বিপ্লবের আইকন : চে গুয়েভারা - আনোয়ার কামাল
বিপ্লবের আইকন : চে গুয়েভারা - আনোয়ার কামাল

চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়

আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁপা

         আত্মায় অবিশ্রান্ত বৃষ্টি-পতনের শব্দ

         শৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস

চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়-

বোলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালূন পরা

         তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর

         তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে

         নেমে গেছে

                     শুকনো রক্তের রেখা

         চোখ দুটি চেয়ে আছে

সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ থেকে ছুটে আসে অন্য গোলার্ধে

চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।

                                      ( সংক্ষেপিত)

 

বিপ্লবী চেএর মৃত্যুতে কতখানি দুঃখ পেলে কেবলমাত্র একজন কবি তার কবিতায় নিজেকে অপরাধী হিসাবে সাব্যস্ত করতে পারে। তার জলন্ত দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রখ্যাত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার কবিতায়। আসলেই চে মৃত্যু আমাদের অনেক বড় অপরাধী করে দেয়। তাইতো চেবেঁচে আছেন আমাদের তারুণ্যের প্রতীক হিসাবে, বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে।

 

চেএর হত্যাকে ঘৃণাভরে দেখা হয় সারা বিশ্বের মুক্তিকামী, স্বাধীনতা প্রিয় মানুষের হৃদয় থেকে। বিপ্লবী আদর্শে সাম্যবাদী চিন্তায় বঞ্চনার বিরুদ্ধে উজ্জীবিত কিংবদন্তী নায়ক চে গুয়েভারা, যার পুরো নাম এর্নেস্তা চে রাফায়েল গুয়েভারা দে লা সেরনা। তবে সারা বিশ্বে তার নাম বা পরিচিতি চে গুয়েভারা সংক্ষেপে কেবলমাত্রচেনামেই তার পরিচিতি। কেবলচেবললেই তাকে বিশ্বের সবচে বেশি লোক চিনে ফেলে। ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিসংগ্রামের অগ্রদূত কিংবদন্তী নায়ক সাম্যবাদের ঝা-াবাহী অগ্রপথিক চে গুয়েভারা। বিশ্বজুড়ে যাঁর নাম হয়ে রয়েছে বিপ্লবের প্রতিশব্দ হিসেবে। নামটি যেন বারুদসম অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

 

ল্যাটিন আমেরিকার আর্জেন্টিনার রোসিও শহরে ১৯২৮ সালের ১৪ জুন জন্মগ্রহণকারী চে গুয়েভারা একজন চিকিৎসক হয়েও তিনি ছিলেন একাধারে একজন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, গেরিলা যোদ্ধা, লেখক, বুদ্ধিজীবী, কুটনৈতিক, সামরিক তত্ত্ববিদ, নিজেকে গেরিলা যোদ্ধায় পরিণত করা, সর্বোপরি তিনি ছিলেন কিউবা বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। কিউবা বিপ্লবের নায়ক ফিদেল কাস্ত্রোর ঘনিষ্ট বন্ধু। বিপ্লবী নেতা ল্যাটিন আমেরিকার মানুষকে মুক্তির আস্বাদন দিতে ছুটে বেড়িয়েছেন এলসালভাদর, কোষ্টারিকা, পানামা, পেরু, কঙ্গো, ভিয়েতনাম, কলাম্বিয়া, ইকুয়েডর, ভেনিজুয়েলা বলিভিয়া। পুরো ল্যাটিন আমেরিকায় পড়ে রয়েছে বিপ্লবীর পদচিহ্ন।

 

বিপ্লবের অবিসংবাদিত নেতা সাধারণত কোন সাংবাদিককে ছবি তুলতে দিতেন না। অবিন্যস্ত ঝাঁকড়া চুলের ওপর চ্যাপ্টা লাল রংয়ের গোল টুপি, চোখের ভেতর থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছিটকে পড়া ছবি তুলেছিলেন আলোকচিত্রী আলবের্তো কোর্দা। ১৯৬০ সালের মার্চ তিনি বিখ্যাত ছবিটি তুলেছিলেন। যে ছবি পরবর্তী অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে অন্যায়, নিপীড়ন শোষণের প্রতিবাদী প্রতীক হয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে চলছে।

 

চিকিৎসক থেকে বিপ্লবী সম্যবাদী নেতা ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মার্কিন সমর্থনপুষ্ট বলিভীয় সেনাবাহিনীর হাতে আহত হয়ে বন্দি হন চে গুয়েভারা। পরদিন সেনাবাহিনীর এক মাতাল সৈনিক তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মৃত্যুর আগে চে বলেছিলেন, ‘ আমি জানি তোমরা আমাকে গুলি করে মারবে। আমি জীবিতাবস্থায় বেরুতে পারবো না।তিনি লিখেছেন, ‘আমার পরাজয়ের মানে এই নয় যে, কোন দিনই বিজয় অর্জন করা যাবে না। ফিলেদকে বলো, পরাজয় বিপ্লবের শেষ হয়ে যাওয়া নয়। বিপ্লবের বিজয় হবেই। সালেইদাকে ( চের স্ত্রী) বলো ব্যাপারটি ভুলে যেতে, সুখী হতে বলো, বাচ্চাদের লেখাপড়ার ব্যাঘাত না ঘটে, আর সৈন্যদের বলো, যেন আমার দিকে ঠিকভাবে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।কত বড় মাপের বিপ্লবী হলেই কেবল মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে ধরনের বক্তব্য দেয়া যায়। তিনি জীবন দিয়ে গেলেও প্রমাণ করেছেনবিপ্লবীর মৃত্যু আছে, কিন্তু বিপ্লবের মৃত্যু নেই।চেবিপ্লবী মৃত্যুঞ্জয়ী, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে চিরঞ্জীব হয়ে আছেন।

 

শারীরিকভাবে চে-কে হত্যা করা হলেও তাঁর স্থান এখন কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের মধ্যিখানে স্থান করে আছে। তারুণ্যের বিপ্লবের প্রতীক হয়ে আছেন। চে গুয়েভারার জীবন দান বিপ্লবের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রবাদ পুরুষ চে ছবি সারা বিশ্বে তরুণদের কাছেআইকনহয়ে আছে।

 

চিলির বিপ্লবী কবি পাবলো নেরুদার স্মৃতিকথায় চে-কে আমরা দেখি বিষণ্ন এক যোদ্ধার প্রতিকৃতিতে, যিনি মানুষকে যেমন ভালবাসতেন তেমনি কবিতাও ভালবাসতেন। তাই মৃত্যুর সময়ও তার পকেটে কবিতা পাওয়া যায়। ফরাসি দার্শনিক জ্যঁ পল সাত্র চে গুয়েভারাকে আন্দোলনের কমান্ডার হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।

 

চে- মৃত্যু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে দমাতে পারেনি। দিকে দিকে দাবানলের মত জ্বলে উঠেছে চে পরবর্তী সময়ে। সারা দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষরা এখনো মনে করে কেবলমাত্র সমাজতন্ত্রই পারে শোষণহীন শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে। আমাদের দেশেও চে মৃত্যুতে আমাদের ব্যথিত করে চোখে জল এনে দেয়। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায় বিপ্লবীর জীবনী পড়ে।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান