন্ধু বলে জেনেছি তোমাকে, কেবল তোমাকে।
বিরোধী নিধন শেষে কতোদিন অকারণে
তাঁবুর ভেতরে ঢুকে দেখেছি তোমাকে বারবার কতোবার।

মনে আছে, আমার জ্বালার বুক
তোমার কঠিন বুকে লাগাতেই গর্জে উঠে তুমি
বিস্ফোরণে প্রকম্পিত করতে আকাশ, আমাদের ভালবাসা
মুহূর্তেই লুফে নিত অত্যাচারী শত্রুর নি:শ্বাস।

মনে পড়ে তোমার কঠিন নলে তন্দ্রাতুর কপালের
মধ্যভাগ রেখে, বুকে রেখে হাত
কেটে গেছে আমাদের জঙ্গলের কতো কালো রাত!
মনে আছে, মনে রেখো
আমাদের সেই সব প্রেম-ইতিহাস।

অথচ তোমাকে আজ সেই আমি কারাগারে
সমর্পণ করে, ফিরে যাচ্ছি ঘরে
মানুষকে ভালোবাসা ভালোবাসি বলে।

যদি কোনোদিন আসে আবার দুর্দিন,
যেদিন ফুরাবে প্রেম অথবা হবে না প্রেম মানুষে মানুষে
ভেঙে সেই কালো কারাগার
আবার প্রণয় হবে মারণাস্ত্র তোমার আমার।




সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান