বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল- সিদ্ধার্থ সিংহ
বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল- সিদ্ধার্থ সিংহ

'বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল'-এর নেপথ্য কাহিনি

আমরা তখন তথ্যচিত্র নয়, উত্তমকুমারকে নিয়ে দূরদর্শনের জন্য একটি ধারাবাহিক বানাচ্ছিলাম। কারণ, দূরদর্শন ছাড়া তখন আর কোনও চ্যানেল ছিল না। কিন্তু উত্তমকুমার তো নেই। তা হলে ধারাবাহিকটা হবে কী করে! ঠিক হল, যাঁরা যাঁরা উত্তমকুমারের সঙ্গে কাজ করেছিলেন, খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখেছিলেন, সেই সব পরিচালক, সহ-পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, ক্যামেরাম্যান, লাইটম্যামন, স্পটবয়, মেক-আপ ম্যান, ড্রেসার, আত্মীয়স্বজন, কাছের মানুষ থেকে দূরের মানুষ, তাঁদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক ধারাবাহিক হবে এটা। মাঝে মাঝে ঢুকবে তাঁর অভিনীত নানান ছায়াছবির নির্বাচিত অংশ, স্থিরচিত্র, তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র, ঘরবাড়ি মায় তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত সব কিছু। শুধুমাত্র  উত্তমকুমারকে ভালবেসে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী, দেবনারায়ণ গুপ্ত, অপর্ণা সেন, তরুণকুমার, উত্তম-পুত্র গৌতম, সরযূবালা, ছায়াদেবী, অনুপকুমার, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, অগ্রদূত, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, ভারতী দেবী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মৃণাল সেন-সহ কে নন?
সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় আমাকে যা বলেছিলেন, সেটা মনে পড়লে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দেয়। যখন উত্তমকুমারের হার্ট অ্যাটাক হয়, তখন তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পুরো ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। কার কোন কথার জেরে হঠাৎ করে এমন বিপর্যয় ঘটেছিল, অসুস্থ শরীরেও তার পুরোটাই তিনি খুব সুন্দর করে সে দিন গুছিয়ে বলেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, উত্তমকুমার মরেননি। তাঁকে মারা হয়েছে। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেম। আমার কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন। সেই সব কথা শিবাশিসের দেওয়া পকেট টেপ-রেকর্ডারে বহু দিন পর্যন্ত বন্দি ছিল। বহু লোককে আমি সেটা শুনিয়েওছিলাম। যাঁরা শুনেছিলেন, প্রত্যেকেই চমকে উঠেছিলেন। কারণ, তিনি সেই অভিনেত্রীর নামটাও অকপটে বলেছিলেন।
   আমি, সুদেষ্ণা রায়, অনিরুদ্ধ ধর, সিদ্ধার্থ সরকার, শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, বাল্মিকী চট্টোপাধ্যায়রা মিলে তো কাজটা করছিলামই। আমাদের পাশে বহু লোক এসে দাঁড়ালেও কেউ কেউ বিরোধীতাও শুরু করে দিলেন। প্রশ্ন তুললেন, লাভের টাকা কে নেবে? লাভ!  আমরা তো সে কথা একবারও ভাবিনি। আমরা তো কাজের আনন্দে কাজ করছি। সানন্দায় লিখলে কিছু টাকা পাই। এই কাজ করতে এসে তো সেটাও বন্ধ। তখন স্যুটিং চলছিল স্টার থিয়েটারে। পুরনো স্টার থিয়েটারে। তখনও সেখানে আগুন লাগেনি। দেবনারায়ণ গুপ্ত বলছিলেন, এই স্টার থিয়েটারেই উত্তমকুমারের সঙ্গে নাটক করার কথা। তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা। দেখাচ্ছিলেন তোথায় দাঁড়িয়ে তারা চা খেতেন। কোথায় বসে আড্ডা দিতেন। হঠাৎ তার মধ্যেই আমার আক্ষেপের কথা শুনে অনিরুদ্ধদা বললেন, এই সংখ্যায় তুই কিছু লিখিসনি? আমি বললাম, না তো। উনি বললেন, সে কী রে! বলেই, দু'মিনিট চুপ করে থেকে কী একটা ভেবে নিয়ে বললেন, তুই একটা কাজ কর। একটা গল্প লিখে ফেল। গল্প লেখার জন্য তো তোকে কোথাও যেতে হবে না। কারও ইন্টারভিউও নিতে হবে না। ঘরে বসে লিখবি। তুই আজ রাতেই একটা গল্প লিখে ফেল। কাল সকালে ডিপার্টমেন্টে যে থাকবে, তাকে বলবি পি টি এস-এ পাঠিয়ে দিতে। তা হলে এই সংখ্যাতেই ধরিয়ে দেওয়া যাবে।
আমি তো অবাক। লিখি কবিতা। গল্প লিখতে হবে! অনিরুদ্ধদা যখন বলেছেন, ঠিক আছে, লিখব। শ্যুটিং সেরে মধ্যরাতে ফিরে লিখে ফেললাম একটা গল্প--- বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল।

দুই

তখন সানন্দা বেরোলেই আমার প্রথম কাজ ছিল সকালেই স্টলে গিয়ে সানন্দা উল্টেপাল্টে দেখা।  যে দিন সানন্দায় আমার 'বাঁ হাতের বু়ড়ো আঙুল' বেরোল, সে দিনও স্টলে গেলাম। না, আমার জীবনের প্রথম গল্প ছাপা হয়েছে দেখে নয়, ওই সংখ্যায় আমার ক'টা লেখা বেরিয়েছে এবং তার জন্য আমি কত টাকা পেতে পারি, তার একটা অনুমান করার জন্য।
কিন্তু স্টলে গিয়ে দেখি একটাও সানন্দা নেই। গেলাম রাসবিহারী মোড়ে।  হাজরা মোড়ে। না, সেখানেও সানন্দা নেই। পরে জানলাম, কে বা কারা নাকি কলকাতা এবং তার আশপাশ থেকে সমস্ত সানন্দা পাঁজা করে কিনে নিয়ে গেছে।
বাড়ি ঢোকার মুখে দেখি এক ডাকসাইডে কংগ্রেসি নেতা, না। তখনও তৃণমূলের জন্ম হয়নি। তাঁকে এবং আরও কয়েক জন ষন্ডা মার্কা তাগরাই দুষ্কৃতিকে নিয়ে আমাদের এলাকার কাউন্সিলার দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখেই তাঁরা ঘিরে ধরলেন। সবাই মিলে এত হম্বিতম্বি করতে লাগলেন যে, কে কী বলছেন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।  আচমকা সেই কাউন্সিলার ওদেরকে হাত দেখিয়ে থামতে বললেন। তার পর প্রচণ্ড রেগে গিয়ে আমাকে বললেন, এই, তুই আমাদের দাদাকে নিয়ে সানন্দায় কী লিখেছিস রে?
মুখে প্রশ্ন করছে ঠিকই, কিন্তু আমাকে তার কোনও উত্তর দিতে দিচ্ছে না। আমাকে ধাক্কা মারতে মারতে দেওয়ালে ঠেসে ধরেছে। তারই মধ্যে কেউ চড়চাপড় মারছে। চুলের মুঠি ধরে টানছে। ভিড়ের মধ্যে থেকে মনে হয় কেউ কেউ লাথিও মারছে। না, আমাকে কোনও কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমাকে টেনে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে নিয়ে গেল কাছেরই একটা নির্মীয়মান বাড়ির তিন তলায়। রাস্তার লোকজন পুরো ঘটনাটা দেখলেও ওদের ভয়ে কেউ এগিয়ে আসার সাহস পেল না।
তিন তলায় নিয়ে গিয়ে একটা থামের সঙ্গে দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে ওরা আমাকে বেঁধে ফেলল। কেউ জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দিতে লাগল। কেউ নীচ থেকে ভাঙা বাঁশ তুলে আমাকে সপাটে কয়েক ঘা কষিয়ে দিল। চড় থাপ্পড় ঘুষি তো চলছিলই।  আমার ঠোঁট থেকে তখন রক্ত ঝর়ছে।  নাক থেকে গলগল করে রক্ত। টেনে আনার সময় আমি আসতে চাইছিলাম না দেখে ওরা আমার হাত ধরে এমন হ্যাঁচকা টান মেরেছিল, হাত মুচড়ে দিয়েছিল যে, যন্ত্রণার আর থাকতে পারছিলাম না।
তারই মধ্যে ডাকসাইডে ওই নেতা চিৎকার করে উঠলেন, তোর এত বড় সাহস? আমাকে নিয়ে কেচ্ছা লেখা? আমি রাত্রবেলায় রেশন দোকানের সাটার নামিয়ে আমার সাঙ্গপাঙ্গোদের নিয়ে আমি ব্লু-ফিল্ম দেখি? মদ খাই? আমার ছেলেপিলেরা পাড়ার মেয়ে-বউদের ইভটিজিং করে? হাত ধরে টানাটানি করে? মার শালাকে। হাত-পা ভেঙে পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দে। তার পর বস্তায় পুরে সাইডিংয়ে ফেলে দিয়ে আয়।
উনি যত বলেন, তার চেয়ে বেশি বলেন সেই কাউন্সিলার। তাঁদেরই উসকানিতে আমার ওপর বাড়তে থাকে অকথ্য অত্যাচার।
বারুইপুরে আমাদের একটি বাগানবাড়ি আছে। সেখানে কিছু দুষ্টু ছেলেমেয়ে থাকে। দুষ্টু মানে যারা খুন-টুন করে। ডাকাতি করে। দাগি আসামিদের হয়ে সাপ্তাহিক বা মাসিক টাকার চুক্তিতে জেল খাটে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে যারা কোনও থাকার জায়গা পায় না, সে রকম ছেলে মেয়ে।  হ্যাঁ, শুধু ছেলেরাই নয়, মেয়েরাও।
ওই বাড়ি থেকে সে দিন আমাদের আলিপুরের বাড়িতে এসেছিল সুদীপা আর রাজু। সুদীপা মানে সুদীপা পাল। এক সময় সংবাদের শিরোনামে ছিল। গৃহ-শিক্ষকের পাল্লায় পড়ে ধর্মতলার কে সি দাস থেকে কালোজাম কিনেছিল। তার পর তার মধ্যে বিষ মিশিয়ে মা, বাবা আর ঠাকুমাকে খাইয়ে একসঙ্গে তিন জনকেই মেরে ফেলেছিল। ধরাও পড়েছিল। জেল থেকে পুলিশ ভ্যানে করে কোর্টে যাওয়ার পথে রাজুর সঙ্গে ওর আলাপ হয়। রাজু তখন ডাকাতির কেসে জেল খাটছে। সেই আলাপ থেকে প্রেম। প্রেম থেকে বিয়ে। বিয়ে করে থাকবে কোথায়? আমার মাকে এসে ধরল। মা বললেন, যা, তা হলে আমাদের বারুইপুরের বাগানবাড়িতে গিয়ে থাক।
ওরা বারুইপুরে থাকত। মাঝে মাঝে এ বাড়িতে আসত। সে দিনও এই বাড়িতে এসেছিল। এসেই, আমাকে কয়েক জন তুলে নিয়ে গেছে শুনে অত্যন্ত কৌশলে ওই দুষ্কৃতিদের চোখে ধুলো দিয়ে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিল।
তখনও মোবাইল আসেনি। বেরিয়েই ছুটতে ছুটতে কিছুটা গিয়ে একটা গ্যারেজ থেকে ফোন করি সানন্দায়। ওখানে তখন দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন সুদেষ্ণা রায়। সুদেষ্ণাদি আমার সব কথা শুনে বললেন, আগে থানায় গিয়ে একটা ডায়েরি কর। করেই সোজা অফিসে চলে আয়।
আমি ওখান থেকে সোজা চলে গেলাম আলিপুর থানায়। কিন্তু ওই ডাকসাইডে নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে এসেছি শুনে থানার লোকেরা এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিল, তারা এ ডায়েরি নিতে পারবে না।

তিন

সানন্দার ঘরে ঢুকতেই সুদেষ্ণাদি বললেন, কী রে? থানায় ডায়েরি করেছিস? আমি বললাম, থানা ডায়েরি নেয়নি। পাশেই ছিলেন দীপান্বিতাদি। অসম্ভব সুন্দরী।  কত তাবড় তাবড় রথি-মহারথিরা যে ওর প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছেন তার হিসেব নেই। কত লোক যে ওকে প্রেমপত্র দিয়েছিল, এক জায়গায় জড়ো করলে হয়তো হিমালয়ের চূড়াও খাটো হয়ে যেত। একমাত্র একজনেরই প্রেমপত্র অতিযত্নে ও বুকে চেপে রেখেছিল, তাঁর নাম--- সমরেশ বসু। বিখ্যাত লেখক সমরেশ বসু। একদিন, সানন্দার দফতরেরেই, যার সঙ্গে তিনি তখন চুটিয়ে প্রেম করছেন, না; তার নাম এখানে বলা ঠিক হবে না। তার সঙ্গে ওঁর প্রাক্তন প্রেমিকদের নিয়ে এতটাই বচসা হয়েছিল যে, রাগ করে তখনই সমস্ত প্রমান লোপাট করার জন্য তিনি সমরেশ বসুর লেখা যাবতীয় প্রেমপত্র একটা পলিপ্যাকে ঠেসেঠুসে ভরে হাওড়া ব্রিজের ওপর থেকে গঙ্গায় ফেলে দিয়েছিলেন।
সেই দীপান্বিতাদি জিজ্ঞেস করলেন, কোন থানা?
আমি বললাম, আলিপুর থানা।
উনি অবাক, আলিপুর থানা ডায়েরি নেয়নি? দাঁড়া দেখছি। বলেই, ফোন করলেন গৌতমমোহন চক্রবর্তীকে। আমরা জানতাম গৌতমমোহন চক্রবর্তী ওর খুব ভাল বন্ধু। তিনি তখন সম্ভবত ডিসিডিডি ওয়ান।
দীপান্বিতাদি ফোনে কথা বলছেন, ঠিক তখনই শুনতে পেলাম সুদেষ্ণাদির গলা। বললেন, তোদের কাউন্সিলার ফোন করেছিল। উনি কি পাগল নাকি?
আমি বললাম, কেন? কী হয়েছে?
সুদেষ্ণাদি বললেন, আরে, এই ধরনের লোকেরা যা বলে উনি তাই বললেন। উনি বললেন আপনারা যা ইচ্ছে তাই করবেন নাকি? আমার চল্লিশ জন ছেলে যাচ্ছে। আনন্দবাজার জ্বালিয়ে দিয়ে আসবে। দেখি, কী করে আটকান। আর সিদ্ধার্থ সিংহ? তার কী অবস্থা করি দেখবেন। একবার এলাকায় ঢুকুক।
সঙ্গে সঙ্গে সে কথাও গৌতমমোহন চক্রবর্তীকে জানিয়ে দিলেন দীপান্বিতাদি।
ছুটে এল টেলিগ্রাফ থেকে একজন। ব্যাপারটা কী ঘটেছে সবটা আমার কাছ থেকে শুনল। যখন আমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছে, আমার সামনে এসে হাজির বিবিদি। বিবিদি মানে বিবি রায়। বাবু-বিবির সেই বিবি। কিন্তু অনেকে ওঁর নাম শুনে ভাবত বি বি রায়। উনি থাকতেন আমাদের বাড়ির খুব কাছেই। সানন্দায় কাজ করলেও উনি ছিলেন অপর্ণা সেনের হেয়ার ড্রেসার। কয়েকটা আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টও নাকি উনি সাজিয়েছিলেন!
আমরা যখন খুব ছোট, তখন ওঁর বাড়িতে প্রায়ই উত্তমকুমার আসতেন। মধ্যরাত অবধি পার্টি হত। নায়ক-নায়িকাদের দেখার জন্য ওঁর বাড়ির সামনে ভিড় জমে যেত। কলকাতার নামডাকওয়ালা  'নবনালন্দা' স্কুলটা ছিল ওঁর দিদি-জামাইবাবুর।
সেই বিবিদি বললেন, তুই একবার তিন তলায় গিয়ে নিউজ এডিটরের সঙ্গে দেখা কর তো...
আমি সঙ্গে সঙ্গে আনন্দবাজারের নিউজ এডিটরের কাছে গেলাম। উনি হাঁক পেড়ে একটি ছেলেকে ডেকে বললেন, ওর সঙ্গে একটু কথা বলে জেনে নে তো, কী হয়েছে।
আমি পুরো ঘটনাটা বললাম।
ওপর থেকে যখন সানন্দার দফতরে ফিরে এলাম সিদ্ধার্থদা, মানে সিদ্ধার্থ সরকার, যিনি পরে ই টিভি-র পূর্বাঞ্চল শাখার সর্বময় কর্তা হয়েছিলেন।  বেহালার চৌরাস্তার কাছে নতুন পাড়ায় থাকতেন। কিন্তু পর দিন আবার অফিসে আসতে হবে বলে রোজ রোজ বাড়ি ফিরতেন না। অফিসের কাছেই চাঁদনিচক মেট্রো স্টেশনের সিঁড়িতে মাথায় এয়ার বালিশ দিয়ে উনি মাঝে মাঝেই ঘুমিয়ে পড়তেন।
তিনি এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন, এখানে একটা ফোন করিস।
--- কার নাম্বার এটা? আমি জিজ্ঞেস করতেই উনি বললেন, মমতা ব্যানার্জির। তোকে খুঁজছিল। তো, আমি বললাম, ও ওপরে গেছে। উনি তখন এই নম্বরটা দিয়ে বললেন, ও এলে যেন আমাকে একটা ফোন করে।
এর ক'দিন আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের অফিসে এসে আমাদের সবাইকে রাখী পরিয়ে গিয়েছিলেন। মিষ্টি খাইয়েছিলেন। উনি এতটাই স্নেহপ্রবণ যে, আমার কখনও মনে হয়নি উনি একজন নেত্রী। যতবার তাঁর কাছাকাছি হয়েছি, বারবারই মনে হয়েছে উনি আমার দিদি। নিজের দিদি।
আমি তড়িঘড়ি ফোন করলাম সেই নাম্বারে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই ধরলেন। এবং অনেক কথা বললেন। কিন্তু ওঁর মতো একজন নেত্রী আমার মতো চালচুলোহীন সামান্য এক লেখকের খোঁজখবর নিচ্ছেন, অভয় দিচ্ছেন, সাহস জোগাচ্ছেন, পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন--- এটা দেখে আমি এতটাই আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম যে, উনি কী বলছেন, আনন্দের চোটে তাঁর অর্ধেক কথাই আমার কানে ঢুকছিল না। তেমন ভাবে বলতেও পারলাম না কোনও কথা।
ফোন রাখতেই একের পর এক ফোন। সবই আমার। ফোন ধরতে ধরতে বিরক্ত হয়ে এক সময় বিশাখাদি, মানে বিশাখা ঘোষ, যিনি পরে বিবিসি-র অত্যন্ত উঁচু পদে আসীন হয়েছিলেন, আমার অনেকগুলো লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন, সেই বিশাখাদি বললেন, এখানে তুই বস। ফোন ধর।
তার পর থেকে খানিক পর পরই আসতে লাগল একের পর এক ফোন। কোনওটা গণশক্তি থেকে, তো কোনওটা আজকাল থেকে, কোনওটা বর্তমান থেকে তো কোনওটা দূরদর্শন থেকে। প্রত্যেককেই আলাদা আলাদা ভাবে বলতে হচ্ছে, আমার সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছে। তাদের কথার উত্তর দিতে দিতে আমার অবস্থা তখন কাহিল।
নিরেনদা, মানে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বললেন, লেখার সময় এ বার থেকে একটু বুঝেশুনে লিখো। শীর্ষেন্দুদা, মানে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বললেন, লেখার সময় সব কিছু হুবহু লিখতে নেই। কিছু কিছু জিনিস একটু বদলে দিতে হয়। সুনীলদা, মানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ওরা কি তোমার বাড়ি চেনে?
আমি বললাম, ওই নেতা না চিনলেও কাউন্লিলার মনে হয় চেনেন।
সুনীলদা বললেন, তা হলে কয়েকটা দিন আর ওই বাড়িতে থেকো না। সে রকম জায়গা না থাকলে আমার বাড়িতে থাকতে পারো।
রমাপদবাবু, মানে লেখকদের লেখক সম্পাদকদের সম্পাদক রমাপদ চৌধুরী বললেন, কেন এ সব ঝামেলার লেখা লিখতে যান? এঁদের বিরুদ্ধে লিখলে তার পরিনাম কী হতে পারে আপনার কোনও ধারণা আছে?
আমাদের অফিসের আরও অনেকেই অনেক কথা বললেন। তবে রমাপদবাবুর কথা শুনে আমি সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গেলাম। ঠিক করলাম, না; আজ আর আমি আলিপুরের বাড়িতে ফিরব না। কিন্তু থাকব কোথায়!
এরা যে টাইপের লোক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই খোঁজখবর নিয়ে নিয়েছেন আমাদের কোথায় কোথায় বাড়ি আছে! তাই শেষপর্যন্ত ঠিক করলাম, টালিগঞ্জের কাছে রানিকুঠী আর বাঘাযতীনের প্রায় মাঝামাঝি জায়গা, যেখানে বারোভূতের মেলা হয়, যার উল্টো দিকে যুব সংঘের মাঠ, সেখানেই থাকব। তাই রমাপদবাবু যখন ট্যাক্সি করে গল্ফগ্রিনের বাড়ির দিকে যাওয়ার জন্য বেরোচ্ছেন, আমি উঠে পড়লাম তাঁর ট্যাক্সিতে। গল্ফগ্রিনে নেমে বারবার পিছন ফিরে দেখতে লাগলাম, কেউ ফলো করছে না তো! এতটাই টেনশনে ছিলাম, যার দিকেই চোখ পড়ছিল, মনে হচ্ছিল, এরা নিশ্চয়ই ওদের লোক। অবশেষে এ গলি ও গলির ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যা নামার আগেই পৌঁছে গেলাম শ্রীকলোনিতে।

চার

সারা রাত ঘুমোতে পারিনি। না, অন্য জায়গায় বলে নয়। ছোটবেলা থেকেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা ছিল আমার। কোনও কারণে কিছু দূর গেলে আমার আযর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করত না। রাস্তাঘাটে অথবা ফুটপাথে ভিখারিদের সঙ্গে কিংবা কোনও পার্কের বেঞ্চে নয়তো প্রচণ্ড মশার উৎপাতেও যে কোনও রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে অনায়াসে ঘুমোবার অভ্যাস আছে আমার।
একবার তো বিরাটি থেকে আর আসতে ইচ্ছে করল না। তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। শীতকাল। বাসটাস বন্ধ হয়ে গেছে। শোওয়ার জন্য এক চিলতে বারান্দাও পেয়ে গেলাম। কিন্তু এই শীতের হাত থেকে বাঁচব কী কে! পাশেই ছিল একটা মুদিখানা দোকান। কাল সকালেই দোকান খোলার সঙ্গে সঙ্গে ফেরত দিয়ে দেব, বলে তাঁর কাছে থেকে দুটো বস্তা জোগাড় করলাম কোনও রকমে। আশপাশ একদম সুনসান হতেই একটা বস্তা নীচে বিছিয়ে আর একটা গায়ে চাপিয়ে গুটিশুটি হয়ে আমি শুয়ে পড়লাম।
না, এক মুহূর্তও কাটল না। যেন কোনও বিষাক্ত সাপ আমাকে ছোবল কষিয়ে দিয়েছে। সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে লাফ মেরে উঠে সামনের ল্যাম্পপোস্টের আলোর নীচে দাঁড়িয়ে দেখলাম, আমার গোটা শরীর লাল পিঁপড়ে ছেঁকে ধরেছে। এত জ্বালা করছিল যে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ওটা শীতকাল। বুঝতে পারলাম, দোকানদার যে দুটো বস্তা আমাকে শোওয়ার জন্য দিয়েছিলেন, তার  মধ্যে একটা বোধহয় চিনি বা গুড়ের বস্তা ছিল। তাতেই ছিল লাল পিঁপড়ে। ক'হাত দূরেই দেখি একটা টিউবওয়েল। আমি দৌড়ে গিয়ে তার নীচে বসে উল্টো দিক থেকে টেনে টেনে কোনও রকমে টিউবয়েলটা টিপতে লাগলাম। আর জামা খুলে সেটা দিয়ে ঘষে ঘষে পিঁপড়েগুলোকে মারতে লাগলাম। হাজার হাজার পিঁপড়ের কামড় যে মাঘ মাসের শীতকেও এক ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিতে পারে, তখন বুঝেছিলাম।
তবে হ্যাঁ, আমি সে দিনও ঘুমিয়েছিলাম। একটু দূরে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে থাকা একটা কুকুরের সঙ্গে।
জহর, মানে কবি সেন মজুমদার তখন সেলিমপুরে থাকে। রাত দশটা মানে তখন অনেক রাত। আমি ওর বাড়ি গিয়ে বললাম, জহর, আজকের রাতটা তোর এখানে আমাকে থাকতে দিবি? জহর বাইরে বেরিয়ে এসে বলল, দ্যাখ, এটা তো আমার বাড়ি না। জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি। আমিই কোনও রকমে মন জুগিয়ে একটু থাকার জায়গা পেয়েছি। তোকে থাকতে দিই কী করে বল তো! তা হলে আমাকেও বের করে দেবে।
আমি বললাম, তুই তো এখানে থাকিস। আশপাশের লোকদের নিশ্চয়ই চিনিস। সে রকম কোনও পরিচিতর বাড়িতে একটা ব্যবস্থা করে দে না! শুধু আজকের রাতটা।
জহর ওর বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা এগিয়ে এসে দূর থেকেই আমাকে একটা দোতলা বাড়ি দেখিয়ে বলল, যা, ওই বাড়িতে গিয়ে বল জহর আমাকে পাঠিয়েছে। আজকের রাতটা যদি আমাকে আপনাদের বাড়িতে থাকতে দেন, তা হলে খুব ভাল হয়। ওরা খুব ভাল। আমার মনে হয় তোর একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।। যা, তাড়াতাড়ি যা। বলেই, ও কেটে গেল।
পর দিন ভোরবেলায় দাঁত ব্রাশ করতে করতে  যখন জহরের বাড়িতে গেলাম, আমাকে দেখে ও যেন ভূত দেখল। বলল, তুই এত সকালে? কোথায় ছিলি? আমি বললাম, কেন? তুই যে বাড়িটা দেখিয়ে দিয়েছিলি, সেই বাড়িতে।
ও অবাক হয়ে বলল, সে কী রে! আমি তো ওই বাড়ির কাউকে চিনি না। ওরাও আমাকে চেনে না। আমি তো তোর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এমনিই ওই বাড়িটা দেখিয়ে দিয়েছিলাম। ওরা তোকে থাকতে দিল! আমি বললাম, শুধু থাকতে দেয়নি। রাতে খেতেও দিয়েছিল। বাইরের দিকের খাটে পাটভাঙা চাদর বিছিয়ে দিয়েছিল। বালিশ দিয়েছিল। ওপরে পাখা ছিল না বলে, মাথার কাছে একটা টেবিল ফ্যান লাগিয়ে দিয়েছিল। রাতে পরে শোয়ার জন্য এই লুঙ্গিটাও দিয়েছিল। এমনকী একটু আগে ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এই নতুন ব্রাশ আর পেস্টও দিল।
আমি যত বলি, জহর তত চমকে চমকে ওঠে। তার পর বলল, তার মানে আমার নামে এখানে আরও একজন কেউ আছে। যে ওদের খুব কাছের। ওরা বোধহয় ভেবেছে সেই জহরই তোকে পাঠিয়েছে। তা, তোর ঘুম হয়েছিল তো? আমি বললাম, শুধু ঘুম নয়, চমৎকার ঘুম হয়েছে।
একবার সাকিল, মানে সাকিল আহমেদ। ডায়মন্ড হারবারের। কবি, সম্পাদক এবং দক্ষ সংগঠক। ও আর আমি সে বার ফলতায় গিয়েছিলাম। যখন ফেরার কথা মনে পড়ল, তখন আর কোনও যানবাহন নেই। তা হলে থাকব কোথায়? সে দিন রাতে যেখামে ছিলাম, সেটা হেলে পড়া মাটির নোংরা একটা গোয়ালখানা। গরু আর আমরা সে দিন একসঙ্গে কটিয়েছিলাম। ঝাঁকঝাঁক বড় বড় মশা আর ভনভন করতে থাকা ডেঁয়ো মাছির দল অত্যন্ত উত্যক্ত করলেও আমি কিন্তু তার মধ্যেই বেশ ঘুমিয়েছুলাম।
আসলে ছোটবেলা থেকেই আমি যেখানে শুই সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ি। শান্তনুদা, মানে শান্তনু দাস। ষাট দশকের জনপ্রিয় কবি। যিনি প্রথম ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে কবিতার সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। 'স্বনির্বাচিত'র যে আইডিয়া, সেটা তিনিই প্রথম এনেছিলেন। উনি বলতেন, উত্তমকুমার, সৌমিত্র, সুচিত্রা সেনের যদি ছবি ছাপা হয়, তা হলে কবিদের ছবি ছাপা হবে না কেন? উনিই প্রথম  চালু করেছিলেন কবিতার সঙ্গে কবিদের ছবি ছাপা। তখন ছবি ছাপা এত সহজ ছিল না। এক-একজন কবির ছবি ছাপতে গেলে জিঙ্কের বল্ক করাতে হত। যেটা ছিল অত্যন্ত ব্যায় সাপেক্ষ।
মনে আছে, একবার উত্তমকুমারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তিনি। শেষ প্রশ্ন ছিল, আপনার প্রিয় তিন জন বাঙালি কবির নাম বলুন।
মহানায়ক বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিষ্ণু দে আর জীবনানন্দ দাশের নাম। ওই সময় অত্যন্ত জনপ্রিয় পত্রিকা ছিল, 'ঘরোয়া'। সেই পত্রিকায় যখন লেখাটা বেরোল, দেখলাম, উত্তমকুমারের বলা তিন জন কবিরই নাম আছে, তবে জীবনানন্দ দাশের জায়গায়--- শান্তনু দাস।
শান্তনুদার বউ সীমন্তিনী বউদি সাউথ পয়েন্ট স্কুলে পড়াতেন। নাটকও করতেন। শান্তনুদার সঙ্গে কলকাতার প্রথম ঘুর্নিয়মান মঞ্চ 'সারকারিনা'য় দেখেছিলাম তাঁর অভিনীত--- বারবধূ। তিনি বাপের বাড়িতে থাকতেন। তাই বেশির ভাগ দিন আমি শান্তনুদার বাড়িতে রাত্রে থাকতাম। ওখানে রাত্রে থাকার আর একটা কারণ ছিল, ওঁর বাবা। ওঁর বাবা ছিলেন একজন বিখ্যাত কবি। কাস্তেকবি দিনেশ দাস। পরে কলকাতার একটি অতি ব্যস্ত রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামে।
বাড়িতে ঘুঘনিই হোক কিংবা পায়েস অথবা মাংস, উনি আমার জন্য বাটি করে ঠিক সরিয়ে রাখতেন। সেগুলোর লোভেই বোধহয় আমি ও বাড়িতে শুতে যেতাম।  মানে যে কোনও জায়গাতেই আমি অনায়াসে ঘুমিয়ে পড়তে পারি। কোনও অসুবিধে হয় না। অথচ গতকাল কী যে হয়েছে, সারা রাত শুধু ছটফট করেছি। বারবার মনে হয়েছে, আমি তো এখানে নিরাপদে আছি। কিন্তু ওই নেতা যদি দলবল নিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকে হামলা করে!  সামান্য খুটখাট আওয়াজ হলেও মনে হচ্ছিল, ওরা এসে দরজা ধাক্কাচ্ছে না তো!
তার পরেই মনে হল, আরে, কাল তো অনেকগুলো খবরের কাগজ আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিল, সেগুলো কি বেরিয়েছে!
সকাল হতেই ওই বাড়ির বড় ছেলে বড়লাটদাকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে খবরের কাগজ কোথায় পাওয়া যায়? উনি বললেন, ওই তো, রাধাগোবিন্দের মন্দিরটা আছে না? অতটাও যেতে হবে না। তার আগেই দেখবে গান্ধীদার বইখাতার দোকান। ওখানেই খবরের কাগজ পাওয়া যায়।
আমি সেখানে গিয়ে আনন্দবাজার চাইলাম। একের পর এক পাতা উল্টে ঝড়ের বেগে ওল্টালাম। দেখলাম আমাকে নিয়ে কিচ্ছু বেরোয়নি।  কিন্তু টেলিগ্রাফ ওল্টাতেই দেখি, বড় বড় হরফে লেখা--- সানন্দা থ্রেটেড ফর প্রিন্টিং স্টোরি / কং কাউন্সিলর / বিটস্ অব অথর।
আমি বললাম, এটা দিন। উনি বললেন, আনন্দবাজারটা নেবেন না? যে কাগজে আমাকে নিয়ে কোনও খবর বেরোয়নি, সেটা নিয়ে আমি কী করব! তাই বলতে যাচ্ছিলাম, 'না', ঠিক তখনই আনন্দবাজারে চোখ পড়তেই দেখি, একেবারে প্রথম পাতার টপে লেখা--- মিল গল্পের / চরিত্রের সঙ্গে, / লেখককে প্রহার / কং পুরপিতার।
তার পর একে একে উল্টে দেখি, প্রত্যেকটা কাগজেই আমাকে নিয়ে বড় বড় করে খবর বেরিয়েছে। কোনও কাগজের প্রথম পাতায়, তো কোনও কাগজের চতুর্থ পাতায়। তবে যে পাতাতেই ছাপুক না কেন, প্রত্যেকটা পত্রিকাই কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে খবরটা ছেপেছে।
যখন কাগজগুলো কিনে নিয়ে ফিরছি, হঠাৎ আমার মনে হল, আচ্ছা, এর জন্য আনন্দবাজারে আমার লেখা ছাপা বন্ধ হয়ে যাবে না তো! তা হলে আমার চলবে কী করে! কয়েক বছর আগেই যে আমি মাকে বলে দিয়েছি, এ বার থেকে আমার খরচ আমিই চালাব। তা হলে!

পাঁচ

কিছুতেই সময় কাটছে না। আটটা বাজল। ন'টা বাজল। দশটা বাজল। প্রতিটি সেকেন্ডকে মনে হচ্ছে সেকেন্ড তো নয়, যেন এক-একটা যুগ। সানন্দার সবার সঙ্গেই আমার এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। রোজই দেখা হয়। রোজ দেখা হয় বলেই হয়তো কারও বাড়ির ফোন নম্বর রাখার কোনও তাগিদ অনুভব করিনি এত দিন।
সেই প্রথম মনে হল, যদি একজনেরও নম্বর থাকত আমার কাছে! এতক্ষণ সময় কাটাই কী করে! বারোটার আগে তো কেউ ডিপার্টমেন্টে আসবে না। অতক্ষণ অপেক্ষা করতে গেলে তো আমারই বারোটা বেজে যাবে!
কাছের কোন দোকানে ফোন আছে জেনে নিয়ে পৌনে বারোটার আগেই পৌঁছে গেলাম সেখানে। এক টাকা দিয়ে তিন মিনিট কথা বলা যায়। কিন্তু ফোন না লাগলে কোনও পয়সাই দিতে হয় না। না, তাই আনন্দবাজারে নয়, কারণ ওই নম্বরে ফোন করলেই কেউ না কেউ ধরবেই এবং সানন্দায় দিতে বললে, সানন্দায় দিয়ে দেবে। কিন্তু তখনও যদি সানন্দায় কেউ এসে না থাকে, কারও সঙ্গে কোনও কথাই বলতে পারব না, কিন্তু টেলিফোন অপারেটর ধরেছে দেখে মাঝখান থেকে আমার একটা টাকা গচ্চা যাবে। সে জন্য আনন্দবাজারে নয়, ঘন ঘন ফোন করতে লাগলাম সরাসরি সানন্দার দফতরে।
আট-দশবার চেষ্টা করার পর ফোন ধরলেন সাবর্ণীদি, মানে সাবর্ণী দাস। ওড়িয়া হলেও বাংলা ভাষাটাকে একেবারে নিজের মাতৃভাষার মতোই করায়ত্ব করেছেন। রিনাদি, মানে অপর্ণা সেনের খুব প্রিয় পাত্রী। সানন্দায় চাকরি করা ছাড়াও ছায়াছবিতে নানা রকম কাজ করেন। ওর বর জন স্টেটসম্যান পত্রিকার একজন স্বনামধন্য সাংবাদিক। আমার গলা শুনেই সাবর্ণীদি বললেন, দেখেছিস, আজকের সব কাগজেই কিন্তু তোর খবরটা বেরিয়েছে।
আমি বললাম, হ্যাঁ, দেখেছি। কিন্তু এই সব ঝামেলার জন্য আমার আবার আনন্দবাজারে লেখা বন্ধ হয়ে যাবে না তো? একটু খেয়াল রেখো কিন্তু...
তখন আমি প্রায় সব পত্রপত্রিকাতেই দু'হাতে লিখি। শুধু সানন্দাতে লিখেই মাসে অন্তত হাজার তিনেক টাকা রোজগার করি। ফলে ওটা বন্ধ হয়ে গেলে আমার অসুবিধে হবে। এটা বোঝাতেই সাবর্ণীদি বললেন, না না, আমার তা মনে হয় না। তা, তুই কখন আসছিস? আমি বললাম, যাব?  সাবর্ণীদি বললেন, আসবি না কেন? দাঁড়া দাঁড়া দাঁড়া, সুদেষ্ণা এসেছে। কথা বল।
সুদেষ্ণাদি ফোন ধরেই বললেন, কালকে তোর কোনও অসুবিধে হয়নি তো? শোন, আজ কিন্তু আলিপুর থানায় ডায়েরি করে আসবি।
আগের দিনের অভিজ্ঞতা আমার মোটেও ভাল ছিল না। তাই আমতা আমতা করে বললাম, ডায়েরি? উনি বললেন, হ্যাঁ, কাল তো ওরা ডায়েরি নেয়নি?
আমি বললাম, হ্যাঁ, নেয়নি। কিন্তু আজ কি নেবে? সুদেষ্ণাদি বললেন, আরে, সব জায়গায় বলা আছে। আমাকে ওরা থ্রেড করেছে দেখে তো আমিও কাল বউবাজার থানায় গিয়ে লিখিত ডায়েরি করে এসেছি। ডায়েরির কপি দিয়ে এসেছি লালবাজারেও। কাল তো তোর ঘটনাটা নিয়ে শুধু রাইটার্স বিল্ডিংয়েই নয়, দিল্লিতেও তোলপাড় হয়েছে। তুই গেলেই ওরা বাপ বাপ করে ডায়েরি নেবে। না নিলে ওরা ওয়ান ফরটি সিক্স ক্লজ থ্রি কেস খাবে। তুই একবার গিয়েই দ্যাখ না...
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, একা যাব?
সুদেষ্ণাদি বললেন, ভয় লাগছে? তা হলে এখানে চলে আয়। তোর সঙ্গে কাউকে দিয়ে দেব।
সুদেষ্ণাদির কথায় যেন কিছুটা ভরসা পেলাম। ওখান থেকে একটা বাস ধরে সোজা ধর্মতলা। তার পর আনন্দবাজারে। তিন তলায় উঠতেই, এ ও সে, যার সঙ্গেই দেখা হচ্ছে প্রত্যেকেরই একই প্রশ্ন, কেমন আছিস?
কিন্তু উত্তর দেব কী? করিডরের ও দিক থেকে আসছিলেন শঙ্করদা, মানে শঙ্করলাল ভট্টাচার্য। যিনি আমাকে দিয়ে মাঝে মাঝেই 'বাবুবিবি সংবাদ' লেখান। একবার ম্যাক্সমুলার ভবনে শো করতে এসেছিলেন পৃথিবীখ্যাত মুখাভিনেতা লোনা রে। তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে পাঠিয়েছিলেন আমাকে। সেই সাক্ষাৎকার আমি যখন শঙ্করদাকে দিলাম, ততক্ষণে সবাই জেনে গেছেন, উনি ফরাসি ছাড়া আর কোনও ভাষাই জানেন না। এবং তাঁর সঙ্গে কোনও দোভাষিও ছিল না। আমার সাক্ষাৎকারটা পড়ে শঙ্করদা বললেন, খুব ভাল লেখা হয়েছে রে। তুই ফরাসিও জানিস?
আমি মাথা নেড়ে না বলতেই উনি হতভম্ব, তা হলে তুই কথা বললি কী করে?
আমি বললাম, কেন? আমি আমার মতো বাংলায় বলেছি। উনি ওঁর মতো ফরাসিতে বলেছেন।
শঙ্করদা আরও অবাক, তোরা একে অন্যের কথা বুঝতে পেরেছিস? আমি বললাম, দু'জনেই দু'জনেরটা বুঝেছি। কারণ, আমরা কথা যত বলছি, তার থেকে বেশি বলেছি আকার-ইঙ্গিতে। উনি মুখাভিনেতা আর আমি অনায়াসে বোবা ভাযায় কথা বলতে পারি, তাই...
আমার কথা শুনে শঙ্করদা হো হো করে হেসে উঠেছিলেন।
সেই শঙ্করদা তিন তলার করিডর দিয়ে আসতে আসতে বললেন, এই, আড্ডা মারবি পরে। আগে সুদেষ্ণার সঙ্গে গিয়ে দেখা কর।
সানন্দার ঘরে ঢুকতেই, সুদেষ্ণাদি বললেন, দাঁড়া, তোকে একজনকে দিয়ে দিচ্ছি। বলেই, গৌতমকে ডাকল। গৌতম মানে গৌতম চক্রবর্তী। আমাদের মধ্যে সব চেয়ে বেশি মোটা মোটা বই পড়ত ও। আমি আর ও সানন্দায় লেখার পাশাপাশি ছদ্মনামে কত যে পর্ণোগ্রাফি লিখেছিলাম তার হিসেব নেই। হলুদ মলাটে মোড়া পিন আপ করা সেই সব বই এক-এক দিনে হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়ে যেত। লেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নগদ টাকা। সেই বই বেনামে প্রকাশ করতেন বিখ্যাত একটি স্কুলের হেড মাস্টারমশাই। তাঁর সঙ্গে আমাদের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল আমার বহু দিনের পুরনো বন্ধু, অনেকগুলো সংকলনের সম্পাদক এবং বেশ কিছু ক্যুইজের বই লিখে যে তখনই যথেষ্ট নামডাক করে ফেলেছে, বিশিষ্ট ছড়াকার বারুইপুরের হাননান আহসান।
এখন, এই বয়সে এসে আমার মনে হয়, আলুওয়ালা-পটলওয়ালাদের জন্য তখন ওই সব পুস্তিকা লিখে হাত পাকিয়েছিলাম বলেই হয়তো আমাদের গদ্যটা এত ঝরঝরে হয়েছে।
সেই গৌতম আর আমি অফিসের একটা গাড়ি নিয়ে হাজির হলাম আলিপুর থানায়। একেবারে সোজা ওসির ঘরে। আমাদের বসতে বলেই আমার দিকে তাকিয়ে ওসি বললেন, আপনি তো আমাকেও ছাড়েননি!
আমি অবাক। মানে? আমার ভ্রু কোঁচকানো দেখে  ওসি বললেন, এই দেখুন। বলেই, টেবিলের ওপর থেকে আদ্যিকালের কালো ঢাউস ফোনটা সরিয়ে দেখালেন, তার নীচে লোকনাথ বাবার ছবি।
সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল, ওই গল্পের একটা জায়গায় আমি লিখেছিলাম--- স্থানীয় থানার ওসি লোকনাথ বাবার ভীষণ ভক্ত। দেওয়ালে টাঙালে কিংবা টেবিলে রাখলে লোকে কে কী ভাববে, তাই টেবিলের কাচের তলায় বাবা লোকনাথের ছবি রেখে উনি ফোন দিয়ে ঢেকে রাখেন। এখানে ঢুকেই এবং রাতে বেরোবার সময় তো বটেই, ঘরে তেমন কেউ না থাকলে মাঝে মাঝেই ফোনটা সরিয়ে উনি লোকনাথ বাবকে  প্রণাম করেন।
হ্যাঁ, এটা লিখেছিলাম ঠিকই, কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও ওঁকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারলাম না যে, এর আগে আমি কখনও আলিপুর থানায় আসিনি। ওসির ঘরে তো নয়ই। পুরোটাই আমার কল্পনাপ্রসূত। শুধু কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে, এই যা! আমি কী করব!
বুঝতে পারলাম, গত কাল আমি যখন কোনও স্টলে সানন্দা না পেয়ে বাড়ি ফিরে আসছিলাম, তখন অহীন্দ্র মঞ্চের সামনে আমাদের পাড়ারই একজন বলেছিল, এ বারকার সানন্দায় তুই যা লিখেছিস না! এক্কেবারে ঝাক্কাস। দেবুদার ঘরের যা ডেসক্রিপশন দিয়েছিস, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি, এমনকী তাঁর সোফাটাকেও বাদ দিসনি।
ওর কথা শুনে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল, সোফা!
ও বলেছিল, কেন, তুই লিখিসনি? ঢুকতেই বাঁ হাতে যে সোফাটা আছে, সেই সোফার সিটটা লম্বালম্বি ভাবে মাঝ বরাবর এমন ভাবে চেঁরা, দেখলে মনে হবে কেউ বুঝি ব্লেড চালিয়ে দিয়েছে।
থানায় বসেই বুঝতে পারলাম, তার মানে সে দিন ও আমার সঙ্গে মজা করেনি। আজকের মতো ওটাও কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে। তা হলে কি ওই নেতা সত্যি সত্যিই রাত্রিবেলায় দলবল নিয়ে রেশন দোকানে এসে সাটার নামিয়ে 'নীল ছবি' দেখেন! মদ খান! জুয়া খেলেন! পর দিন কোথায় কোথায় তাঁর ছেলেদের তোলা তুলতে পাঠাবেন, তার ছক কষেন! যদি সত্যিই তাই হয়, তা হলে  তো কেলেঙ্কারি কাণ্ড। আমি গেছি।
কিন্তু না, সে রকম কিছু হল না। থানা শুধু আমার ডায়েরিই নিল না, চা-বিস্কুটও খাওয়াল। ওই ওসিই বললেন, গৌতমমোহন চক্রবর্তীর উদ্যোগে নাকি কলকাতার সমস্ত থানাকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। আমি কোনও সমস্যায় পড়লে একটা নম্বরে ফোন করলেই নাকি নিকটবর্তী পুলিশ স্টেশন আমাকে সাহায্য করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছ থেকে নির্দেশ এসেছে, আমার বাড়িতে পুলিশি প্রহরার ব্যবস্থ করার জন্য।
তাঁর কথা শুনে আমি বললাম, তার মানে আজ রাতে আমি বাড়ি থাকতে পারব?
ওসি বললেন, কেন? কাল আপনি বাড়ি ছিলেন না?
আমি কাঁচুমাচু মুখ করে বললাম, না।
উনি বললেন, ধ্যাৎ, আপনার ভয় কীসের? আপনি বুক ফুলিয়ে যাবেন। আপনাকে দেখে এখন ওরা পালাবে। আপনার পাশে শুধু প্রশাসনই নয়, বিরোধী দলও আছে। এ রকম ঘটনা সচরাচর ঘটে না। আপনার কোনও ভয় নেই। আর যদি কোনও সমস্যা হয়, দাঁড়ান। বলেই, খসখস করে একটা ফোন নম্বর লিখে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এই নম্বরে একটা ফোন করবেন। শুধু বলে দেবেন আপনি ঠিক কোথায় আছেন, ব্যাস। সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে রেসকিউ করার জন্য নিয়ারেস্ট থানা থেকে ফোর্স পৌঁছে যাবে। তবে আমার মনে হয় না, ওরা আর সে সাহস পাবে।

ছয়

পুলিশ যতই নির্ভয় দিক, আমার সহকর্মীরা যতই সাহস জোগাক, বন্ধুবান্ধবেরা যতই বলুক, আমরা তোর পাশে আছি। তবু মনের ভিতরে কোথায় যেন একটা ভয় গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। পাড়ার রকে গিয়ে বসতে পারছি না। চায়ের দোকানে গিয়ে চা খেতে পারছি না। অ্যাকোরিয়ামের মাছগুলোর জন্য লাল কেঁচো কিনতে যেতে পারছি না। বারবারই মনে হচ্ছে, ওরা আচমকা এসে আবার আমার ওপরে হামলা চালাবে না তো! আমি কি আমার বাড়ির গেটে পুলিশি প্রহরা বসানোর তোড়জোড় সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়ে ভুল করলাম!
ভয়ে ভয়ে সারা দিন আর বাড়ির বাইরে বেরোলাম না। তবে কানাঘুষোয় শুনলাম, ওরা নাকি এলাকায় আর কেউ নেই। এমনকী সেই কাউন্সিলরও। গা ঢাকা দিয়েছেন তাঁর ছেলেও।
সন্ধের মুখে বাড়িতে এলেন আমার আন্টি। আন্টি মানে আমার গৃহশিক্ষিকা। ক্লাস সিক্স থেকে পড়াতেন। যখন আমি সেভেনে উঠি তখন উনি একটি কলেজে অধ্যাপিকা হিসেবে জয়েন করেন।  তার আগেই পর পর টানা তিন বার সুন্দরী প্রতিযোগিতায় কলকাতার সেরা সুন্দরী হন।
মায়ের মুখে শুনেছিলাম, উনি নাকি আমাকে ছোটবেলায় খুব ভাল ভাসতেন। কোলে করে বিকেলবেলায় ঘোরাতে নিয়ে যেতেন। লজেন্স কিনে দিতেন। আইসক্রিম কিনে দিতেন। কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না, যিনি এক সময় আমাকে এত ভালবাসতেন, সামান্য পড়া না পারলে তিনি কেন আমাকে এত বেধড়ক মারেন!
একদিন স্কেল দিয়ে এত মেরেছিলেন যে, আমার পুরো পায়ে চাকা চাকা কালশিটে দাগ পড়ে গিয়েছিল। দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কের উল্টো দিকে একটি রেস্টুরেন্ট আছে--- সুতৃপ্তি। সেখানে তখন একেবারে নিয়ম করে প্রতি রবিবার  সকালে আড্ডা দিতেন অনেক কবি, লেখক, অধ্যাপকেরা। আমিও যেতাম। একদিন পবিত্রদা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? ও রকম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছ কেন?
আমি বললাম, আন্টি মেরেছেন।
উনি বললেন, মারবেই তো। মারের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় কি জানো তো?
আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললাম, না।
উনি বললেন, ভালবাসা। যে মারে তাকে যদি তুমি ভালবাসো, সে আর তোমাকে কোনও দিন মারবে না, বুঝেছ?
তার পর দিনই ছিল উল্টোরথ। আন্টি এসেছেন পড়াতে। মা তখন রান্নাঘরে পাঁপড় ভাঁজছেন। আমাকে ডেকে একটা থালায় কয়েকটা পাঁপড় ভাঁজা দিয়ে মা বললেন, যা, আন্টিকে গিয়ে দে।
আন্টির কাছে যাওয়া মাত্রই আমার মনে পড়ে গেল পবিত্রদার কথা। হঠাৎ কী হল কে জানে! আন্টিকে বললাম, আন্টি একটু চোখ বন্ধ করুন না... আপনাকে একটা জিনিস দেব।
আন্টি বললেন, একদম দুষ্টুমি করবে না, তাড়াতাড়ি বইখাতা নিয়ো বসো। যত দেরি করে পড়তে বসবে তত দেরি করে ছাড়ব। তা হলে বন্ধুদের সঙ্গে রথ নিয়ে বেরোতে তোমার তত দেরি হবে।
আমি বললাম, একটু চোখ বন্ধ করুন না প্লিজ...  একটা সারপ্রাইজ দেব।
আন্টি বললেন, জানি কি সারপ্রাইজ দেবে। ওই পাঁপড় তো? ওটা তো আমি এখান থেকেই দেখতেই পারছি।
আমি বললাম, না আন্টি, পাঁপড় না।
উনি বললেন, তা হলে?
আমি ফের বললাম, আগে চোখটা বন্ধ করুন, তার পর। আমি খুলতে না বললে কিন্তু চোখ খুলবেন না।
শেষমেশ আন্টি চোখ বন্ধ করতেই তাঁর সামনে পাঁপড়ের থালাটা কোনও রকমে নামিয়ে ঝট করে আন্টির গালে, গালে না নাকে, নাকি কপালে ঠিক বুঝতে পারলাম না, একটা চুমু খেয়েই দে ছুট।
পবিত্রদা বলেছেন, যে মারে তাকে ভালবাসলে সে আর মারবে না। আমি তাই মার খাওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য আন্টিকে চুমু খেয়েছি, আমার কি দোষ!
তবু না, চুমু খাওয়ার পর সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, আন্টি না যাওয়া অবধি গলির মুখে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলাম, আন্টি বেরোয় কি না! উল্টোরথ তখন আমার মাথায় উঠেছে। বন্ধুরা রথ নিয়ে বেরিয়েছে। আমাকে কত করে ডেকেছে, তবু আমি যাইনি। তার পর দিনও আন্টি আসার আগেই আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। তার পর দিনও তাই। মা খুব বকলেন, কী রে, আন্টি এসে রোজ রোজ ফিরে যাচ্ছে! তুই কোথায় ছিলি?
আমি জানতাম, সামনে গেলেই আন্টি আমাকে মারবেন। কিন্তু এ বার তো আরেক উপদ্রপ শুরু হল। আন্টির কাছে পড়তে না বসলে যে মা আমাকে এখন উত্তম-মধ্যম দেওয়া শুরু করবেন! তাই ফের দ্বারস্থ হলাম, পবিত্রদার। যিনি আমাকে এই বুদ্ধি দিয়ে বিপাকে ফেলেছেন, তাঁকেই ফের বুদ্ধি দিয়ে আমাকে ওই মার খাওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর কৌশল বাতলে দিতে হবে।
পবিত্রদা বললেন, আমার সঙ্গে ওকে একবার দেখা করতে বোলো। কালই তো রবিবার। সকালের দিকে আমি সুতৃপ্তিতে থাকব।
না, সে কথা আন্টির সামনে গিয়ে বলার সাহস হল না। আন্টির ছোট ভাইকে গিয়ে বললাম, আন্টিকে একটু বলে দেবেন, কাল এগারোটা-বারোটা নাগাদ সুতৃপ্তিতে গিয়ে যেন পবিত্রদার  সঙ্গে দেখা করেন। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এই আন্টিও কিন্তু পবিত্রদারই ছাত্রী।
রবিবার সুতৃপ্তির উল্টো ফুটপাথে বাসস্টপের একটা মোটা থামের আড়ালে লুকিয়ে রইলাম, আন্টি আসে কি না দেখার জন্য। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হল না।
আন্টি সুতৃপ্তিতে ঢুকতেই পবিত্রদাও ওঁর সঙ্গে বেরিয়ে এলেন। দূর থেকেই দেখলাম, ওঁরা কী সব কথাবার্তা বলছেন। মাঝে মাঝেই বাস এসে মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। বড় বিরক্ত লাগছিল। কিন্তু কী করব! এটা যে বাসস্টপ!
তার পর আন্টি চলে যেতেই আমি এক দৌড়ে পবিত্রদার কাছে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কথা হয়েছে? কী বলল? আর মারবে না তো?
পবিত্রদা শুধু বললেন, যা বলার আমি বলে দিয়েছি। আর ভয় নেই। আজ থেকে আবার ওর কাছে পড়তে বোসো।
সে দিন সন্ধেবেলায় আন্টি আসতেই আমি তো ভয়ে কাঁপছি। বুক ধড়ফড় করছে। পবিত্রদা যতই যা বলে থাকুক, কয়েক ঘা না দিয়ে কি আন্টি আমাকে ছাড়বেন! যখন তাঁর সামনে বই নিয়ে বসলাম, আন্টি বললেন, এই সব ভূত মাথা থেকে তাড়াও। আগে পড়াশোনা করো। বুঝেছ? এ সব করার প্রচুর সময় পাবে। যে হোমটাস্কগুলো দিয়ে গিয়েছিলাম, সেগুলো করেছ?
উল্টোরথের দিন থেকে তো আমি বই-ই ছুঁইনি। হোমটাস্ক করব কী! নাঃ, আজ আর আন্টির হাত থেকে নিস্তার নেই। আমার চোখ ছলছল করে উঠল এবং অবাক কাণ্ড, আমাকে চমকে দিয়ে আন্টি বললেন, এতে কাঁদার কী আছে? আমি তোমাকে মেরেছি, না বকেছি? চোখ মোছো। বলেই, তাঁর কাঁধে ঝালানো শান্তিনিকেতনি ব্যাগ থেকে দুটো লজেন্স বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, এ বার থেকে একটু মন দিয়ে পড়াশোনা কোরো, কেমন?
আন্টির সেই কথায় মধ্যে এমন কী মন্ত্র ছিল আমি জানি না। তার পর থেকে সত্যি সত্যিই আমি রীতিমত পড়ুয়া হয়ে উঠলাম। যা কোনও দিন হব ভাবিনি, তাই হলাম।
পরে এই আন্টিকেই আমি বিয়ে করি। বাড়িতে বলতেই মা বলেছিলেন, তোর থেকে চোদ্দো বছরের বড়! একটু ছোট মেয়ে পেলি না?
আমি বলেছিলাম, বড়ই তো ভাল। ছোট হলে শুধু বউ পাব। আর বড় হলে একজনের মধ্যেই মা, মাসি, পিসি, কাকি, মামি--- সবাইকেই পাব। শুধু আমিই পাব না। তুমিও একজন কথা বলার মতো ভাল বন্ধু পাবে, তাই না?
বাবা হেসে বলেছিলেন, এতে তো ভালই হল। মেয়েটার কী হল জানি না। তবে তোর পক্ষে ভালই হল। যে মেয়েটা তোকে ছোটবেলা থেকে ভালবসত, কোলে কোরে নিয়ে ঘুরে বেড়াত, স্বামী হিসেবে পেলে সে আর যে কোনও মেয়ের চেয়েই তোকে একটু বেশিই ভালবাসবে।
বিয়ে তো হল, তবে বিয়ের পরেও বেশ কয়েক বছর আমি খুব একটা সহজ হতে পারিনি। আমি তাঁকে আন্টি বলেই ডাকতাম। ভয়ে ভয়ে থাকতাম, কখন কী কারণে মারে। তবে একটু সময় লাগলেও, উনিই আমাকে ওই আন্টি ডাক ছাড়িয়েছেন। এবং 'আপনি' থেকে 'তুমি' বলতে সাহস জুগিয়েছেন। এখানে আর একটা কথা চুপিচুপি বলে রাখি, উল্টোরথের দিন সেই চুমু খাওয়ার পর থেকে আজ অবধি উনি কিন্তু আমাকে একটা টোকাও মারেননি। এমনকী, কখনও কোনও বকাঝকাও করেননি।

তো, সেই আন্টি আমাদের বাড়িতে এসে বললেন, তুমি আজকে বেরোওনি?
আমি বললাম, না আন্টি।
উনি বললেন, কেন?
আমি বললাম, না, রাস্তায় একা পেলে ওরা যদি...
উনি বললেন, তুমি যত ভয় পাবে ওরা কিন্তু তোমাকে তত পেয়ে বসবে। আজ কোথাও যাবার নেই?
আমি বললাম, ভেবেছিলাম, মাছের জন্য কেঁচো আনতে যাব।
উনি বললেন, তো যাও।
আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, যাব?
উনি বললেন, চলো, আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।
আমি চমকে উঠেছিলাম ওঁর সাহস দেখে। তাঁর পিছু পিছু হেঁটে গিয়েছিলাম চেতলা ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে। ফেরার সময় আন্টি দুম করে বললেন, আর আমার পিছু পিছু নয়, এ বার
তুমি আগে আগে যাও। ভয় নেই, আমি তোমার পিছনে আছি।
সে দিন উনি আমার পেছনে পেছনে এলেও, সারাটা জীবন কিন্তু উনি আমার পাশে পাশেই থেকেছেন। সব সময়।

সাত

স্বর্ণ বারবার দরজা ধাক্কাচ্ছে--- দাদা ওঠেন। আপনারে কারা যেন ডাকতাছে...
চোখ মেলে দেখি তখনও ঠিক মতো আলো ফোটেনি। দেয়ালঘড়িতে তখন সবে সাড়ে পাঁচটা। আমি ধড়মড় করে উঠলাম।
আমাকে ডাকছে! কারা! তা হলে কি কাল সন্ধ্যাবেলায় আমি যখন আন্টির সঙ্গে লাল কেঁচো কিনতে রাসবিহারীর দিকে গিয়েছিলাম, ওদের কোনও লোক তখন কি আমাকে দেখেছিল! বাড়ির আশপাশে লুকিয়ে লুকিয়ে ফলো করেছিল, আমি রাত্রে অন্য কোথাও থাকতে যাই কি না! আমাকে বেরোতে না দেখে নিশ্চিত হয়েছিল, আমি বাড়িতেই আছি। তাই লোকজন ওঠার আগেই ওরা এসে হাজির হয়েছে! তা হলে আর রক্ষে নেই। সে দিন তো শুধু মেরেছিল। আজ একেবারে শেষ করে দেবে। বাড়ির কাউকে ডাকব! ঝামেলা যা হচ্ছে, সেটা আমার লেখার জন্য। আমি কেন বাড়ির লোককে এর মধ্যে জড়াব! মরলে না হয় আমিই মরব। তা হলে কি স্যামু, একলেন, স্যামসুন, ম্যায়লাকে ডাকব! এরা তো আমার খুব ভাল বন্ধু।
এদের কেউ নেপালি, তো কেউ খ্রিস্টান। কেউ  মুসলিম, তো কেউ ওড়িয়া।
খুব ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফিরে খেয়েদেয়েই আমরা দল বেঁধে হাঁটতে হাঁটতে টুক করে চলে যেতাম আমাদের বাড়ির খুব কাছেই ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। নীচতলাটা ছিল ছোটদের জন্য। সেখানে হাজার হাজার ঢালাও বই। যার যেটা পছন্দ সেই মতো তাক থেকে যে কোনও বই নিয়ে পড়তাম। উল্টোপাল্টে দেখতাম। কিছুটা পড়ে ভাল না লাগলে সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে নিতাম।
দারুণ কাটছিল। কিন্তু সমস্যা হল, আমাদের মধ্যে একজনের বয়স যখন হঠাৎ করে চোদ্দো বছর ক্রশ করল। কারণ, ছোটদের ওই রিডিংরুমে একমাত্র চোদ্দো বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেমেয়েরাই ঢুকতে পারত। তার চেয়ে বেশি বয়সিরা নয়।
বুঝতে পারলাম, দারোয়ানরা ওকে আর ঢুকতে দেবে না। আমাদের দলের বাকিদের কারও বয়স তখনও চোদ্দো না হলেও, আমরা ঠিক করলাম, ওকে ঢুকতে না দিলে আমরাও ঢুকব না। তা হলে দুপুরটা কাটাব কোথায়! ওপরের বড়দেরটায় ঢুকতে গেলে তো অন্তত আঠারো বছর বয়স হতে হবে। তা হলে চোদ্দো থেকে আঠারো এই চারটে বছর আমরা কী করব!
স্যামসুন বলল, কাল গোর্কি সদন যাবি? সকাল দশটা নাগাদ।
--- কোনও অসুবিধে নেই। কাল রোববার। স্কুল ছুটি। যাওয়াই যায়। কিন্তু কী আছে সেখানে? আমি জিজ্ঞেস করতেই ও বলল, চলই না, গিয়ে দেখবি।
গোর্কি সদনে ঢুকেই আমরা চমকে উঠলাম। দেখলাম, প্রত্যেকটা  সিটেই গাদাগুচ্ছের করে রংচঙে বই। স্যামসুনই বলল, যে যে-সিটে বসবি, সেই সিটের বইগুলো তার। এত সুন্দর ঝকঝকে বই পেয়ে আমরা সবাই খুশি। খানিক বাদেই শুরু হল অনুষ্ঠান। ম্যাজিক। হরবোলা। নাচ।
বেরোবার সময় গেটের মুখেই আমাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল খাবারের বড় একটা প্যাকেট। আমাদের সবার মুখেই তখন এক কথা, বাঃ, দারুণ তো! আগে বলিসনি কেন? আমরা রোজ আসব।
আমরা আসতে চাইলে হবে কী! ওখানে তো আর রোজ রোজ অনুষ্ঠান হয় না।
তাই আমরা ঠিক করলাম, যত দিন না আমাদের সবার বয়স আঠারো বছর হচ্ছে, মানে ন্যাশনাল লাইব্রেরির বড়দের জায়গাটায় ঢোকার অনুমতি পাচ্ছি, তত দিন আমরা তা হলে কলকাতার রাস্তা চিনতে বেরোব।
সেই মতো আমরা কোনও দিন চলে যেতাম কালীঘাট রেল স্টেশনের কাছে সাইডিংয়ে।  কোনও দিন লেকের লিলিপুলে। ইয়া বড় বড় মাছ দেখতাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মসজিদের সামনে চুপচাপ বসে থাকতাম। কোনও দিন হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম ভিক্টোরিয়া কিংবা গড়ের মাঠ অথবা মনুমেন্ট দেখতে।
একদিন আকাদেমি অব ফাইন আর্টসে ছবি দেখে় সোজা যাচ্ছি, ধর্মতলার আগেই, লিন্ডসে স্ট্রিটের উন্টো দিকে যে জলাশয়টা আছে, সেই মনোহরদাস তরাগে দেখি, কতগুলো ছেলেমেয়ে পাড়ে নেমে কী যেন খুঁজছে। ওদের দেখাদেখি আমরাও নেমে পড়লাম সেখানে।
পর দিন হরলিক্সের বোতল জোগাড় করে আমরা আবার ওখানে গেলাম। ওদের শিখিয়ে দেওয়া কৌশলই প্রয়োগ করলাম। অতি সন্তর্পণে পা টিপে টিপে নেমে পড়লাম বেশ কয়েক পা।  তার পর আরও সাবধানে, যাতে কেউ টের না পায়, এমনকী জলও যাতে বুঝতে না পারে আমরা নেমেছি, এত সতর্ক ভাবে নিশ্বাস বন্ধ করে আস্তে আস্তে জল ভেদ করে ডুবিয়ে দিলাম হাত। তার পর হাতড়ে হাতড়ে সামনে যে ডাবটা পেলাম, সঙ্গে সঙ্গে
হাতের তালু দিয়ে তার মুখটা চেপে ধরে উঠে এলাম পাড়ে। আরও সাবধানে। দেখে দেখে পা ফেলে। কারণ, এখানে ডাব খেয়ে শুধু লোকেরাই ডাব ফেলে না, ডাবওয়ালারাও যাবার সময় বস্তা উপুড় করে ফেলে দিয়ে যায় ডাবের খোলা।  একবার বেকায়দায় পা পড়লে শুধু যে নীচেই পড়ব, তা নয়, হাত, পা, এমনকী কোমরও ভাঙতে পারে।
তো, সেই ভাবে পাড়ে এসে ডাবের মুখটার উপরে  হরলিক্সের বোতলের খোলা মুখটা চেপে ধরে ঝট করে উল্টে দিলাম। ডাবের ভিতরে থাকা পুকুরের সব জল বগবগ করে বোতলে গিয়ে পড়ল। সেই জলের সঙ্গে পড়ল লাল, কালো, পাখনাওয়ালা, লম্বা লেজওয়ালা বেশ কয়েকটা ছোট্ট ছোট্ট মাছ। যে মাছ লোকেরা দোকান থেকে কিনে নিয়ে গিয়ে অ্যাকোরিয়ামে পোষে।
তবে আমাদের কেউ কেউ টকটকে লাল আর কুচকুচে কালো মাছ পেলেও, বেশির ভাগ বন্ধুর কপালেই কিন্তু জুটল শুধু ফাইটার মাছ। ওখানে নাকি ফাইটার মাছই বেশি। এই মাছ ধরাটা আমাদের নেশায় দাঁড়িয়ে গেল।
মাছ তো পুষব, কিন্তু কেঁচো? সেটারও সন্ধান পেয়ে গেলাম একদিন। জেল গ্রাউন্ডের পিছনে একটা বহু পুরনো নালা আছে। সবাই ওটাকে নালা বলে ঠিকই, কিন্তু কোথা থেকে যে এত ঝকঝকে পরিষ্কার জল ওখান দিয়ে বারোমাস টালিনালায় গিয়ে পড়ে, কে জানে! সেখানেই দু'ধারে থিকথিক করে লালকেঁচো। যে কেঁচো মাছেরা খায়। আমরা ওখান থেকে প্রতি সপ্তাহে গিয়ে কেঁচো তুলে নিয়ে আসতাম।
সে সময় আমরা অদ্ভুত অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখতাম। ভাবতাম, সে দিন আর বেশি দূরে নেই, যে দিন হঠাৎ করে শুনব, আমাদের দূর সম্পর্কের কোনও এক অবিবাহিত আত্মীয় বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করে দেশে ফিরে, মরার আগে তার বিপুল সম্পত্তি  আমাদের নামে লিখে দিয়ে গেছেন। কিংবা আমাদের মধ্যে থেকেই কেউ একজন এই ভাবেই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কুড়িয়ে পাব সেই পরশ পাথরটা। তবে হ্যাঁ, যে-ই পাই না কেন, এবং যাই পাই না কেন, তা কিন্তু আমরা সবাই মিলে সমান ভাবে ভাগ করে নেব।
ক'দিন ঘুরে, একদিন নিজেরাই ঠিক করলাম, এই ভাবে শুধু কলকাতার মধ্যে না ঘুরে আমরা তো মাঝে মাঝে আরও দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে পারি।
সে দিন কে যে কথাটা বলেছিল, এখন আর তার নাম মনে নেই। সে বলেছিল, দূরেই যদি যেতে হয়, তা হলে আমেরিকায় চল।
ওর কথা শুনে আমরা অবাক। আমেরিকা! ভাড়া কে দেবে! তোর বাবা?
সে বলেছিল, আমেরিকাটা কোথায় জানিস তো? যা, পৃথিবীর গ্লোবটা একবার দেখে আয়। দেখবি, ইন্ডিয়ার ঠিক উল্টো দিকে। আমরা যদি এখানে একটা গর্ত করা শুরু করি, লাগুক না যত দিন লাগবে। খুঁড়তে খুঁড়তে আমরা ঠিক একদিন আমেরিকায় পৌঁছে যাব। তখন দেখবি, কেউ আর প্লেনে করে নয়, সেই গর্ত দিয়েই, হয় দড়ি বেয়ে নয়তো হামাগুড়়ি দিয়ে বিনে পয়সায় শর্টকাটে আমেরিকায় যাচ্ছে।
স্যামসুন বলেছিল, না, তা হলে করব না।
আমি বলেছিলাম, কেন?
ও বলেছিল, ও, আমরা খেটেখুটে বুদ্ধি খাটিয়ে একটা রাস্তা বানাব আর অন্যরা ফোকটে সেটা দিয়ে আমেরিকায় চলে যাবে, তা হবে না। আমি কিছুতেই এটা হতে দেব না।
বিশ্বাস করুন, সে দিন স্যামসুন বলেছিল বলেই শেষ পর্ষন্ত আমরা মাটি খুঁড়ে আমেরিকা যাওয়ার সহজ রাস্তাটা আর বানাইনি। না হলে এত দিনে সবাই সেই সুড়ঙ্গ দিয়েই আমেরিকায় যাতায়াত করত। এই বিশ্বাসটা আমার অনেক বড় বয়স পর্যন্ত ছিল।
আরও কত কী যে ভাবতাম! কত দিন আমরা ভেবেছি, এ গলি ও গলি দিয়ে যেতে যেতে আমরা এমন এক-একটা রাস্তা খুঁজে পাব, যেটা দিয়ে কয়েক পা গেলেই চিনে পৌঁছে যাব কিংবা মালয়েশিয়ায়। ভাস্কো দ্য গামা যদি নতুন একটা দেশ আবিষ্কার করে থাকেন, আমরা সামান্য একটা অজাননা রাস্তা আবিষ্কার করতে পারব না!
সে যাই হোক, আমরা স্কুল করছিলাম। পড়াশোনা করছিলাম। আবার তার পাশাপাশি এগুলোও করছিলাম।
আমার সেই বন্ধুরা অন্য ভাষাভাষির হলেও এখানে থাকার দরুন যেমন ঝরঝরে বাংলা বলতে শিখে গিয়েছিল, ওদের সঙ্গে মিশে মিশে আমিও, অতটা না হলেও, কাজ চালাবার মতো রপ্ত করে ফেলেছিলাম নেপালি ভাষা। ওড়িয়া ভাষা। উর্দু ভাষা।

দেখতে দেখতে কখন যে চার বছর পার হয়ে গেল টেরই পেলাম না। যখন হুঁশ হল, তখন আমাদের অনেকেরই চোখ ফুটে গেছে। সিগারেটে টান মারতে শিখেছি। মেয়েদের দেখতে শিখেছি। এ-মার্কা সিনেমায় যাওয়া শুরু করেছি। ঝান্ডা-মুকুট খেলায় চোস্ত হয়ে উঠেছি। সবাই নতুন নতুন বন্ধু হয়েছে আরও। ফলে আমাদের সবার বয়স আঠারো পেরিয়ে গেলেও কেউ আর ন্যাশনাল লাইব্রেরির দিকে পা বাড়ালাম না। আমাদের বন্ধুত্বের সেই অটুট বন্ধনও কেমন যেন শিথিল হয়ে গেল।

যতই শিথিল হোক, আমরা যদি কেউ বিপদে পরি, একজন কি আর একজনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ব না! সবাই তো আশপাশেই থাকে! আমার যা গলার জোর, আমি যদি চিৎকার করি, ওরা যতই ঘুমিয়ে থাক, আমার গলা কি ওদের কানে গিয়ে পৌঁছবে না! যাই, গিয়ে দেখি, ওরা কত জন এসেছে। যদি দেখি, না; ওরা মারমুখী নয়, তা হলে তো ঠিকই আছে। কিন্তু যদি তেমন কোনও বেচাল দেখি, আর কিছু না পারি, অন্তত গলা ফাটিয়ে আমার সেই বন্ধুদের তো ডাকতে পারব! আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি বিপদে পড়েছি বুঝতে পারলে একজন দু'জন নয়, আমার সব ক'টা বন্ধুই ছুটে আসবে।
আগে তো যাই, তার পর না হয় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। যদি এমনি চড়-চাপড়, কিল-ঘুসি কিংবা রাস্তায় ফেলে বেধড়ক মারে, তা হলেও ঠিক আছে। কিন্তু আমি দরজা খুলে বেরোলেই যদি আমাকে ছুরি বা ভোজালি দিয়ে কোপাতে শুরু করে অথবা দুম করে একটা গুলি করে দেয়, তখন? সেটা তাও ভাল। যা হবার আমার ওপর দিয়ে হবে। কিন্তু দরজা খোলামাত্র ওরা যদি জোর করে বাড়িতে ঢুকে তাণ্ডব চালায়! বাড়ির লোককে মারধর করে, তখন কী হবে? আমি কি ওদের সঙ্গে পারব! নাকি দরজা খুলেই সটান ওদের পায়ে পড়ে যাব! বলব, যা করেছি ভুল করেছি। আর কখনও হবে না। আমাকে ক্ষমা করে দিন! বাড়ির লোককে কিছু করবেন না। যা করার আমাকে করুন। মারতে হলে আমাকে মারুন। তাও বাড়ির লোককে কিছু করবেন না।--- এই সব সাত-পাঁচ  ভাবতে ভাবতে আমি স্বর্ণকে বললাম, তুই কিন্তু বেরোস না। বলে, যাব কি যাব না, দোনোমোনো করতে করতে শেষ পর্যন্ত ভয়ে ভয়ে বাড়ির সদর দরজাটা খুলেই ফেললাম। আর খুলতেই, আমি একেবারে চমকে উঠলাম। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দেখলাম, পেছনে দশ-বারো জন ছেলে থাকলেও, আমার সামনে, আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর বাবলা আইচ।

আট

বহু দিন আগে এই বাবলাদাই আমাকে প্রথম আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বাবলাদা আমাদের নিউ আলিপুর কলেজে পড়তেন। কংগ্রেস বলতে অজ্ঞান। তাবড় তাবড় নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। দহরম মহরম।
বেশ কিছু দিন আগে গভীর রাতে ধর্মতলা থেকে গাড়ি করে বাড়ি ফিরছি। গোপাল নগরে ঢুকতেই দেখি, রাস্তা জুড়ে বিশাল প্যান্ডেল। যত্রতত্র চেয়ার। এ দিকে ও দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লোকজন। এখানে সেখানে জটলা। প্যান্ডেলের পাশ দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স বা দমকলের মতো ওই জাতীয় গাড়ির জন্য আপতকালীন নিয়ম অনুযায়ী যেটুকু রাস্তা ছাড়া আছে, তাতে আমাদের গাড়ি অনায়াসে যেতে পারে। এটা ভেবে আমার গাড়ির চালক আর ঘুরপথে যাননি। ঢুকিয়ে দিয়েছেন গোপাল নগরে। কিন্তু ক'হাত যেতেই  বিপত্তি। দূর থেকে বোঝা যায়নি। কাছে যেতেই টের পাওয়া গেল, প্যান্ডেলের পাশ থেকে ছাড়া জায়গাটাতেও সার সার চেয়ার পাতা। চালক যখন জানালা দিয়ে মাথা বের করে উঁকিঝুঁকি মেরে বোঝার চেষ্টা করছেন, যাওয়া যাবে কি না! নাকি গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা ধরবেন, ঠিক তখনই আরও অনেকের মতো পরিচিত একটা মুখ জানালা দিয়ে উঁকি মারতেই আমি একটু নিশ্চিন্ত হলাম। যাক বাবা, বাঁচা গেল। এখান থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা যদি কেউ করে দিতে পারেন, তবে তা ইনিই পারবেন। ইনি আমাদের কলেজের বাবলাদা।
তখন বিপুল ভোটে জিতে কলেজের ইউনিয়ন ছাত্র পরিষদের দখলে। যদিও সমানে সমানে টক্কর দিয়েছিল এস এফ আই এবং এস ইউ সি। ভোটের আগের কয়েক দিন তাদের একে অপরের ওপরে  এমন মারমুখী ধুন্ধুমার কাণ্ড দেখেছিলাম যে, আমার মনে হয়েছিল এরা বুঝি জন্মজন্মান্তরের শত্রু। কিন্তু যেই ভোট শেষ হয়ে গেল, অমনি কোথায় কী! কারও সঙ্গেই আর কারও কোনও বিরোধ নেই। সবাই সবার বন্ধু।
আমার থেকে দু'ক্লাস উঁচুতে পড়লেও টিটু ছিল আমার খুব ভাল বন্ধু। ক্লাস না থাকলে কিংবা ক্লাস কেটে, না; কমন রুমে নয়, ওরা দল বেঁধে সামনের মাঠে গোল করে বসে গল্পগুজব করত। আমি মাঝে মাঝেই সেই আড্ডায় গিয়ে বসে পড়তাম। সেই আড্ডায় বাবলাদাও থাকতেন।
ওরা মাঝে সাঝেই সবাই মিলে টিটুদের নিউ আলিপুরের বাড়িতে যেত। সঙ্গে আমিও যেতাম। ওর মা আমাদের না খাইয়ে কোনও দিন ছাড়তেন না।
ওর বাবা ছিলেন খুব গম্ভীর মানুষ। অনেক বিখ্যাত গায়ক-গায়িকারা ওর বাবার কাছে আসতেন। কয়েক জনকে আমিও দেখেছি। ওর বাবাও কম বিখ্যাত ছিলেন না। অসামান্য অসামান্য এক-একটা গল্প লিখলেও, সাংবাদিক হিসেবে তিনি এমন এক উঁচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন যে, তাঁর সেই লেখক-খ্যাতি চাপা পড়ে গিয়েছিল।
এখনও সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেন, যুগান্তরের ওই রমরমাকে ছাপিয়ে আনন্দবাজারকে এক নম্বরে তুলে ধরার পিছনে যে-গুটিকতক মানুষের অবদান আছে, তাঁদের মধ্যে ওর বাবা ছিলেন অন্যতম। নাম--- সন্তোষকুমার ঘোষ।
যদিও টিটুকে আমি সহকর্মী হিসেবেও পেয়েছি আনন্দবাজারে। এই মুহূর্তে ও এখন বর্তমান পত্রিকার এম ডি।
ওর দিদি মিলুদিও আমাদের খুব ভালবাসতেন।  এই মিলুদির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুনে আমি ভেবেছিলাম, যাঃ, মিলুদির সঙ্গে আমাদের বুঝি আর কোনও দিন দেখাই হবে না। কিন্তু না, তা হয়নি। মিলুদির সঙ্গে আমার যোগাযোগ থেকেই গেল। তবে টিটুর সূত্রে নয়। আমার আর এক অত্যন্ত প্রিয় মানুষ--- নিরেনদা, মানে, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সূত্রে। আসলে মিলুদির বিয়ে হয়েছিল নিরেনদার ছেলের সঙ্গে।
পরবর্তী কালে এই মিলুদি আমার কত লেখা যে বর্তমানে এবং শারদীয়া বর্তমানে ছেপেছেন তার হিসেব নেই।
তো, সেই টিটুর সুবাদেই এই বাবলাদার খুব কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম আমি।

গোপাল নগরে ঢুকে আমাদের গাড়ি তখন নট নড়ন চড়ন। জানালার কাচ নামানোই ছিল। মুখ বাড়িয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে বাবলাদা বললেন, কোথায় যাবে? বাড়ি?
আমি ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছি। ভাঙা হাট দেখে  বুঝতে পেরেছিলাম, একটু আগেই শেষ হয়েছে জনসভা। তবু অত রাতে এত সরগরম দেখে বুঝতে অসুবিধে হল না যে, বেশির ভাগ লোকজন চলে গেলেও, আশপাশের নেতৃত্ব স্থানীয় লোকেরা এখনও আছেন। এ বার হয়তো একে-একে বাড়ি ফিরবেন। বাবলাদাও ফিরবেন।
আমার বাড়ি থেকে বাবলাদার বাড়ি এতটুখানি। তাই বাবলাদাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি যাবে নাকি? 
বাবলাদা বললেন, না গো, আজ এখানে সারা রাত থাকব।
আমি অবাক হয়ে বললাম, সারা রাত!
বাবলাদা বললেল, দিদিও আছে তো! কথা বলবে? আমাকে প্রায় জোর করেই নিয়ে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। সামনাসামনি বহু বার দেখা হলেও, সরাসরি এবং ফোনে কিছু কিছু কথা হলেও, সত্যি কথা বলতে কি, তাঁর সঙ্গে সেই আমার প্রথম আলাপ।

'সানন্দা'য় ওই 'বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল' বেরোনোর পরে সেই দাপুটে নেতার পাল্লায় পড়ে সে দিন যাঁরা আমাকে টানতে টানতে কাছেরই একটি নির্মীয়মান বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। মারধর করেছিলেন। সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়েছিলেন। সেই দলে ছিলেন আমাদের পাশের বাড়ির আর এক একনিষ্ঠ কংগ্রেস কর্মী--- তপনদা।
এই তপনদাই দাবি করেছিলেন, আমি নাকি শুধু  তাঁকে নিয়েই নয়, ওই গল্পে তাঁর বোনকে নিয়েও লিখেছি। লিখেছি, মিনিবাসের পারমিট এবং এটা ওটা সেটা এবং ছোট বড় নানা রকম সুযোগ সুবিধে পাবার জন্য উনি কী ভাবে তাঁর বোনকে ব্যবহার করেন।
সেই তপনদার সঙ্গে বাবলাদার মুখোমুখি দেখা হলে দু'জনেই হেসে হেসে কথা বলেন ঠিকই, লোককে দেখানোর চেষ্টা করেন তাঁদের কী রকম গলায় গলায় ভাব, কিন্তু সকলেই জানেন, ওঁরা উপরে উপরে যতই দেখান না কেন, ভিতরে ভিতরে দু'জনেই কিন্তু একেবারে আদায় কাঁচকলা। কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সব চেয়ে কাছের, তা নিয়ে একটু সূক্ষ প্রতিযোগিতা আছে ওঁদের মধ্যে।
সেই দাপুটে নেতার ন্যাওটা আবার এই তপনদা। ফলে সেই নেতা এই তপনদাকে বেশ তোল্লাইও দেন। কিন্তু যেহেতু ওঁরা একই দলের, তাই সরাসরি কিছু বলতে না পারলেও ওই নেতাকে মোটেও পছন্দ করেন না বাবলাদা।
আর যে লোকটা সেই দাপুটে নেতা এবং তপনদার বিপক্ষে, তিনি যখন আমার কাছে এসেছেন, তার মানে তিনি আমার পাশে দাঁড়াবার জন্যই এসেছেন। তাই বাবলাদাকে দেখে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমি একদম নিশ্চিত, আর যে যা-ই কিছু করুন না কেন, বাবলাদা আমার কোনও ক্ষতি করবেন না। তার ওপরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন নিজে এসেছেন তখন আমার আর কোনও ভয় নেই।
দিদি বললেন, তোমাকে বলেছিলাম না... আমার সঙ্গে দেখা করতে। তুমি তো এলে না!
এ কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। উনি আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন! কী করে বলি, উনি ফোন করেছেন শুনে আমি তড়িঘড়ি করে রিং ব্যাক করেছিলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে উনিই ফোনটা ধরেছিলেন। তাঁর গলা শুনে আমি এতটাই বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম যে, ওঁর মতো একজন মানুষ নিজে থেকে আমার বিপদের সময় পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, এর থেকে বড় আর কী হতে পারে! 
সেই প্রাপ্তিতেই আনন্দের চোটে উনি যে কী বলছিলেন, সেটা কান দিয়ে ঢুকলেও, সেই কথাগুলো নিশ্চয়ই আমার মগজে গিয়ে পৌঁছয়নি। যদি একবারও পৌঁছত, আমি কি তাঁর বাড়ি যেতাম না! আমার বাড়ি থেকে তাঁর বাড়ি তো মাত্র কয়েক মিনিটের হাঁটা পথ।
কী বলব বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। আমার অবস্থা বোধহয় উনি আঁচ করতে পেরেছিলেন, তাই বললেন, শোনো, আমি সব শুনেছি। তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওদের যা বলার আমি বলে দিয়েছি। ওরা কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। আর যদি কিছু বলেও, তুমি আমাকে জানাবে। এদের ভাল করে দেখে রাখো, বলেই, তাঁকে ঘিরে থাকা ছেলেগুলোকে দেখিয়ে উনি বললেন, এরা মাঝে মাঝে এসে তোমার খোঁজখবর নিয়ে যাবে। কোনও সমস্যা হলেই এদেরকে বলবে, কেমন? আর বাবলা, তুই তো কাছেই থাকিস, খেয়াল রাখিস তো...
তাঁর কথা শুনে বাবলাদা মাথা কাত করলেন।

যাঁরা আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং মেরেছিলেন, সেই দাপুটে নেতা এবং স্থানীয় কাউন্সিলর দু'জনেই কিন্তু এই নেত্রীরই স্নেহধন্য। আমরা এত দিন জানতাম, দলের লোকেরা যতই অন্যায় করুক কিংবা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ুক, তার দলের নেতানেত্রীরা সব সময় সেটা ঢাকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু এই প্রথম দেখলাম, একেবারে ভিন্নধারার এক নেত্রীকে। 
উনি বলে দিয়েছেন। তার ওপর বাবলাদা আমার পাশে আছেন। আমার আর কোনও চিন্তা নেই। না, পাশের বাড়ির তপনদা বা উল্টো দিকের ওই কাউন্সিলর কিংবা সেই দাপুটে নেতা এ বার আমার সঙ্গে কিছু করতে এলে নিশ্চয়ই দু'বার ভাববেন।
অনেকটাই হালকা মনে হচ্ছে নিজেকে। যে ভয় আমাকে এ ক'দিন ধরে কুরে কুরে খাচ্ছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই ক'টা কথায় তা যেন এক ঝটকায় উধাও হয়ে গেল।
ওরা যখন সবাই চলে গেলেন, আমার সম্বিৎ ফিরল। বুঝতে পারলাম, আমি কী ভুল করে ফেলেছি। ওঁরা আমাকে সাহায্য করার জন্য আমার কাছে এসেছেন, আর আমি কিনা তাঁদের একবারও বাড়িতে আসতে বললাম না! এক কাপ চা-ও খাওয়ালাম না! ছিঃ ছিঃ ছিঃ।
আমি বাড়ির ভিতরে ঢুকে গত কয়েক দিনের মতো দরজা বন্ধ করে খিল তুলতে যাচ্ছিলাম, যাতে কেউ হুটহাট করে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়তে না পারে, ঠিক তখনই মনে হল, আমি তো আর একা নই! আমার পাশে এখন অনেক লোক। আমার আবার কীসের ভয়! তাই আমি আর খিল তো দিলামই না, দরজাটাও আগের মতোই হাট করে খুলে রাখলাম। এখন আমার আর কোনও ভয় নেই। সব ভয় আজ একটা মানুষই দূর করে দিয়ে গেছেন, তাঁর নাম--- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

নয়

একটু বেলা বাড়তেই সুজাতা আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। সুজাতা মানে, সুজাতা গঙ্গোপাধ্যায়। এক সময় 'মনোরমা' পত্রিকায় কাজ করত। তার পর সানন্দা'য়। ওর লেখা কবিতা শুধু রিনাদি, মানে অপর্ণা সেন তাঁর 'পারমিতার একদিন' সিনেমাতেই রাখেননি, স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন পর্যন্ত ওর কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন।
আমাকে দেখেই ও বলল, কীরে, কাল অফিসে আসিসনি কেন? এমন করে বলল, যেন আমি ওখানে পে-রোলে আছি। শুধু আমি নই, সে সময় আমরা যে-ক'জন আনন্দবাজারের বিভিন্ন বিভাগে, আনন্দমেলায় এবং বিশেষ করে সানন্দা'য় ফ্রিল্যান্স করতাম, মানে লিখলে টাকা, না লিখলে নয়, তাদেরকে সবাই, এমনকী ওই অফিসের অন্য দফতরের লোকেরা পর্যন্ত ভাবতেন, আমরা ওখানেই চাকরি করে।
তো, সুজাতা ও কথা বলতেই আমি বললাম, না গো, কাল যেতে পারিনি। আজ ভাবছি যাব।
ও বলল, ভাবা-ভাবি নয়। আজ দুটোর মধ্যে অফিসে চলে আসিস। অরূপবাবু তোকে কাল খুঁজছিল। তাই সুদেষ্ণাদি বলল, আমি যেন অফিস যাওয়ার আগে তোকে খবরটা দিয়ে যাই। তাই দিয়ে গেলাম...
অরূপবাবু আমাকে খুঁজছেন শুনে আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। আনন্দবাজার সংস্থা, থুড়ি, তখনও 'সংস্থা' হয়নি, গোষ্ঠী। সেই গোষ্ঠী থেকে যতগুলো পত্রপত্রিকা বেরোয়, তার সর্বময় কর্তা এই অরূপবাবু, মানে অরূপ সরকার। তিনি ডেকেছেন মানে আমার কপালে দুর্ভোগ আছে। ভয়ে ঠিক মতো খেতেও পারলাম না। কোনও রকমে নাকে-মুখে গুঁজে সোজা আনন্দবাজারে।
সুদেষ্ণাদি বললেন, শোন, ঘাবড়াবার কিছু নেই। তোকে তো আর খেয়ে ফেলবেন না। যা। কিচ্ছু হবে না। উল্টে হয়তো ভালও হতে পারে। যা।
তবু আমি ভয় ভয় পাচ্ছি দেখে সুদেষ্ণাদি বললেন, বুঝতে পেরেছি, চল, আমার সঙ্গে চল। বলে, আমাকে অরূপবাবুর কাছে নিয়ে গেলেন।
সেখানে তখন কালাদা, মানে আনন্দবাজার গ্রুপ অব পাবলিকেশনের মুদ্রক এবং প্রকাশক হিসেবে যাঁর নাম ছাপা হয়, সেই বিজিতকুমার বসু।
উনিই প্রথম শুরু করলেন, কী লিখছিস ওটা? ওরা তো তোর নামে মামলা করসে।
এই বিজিতদা হচ্ছেন বাল্মিকীর দাদা। বাল্মিকী মানে বাল্মিকী চট্টোপাধ্যায়। ও-ও আমাদের সঙ্গে লেখালিখি করত। ওর বন্ধু আমরা। সেই সুবাদে উনি আমাদের সবাইকেই তুই-তোকারি করতেন।
তাঁর কাছে মামলার কথা শুনে আমি হতভম্ব। আমার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, মামলা!
কালাদা বললেন, হ্যাঁ, মামলা। মানহানির মামলা।
অামি বললাম, মানহানির!
উনি বললেন, হ্যাঁ, মানহানির। ওরা পাঁচ জনের নামে মানহানির মামলা করসে। 
--- পাঁচ জনের নামে!
উনি বললেন, হ্যাঁ, পাঁচ জনের নামে। অরূপ সরকার, অপর্ণা সেন, সুদেষ্ণা রায়, আমার নামে আর তোর নামে। প্রত্যেকের নামে এক কোটি টাকা কইরা বাকি চার জনেরটা আমি বুইঝা নিমু। তোরটা কী করবি?
আমার মুখ থেকে কোনও শব্দ বেরোল না। মনে মনে বললাম, এক কোটি!
উনি আমার চোখ-মুখ দেখে কী বুঝলেন কে জানে। ফের বললেন, দিতে পারবি?
আমি মাথাটাথা চুলকে, অনেক ভেবেচিন্তে বললাম, এ মাসে তো আমার একটু অসুবিধে আছে।
কথাটা আমি এমন করে বললাম, যেন সামনের মাসে হলে আমার কোনও অসুবিধে নেই, এক কোটি টাকাটা ঠিক দিয়ে দিতে পারব। তো, আমার কথা শুনে শুধু কালাদাই নন, অরূপবাবুও আমাকে পা থেকে মাথা অবধি ভাল করে দেখতে লাগলেন। তাই আমি ফের বললাম, আচ্ছা, আমি যদি কোনও কারণে ওই টাকাটা দিতে না পারি, তা হলে কী হবে?
কালাদা বললেন, জেল।
জেলের কথা শুনে আামি থতমত খেয়ে গেলাম। জেল! জেল হলে আর কী করব! ঠিক আছে, নয় জেল হবে, কিন্তু কত দিনের?
কালাদা বললেন, সেটা মেরিট বুঝে। তিন মাসেরও হতে পারে, আবার তিন বছরেরও হতে পারে।
আমি মনে মনে একটু হিসেব করে নিয়ে বললাম, তিন মাস হলে তাও ঠিক আছে। তিন মাসের সংসার চালানোর টাকা আমার কাছে আছে। কিন্তু তার বেশি হলে...
আমার কথা শেষ হল না। ওঁরা দু'জনেই হেসে ফেললেন। তার পর কালাদা আমাকে বললেন, একটু পরে আমার ঘরে আসিস।
আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, কেন?
উনি বললেন, কয়েকটা কাগজে সই করতে হবে। তোর কেসটা আনন্দবাজার লড়বে।
আমি যখন 'ঠিক আছে, তা হলে আমি আসছি' বলে পিছন ঘুরতে যাব, ঠিক তখনই অরূপবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী করো?
আমি বললাম, কিছু না।
উনি বললেন, চাকরি করবে?
আমি কোথাও কোনও দিন চাকরি করব ভাবিনি। ভেবেছিলাম, এই ভাবেই লেখালিখি করে যা পাই, তাতেই যখন চলে যাচ্ছে, খামোখা চাকরি করতে যাব কেন? কিন্তু যেই উনি আমাকে বললেন চাকরি করবে? অমনি গদগদ হয়ে আমি মাথা কাত করলাম, হ্যাঁ, করব।
উনি বললেন, তা হলে কাল থেকেই চলে আসুন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়?
উনি বললেন, এখানে।

সানন্দা'য় গিয়ে এ কথা বলতেই সবাই আমাকে ঘিরে ধরল, এ তো দারুণ খবর। তা হলে কাল থেকে তুই এখানে আসছিস? তুই অবশ্য এমনিই রোজ আসতি, কাল থেকে একেবারে পাকাপাকি ভাবে। খুব ভাল হল রে। খুব ভাল খবর। যা, মিষ্টি নিয়ে আয়।
সুদেষ্ণাদি বললেন, যাঃ, ও এখন কোথায় টাকা পাবে! মাইনে পাক, তার পর খাওয়াবে। 
ওদিককার কোণে বসতেন সিদ্ধার্থদা। মানে সিদ্ধার্থ সরকার। তিনি আমাকে ইশারায় ডেকে পকেট থেকে পাঁচশো টাকা বের করে চুপিচুপি আমার হাতে দিয়ে বললেন, আমি দিয়েছি কাউকে বলার দরকার নেই। যাও, মিষ্টি নিয়ে এসো।
কাল থেকে আমার চাকরি হচ্ছে, সানন্দার সকলেই বেশ খুশি। আমিও খুশি। কিন্তু পর দিন যখন অরূপবাবুর কাছে গেলাম, আমি একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম। না, আমার চাকরি সানন্দায় হচ্ছে না। উনি আমাকে নিয়ে গেলেন রমাপদ চৌধুরীর ঘরে। আমাকে দেখিয়ে রমাপদবাবুকে বললেন, আপনাকে বলেছিলাম না... একটা নতুন ছেলে দেব। এই-ই সে।
রমাপদবাবু আমাকে খুব ভাল করেই চিনতেন। তিনি বললেন, ওঁকে তো আমি চিনি। সিদ্ধার্থ সিংহ। ও তো বহু দিন আগে থেকেই আমার পাতায় লেখে।
অরূপবাবু বললেন, তা হলে তো ভালই হল। তার পর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ থেকেই কাজে লেগে যান। আপনি ওনাকে হেল্প করবেন।
সে দিন থেকেই আমার চাকরি হয়ে গেল রবিবাসরীয়তে।
যে রমাপদবাবুকে আমি এত দিন ধরে চিনতাম, যাঁর সঙ্গে কলেজ স্ট্রিট মোড়ের 'দিলখুশ' রেস্টুরেন্ট গিয়ে নিরেনদা আর তাঁর সব চেয়ে প্রিয় পদ--- কবিরাজি কাটলেট খেতাম, যিনি বাসে করে অফিসে এলে ট্যাক্সিতে ফিরতেন, আর ট্যাক্সিতে এলে বাসে, যাঁকে মাঝে মাঝেই আমি বি বা দি বাগের মিনিবাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দিয়ে আসতাম, তাঁর অধীনে যেই আমার চাকরি হল, দেখলাম তাঁর চেহারা পাল্টে গেছে।
অরূপবাবু চলে যেতেই তিনি বললেন, বসুন। একটা কথা মন দিয়ে শুনুন। আপনি এখানে কাজ করবেন তো? আপনাকে প্রথমেই একটা কথা বলে রাখি, এটা যেন দ্বিতীয়বার আমাকে আর কখনও বলতে না হয়। আপনি যখন এই অফিসে ঢুকবেন, তখন আপনার যত রাগ, ক্ষোভ, দুঃক্ষ, হা-হুতাস আছে, সব আনন্দবাজারের গেটের বাইরে রেখে আসবেন। আর তার সঙ্গে সঙ্গে একটা কথা মনে রাখবেন, এটা তো রবিবাসরীয়। এখানে গল্প আর ধারাবাহিক উপন্যাস ছাপা হয়। অনেক হাতছানি থাকবে। সেগুলোকে উপেক্ষা করবেন। অনেক লেখক গায়ে পড়ে বন্ধুত্ব করতে আসবে। খুব সাবধান। আর একটা কথা মনে রাখবেন, আপনার শত্রুও যদি ভাল লেখে, তার বাড়ি বয়ে গিয়ে লেখা নিয়ে আসবেন। আর আপনার বন্ধুর লেখা যদি নট আপ টু দ্য মার্ক হয়, তা হলে জোড় হাত করে তাকে বিদেয় করবেন। বুঝেছেন?
সে দিনকার তাঁর সেই কথা আমি এমন অক্ষরে অক্ষরে মাথার ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম যে, শুধু অফিসের কাজের ক্ষেত্রেই নয়, শুধু তাঁর সঙ্গে যৌথ ভাবেই নয়, যখন লীলা মজুমদার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, প্রদীপ ঘোষ, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বা একক ভাবেও কোনও সংকলন সম্পাদনা করেছি, রমাপদবাবুর সেই কথাটা আমি সব সময় মনে রেখেছি। এবং সেই সংকলন আরও সুন্দর, হৃদয়গ্রাহী করার জন্য আমি নিজের থেকেও প্রয়োগ করেছি আমার নিজস্ব কিছু কৌশল। সেটা অন্য প্রসঙ্গ।
আমি তো নিয়মিত অফিস যাওয়া শুরু করলাম। রবিবাসরীয়তে কাজ করলেও আমার মন পড়ে থাকত সানন্দা'য়।
একদিন হঠাৎ করিডর দিয়ে যেতে যেতে কালাদার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। তিনি থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, অনেক দিন ধরে ভাবছি তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব।
আমি বললাম, কী?
উনি বললেন, তোর বাবা কী করে?
আমি একটু জড়সড় হয়ে গেলাম। উনি হঠাৎ আমার বাবার কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন! আমি বললাম, কেন বলুন তো?
কালাদা বললেন, না, সে দিন তোকে যখন বললাম, মানহানির ওই এক কোটি টাকা তুই দিতে পারবি কি না, তখন তুই বললি না... এ মাসে একটু অসুবিধে আছে। তাই... 
আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। বললাম, আসলে আমার পকেটে তখন একশো টাকাও ছিল না। একশো টাকাও নেই, এক কোটি টাকাও নেই। আমার কাছে তখন দুটোই সমান। তাই ওই কথা বলেছিলাম।
আমার কথা শুনে উনি আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না। গডগড করে চলে গেলেন।

দশ

মামলা চলছিল। ডেট পড়লে ওরাও কোর্টে যেত। আমরাও। প্রথম একটা-দুটো ডেটে ওদের সঙ্গে প্রচুর ছেলেপুলে থাকত। যত ডেট পড়তে লাগল, ওদের সঙ্গে আসা লোকজনের সংখ্যাও তত কমতে লাগল। তবু আমি যখন কোর্ট চত্বরে ঢুকতাম, বুঝতে পারতাম না কারা ওদের লোক। আমার দিকে কেউ তাকালেই মনে হত সবাই বুঝি আমাকেই ফলো করছে। তাই কোর্টের কাজ মিটে গেলেও আমি সহজে কোর্ট চত্বর থেকে বেরোতাম না। একা পেয়ে যদি ওরা কিছু করে!
কিন্তু না। তেমন কোনও কিছুই ঘটল না। উল্টে পঞ্চম যে ডেটটা পড়ল, দেখলাম, আমার মুখোমুখি হতেই, যে তপনদা আমাকে সে দিন টানতে টানতে সামনের নির্মীয়মান বাড়িকে নিয়ে গিয়েছিলেন, মারধর করেছিলেন, সেই তপনদাই আমাকে দেখে এক গাল হেসে বললেন, ভাল তো?
যে কাউন্সিলরের নেতৃত্বে পুরো ঘটনাটা ঘটেছিল, ফেরার সময় তিনি আমাকে বললেন, বাড়ি যাবে তো? আমাদের গাড়িতে যেতে পারো।
যে দাপুটে নেতা দাবি করেছিলেন, এই গল্পটা আমাকে নিয়ে লেখা, আমিই রাত্রবেলায় দলবল নিয়ে রেশন দোকানের সার্টার ফেলে ব্লু-ফিল্ম দেখি,  সেই তিনিই যখন লোকজন পরিবৃত হয়ে এজলাসের বাইরে দাঁড়িয়ে ফুটপাথের চায়ের দোকান থেকে চা খাচ্ছিলেন, আমাকে দেখে তিনি বললেন, ভাই, চা খাবে নাকি?
আর তাঁদের সঙ্গে যারা ছিল? তারা তো আমাকে দেখলেই একেবারে গদগদ।
মামলা চলছিল। আমার হয়ে মামলাটা লড়ছিল আনন্দবাজার গোষ্ঠী। এরই মধ্যে একদিন আনন্দবাজারের স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টের মানস চক্রবর্তী আমাকে এসে বললেন, এই শোন, তোর সানন্দার যে গল্পটা নিয়ে ঝামেলা হয়েছে, সেই গল্পটা দে না, বই করি। 
আমি জানতাম, সেই মুহূর্তে যে প্রকাশন সংস্থা বাংলা বাজারে এসেই হইচই ফেলে দিয়েছে, লেখকদের আগাম টাকা দিয়ে পাণ্ডুলিপি কিনে নিচ্ছে, একই দিনে একদম অচেনা, অজানা তরুণ কবিদের একশো পঁচিশটা কবিতার বই, না; এক-দু'ফর্মার নয়, কমপক্ষে চার ফর্মা থেকে শুরু করে ছয়, সাত, আট, দশ ফর্মার বই একসঙ্গে বের করে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে, সেই সৃষ্টি প্রকাশনীর কর্ণধার অমল সাহার সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক একেবারে গলায় গলায়। সেই প্রকাশনীর অনেকটাই দেখভাল করেন এই মানসদা। তবু আমি বললাম, ওটা দিয়ে বই হবে কী করে! ওটা তো একটা ছোট গল্প। ছাপলে খুব বেশি হলে পাঁচ-ছ'পাতা হবে।
সঙ্গে সঙ্গে উনি বললেন, ধুর বোকা, শুধু ওই গল্পটা দিয়ে কোনও বই হয় নাকি? আমি জানি না? ওই গল্পটার সঙ্গে আরও দশ, বারো বা কুড়িটা গল্প দিয়ে দে। দেখবি, গায়ে-গতরে একটা ভাল বই হয়ে যাবে। শুধু ওই গল্পটা বইয়ের প্রথমে দিবি আর বইটার নাম রাখবি--- বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল, ব্যাস।
আমি অবাক। বাব্বা, আমার গল্পের নাম ওঁর মনে আছে! কিন্তু সমস্যা হল, আমি তো ওই একটাই গল্প লিখেছি। ওটাই প্রথম ওটাই শেষ। একটা গল্প লিখেই এত ঝামেলা! এর পরে আরও গল্প লিখলে না জানি আরও কত বড় বিপদ এসে সামনে দাঁড়াবে! কিন্তু আর যদি কোনও গল্প না লিখি তা হলে বই হবে কী করে! তার মানে আমাকে আরও অন্তত বেশ কয়েকটা গল্প লিখতে হবে। কিন্তু দশ, বারো, কুড়িটা গল্প তো আর এক-দু'দিনে লিখে উঠতে পারব না! একটু সময় লাগবে। সব কাজকর্ম করে, সানন্দার নিয়মিত অর্ডারি লেখাগুলো লিখে দিনে যদি দুটো করেও গল্প লিখি, দশটা গল্প লিখতেই তো কম করে পাঁচ দিন লেগে যাবে! তা হলে!
আমি তাই মানসদাকে বললাম, ঠিক আছে, দেব। কিন্তু আমাকে ক'টা দিন সময় দাও।
মানসদা বললেন, নে না, দু'-তিন সপ্তাহ সময় নে। কোনও অসুবিধে নেই। ম্যানেসক্রিপ্ট রেডি হয়ে গেলে আমাকে দিয়ে দিস। 
মানসদার কথা শুনে আমি যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেলাম। আমি তো ভেবেছিলাম, উনি ম্যানেসক্রিপ্ট চাইছেন মানে কালই দিতে হবে। কিন্তু তা না। দু'-তিন সপ্তাহ সময়! সে তো প্রচুর সময়! একটা কেন? অত সময় পেলে তো আমি দশটা বই লিখে ফেলতে পারি!
এরই মধ্যে একজন চিত্রপরিচালক খোঁজ করে করে আমার বাড়িতে এসে 'বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল'-এর ছায়াছবির সত্ত্ব কিনে নিয়ে গেলেন। তিন বছরের মধ্যে করবেন। যদি ওই সময়ের মধ্যে উনি করতে না পারেন, তা হলে চুক্তি বাতিল।
এক সপ্তাহও কাটল না। আমার এলাকারই একটি ছেলে এলেন ওই গল্পটি নিয়ে নাটক করার জন্য। তিনি জোড়াজুড়ি করতে লাগলেন, ওটার নাট্যরূপ লিখে দিন।
আমি তাকে সরাসরি বলে দিলাম আমাকে আরও কয়েকটা নতুন গল্প লিখতে হচ্ছে, শুধু লিখলেই তো হবে না, লেখার সঙ্গে সঙ্গে যাতে সেগুলো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়ে যায়, সে দিকেও নজর দিতে হবে। কারণ, একবার বইয়ে ছাপা হয়ে গেলে সেগুলো আর কোনও পত্রিকা ছাপবে না। ফলে একটু চাপে আছি। আমার পক্ষে এক্ষুনি নাট্যরূপ দেওয়া সম্ভব নয়। তবে আপনি যদি একান্তই নাটকটা করতে চান, তা হলে আপনি নিজেই নাট্যরূপ দিয়ে নিন না... দরকার হলে না হয় আমি একবার চোখ বুলিয়ে দেব।
ছেলেটা রাজি হয়ে গেলেন।
অভিষেক নামে ভবানীপুরের একটি সাংস্কৃতিক সংস্থা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে গড়ে তুলল 'সিদ্ধার্থ সিংহ ফ্যান অ্যাসোসিয়েশন'। তখন কে যে কী করছে আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
হঠাৎই আমার পাড়ার একটা লোকের মাধ্যমে ওরা, মানে এই গল্প লেখার জন্য যাদের হাতে আমি আক্রান্ত হয়েছিলাম, সেই দলের পান্ডা, মানে ওই দাপুটে নেতার তরফ থেকে আমার কাছে প্রস্তাব এল, কোর্টের বাইরে কেসটা মিটমাট করে নেওয়ার জন্য।
আমি সে কথা কালাদা, মানে বিজিতকুমার বসুকে বলতেই কালাদা বললেন, তুই কী চাইছিস?
আমি বললাম, উনি আমার বাড়ির কাছাকাছি থাকেন না ঠিকই, কিন্তু বাকিরা তো সবই আমার বাড়ির আশপাশে থাকে, তাই ভাবছিলাম, সকাল হলেই যখন মুখোমুখি দেখা হবে... তা ছাড়া শুধু কোর্টে নয়, রাস্তাঘাটে যেখানেই ওদের সঙ্গে এখন দেখা হচ্ছে, ওরা কিন্তু কেউ আমার সঙ্গে আর কোনও খারাপ ব্যবহার করছে না। কোনও আজেবাজে কথাও বলছে না। উল্টে ভাল ব্যবহার করছে। আমাকে তো কোর্টের মধ্যে ওই নেতাও একদিন চা খাওয়াতে চেয়েছিলেন।
কালাদা বললেন, টাকা চা। 
আমি হতবাক। টাকা!
উনি বললেন, ওরা তো তোকে মারধর করেছে। বেইজ্জত করেছে। কিছু খেসারত দেবে না? এমনি এমনি মিটিয়ে নিবি?
মামলা মামলার মতো চলছিল। এরই মধ্যে  শিশির মঞ্চে 'বিশ্ব ও শিল্পী' মহাধুমধাম করে মঞ্চস্থ করল--- 'বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল'। নাট্যরূপ সত্যজিৎ কোটালের। কলকাতা ছেয়ে গেল পোস্টারে--- 'ইভটিজিং কী চলতেই থাকবে? 'বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল' একটি আন্দোলন। আপনিও সামিল হোন।'
কোনও হোর্ডিংয়ে লেখা হল--- '৩১ অক্টোবর সন্ধে সাড়ে পাঁচটার পর কোথাও আর ইভটিজিং নয়।'
এ দিন নাটক শুরুর আগে সংবর্ধনা জানানো হয় সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত, চিত্রশিল্পী বিজন চৌধুরী, বাচিকশিল্পী প্রদীপ ঘোষ, নাট্যকার বিভাস চক্রবর্তী, নৃত্যশিল্পী বৈশাখী মজুমদার, ফুটবলার সুব্রত ভট্টাচার্য-সহ মোট আট জনকে। সে দিন শিশির মঞ্চে এত দর্শক উপচে পড়েছিলেন যে, 'বিশ্ব ও শিল্পী' সবাইকে বসার আসনও দিতে পারেনি। বহু লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পুরো অনুষ্ঠানটা দেখেছিলেন। সে খবর শুধু বাংলা নয়, হিন্দি, ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার দৈনিক পত্রিকাগুলোতে ছবি-সহ ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। তার পরেও কত বার যে ওই নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে, তার কোনও হিসেব নেই।
মামলা চলছিল। পাশাপাশি আমার লেখাও। কয়েক দিনের মধ্যেই লিখে ফেললাম বেশ কিছু গল্প। গল্পগুলো ছাপাও হতে লাগল আনন্দবাজার, দেশ, সানন্দা, প্রতিদিন, সাপ্তাহিক বর্তমান, নবকল্লোল, প্রসাদ, কথাসাহিত্যে।
লেখার ঘোরে ক'টা গল্প লিখে ফেলেছি, গুনিনি। যখন মানসদার জন্য পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে গেলাম, তখন আমি আর লেখক নই, সম্পাদক। ফলে আমার নিজের লেখা হলেও নির্মম ভাবে বাদ দিতে লাগলাম একটার পর একটা গল্প।
অবশেষে মানসদার হাতে পাণ্ডুলিপি তুলে দেওয়ার মাত্র ষোলো দিনের মথায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বেরিয়ে গেল সেই বই। কানায় কানায় পূর্ণ কলকাতা প্রেস ক্লাবে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিত হল--- বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল। সে দিন কে উপস্থিত ছিলেন না সেখানে? বাঘ-সিংহ, হাতি-ঘোড়া-সহ সব রাঘব বোয়ালেরা।
তিন বছরের জন্য চুক্তি করে গেলেও যেহেতু মামলা চলছিল, তাই আইনের লাল সুতোর প্যাঁচে পড়ে সেই চিত্রপরিচালক আর শ্যুটিং শুরু করতে পারলেন না। বাতিল হয়ে গেল চুক্তি। তাঁর দিয়ে যাওয়া চুক্তির টাকা আমি ফেরত দিতে চাইলেও তিনি সবিনয়ে তা ফিরিয়ে দেন।
মামলা চলাকালীনই--- না, কোনও টাকাপয়সা নিয়ে রফা নয়, যেহেতু উনি নিজেই আমার কাছে স্বীকার করেছিলেন, বিভিন্ন লোকের উসকানিকে ঝোঁকের মাথায় দলে পড়ে উনি ও রকম একটা কাজ করে ফেলেছেন, তাই তাঁর আবেদনে শেষ পর্যন্ত আমি কালাদাকে কেসটা তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করি এবং আমার অনুরোধেই সব দিক খতিয়ে দেখে ওদের দিয়ে মুচলেকা লিখিয়ে নিয়ে আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষ অবশেষে মামলাটা তুলে নেয়।
সেই 'বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল' বইটা বেরোনোর পরে প্রচুর পত্রপত্রিকায় উচ্ছ্বসিত প্রশংসা বেরোলেও,  প্রচুর লোকজন চিঠি দিয়ে, ফোন করে আমাকে বাহবা দিলেও, ওই বই পড়ে রমাপদ চৌধুরী আমাকে যে চিঠিটা দিয়েছিলেন, তা আমি কোনও দিনও ভুলব না। উনি লিখেছিলেন, প্রথম গল্প লিখেই বাংলা সাহিত্যে আপনি যে ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছেন, তার ধ্বনী  বহু দিন পর্যন্ত, এমনকী এই পৃথিবীতে যখন আপনি থাকবেন না, তখনও শোনা যাবে, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
পঁচিশ বছর আগে এ সব ঘটনা ঘটলেও, এখনও যেন মনে হয়, এই তো সে দিনের কথা! সমস্তটাই যেন আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ভেসে ওঠে প্রথম দিনের ঘটনাটাও।



সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান