কবিতার কথা - মালেকা ফেরদৌস
কবিতার কথা - মালেকা ফেরদৌস

স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মিশেলেই কবিতার জন্ম (আল মাহমুদ)। আসলে কবিতা একটা অভিজ্ঞতা,বিশেষ সচলতায়,বিশেষ মাধুর্যে তা কবিতার রূপ নেয়।স্বাপ্নিক কবির মধ্যে একজন প্রেমিকের অন্তরঙ্গ ইচ্ছের লাবণ্য ও পেষণ আছে।আর সেখানেই তার কবিতায় অভিজ্ঞতার পুনর্নির্মাণ ঘটে।

কবি তার কবিতায় একটা আকুলতার সাম্রাজ্য নির্মাণ করেন।যেখানে প্রতিদিনের সূর্যোদয়,প্রজাপতির ডানা,পাখির চোখ-তার উড়ার শব্দ,বৃষ্টি বর্ষণের আনন্দ,একটা রূপালী রেখার মত নদী,স্নিগ্ধ একটা ভালো লাগাকে সম্বল করে যে গভীর মমতা মাখানো শব্দ উচ্চারিত হয় তার মাঝে কবি কখনো কখনো বেদনাও নির্মান করেন।কবি একজন শিল্পী কিন্তু যারা শুধু শিল্পকেই গুরুতর মূল্য দিয়েছে,জীবনকে দেয়নি ,তাদের পক্ষে মহৎ কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব না।যারা সবার সাথ এক হয়ে দুঃখ যন্ত্রনা ভোগ করেন, সময় ও কালের সব সংঘর্ষকে অবলোকন করেন এবং সব কিছুর সাথেই নিজেদের সম্পৃক্ত করেন। তারাই কালে কালে মানুষের অতি কাছের।শেক্সপীয়র, বোদলেয়র, দস্তয়ভস্কী,নজরুল,রবীন্দ্রনাথ,জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দ চিরকালই মানুষের সমসাময়িক।

জ্ঞানের অভিমান যাদের প্রচন্ড তারা তাদের তথাকথিত অসম্ভব জানাকে প্রকাশ করতে যেয়ে সব অনুভুতিকে ম্রিয়মান করে দেন।তাদের সংলাপ,তর্ক তাৎপর্যময় উচ্চারণ একটি শৃঙ্খলিত পরিধির মধ্যে চিত্তকে বন্দীদশায় হারিয়ে ফেলে।ফলে পাঠক, শ্রোতা তাদের সাথে একত্ব হতে না পেরে নিজেকে তাদের কাছ থেকে সরিয়ে নেন।
কবিতা বিচিত্র ভঙ্গুর শব্দচূর্নের উদ্দেশ্যহীন সমস্বর।কেউ বলেন আত্মার আর্তনাদ।আবেগের বিস্ময় নিয়েই কবিতা।কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ কতবার বিমুগ্ধ চিত্তের কলগান বহন করেছে,মানুষের আর্তনাদকে উন্মোচিত করেছে,কতবার আনন্দের অর্থহীন কাকলি আকাশে ও বাতাসে ছড়িয়েছে।কতবার যে বাককুন্ঠতার স্মারক হয়েছে তা কেউ হিসেব রাখেনি।শব্দ সদা অর্থের মধ্যে পল্লবিত,সমুদ্র যেমন তরঙ্গের মধ্যে বিগলিত,প্রাণ সঞ্চয় যেমন নিঃশ্বাসের মধ্যে সঞ্চারিত।

মানুষের জীবনের সবচে বড় সম্পদ হচ্ছে তার দৃষ্টির বৈভব।কবিতার স্বভাব ও তাৎপর্য উৎঘাটন ও করতে গেলে কবির জীবনও বিশ্বাসকে জানা প্রয়োজন, সামাজিক,ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত জানা প্রয়োজন।সৃষ্টির সময় কাল,দার্শনিক ও নন্দন তাত্বিক উপোলব্দি প্রয়োজন।কবির নানা অবলোকনকেও চিত্তে ধারণ করতে হয়।কবি হচ্ছেন সময়, স্থান এবং অনন্তবোধের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের হৃদয়ে ধারণ করার একজন শিল্পী।

কবি শুধু সুন্দর সুসংবদ্ধ কবিতা রচনা করেই ক্ষান্ত হবেন না। তিনি হবেন ভবিষ্যদ্বক্তা, দূরদর্শী, চারণ,নীতিবাদী। কবিতার গঠন হবে সহজাত এবং গুল্ম শীর্ষে প্রস্ফুটিত অনবদ্য ও নিখুঁত গোলাপ বা লাইলাক ফুলের মতো মুক্ত ছন্দের অনুপ্রকাশক।

অনেকে মনে করেন কবিতা কোন শিল্প নয়-নিছক অনুপ্রেরণা মাত্র।আবার অনেকে কাব্য সৃষ্টিকে প্রার্থনা- মুহূর্তের নিবেদিত চিত্ততার সাথে তুলনা করেন।

কবি কীটস বলেন-“আমি ক্ষণকালও কবিতা ছাড়া বাঁচতে পারিনা- অর্ধদিনও নয়,সম্পূর্ণ দিনতো নয়ই।”কথাগুলো ভীষণ সুন্দর কিন্তু স্বপ্নের মত অস্বচ্ছ ।সৃষ্টি প্রেরণার নিদ্দিষ্ট ব্যাখ্যা করা চলেনা।এ প্রেরণা চিরদিনই রহস্য- সংসক্ত।স্বপ্নের মত অনির্ণিত
ও অস্পষ্ট ।

একজন কবি পৃথিবীর কাজ ও প্রয়োজনের কলরবে কখনো বিভ্রান্ত হন না। তিনি অবলোকন করেন,প্রকৃতিকে দেখেন, প্রত্যহ নানা গুঞ্জন- পাখির কলরব শোনেন,আকাশ দেখেন।এ দেখাটাই কবির সৃজন ক্ষমতাকে বাঁচিয়ে রাখে। কবির এই একান্ত অনুভুতি কখনো বিমর্ষ হয়না।

শব্দ,চিত্রকল্প, রূপক,তথ্য ও বাণীবিন্যাস কবিতার প্রাণ।কবি মালার্মকে তার এক চিত্রকর বন্ধু প্রশ্ন করেছিলেন-“তোমার মধ্যে ভাবের ভীষণ পীড়ন কিন্তু কবিতা লিখতে পারোনা কেন?”
মার্লাম বললেন-“ one does not write a poem withideas.one writes it with good words”.( নান্দনিক ঐশ্বর্যেকবিতার রূপদান করতে হলে সুন্দর শব্দ ও বাণীবিন্যাস চাই।) শক্তিশালী একজন কবির হাতে এক একটি শব্দ হয়ে ওঠে বজ্রের মতো,আলোর মত উজ্জল,সমুদ্রের মত অতলান্ত গভীর।
এককালে আর্য ঋষিরা ঈশ্বরের কাছে শৈল্পিক শব্দ এবং ওজস্বী আবেদনে ঋদ্ধ উচ্চারণে প্রার্থনা করতেন।যেন তার প্রার্থনা ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে। শক্তিশালী কবির ভাব কখনো জরাগ্রস্ত
হয়না।ঠিক পৌরাণিক ফিনিক্স পাখির মতো।

কবিতার ভাষা চিত্তবৃত্তির প্রসার বিকাশের ক্ষেত্রেই সক্রিয়।আলোচনার সুবিধার জন্য কয়েকটি লাইনের উদ্ধৃতি দিলাম-”
“সারাদিন অশান্ত বাতাস ফেলিতেছে মর্মর নিঃশ্বাস”
“ শুষ্ক তৃণ গন্ধ বহি ধেয়ে আসে ছুটে তপ্ত সমীরণ”
লব্ধ ক্ষুব্ধ হিংস্র বারী রাশি প্রশান্ত সূর্যাস্ত পানে উঠিছে উচ্ছাসি”
“আমারই চেতনার রঙে পান্না হ’ল সবুজ চুনি উঠলো রাঙা হয়ে”
চিত্তবৃত্তি বিকাশের সাথে লাইনগুলো হৃদয়ের আবেগকে উচ্ছসিত করেছে, প্রাণবন্ত বাস্তবকে প্রতিভাসিত করেছে।অনুভুতি ও আবেগের এই যে স্বতঃবেদ্য স্বাভাবিকতা,শব্দ ব্যবহারের নিপুণতা একেই আমরা কাব্য প্রকাশ বলি।বস্তুর বাঙ্ময় ছবি ফুটে ওঠে।এ ছবি কবির বোধের।কবিতায় এ বোধ,অনুভুতি কল্পনার সাথে বিজড়িত।কবিরা প্রয়োজনবোধে রূপক ও উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করেন। এতে কবিতা ভাষায় জীবন্তও বাস্তব হয়ে ওঠে।
সার্থক কবিদের কল্পনার ব্যাপ্তি অসাধারণ, জীবন চেতনাও অসীম পরিসরের।তারা স্পর্ধিত নিঃশঙ্ক চারণ।

প্রাচীন সংস্কৃত কবিদের অনুরাগের রং একাকার হয়েছে প্রেমের কবিতায়। কবিতার রং হচ্ছে অস্তিত্বের রহস্যময়তা এবং আনন্দ।

কবিরা আজীবন অসীমের প্রতি,অধরা এবং অনন্তের প্রতি একটা দূরায়ণ টান ও আকর্ষণ অনুভব করেন।কোন এক সুদূর লোক থেকে কি যেন তীব্র ব্যাকুলতা না পাওয়ার বেদনা কবিকে কুড়ে কুড়ে খায়- “ “যদি জানতেম সে কিসের ব্যথা”- (রবীন্দ্রনাথ।)

আধুনিক কবিরা সৌন্দর্যবোধ ও আধুনিকতার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত।নান্দনিক কবিরা কখনো কখনো আর্দশের বৃত্ত ভাঙ্গেন।সমাজের নানা অসঙ্গতি থেকে একটি রক্তিম গোলাপকে ফুটিয়ে তোলেন।সমাজের নীতি আদর্শের বৃত্ত ভাঙ্গার জন ফরাসি কবি বোদলেয়ারকে কাঠ গড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে।তার ‘লে ফ্ল্যার দু’মাল’ এবং গুস্তাভ ফ্লোবের ‘ মাদাম বোভারি’ উপন্যাসটি ফরাসি সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন ।নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই মানুষের সহজাত আকর্ষণ বেশি থাকে।বই বিক্রি তাদের বিখ্যাত করে দেয়।এদিক দিয়ে আমাদের রবীন্দ্রনাথ ভাগ্যবান।যিনি আমাদের দ্বিমাত্রিক ধারনা দেন- কড়ি ও কোমলে,’মানসির, মানবিক মিলন ও চিত্রা’র উর্বশী,’বিজয়নী’তে। আসলে—“Art is woeful because it is Art.

বিশ্বের সব বড় কবিরাই আদিম যুগের কোলাহলকে স্মরণে এনেছেন।সৌন্দর্যবোধ, শিল্প, সংবেদনশীল, আবেগপ্রবণ তারা অনেক সময় ক্ষত বিক্ষত ও রক্ত- ক্ষরিত এবং অস্তিত্বের যন্ত্রনায় অস্থির হন।যন্ত্র যুগের শক্তিমত্তার সাথে সম্পর্ক খোঁজেন। আমাদের কবি নজরুলও লিখতে গিয়ে নানারকম বাধার সমুক্ষিন হয়েছেন, জেল জুলুম, হুলিয়া ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতার মুখামুখি দাঁড়িয়েছিলেন। তারপরও সৌন্দর্যের প্রতি তার ছিল অপরিসীম টান।রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যবোধ ছিল বিস্ময়ের আর নজরুলের ছিল প্রেম ও দ্রোহের।
রবীন্দ্রনাথ যেমন পুরাণে, বেদে তার ঐতিহ্য খুঁজেছেন, নজরুলও তেমন কোরানে, পুরাণে ঐতিহ্য খুঁজেছেন। যুগ যন্ত্রণাও তাদের ভীষণভাবে স্পর্শ করেছে।

প্রথম মহাযুদ্ধের পর ও সময়ে সারা বিশ্বের সমাজ জীবনে বিপুল একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।বিশেষ করে ইউরোপে। তার ঢেউ সারা বিশ্বের শিল্পীদের নাড়া দেয় এবং একটা বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। সে যুগযন্ত্রণার যুগে শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি সবাই এই বিশৃঙ্খলার হাত থেকে মুক্তি চাইলেন।সবাই একটা সুস্থ জীবনের কামনা করলেন। যেখানে দুর্ঘটনা থাকবে না, অস্বস্তি, থাকবেনা কারো হতাশা। এ সময়ে শিল্প,সংগীত, চিত্রকলা ও কবিতায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। এ পরিবর্তন গুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে স্যুররিয়ালিজম। যাকে আমরা পরা বাস্তববাদ বলি।

বাস্তবতার ভেতরে নানা ধরনের পরিবর্তন, দুর্ঘটনা ঘটেছে, ছন্দ ভেঙ্গে গেছে, বিশৃঙ্খলা এসেছে, নীতিবোধহীনতার জন্ম দিয়েছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য সবাই একটা স্বপ্নের জগত কল্পনা করলেন। যেখানে সব কিছুই সম্ভব ।যেখানে সময় একটা বিগলিত ঘড়ির মত গড়িয়ে চলে, নীলাভ আলোর মধ্যে মানুষ বাস করে।যেখানে একটি ফর্ম অবিকল বাস্তবের মত প্রতিভাত হয়। এভাবেই কবি, লেখক,শিল্পীরা স্যুররিয়ালিজমের জন্ম দিল।

(চলবে)


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান