ডি. লিট উপাধি পেলেন কথাসাহিত্যের দুই নক্ষত্র
ডি. লিট উপাধি পেলেন কথাসাহিত্যের দুই নক্ষত্র

বাংলাসাহিত্যে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট উপাধি পেয়েছেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ও সেলিনা হোসেন।

২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ম সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তাদের এ ডিগ্রি প্রদান করেন।

হাসান আজিজুল হক ও সেলিনা হোসেন দুজনই রাবির সাবেক শিক্ষার্থী। হাসান আজিজুল হক বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতাও করেছেন।

দীর্ঘদিন ধরে এ দুজন তাদের লেখালেখির মাধ্যমে বাংলাসাহিত্যেকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। বাংলা ভাষা ছাড়াও বিশ্বের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ভাষায় এদের সাহিত্য অনুবাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

হাসান আজিজুল হক ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন।

সেলিনা হোসেনও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৯৬৭ সালে বিএ এবং ১৯৬৮ সালে এমএ পাস করেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ সমাবর্তনে সর্বশেষ ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করে রাবি। সেবার ডি. লিট সম্মাননা পেয়েছিলেন ফরাসি বুদ্ধিজীবী আঁন্দ্রে মলরো।

হাসান আজিজুল হক

হাসান আজিজুল হক কথাসাহিত্যের দুটো শাখায়ই বিশেষ অবদান রেখেছেন। তবে পাঠকের কাছে পৌঁছেছেন মূলত ছোটগল্পের মাধ্যমে। তার গল্পে নতুন আঙ্গিকের সঙ্গে নতুন জীবন জিজ্ঞাসাও রয়েছে; যা তাকে তার সময়ের অন্য গল্পকারের চেয়ে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে।

প্রধানত ছোট গল্প লিখলেও- ‘আগুনপাখি’, ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’, ‘শামুক’ নামে তিনটি উপন্যাসও লিখেছেন। আগুনপাখি উপন্যাসটি দুই বাংলায় বেশ সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। ষাটের দশকে আবির্ভূত হাসান তার কাব্যময় গদ্য এবং জীবনস্পর্শী বর্ণনাভঙ্গির মাধ্যমে নিজেকে আলাদা করে দেখাতে পেরেছেন।

যে কারণে হাসান আজিজুল হক বাংলাসাহিত্যের একজন শক্তিমান কথাসাহিত্যিকই শুধু নন, বরং নতুন ধারারও প্রবর্তক। জীবন-সংগ্রামে লিপ্ত মানুষের কথকতা তার গল্প-উপন্যাসের প্রধানতম অনুষঙ্গ। রাঢ়বঙ্গ তার অনেক গল্পের পটভূমি।

সাহিত্য বিষয়েও তার গুরুত্বপূর্ণ লেখালিখি রয়েছে। তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন ১৯৭০ সালে। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। এ অসামান্য গদ্যশিল্পী তার সার্বজৈবনিক সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতি স্বরূপ চুয়াত্তর বছর বয়সে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ‘সাহিত্যরতœ’ উপাধি লাভ করেন।

হাসান আজিজুল হক ১৯৩৯ সারের ২ ফেব্র“য়ারি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মোহাম্মদ দোয়া বখশ্ এবং মাতা জোহরা খাতুন। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি রাজশাহীতে কাটিয়েছেন।

প্রথম যৌবনেই ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। রাজনীতি করার কারণেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে চরম নির্যাতন ভোগ করেন।

১৯৬০ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত হাসান আজিজুল হক রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা গার্লস কলেজ এবং দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৭৩-এ তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৪ সাল পর্যন্ত একনাগাড়ে ৩১ বছর অধ্যাপনা করেন। ২০০৯-এ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার পদের জন্য মনোনীত হন এবং দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪-এর আগস্টে তিনি বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন। তার নিজস্ব বাসভবন ‘উজান’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বদিকে ‘বিহাস’-এ।

রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় কলেজের উদ্যমী তরুণ মিসবাহুল আজীমের সম্পাদনায় প্রকাশিত ভাঁজপত্র ‘চারপাতা’য় হাসানের প্রথম লেখা ছাপা হয়, লেখাটির বিষয় ছিল রাজশাহীর আমের মাহাত্ম্য।

তবে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় ১৯৬০ সালে ‘শকুন’ শীর্ষক গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে হাসান আজিজুল হক সাহিত্যাঙ্গনে তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

১৯৬০ সালে ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকায় ‘একজন চরিত্রহীনের স্বপক্ষে’ গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল সব পত্রিকায় লিখেছেন।

‘পূবালী’, ‘কালবেলা’, ‘গণসাহিত্য’, ‘ছোটগল্প’, ‘নাগরিক’, ‘পরিক্রম’, ‘কণ্ঠস্বর’, ‘পূর্বমেঘ’ ইত্যাদি পত্রিকায় তিনি প্রায় নিয়মিত লিখেছেন। ১৯৬৩ সালে সুহৃদ নাজিম মাহমুদের সহযোগিতায় ‘সন্দীপন গোষ্ঠী’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে হাসান আজিজুল হক যুক্ত হন।

হাসান আজিজুল হক এসময় সুহৃদ নাজিম মাহমুদের সঙ্গে যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেন ‘সন্দীপন’ শীর্ষক একটি সাহিত্য পত্রিকা।

খুলনায় এসে তার সাহিত্য সৃষ্টির উৎসমুখ খুলে গেল প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সন্দীপন’কে কেন্দ্র করে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে নাজিম মাহমুদ, মুস্তাফিজুর রহমান, জহরলাল রায়, সাধন সরকার, খালেদ রশীদ প্রমুখ সংগ্রামী কয়েকজন তরুণের চেষ্টায় গঠিত হয়েছিল ‘সন্দীপন গোষ্ঠী’।

ততদিনে অবশ্য হাসান আজিজুল হক প্রতিষ্ঠিত লেখক। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’র প্রথম গল্প ‘শকুন’ এ সুদখোর মহাজন তথা গ্রামের সমাজের তলদেশ উন্মোচিত করেছিলেন তিনি। প্রায় অর্ধশতাব্দীর গল্পচর্চায় বিষয়, চরিত্র ও নির্মাণ কুশলতায় হাসান আজিজুল হক অনেক উল্লেখযোগ্য গল্পের রচয়িতা।

এসবের মধ্যে রয়েছে ‘শকুন’, ‘তৃষ্ণা’, ‘উত্তরবসন্তে’, ‘বিমর্ষ রাত্রি, প্রথম প্রহর’, ‘পরবাসী’, ‘আমৃত্যু’ ‘আজীবন’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘খাঁচা’, ‘ভূষণের একদিন’, ‘ফেরা’, ‘মন তার শঙ্খিনী’, ‘মাটির তলার মাটি’, ‘শোণিত সেতু’, ‘ঘরগেরস্থি’, ‘সরল হিংসা’, ‘খনন’, ‘সমুখে শান্তির পারাবার’, ‘অচিন পাখি’, ‘মা-মেয়ের সংসার’, ‘বিধবাদের কথা’ ‘সারা দুপুর’ ও ‘কেউ আসেনি’।

সেলিনা হোসেন

সেলিনা হোসনে বাংলাদেশের বর্তমান কথাসাহিত্যিকদের উজ্জ্বল নাম। কথাসাহিত্যের দুটো শাখায়ই তার যথেষ্ট কাজ রয়েছে। তবে ছোটগল্পকারের চেয়ে উপন্যাসিক হিসেবেই তার পরিচিতি বেশি। সেলিনা হোসেন একজন ব্যতিক্রম কথাসাহিত্যিক।

সাহিত্যগুণ রক্ষা করে সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছানো বাংলাসাহিত্যের অল্প কিছু লেখকের মধ্যে সেলিনা হোসেন অন্যতম। তার উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে সমকালের সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংকটের সামগ্রিকতা। বাঙালির অহংকার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তার লেখায় নতুনমাত্রা যোগ করেছে।

তার গল্প-উপন্যাস ইংরেজি, রুশ, মেলে এবং কানাড়ি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

সেলিনা হোসেনের জন্ম রাজশাহী শহরে। পৈতৃক নিবাস লক্ষ্মীপুর জেলার হাজিরপাড়া গ্রামে। বাবা একে মোশাররফ হোসেনের আদিবাড়ি নোয়াখালী হলেও চাকরিসূত্রে বগুড়া ও পরে রাজশাহী থেকেছেন দীর্ঘকাল।

ভাষা আন্দোলনের দু’বছর পর (অর্থাৎ, ১৯৫৪ সালে) বগুড়ার লতিফপুর প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন বালিকা সেলিনা। ক্লাস থ্রিতে, ১৯৫৯ সালে রাজশাহীর নাথ গার্লস স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন; ওখান থেকেই ম্যাট্রিক (তখন এসএসসি বলা হতো না) পাস করেন ১৯৬২ সালে। প

রবর্তী সময়ে ১৯৬৪ সালে রাজশাহী মহিলা কলেজে ভর্তি হন। কলেজ জীবন শেষ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবার জীবনে যুক্ত হল নিবিড় সাংস্কৃতিক ও গভীর রাজনৈতিক অধ্যায়।

সেলিনা হোসেনের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে। বাংলা একাডেমির ‘অভিধান প্রকল্প’, ‘বিজ্ঞান বিশ্বকোষ প্রকল্প’, ‘বিখ্যাত লেখকদের রচনাবলি প্রকাশ’, ‘লেখক অভিধান’, ‘চরিতাভিধান’ এবং ‘একশত এক সিরিজের’ গ্রন্থগুলো প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন।

এছাড়াও ২০ বছরেরও বেশি সময় ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সেলিনা হোসেন ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমির প্রথম মহিলা পরিচালক হন। ২০০৪ সালের ১৪ জুন চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সর্বশেষ তিনি ২০১৪ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে দুই বছরের জন্য নিয়োগ পান।

তার অনেক জনপ্রিয় উপন্যাস রয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘মগ্ন চৈতন্যে শিস’, ‘যাপিত জীবন’, ‘নীল ময়ূরের যৌবন’, ‘পোকা মাকড়ের ঘরবসতি’, ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’, ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’। এছাড়া গল্পে ও প্রবন্ধ এবং শিশুসাহিত্যেও তার বিশেষ অবদান রয়েছে। হ স কামাল হোসেন


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান