রবীন্দ্রনাথ: এক বোহেমিয়ান কাবুলিওয়ালা - ভীষ্মদেব বাড়ৈ
রবীন্দ্রনাথ: এক বোহেমিয়ান কাবুলিওয়ালা - ভীষ্মদেব বাড়ৈ


আগেও পড়েছি আবার পড়লাম রবি ঠাকুরের ছোট গল্প কাবুলিওয়ালা। পাঁচ বছরের চিরচঞ্চল শিশু মিনি, ভিনদেশী অপত্য স্নেহের রহমত নামের কাবুলিওয়ালা এবং অগাধ মানবিক মিনির পিতাকে নিয়ে তৈরী হয়েছে কালজয়ী গল্পের বুনিয়াদ। আমার মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ যেন এক জন্ম বোহেমিয়ান কাবুলিওয়ালা। মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ একে একে হারিয়েছেন প্রিয়জন, কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে ক্ষত-বিক্ষত, বিধ্বস্ত যোদ্ধার মতো বুকের মাঝে খাখা শূণ্যতায় মৃত্যু হয়েছে পুত্র-কন্যা সহ প্রিয়তমদের। জলদগম্ভীর চাপা বেদনা নিয়ে তিনি হেঁটে চলেছেন/হাঁটছেন সন্তান হারা এক বুভুক্ষু কাবুলিওয়ালার মতো। লম্বাচুল-শ্মশ্রুমণ্ডিত সুঠাম কান্তশ্রী। কিন্তু লম্বা জোব্বার ভেতরে লুকায়িত ত্রাহি-ত্রাহি বুকভাঙা হাহাকার- এ যেন এক অন্তর্ভেদী মূর্তমান-বিমূর্ত রবীন্দ্রনাথ। তাই আজন্ম সন্ন্যাস আর বৈরাগ্যের প্রতিচ্ছি রবীন্দ্রনাথ যেন বিশ্বসংসারের এক নতুন কাবুলিওয়ালা।

কালজয়ী কাবুলিওয়ালা ছোট গল্পে- বৃহৎ জীবন বোধের সব অনুষঙ্গ তালপাতায় বাবুই পাখির ঘর বানানোর মতো শৈল্পিক সত্তার অপরূপ ব্যঞ্জনে রূপায়ন করেছেন ররীন্দ্রনাথ। জীবনাচরণের কি নেই এখানে! প্রেম, বন্ধুত্ব, মমতা, শিশু চিত্তের প্রগভলতা‌ আর চিরন্তন‌ জিজ্ঞাসা, কৈশোরের লাজুকতা, মানুষের প্রতি মানুষের সৌজন্যতা বোধ, শিশুর সহিত এক ভিনদেশী পিতৃব্য কাবুলিওয়ালার এক নিবিড় বন্ধুত্ব, মানবিকতা, অপত্য স্নেহ, সত্যের প্রতি কাবুলবাসীর চিরন্তন জেদ, প্রবাসীর জীবনাচরণ, চরম আত্মত্যাগ, শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবনে বেড়ে উঠার গল্প, বিদেশী লোকের গল্প কথায় গিরি-পর্বত,‌মরুর এক অজানা দেশের চিত্রকল্প যেন‌ ভ্রমনের‌ স্বাদ- চিত্রে-চিত্রে যেন সংবেদনশীল নকশীকাঁথায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে সুঁইয়ের ফোঁড়ে ফোঁড়ে, তরঙ্গে-তরঙ্গে, অন্তরে-অভিঘাতে। আমি যতো পড়ি ততো বিস্মিত হই।

আমি এ গল্পে-
বিদেশীর সাথে আলাপে আলাপে ভ্রমনের স্বাদ,
রহমত নামী কাবুলিওয়ালার চির স্বাধীন‌ মানুষের জেলবন্দির বেদনা,
পিতা-পুত্রীর বিচ্ছেদের কষ্ট,
অগাধ মানবিকতার কিছু চুম্বক অংশ তুলে ধরলাম যা- পাঠক হৃদয়ের গভীর বেদনার গিরিঘাতকে নাড়িয়ে দিবে, এখানেই গল্পের সার্থকতা।

"এইজন্য সকালবেলায় আমার ছোটো ঘরে টেবিলের সামনে বসিয়া এই কাবুলির সঙ্গে গল্প করিয়া আমার অনেকটা ভ্রমণের কাজ হইত। দুইধারে বন্ধুর দুর্গম দগ্ধ রক্তবর্ণ উচ্চ গিরিশ্রেণী, মধ্যে সংকীর্ণ মরুপথ, বোঝাইকরা উষ্ট্রের শ্রেণী চলিয়াছে; পাগড়িপরা বণিক ও পথিকেরা কেহ বা উটের 'পরে, কেহ বা পদব্রজে, কাহারো হাতে বর্শা, কাহারো হাতে সেকেলে চকমকি-ঠোকা বন্দুক-- কাবুলি মেঘমন্দ্রস্বরে ভাঙা বাংলায় স্বদেশের গল্প করিত, আর এই ছবি আমার চোখের সম্মুখ দিয়া চলিয়া যাইত।"

"আমরা যখন ঘরে বসিয়া চিরাভ্যস্তমত নিত্য কাজের মধ্যে দিনের পর দিন কাটাইতাম তখন একজন স্বাধীন পর্বতচারী পুরুষ কারাপ্রাচীরের মধ্যে যে কেমন করিয়া বর্ষযাপন করিতেছে, তাহা আমাদের মনেও উদয় হইত না।"

"এই বলিয়া সে আপনার মস্ত ঢিলা জামাটার ভিতর হাত চালাইয়া দিয়া বুকের কাছে কোথা হইতে একটুকরা ময়লা কাগজ বাহির করিল। বহু সযত্নে ভাঁজ খুলিয়া দুই হস্তে আমার টেবিলের উপর মেলিয়া ধরিল।

"দেখিলাম, কাগজের উপর একটি ছোটো হাতের ছাপ। ফোটোগ্রাফ নহে, তেলের ছবি নহে, হাতে খানিকটা ভুসা
মাখাইয়া কাগজের উপরে তাহার চিহ্ন ধরিয়া লইয়াছে। কন্যার এই স্মরণচিহ্নটুকু বুকের কাছে লইয়া রহমত প্রতিবৎসর কলিকাতার রাস্তায় মেওয়া বেচিতে আসে-- যেন সেই সুকোমল ক্ষুদ্র শিশুহস্তটুকুর স্পর্শখানি তাহার বিরাট বিরহী বক্ষের মধ্যে সুধাসঞ্চয় করিয়া রাখে।"

"দেখিয়া আমার চোখ ছল্‌ছল্‌ করিয়া আসিল। তখন, সে যে একজন কাবুলি মেওয়াওয়ালা আর আমি যে একজন বাঙালি সম্ভ্রান্তবংশীয়, তাহা ভুলিয়া গেলাম -- তখন বুঝিতে পারিলাম, সেও যে আমিও সে, সেও পিতা আমিও পিতা। তাহার পর্বতগৃহবাসিনী ক্ষুদ্র পার্বতীর সেই হস্তচিহ্ন আমারই মিনিকে স্মরণ করাইয়া দিল। আমি তৎক্ষণাৎ তাহাকে অন্তঃপুর হইতে ডাকাইয়া পাঠাইলাম। অন্তঃপুরে ইহাতে অনেক আপত্তি উঠিয়াছিল। কিন্তু আমি কিছুতে কর্ণপাত করিলাম না। রাঙাচেলি-পরা কপালে-চন্দন-আঁকা বধূবেশিনী মিনি সলজ্জ ভাবে আমার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।"

"মিনি চলিয়া গেলে একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া রহমত মাটিতে বসিয়া পড়িল। সে হঠাৎ স্পষ্ট বুঝিতে পারিল, তাহার মেয়েটিও ইতিমধ্যে এইরূপ বড়ো হইয়াছে, তাহার সঙ্গেও আবার নূতন আলাপ করিতে হইবে-- তাহাকে ঠিক পূর্বের মতো তেমনটি আর পাইবে না। এ আট বৎসরে তাহার কী হইয়াছে তাই বা কে জানে। সকালবেলায় শরতের স্নিগ্ধ রৌদ্রকিরণের মধ্যে সানাই বাজিতে লাগিল, রহমত কলিকাতার এক গলির ভিতরে বসিয়া আফগানিস্থানের এক মরু-পর্বতের দৃশ্য দেখিতে লাগিল।"

রবীন্দ্রনাথ এক বিস্ময়কর প্রতিভার নাম। জীবন থেকে মৃত্যু, মৃত্যু থেকে পরকাল, স্বর্গ-মত্য-ধরাতল সবখানে এ মহা-মনীষীর দীপ্ত পদচারণা। জীবনে তিনি শুদ্ধ, মরণে তিনি আধ্যাত্মিক। তিনি অকলঙ্ক জীবনাচরণের দেবদূত। রবীন্দ্র চর্চায় আমরা শুধু একজনম নয়, সাত-সাত জনম পার করে দিতে পারি। শুধু গান নয়, তাঁর গল্প-কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ গবেষণা, চিত্রকলা (২০০০ এর উপরে চিত্রকলা), ভ্রমনকাহিনীসহ সবকিছুতে তিনি তুলে ধরেছেন মানবচরিত হৃত্বিক চেতনা। আসুন বিশ্বকবির এ চেতনা আমরা সারা পৃথিবী ছড়িয়ে দেই, আলোয় আলোয় ভরিয়ে তুলি এ বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড।

সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান