উদিত দুঃখের দেশের কবি আবুল হাসান
উদিত দুঃখের দেশের কবি আবুল হাসান

'উদিত দুঃখের দেশ তাই বলে হে কবিতা, দুধভাত তুমি ফিরে এসো,/ সূর্য হোক শিশিরের ভোর, মাতৃস্তন হোক শিশুর শহর।'- বাংলাদেশ আবুল হাসানের আজন্ম দুঃখিনী স্বদেশ; কোল-ভিল-শবরীর স্তন্যে লালিত, শত হায়নার হিংস্র থাবায় জর্জরিত এদেশের ললাটে অঙ্কিত হয়েছে বিচিত্র কলঙ্কতিলক। কত মগ-ফিরিঙ্গি, রাজন্য-আমির, তাতার-তৈমুর হানা দিছে এই বাংলায়; বখতিয়ারের ঘোড়ার খুর, বেনিয়াদের চাবুক আর খানসেনাদের শক্ত বুট ও বন্দুকে পিষ্ট ও রক্তাক্ত হয়েছে তাঁর প্রিয় স্বদেশ। মারী-মন্বন্তরে দু'মুঠো ভাত জোটেনি বঙ্গাল-জননীর ভুখা সন্তানদের মুখে। অভাবক্লিষ্ট বাঙালির ভাতহীন 'হাঁড়ি' চর্যাপদের কবিও দেখেছিলেন। ফুল্লরার বারমাসের দুঃখের বর্ণনা বঙ্গের দারিদ্র্যপীড়িত গৃহেরই প্রতিচ্ছবি। ক্ষুধিত বাংলার কবি সুকান্তের কাছে পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটির মতো মনে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাছেও মনে হয়েছে দেশ বড় 'দুর্ভাগা'। কারণ দুঃখই বাঙালির নিত্যসহচর। এই দেশই আবুল হাসানের উদিত দুঃখের দেশ। আর সে জন্য এখানকার জননীর প্রত্যাশা বেশি কিছু নয়, দুটো ভাত একটু নুন আর এক টুকরো মোটা কাপড়। দুধভাত যদি জোটে তবে আর কোনো প্রত্যাশা নেই। সে জন্য সন্তানের জন্য দেবীর কাছে বর চায়- 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।' আবুল হাসানও এই দুর্ভাগা দেশে কবিতার সঙ্গে দুধভাতকে ফিরে আসতে বলেছেন।আবুল হাসান ঝিনুকের মতো বিষের বালি সহ্য করে মুক্তা-সদৃশ কবিতা ফলিয়েছেন। তিনি লিখেছেন :'ঝিনুক নীরবে সহো/ ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও।'

বাংলা কবিতায় এই হীরকদ্যুতিময় পঙ্‌ক্তিমালার রচয়িতা আবুল হাসান, যিনি স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে উচ্চারণ করেছিলেন :'আমি শান্তি আর শিল্পের মানুষ।' এই শান্তি আর শিল্পের দ্রোণাচার্য সম্পর্কে শামসুর রাহমান বলেছেন :'আবুল হাসান মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত কবি, কবি ছাড়া তিনি আর কিছুই নন। তাঁর প্রতিটি নিঃশ্বাসে রয়ে গেছে কবিতা।' আবুল হাসান অতি অল্প সময় বাংলা সাহিত্যের মসনদে রাজত্ব করলেও, অবিনাশী কাল পৃথক পালঙ্কে চড়িয়ে তাঁকে হরণ করে নিয়ে গেলেও, ঝিনুক যেমন বিষের বালি সহ্য করে নীরবে মুক্তা ফলায়; তিনিও তেমনি যুগ ও জীবন-জটিলতায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে কবিতার মুক্তা ফলিয়েছেন। আর্থিক অনটন, বেকারত্বের গ্লানি, যুগজীবনের সমস্যা-সংকট এবং মরণব্যাধির যন্ত্রণায় তিনি ছটফট করেছেন। জীবনের সেই বেদনাময় অভিব্যক্তির শৈল্পিক প্রকাশ ঘটিয়েছেন 'রাজা যায় রাজা আসে' [১৯৭২], 'যে তুমি হরণ কর' [১৯৭৪], 'পৃথক পালঙ্ক' [১৯৭৫], 'আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা' [১৯৮৬], 'প্রেমের কবিতা' [১৯৯১], 'ওরা কয়েকজন' [কাব্যনাট্য, ১৯৯৮], 'আবুল হাসান গল্পসংগ্রহ' [১৯৯০] প্রভৃতি গ্রন্থে। সতত যন্ত্রণার মাঝেও তিনি শান্তি আর শিল্পের কেতন উড়িয়েছেন।

কোনো কবিই সমকালকে উপেক্ষা করতে পারেন না, রবীন্দ্রনাথ এ জন্যই বলেছিলেন, লেখকের কাল লেখকের চিত্তে গোচরে-অগোচরে কাজ করে। এ ছাড়া পূর্বযুগের ঐতিহ্যের ঢেউ আছড়ে পড়ে তার চিত্ত-মননে। আবুল হাসান সমকালকে আত্মস্থ করেই সাহিত্য-সাধনায় মগ্ন হয়েছিলেন। এ গ্রহে বসেই তিনি চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র তথা আকাশলোকের সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে তুলেছিলেন। পৃথিবীর আলো-বাতাসে এসেই দেখেছেন রক্তাক্ত আর সমস্যা-সংকুল পরিপার্শ্ব। তাঁর জন্মের অব্যবহিত পরেই ঘটেছে ভারতবর্ষের ইতিহাসের বেদনাময় ঘটনা দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত, ভুখা-নাঙ্গা কঙ্কালসার কান্নার রোল আর লাশের উৎকট গন্ধে নিঃশ্বাস ফেলতে হয়েছে তাঁকে। দীর্ঘ কালের শ্বেতাঙ্গ শাসন-শোষণের চিহ্ন তখনও একবারে লীন হয়ে যায়নি। তিনি দেখেছেন পাকসার জমিন সাদবাদ আর 'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান' ধ্বনির অসারতা এবং চাঁদ-তারার নিশান ডুবতে দেখেছেন। দেখেছেন বায়ান্ন-চুয়ান্ন-একাত্তর ও পঁচাত্তরের রক্তগঙ্গা। শ্বাসরুদ্ধকর বধ্যভূমি স্বদেশ থেকে থেকে বাইরে তাকিয়েও স্বস্তি পাননি; প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংসলীলার ক্ষত তখনও শুকায়নি; পুঁজিবাদ-সাম্যবাদ আর আধিপত্যবাদের লড়াইয়ে পৃথিবীর মানুষ তখন অসহায় হরিণীর মতো দিজ্ঞ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। চারদিকে এমন অস্থির-সংশয়পূর্ণ প্রতিবেশের দিকে তাকিয়ে আবুল হোসেন লিখেছেন :'অস্থিরতা চতুর্দিকে বলছি কিনা যাব কোথায়?', 'ইঁদুরের তবু পালাবার পথ রয়েছে গর্ত/ আমাদের তাও নেই হে ময়ূর মনে করে নিও/ আমরা এখনো কুষ্ঠ রোগীর কাতর।' সমকালীন মানুষের নৈরাশ্য, বেদনাবোধ, অনিশ্চয়তা এবং বিষণ্ণতা- সবই প্রোথিত ছিল আবুল হাসানের কবিচেতনার মর্মমূলে। এ জন্যই তাঁর কলমে এসেছে :'আমি কার কাছে যাবো? কোনদিকে যাবো/ অধঃপতনের ধুম সবদিকে, সভ্যতার সেয়ানা গুণ্ডার মতো/ মতবাদ, রাজনীতি, শিল্পকলা, শ্বাস ফেলছে এদিকে ওদিকে/ শহরের সব দিকে সাজানো রয়েছে শুধু শানিত দুর্দিন/ বন্যা অবরোধ, আহত বাতাস।' সবকিছু স্তাবকদের দখলে, সুকুমারবৃত্তির চর্চা সুবিধাবাদে আচ্ছন্ন, আলোকিত মানুষের সংশ্রব-প্রত্যাশাও মায়া-মরীচিকা; এমন পরিস্থিতিতে আবুল হাসানের উপলব্ধি :'গ্রন্থ এখন কেবলি ছাপার হরপ, সভ্যতার অধঃপতন,/ অমর কোনো পাইনি মানুষ যাকে ধারণ করলে আমি আলো পেতাম!/ শুধু শুধুই দুপুর গেছে মানুষ গেছে ব্যর্থ মানুষ,/ শিল্প এখন সুবিধাবাদ!' কোথাও যেন স্বস্তি নেই, কেবলই বেদনাদগ্ধ মানুষের আর্তনাদ; আর্তনাদ আবুল হাসানেরও :'বেদনার বিষবাষ্পে জর্জরিত এখন সবার চতুর্দিকে, খাঁ, খাঁ, খল/ তীব্র এক বেদেনীর সাপ খেলা দেখছি, আমি।'

জন্মগতভাবে মানুষ একা; একা সে মৃত্যুতেও। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে মানুষের সঙ্গী হয়েছে এই একাকিত্ব বা বিচ্ছিন্নতাবোধ। কালভেদে এর চারিত্র্য ছিল আলাদা। অর্থাৎ গুহাবাসী অরণ্যচারী মানুষের একাকিত্ব আর সামন্তবাদী ধর্মাশ্রয়ী মানুষের বিচ্ছিন্নতা এবং আধুনিক যুগের পণ্যসর্বস্ব জটিল জীবনে অভ্যস্ত মানুষের একাকিত্বের প্রভেদ বিস্তর। আর্থ-সামাজিক শোষণ, দুর্বলের প্রতি সবলের নিষ্পেষণ, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং জীবনের চাওয়া-পাওয়ার অপূর্ণতা থেকে মানুষ একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত হয়।

আবুল হাসান যুগের বৈরী পরিবেশে 'জয়শ্রীজীবন' থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা থেকে তিনি উচ্চারণ করেছেন :'অবশেষে জেনেছি মানুষ একা!/ জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা।' কেবল আবুল হাসানই নন; আধুনিক কালের অনেক কবির মধ্যেই যুগের আময় থেকে বিচ্ছিন্নবোধের জন্ম হয়েছে। জীবনানন্দ দাশ সকল লোকের মাঝে বসে নিজের মুদ্রাদোষে বিচ্ছিন্নতার জ্বালা ভোগ করেছেন। সুধীন্দ্রনাথ বিরূপ বিশ্বে একাকী আর্তনাদ করেছেন :'সহে না সহে আর জনতার জঘন্য মিতালী।' আবুল হাসান একইভাবে লিখেছেন :'হলুদ সন্ধ্যায় একা একা, আমি হায় কার অভিশাপে/ এত নির্জনতা, নিমর্ষ সঙ্গতা এই আমার রক্তের, করেছি কেবল পান।' জীবনের প্রতিটি পল তাঁর কেটেছে শঙ্কায়। অনেক সময় নিজের ছায়াও নিজের কাছে খারাপ লেগেছে। মন-মুকুরে নিজের প্রতিবিম্ব দেখেও আতঙ্কবোধ করেছেন। সেখানে নিজেকে দেখেছেন :'পাণ্ডুর খুবই নিঃসঙ্গ একাকী।' 'প্রতি পদক্ষেপে এক একটি রোমশ ভয় আমুণ্ডু আচ্ছন্ন করেছে' তাঁকে। বলেছেন :'আমি একজন নিঃসঙ্গ কবি, নিঃসঙ্গ/ নিঃসঙ্গ, নিঃসঙ্গ'। বলেছেন :'একরকম নিঃসঙ্গতা ভালোবাসি/ এরকম নিঃসঙ্গতা যদিও ভালো নয়/ তবু ভালোবাসি আমি নিঃসঙ্গতা।'

আবুল হাসানের কবি-মন ছিল অতি সংবেদনশীল, সূক্ষ্ণ অনুভূতিসম্পন্ন এবং সৌন্দর্যপ্রিয়। যুগের বৈরী পরিবেশ সত্ত্বেও শান্তি, মানবতা, কল্যাণ এবং সত্যের প্রতি তাঁর আস্থা ছিল সীমাহীন। কৃত্রিমতা, শঠতা ও প্রবঞ্চনা তিনি পছন্দ করতেন না। কিন্তু নির্মম হলেও সত্য যে, আবুল হাসানকে এসবই দেখতে হয়েছে। কালের বিধ্বস্ত রূপ তাঁর কবিচিত্তে আলোড়ন তুলেছিল বলেই তিনি লিখেছেন :'গোলাপ এখানে লাশ, মানুষের লাশ,/ কুকুর এখানে আজ হতে চায় কোমল হরিণ/ তাকাও এদিকে ক্ষত, ঐ দিকে খুন, তুমি তাকাও সময়/ যেখানে মমতা নেই, মনীষীর ছায়া নেই-আমার গমন!' এখানেই শেষ নয়; ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অভাব-অনটনের সঙ্গে সংগ্রাম করে চলতে হয়েছে আবুল হাসানকে। রোগ-জর্জর শরীর, বেকারত্ব, সংসারের ঘানি টানার ব্যর্থতা তাঁকে দারুণ যন্ত্রণা দিয়েছে। কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে তারই শিল্পভাষ্য :'আমি পকেটে দুর্ভিক্ষ নিয়ে একা অভাবের রক্তের রাস্তায় ঘুরছি।' কষ্টের বোঝা বহন করা তাঁর জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছিল। এ জন্য বলতে বাধ্য হয়েছেন :'আগুনে লাফিয়ে পড়ো, বিষ খাও, মরো/ না হলে নিজের কাছে ভুলে যাও। এত কষ্ট সহ্য করো না।'

কেবল আবুল হাসানই নন; বাংলা সাহিত্যের অনেক কবিই দুর্বিষহ জীবন-যন্ত্রণার চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করেছেন। জীবনানন্দ দাশ মৃত্যুকে 'বন্ধুর মতো', 'প্রিয়ার মতন' ডেকেছেন। রবীন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে মরণকে 'শ্যাম সমান' ভেবেছিলেন; জীবনসায়াহ্নে মৃত্যুকে দেখেছিলেন 'রাহুর মতন'। আবুল হাসান ভালোবাসার স্বীকৃতি চেয়েছিলেন, ভালোভাবে বাঁচতে চেয়েছিলেন। তা পারেননি বলে গভীর অভিমানে লিখেছেন :'এইসব থেকে আমি ছুটি চাই, ছুটি চাই', 'মৃত্যু আমাকে নেবে জাতিসংঘ আমাকে নেবে না।' এখানেই শেষ নয়। তিনি মৃত কবির কল্পছবি এঁকেছেন এভাবে :'ঐ তো পদ্মায় ওরা কবির ভাসন্ত মরা দেহ নিয়ে খেলছে, খেলছে।' অনেক সময় সূর্যের রোদে চাবুক বানিয়ে মৃত্যুকে সাবধান করেছেন।

জীবনযুদ্ধে পরাস্ত এবং সমকালীন যুগ-পরিবেশে পর্যুদস্ত হলেও শেষপর্যন্ত আবুল হাসান নৈরাশ্যবাদীদের দলে ভিড়ে যাননি। তিনি শিল্পের প্রতি আস্থাশীল হয়েছেন। কারণ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, 'শিল্প তো নিরাশ্রয় করে না কাউকে, দুঃখ দেয় না।' শিল্পের সাধনাকে তিনি জীবনের দুঃখ লাঘবের উপায়রূপে গ্রহণ করেছিলেন। মানুষের কল্যাণ সুখ এবং নিঃশঙ্ক জীবন আবুল হাসান একান্তভাবে কামনা করেছেন। মানুষের নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে তবেই তিনি হাসতে হাসতে ঘরে ফিরে যাবেন :'যদি দেখি, না,/ পৃথিবীর কোথাও এখন আর যুদ্ধ নেই, ঘৃণা নেই, ক্ষয়ক্ষতি নেই;/ তাহলেই হাসতে হাসতে যে যার আপন ঘরে/ আমরা ফিরে যেতে পারি।' হানাহানি, যুদ্ধের ধ্বংসলীলা, ক্ষয়ক্ষতি নয়; শান্তির আলয় হিসেবে তিনি পৃথিবীকে দেখতে চেয়েছেন। সে জন্য মৃত্যুর পূর্বে নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে বলে গেছেন :'সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন/ কী লাভ যুদ্ধ করে?/ শত্রুতায় কী লাভ বলুন?' শান্তি অন্বেষায় এবং জীবনের জ্বালা ভুলে থাকার জন্য তিনি একমনে সাহিত্য ও শিল্পের সাধনা করেছেন। শিল্পই তাঁর শান্তি-সুধা এবং শেষ ভরসার স্থল।

সূত্র: সমকাল ( কালের খেয়া )


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান