‘চিলেকোঠার সেপাই’ উনসত্তরের মহাকাব্য
‘চিলেকোঠার সেপাই’ উনসত্তরের মহাকাব্য

লেখক : শৌনক দত্ত


আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপন্যাস।ব্যক্তির জীবনপরিসরকে কিংবদন্তী, ইতিহাস আর সমকালের এমন অভাবনীয় পটে মেলে ধরেছেন যে তার এই রচনা হয়ে উঠেছে আমাদের জীবনের অস্তিত্বগাথা, একই সঙ্গে বর্তমান ও ভবিষ্যতের মহাকাব্যিক ডিসকোর্স।

উপন্যাসের যারা বিদগ্ধ পাঠক তারা এর নানা দিক নিয়ে ইতিমধ্যেই আলোচনা-সমালোচনা করেছেন। এর শৈল্পিক দিক ও আঙ্গিক দিক নিয়েও আলোচনা হয়েছে বিস্তর। উপন্যাসের সামাজিক বাস্তবতাও উঠে এসেছে অনেকের আলোচনায়। তবে আমার বিবেচনায় ষাটের দশকের বাংলাদেশ বুঝতে,চিনতে,জানতে হলে এই উপন্যাসের স্মরণ নিতেই হবে, না নিলে তাদের বুঝতে পারাটা পূর্ণতা পাবে না।ইলিয়াস ইতিহাসমোথিত সময়, মানুষ আর সমাজকে উপজীব্য করেছেন তাঁর উপন্যাসে। তিনি যথার্থই জানতেন ঔপন্যাসিকের এটাই মূল কাজ, “সমাজের বাস্তব চেহারা তাঁকে তুলে ধরতে হয় এবং শুধু স্থিরচিত্র নয়, তার ভেতরকার স্পন্দটিই বুঝতে পারা কথাসাহিত্যিকের প্রধান লক্ষ্য।”

রাজনীতির নানা ঘটনা পরম্পরা উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। সেখানে চিত্রিত হয়েছে, একদল কীভাবে দিনের পর দিন ধরে বিনির্মাণ করে চলেছেন উনসত্তর। আবার তারাই হারিয়ে যাচ্ছেন; এর বিপরীতে উঠে আসে আরেক শক্তি। তারাই প্রবল বেগে প্রভাব বিস্তার করছেন সেই বিনির্মিত উনসত্তরের পাটাতনের ওপর। এর মাঝেও ফুটে উঠেছে মানুষের বৈশিষ্ট্য, চরিত্রের নানা দিক। গল্পে গল্পে এগিয়ে গেছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন সংগ্রাম। শত কুসংস্কার নিয়েও আন্দোলনে তুখোড় ভূমিকা নিচ্ছেন এক ‘প্রান্তিকজন’, আবার ‘আধুনিক শিক্ষা’ নিয়েও সেই ভূমিকা থেকে একটু দূরবর্তী অবস্থান নিচ্ছেন, শুধু তার শ্রেণি চরিত্রের কারণে। অন্ত্যজনের ভাষা, জীবন, লড়াই ও স্বপ্ন যেন বাঙময় হয়ে উঠেছে উপন্যাসে।

উপন্যাসের নায়ক আসলে ১৯৬৯ সাল। এ সময়টিকে ধারণ করে আছে তৎকালীন পূর্ববাংলার ঐতিহাসিক গণজাগরণ। ইতিহাসের এ সময়কে চিত্রিত করতে আন্দোলিত সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে অনেক চরিত্রকে তুলে ধরেছেন লেখক। তাই সে সময়ের অনুষঙ্গ হিসেবে দুটি বিষয় এসেছে এ উপন্যাসে- মিছিল ও রাজনীতি। শত শত বছর আগের ইতিহাস থেকে উঠে আসা নিপীড়িত মানুষের স্রোতের উত্তালতা দেখা যায় এ উপন্যাসে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উৎসারণ, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নিষ্পেষণ থেকে হাজার বছরের বাঙালি অস্তিত্ব রক্ষাই ছিল এ মিছিলের মূল উদ্দেশ্য। ’৬৯-এর মিছিল বর্ণনায় লেখকের যে ভাবাবেগ, তা বাস্তবতাবোধের সম্প্রসারণ। তাইতো এ মিছিলের উত্তাপ, অস্তিত্ব-বিচ্ছিন্ন ওসমান চরিত্রটিকেও আলোকিত করতে পেরেছিল।

ওসমান এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, যে একজন ছোটখাট সরকারি চাকুরীজীবি। এ উপন্যাসে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দুটি প্রধান আঙ্গিক হলো ব্যক্তি ও সমষ্টি। ওসমান নামক আত্মকেন্দ্রিক চরিত্রের ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে চিলেকোঠার ব্যক্তিমানস। আর সমষ্টি তথা শোষিত শ্রেণির মানুষরা এসেছে মিছিলের রূপে, সংগ্রামী ঐক্যতান নিয়ে। উপন্যাসের প্রথমেই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আবু তালেবের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যায়। এ মৃত্যুর মধ্য দিয়েই আমরা পরিচয় পাই ওসমান, হাড্ডিখিজির, রহমত উল্লাহ আলাউদ্দিনের। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ও বগুড়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহ একসূত্রে গ্রথিত হয়েছে এই উপন্যাসে। নগরকেন্দ্রিক মুসলিম লীগপন্থী নব্য সুবিধাভোগী শ্রেণির সঙ্গে মধ্যবিত্ত ও নিম্নশ্রেণির দ্ব›দ্ব ও গ্রামকেন্দ্রিক আইয়ুবী গণতন্ত্রীদের দৌরাত্ম্য ও শোষণ এই উপন্যাসের উপজীব্য। অন্যদিক থেকে চিন্তা করলে এর প্রধান চরিত্র বলা যায় হাড্ডিখিজিরকে, যে কিনা ওসমানের বাড়িওয়ালার ভাগনের গ্যারেজ দেখাশোনা করে। আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে সংগ্রামী চেতনায় ভরপুর এ চরিত্রটি। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের শিল্পসম্মত একটি প্রতিভূ হাড্ডিখিজির। গুলিবিদ্ধ মুমূর্ষু খিজিরের অবস্থান ও প্রতিক্রিয়া বর্ণনাতে লেখক বাস্তবতায় থাকতে চেয়েছেন। কিন্তু গভীর বেদনাবোধের স্তরে তিনি পৌঁছাননি। লেখকের বাস্তবতাবোধ নিরাবেগ হতে পারে, কিন্তু ভাষা তাঁর তীক্ষ্ণ। খিজিরকে আখতারুজ্জামান অ্যারসারডিটি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, সেই সঙ্গে ওসমান চরিত্রটিকেও।এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রা ও স্তরের চরিত্রই উপন্যাসটিকে টেনে নিয়ে গেছে ঊনসত্তরের উত্তাল সময়ের ভেতর দিয়ে। আরেকটি গুরুত্ববহ চরিত্র আনোয়ার, যে মূলতঃ একজন বামপন্থী কর্মী। ঊনসত্তরের এই টালমাটাল বিক্ষুব্ধ সময়েই সে ঘটনাক্রমে যায় তার গ্রামের বাড়িতে,আর সেখানে পাই চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসের গ্রামীণ ঘটনাংশে শ্রেণিসংগ্রাম ও তার অস্বভাবী পরিণতি রূপায়িত হয়েছে। রহমতউল্লার মতো খয়বার গাজীও পাকিস্তানি শাসকচক্রের সেবাদাস। বর্গাচাষিদের নির্মমভাবে শোষণ করে সে। তার নির্দেশে গ্রামাঞ্চলের বর্গাচাষিদের গরু চুরি করে জমা করা হয় চরের এক নিরাপদ আস্তানায়। ফলে গ্রামের মানুষ একসময় ক্রুদ্ধ হয়ে আলি বক্সের নেতৃত্বে পুড়িয়ে দেয় খয়বার গাজীর ট্যান্ডল আর হোসেন আলীর আস্তানা।


চেংটুর মধ্যেই শ্রেণিস্বভাবের স্বতঃস্ফূর্ত বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত। বিপ্লবী কর্মী আলি বক্স তার রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হলেও চেংটুর স্বভাবে খিজিরের সমধর্মিতা বিদ্যমান। সংগঠিত জনতা অতঃপর গ্রাম্য কুসংস্কারের উৎস বৈরাগীর ভিটা পরিষ্কার করে গণশত্রু খয়বার গাজীর বিচারের লক্ষ্যে গণ-আদালতের আয়োজন করে। খয়বার গাজী জুম্মার নামাজের প্রার্থনা করে আদালতের কার্যক্রম বিলম্বিত করে। আনোয়ারদের গ্রামে সংগঠিত এই ঘটনাধারায় শ্রেণিসচেতন রাজনৈতিক কর্মী আনোয়ারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।


আনোয়ারের মধ্যে সদর্থক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বিধৃত। গণ-আন্দোলনের নেতৃত্ব ক্রমান্বয়ে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় শ্রেণিসংগ্রামে বিশ্বাসী সংগঠনসমূহের দীর্ঘসংগ্রামের গতি বাধাগ্রস্ত হয়। তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি গণসংগ্রামের উদ্দেশ্য থেকে ক্রমান্বয়ে দূরবর্তী হতে থাকে।

 

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস জাতীয় রাজনীতির এই অন্তঃস্বরূপকেও প্রত্যক্ষ করেছেন নিরাসক্ত দৃষ্টিতে। ঊনসত্তরের প্রবল গণ-আন্দোলনের টানে জাতীয় মুক্তির সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত হলেও সাধারণ মানুষের জীবন প্যাটার্নের গুণগত পরিবর্তন দুঃস্বপ্নই থেকে যায়। ওসমানের আত্ম-রূপান্তরে এ-কারণেই সম্ভবত তার শ্রেণিসত্তার বিলুপ্তি নির্দেশ করেন ঔপন্যাসিক। বাঙালির মুক্তি আন্দোলন শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্তের স্বপ্ন ও সংগ্রামে পরিণত হয়।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান