'বিব্রত ময়ূর' এর কবি রাসেল রায়হান'র জন্মদিন
'বিব্রত ময়ূর' এর কবি রাসেল রায়হান'র জন্মদিন

কবি রাসেল রায়হানের জন্ম ০৬ ডিসেম্বর ১৯৮৮, বাগেরহাটে। মা মাসুমা আক্তার, বাবা আলী আকবর। ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর।

‘বিব্রত ময়ূর’ পাণ্ডুলিপির জন্য মার্কিন গবেষক অধ্যাপক ক্লিন্টন বি সিলি ও প্রথমা প্রকাশনের যৌথ উদ্যোগে প্রবর্তিত ‘জীবনানন্দ দাশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার ১৪২২’ পেয়েছেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ দুইটি- সুখী ধনুর্বিদ (প্রকাশক: প্লাটফর্ম) এবং বিব্রত ময়ূর (প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন)।

কবি রাসেল রায়হানের কবিতার তৃতীয় বই ‘তৃতীয় অশ্বারোহী’। প্রেম বিষয়ক ৪০ টি কবিতার সমাহারে ভরপুর বইটি । পাঠক মহলে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সুখী ধনুর্বিদ ও বিব্রত ময়ূর এর মতই । কবি জন্মদিন উপলক্ষে সাহিত্যবার্তা পরিবারের পক্ষ থেকে একরাশ ফুলেল শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন ।

কবি রাসেল রায়হানের প্রিয় পাঁচ কবিতা ( বাঙলা নিউজে প্রকাশিত )

ক্লান্তি 


এই ক্লান্তি আশ্চর্য কমনীয়, রহস্যময় 
আর তুমি শুয়ে আছ নম্র ভঙ্গিতে—
ভিন্ন এক দেশে
দূরে আজান হচ্ছে। 
এ-সময় সমস্ত পার্সিয়ান রমণীদের 
আমার শিরিন বলে ভ্রম হয়। 

শিরিন, তোমার ওখানেও কি 
শোনা যাচ্ছে পারস্যের আজান

হলুদ ট্যাক্সির দরজা 


হলুদ ট্যাক্সিগুলোর দরজা খুলতে গেলেই আমার হাত কেঁপে ওঠে। পাশ দিয়ে বর্ষাতি পরা নারী-পুরুষ ট্যাক্সিতে উঠে যায়, আমি তাদের পারফিউমের গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারি, আমরা প্রত্যেক শীতে বর্ষাতি হারাই, সেটি টের পাই বরষায় এসে! হলুদ ট্যাক্সিগামী মানুষের শরীরে তখন হ্যামেলিন শহরের উপস্থিতি। শরীরভর্তি ইঁদুর বাঁশি বাজিয়ে নিয়ে যায় যে বাঁশিওয়ালা, মানুষ তার বাঁশির বাঁকা অংশটুকু দেখায়, সুরের ভুল ধরে। সেসব ভুলে গিয়ে বাতাসে লেগে থাকা তোমার নিশ্বাস টের পাই। বৃষ্টির সাথে সাথে দামি মদের চাকচিক্য নিয়ে তারা আমায় সঙ্গ দেয়। বৃষ্টি তুমুল হলেই বুঝতে পারি, অশ্রু পানিতে মিশে যায় বলে মাছের মায়ের পুত্রশোক নিয়ে আমাদের এত উপহাস

পরম্পরা


মাছের লেজের ঢঙে, মাছির ডানার ঢঙে জেগে উঠতেন আমার বাবা। তারপর ছুটতেন বাজারে। রাতে যখন ফিরে আসতেন মাছ ও মাছির গন্ধ নিয়ে, আমি ভাবতাম, আহা, একদা কি চন্দনের ঘ্রাণ নিয়ে আসতে পারেন না? (তখন মোটেই জানা ছিল না, সেসব নিয়ম অনেক আগে উঠে গেছে, আজকাল শুধু মৃত্যু এই গন্ধ নিয়ে আসে)। আজ রাতে যখন বাবার শরীর ভর্তি চন্দনের ঘ্রাণ, ভাবছি, মাছ ও মাছির গন্ধ আরও বেশি ভালো ছিল!
২. 
আমি যখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি, ফিস চাইতে গেলে বাবা আমার দিকে ম্রিয়মান ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছিলেন, যেন তার মনে পড়ে গেছে গত রাতের কথা, যখন আমি মোমের আলোয় চেঁচিয়ে পড়ছিলাম, ‘ফিস মানে মাছ, ফিস মানে মাছ...।’
তিনি মাছ কুটছিলেন। সেই মুহূর্তে আমার দিকে মনোযোগ দেওয়ার ফলে তাঁর একটি আঙুল ছিন্ন হয়ে যায়। যেহেতু ফিস দেওয়া হচ্ছেই না, কিছু অ্যাডভেঞ্চার করা যাক ভেবে আমি সেই আঙুল রঙিন পেপারে মুড়ে স্কুলে জমা দিয়ে দিলাম।...এইভাবে দশম শ্রেণি পর্যন্ত দশ ক্লাসে দশটি আঙুল জমা পড়ে স্কুলে! স্কুল ছাড়ার আগে ফিজিক্স-টিচার দেখলাম শল্যচিকিৎসকের ভূমিকায় নেমে গিয়ে কাগজে মুড়িয়ে রাখা পুরাতন দশটি আঙুল আমার দুহাতে লাগিয়ে দিলেন। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, আমার সন্তানকে বিশ ক্লাস পড়াতে পারব। সেও নিশ্চয়ই তার সন্তানকে পড়াবে ত্রিশ-ত্রিশটি ক্লাস...

চায়ের দোকান


ভাবছিলাম অদ্ভুত সেই চায়ের দোকানের কথা—একশ সতের পদের চা পাওয়া যেত যেখানে? তুমি বলছিলে, সব মিথ্যে! এসব নিতান্তই বিজ্ঞাপন। অত রকম চা নিশ্চয়ই বানানো সম্ভব নয়! আমরা পরীক্ষা করার জন্য একেকদিন একেকটা চায়ের অর্ডার দিতে শুরু করলাম। 
একশ ষোল পদের চা আমরা পেয়েছিলাম। জ্যোৎস্নার সাথে অ্যালোভেরার চা দিতে পারেনি কালো দোকানদার। মনে আছে কিনা, একটা চা খেয়েছিলাম, জলপ্রপাতের সাথে মৌমাছির ডানার গুঞ্জন, কিশমিশ আর আমলকিমিশ্রিত। আরেকটা চা ছিল, যেটা খেলে ক্ষুধা নিবারণ হয়। সেই এক কাপ চা পানের পরবর্তী এক সপ্তাহ আমরা আর কোনো ক্ষুধা বোধ করি নি।
ভাবছি এবার শীতের ছুটিতে পৃথিবীতে যাবার সময় ঐ চা বানানোর পদ্ধতিটা শিখে যাব। তারপর আমরা পৃথিবীতে একটা ক্ষুধানিবারক চায়ের দোকান খুলে বসব।

গাথা


পৃথিবীতে ঘুরছিল হাজার হাজার রাজহাঁস...

অকস্মাৎ উড়ে এসে পৃথিবীর অন্তিম ময়ূর
সাদাটে পেখম নিয়ে তাদের সম্মুখে বসে পড়ে।
প্রথমে হাজার হাঁস ঢেকে দিলো তার কেকারব;
ঠুকরে অহমরূপ তার সাদা পেখমসমূহ
তুলে নিলো। অতঃপর পাখনায় মেঘের মিনার
ঢেকে দিলো; গর্জনও। ফলত এই উপলক্ষহীন
আবহাওয়া আটকাল ময়ূরের তুমুল নৃত্য।
চর্চাহীন মজবুত নখ দিয়ে আজকাল সাপ
অদরকারী নির্মোক ঘষে ঘষে তুলে নেয় রাতে।

...ক্রমশ নিজেকে ভাবে রাজহাঁস, সাদাটে ময়ূর।

আমি জানি, পৃথিবীর অজ¯্র অঞ্চল জুড়ে ডাকে
হাঁসের চেহারা নিয়ে শতশত ময়ূর—বিব্রত।
তুমুল হর্ষের মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে যাবে, যদি
তোমাদের কানে আসে কখনো করুণ সেই ডাক।

কবিতার গল্প


এমনিতেই নিজের লেখা থেকে প্রিয় পাঁচ নির্বাচন ব্যাপারটিই ভয়াবহ, তার উপরে পেছনের গল্প! এটা হয়তো সত্যি, প্রতিটি কবিতার পেছনেই কিছু গল্প থাকে; সমস্যা হয় সেগুলি বলবার সময়। আমার কবিতা লেখার একটা বড় কারণই হলো, যেসব কথা আমি সরাসরি বলতে পারি না, সেগুলিই কবিতায় অনায়াসে বলে দেওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, ঘৃণার কথা। কিংবা প্রেমের কথাও। শিল্পের ঢঙে সত্যি কথা বলা অনেকটা নিরাপদ বিষয়। চরম শত্রুকে আঘাত করেও কিছু লিখলে দেখা যাচ্ছে সে পিঠে হাত বুলিয়ে বলছে, ভালো লেখা। আবার আমার পিতাকে হয়তো আমি ‘ভালোবাসি’ শব্দটা কখনো বলতে পারিনি, কবিতা সেই ভার কমিয়ে দিলো। তো এই গল্পগুলো বলা মানে কিছু গোপন বিষয় ফাঁস করে দেওয়া। তাও ঝুঁকি নিয়ে বলে ফেলা যাক:

প্রথম কবিতাটি প্রেমের, সহজেই বোঝা যায়। কোনো বিদেশিনীকে প্রেমের কথা বলা। এখন সে নারী হয়তো পারস্যেই থাকে, কিংবা থাকে না, থাকে অন্য কোথাও। যা-ই হোক, একদিন ফজরের আজানের সময় আমার ঘুম হুট করে ভেঙে গেলো। আসসালাতু খাইরুম মিনান নাঊম শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, বিদেশিনীকেও যেনো কল্যাণের পথে আসতে বলা হচ্ছে। মনে হচ্ছিল, সুদূর বিদেশে সে-ও আজান শুনছে, যেমন আমরা যেখানেই থাকি একই চাঁদ দেখি, যেমন একই সূর্য দেখি, অন্যান্য নক্ষত্র দেখি। এমনই। মনে হলো কবিতায় বিষয়টি স্বচ্ছন্দে বলে ফেলাই যায়; বললাম।

আসা যাক হলুদ ট্যাক্সির দরজা’য়। ‘সুখী ধনুর্বিদ’ বইয়ের কবিতা। এটার পেছনে জড়িয়ে রয়েছেন একজন বাঙালি কবি, প্রবাসী। উনি ফেব্রুয়ারিতে দেশে আসতেন, আর এসেই নক করতেন আমায় সেসময়। গাড়ি ভাড়া করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতেন। তার কল্যাণেই আমার প্রথম প্রাইভেট কার, ট্যাক্সিতে চড়া। তো প্রথম দিকে দরজা খোলার সময় খুব ঘেমে উঠতাম। দেখা যায় ড্রাইভার বলে, লক খোলা, অথচ আমি টানি, দরজা খোলে না। প্রায়ই ঘটত এমনটা। প্রতিবারই বোধ হয় ফেব্রুয়ারিতে দু-একবার বৃষ্টি নামে। আর গাড়িতে ওঠার পর বাইরের মানুষ দেখতে ভালো লাগে আমার, বিশেষত বৃষ্টিকালীন। সবার চেহারা যেনো পালটে যায়। এমনই কোনো বর্ষায় গাড়িতে বসে বসে এই কবিতার বীজ রোপিত হয় আমার মগজে।

এবার পরম্পরা। পরম্পরা আমার নিজের গল্প। আমার লেখা সবচেয়ে প্রিয় কবিতা। এই কবিতা অন্য কেউ লিখলে তাকে হয়তো আমি খুন করে ফেলতাম। আমার নিজের বাবার গল্প এটা। উনি ট্রলার থেকে মাছ কিনে ঝুড়িতে নিয়ে বাজারে বিক্রি করেন। ছোটবেলায় ওনার সঙ্গে কয়েকবার আমার নিজেরও বাজারে যাওয়া হয়েছে। অভিজ্ঞতাটি পুরোপুরি আছে। যদিও, বাবা নিতে চাইতেন না। কখনও চাননি, ওই জীবনের ছোঁয়া আমার লাগুক। তো এমন কিছু দেখা আর না দেখা, রিয়েলিজম আর ম্যাজিক রিয়েলিজমের সমন্বয়ে লেখা পরম্পরা, পিতার প্রতি পুত্রের ভালোবাসা।

চায়ের দোকান লেখার পটভূমি শনির আখড়ার একটা চায়ের দোকান। কবি কিশোর মাহমুদ আর নাজমুল হাসান আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন ওখানকার বিখ্যাত এক চায়ের দোকানে। সেখানে নানা পদের চা পাওয়া যেতো। আমি শুধু কিছু বাড়তি চায়ের প্রকার কল্পনা করে নিয়েছিলাম, আর জায়গাটা শনির আখড়ার বদলে পৃথিবীর বাইরের কোনো রাজ্য কল্পনা করে নিয়েছিলাম। এইই!

এবার গাথা। গাথাও আমার নিজেরই গল্প। নিজের গাথা। এটা আমার ‘বিব্রত ময়ূর’ বইয়ের নামকবিতাও। একবার কী একটা কাজে হোটেল শেরাটনে গিয়েছিলাম। ঢোকার পরে দেখি যে আমাকে এখানে মানাচ্ছে না, একদম মানাচ্ছে না। আপাতসব হুর-পরি আর অন্য জগতের বাসিন্দারা উড়ে বেড়াচ্ছে চারপাশে। চরম বিব্রতবোধ করছিলাম। নিজেকে মনে হচ্ছিল একঝাঁক শাদা ময়ূরের মধ্যে একটা রাজহাঁস। কবিতায় পাশার চালটা শুধু পালটে ফেললাম। আসলে সমস্ত ঢাকা নগরীতেই আপাত বেমানান ছিলাম আমি। এই কবিতাটির আরেকটা বিশেষ বিষয় আছে- সম্পূর্ণ কবিতাটির মূল খসড়া মোবাইলে লেখা, সম্ভবত প্রভাতী-বনশ্রী বাসের ছাদে বসে। অফিস থেকে বাসায় যাওয়ার সময় মাঝে মাঝেই বাসের ছাদে যাই আমি। এমনই একদিন বাসায় যাওয়ার পথে পুরনো শেরাটন মাথায় এসে ভর করে। আর গানের মতো বাজতে বাজতে আঙুলের ডগায় ভর করতে থাকে গাথার এক-একটা পঙ্‌ক্তি।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান