ভালবাসার ব্ল্যাকদার - হুসাইন দিলাওয়ার
ভালবাসার ব্ল্যাকদার - হুসাইন দিলাওয়ার


কি ওটা  ?
পোকা না পাখি, পাখি না পোকা ! 
ভাবতে না ভাবতেই আচানক  দানবিক গতিতে কিছু একটা ভক করে পেটে বিঁধল ।   শিরদাঁড়া ভেদ করে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেল ধাতব কিছু । চলন্ত সাইকেল থেকে মুহূর্তেই  লুটিয়ে পড়ল জুয়েল ।   সাইকেলের নিচ থেকে একটা পা বের করে হাঁটু গেড়ে বসল  ।
রক্তের সরু একটা প্রবাহ পেট থেকে নিচে গড়াতে থাকে ।  ধবধবে সাদা লুঙ্গিতে রক্ত লাগতে দেখে উদ্বেগ হয় তার ।
ওহ্ রে, নয়া লুঙ্গিখান নষ্ট হয়ে গেইল ।
অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করতে করতে  গলগলিয়ে ফিনকি দিয়ে প্রবাহমান রক্তের স্রোত হাত দিয়ে আটকাতে চায় ।  লুঙ্গিটা নতুন । তারচেয়ে বড়কথা হল ওটা শ্বশুর বাড়ি থেকে উপহার পাওয়া ।
তাতে সুফিয়ার ছোঁয়া রয়েছে ।  কিশোনগঞ্জ বাজার থেকে তার চাচা শ্বশুর লুঙ্গিটা কিনে  দেন ।
সুফিয়া তা রগড়ে রগড়ে ধুয়ে ভাতের মাড় দিয়ে রোদে মেলে দেয় ।  গ্রামীণ চেকের সাদা লুঙ্গিখানা এখনো ধবধবে খসখসে । 
এবার তার চোখ পড়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলে থাকা চটের ব্যাগটার ওপর । হ্যাপির জন্য প্লাস্টিকের বতলে নানু বাড়ি থেক দেয়া দুধ পড়ে যাচ্ছে ।
নাগর নদীর পিপাসিত বালুয়াড়ি চো চো শব্দে শুষে  নিচ্ছে চুইয়ে পড়া দুধ । 
জুয়েলের মাঘায় ঝিম ধরে । আশৈশবের চেনা নাগর নদী,  গম খেতে, অতি যত্নের সাইকেলখানা চোখে ঝাপসা দেখায় ।
এখন আর ওসব কিছুই দেখছে না সে ।  তার চোখে জ্বলজ্বল করে ভেসে আসে সুফিয়ার মুখচ্ছবি । সরু চিবুক, চিকন ঠোঁট, সলাজ চোখ আর তার কয়লাকালো চুলের খোপা । প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্তটুকু থেকে স্থিরচিত্র পিছনের দিকে মোড় নেয় । রিমোট চেপে যেন কেউ পিছিয়ে দেখতে চায় চলচ্চিত্রের মিস করা কোন সিন । 

ঠাকুরগাঁওয়ের সীমান্তঘেষাঁ গ্রাম জগদল । জগদল থেকে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলি স্পষ্ট দেখা যায় । ঐ তো নাগর নদী । নদী পার হয়ে বাংলাদেশিদের ফসলের মাঠ । তারপরেই বিএসএফদের চা বাগান । নো ম্যানস ল্যান্ড ।  কাঁটার বেড়া ডিঙোলেই ইন্ডিয়া ।  বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের চাক্ষুষ্মান এ গ্রামগুলোর মধ্যে কোন ফারাক নেই ।  শুধু ঐ নির্দয় ধারালো কাঁটাতারের বেড়াটুকু ছাড়া । 
সাযুজ্যে, প্রাকৃতিক পরিবেশে, চলনে-বলনে কোন তফাত চোখে পড়ে না তেমন । 
জগদল গ্রামের ছেলে জুয়েল ।  পড়ালেখা ঠেলেঠুলে ফাইভ পর্যন্ত ।  গাঁ'য়ের বাজারে তার একটা ছোট্ট ঘুন্টিঘর ।
চা,পান, বিড়ি, শ্যাম্পু আর ফ্রিজে কোমল পানীয়, আইসক্রিম ।  এই ঘুন্টি দোকন থেকে যা আয় হয় তাতেই বেশ কেটে যায় ।  তাছাড়া ধানিজমিও আছে বিঘা পাঁচেক । তা থেকে বছরের খাওয়ার চালটা অন্তত জুটে যায় ।

তার মাতৃভূমি  বাংলাদেশে হলেও শ্বশুর বাড়ি ইন্ডিয়ায় ।  গ্রামের নাম বিতনী । খুব নাটকীয় ভাবেই তাদের বিয়ে হয় । আর প্রথম সাক্ষাতটাও ছিল  অন্যরকম,  আচানক । 

প্রতি পহেলা বৈশাখে ভারত-বাংলাদেশ মিলন মেলা বসে । সীমান্তের কাঁটাতারে এপার-ওপার বাংলার আত্নীয় স্বজনরা দেখা করে । কথা বলে ।  কাঁটাতারের ওপর দিয়ে ছুড়াছুঁড়ি করে কাপড়, খাবার, চিঠি আদান-প্রদান করে । পাঁচ বছর আগে এমন এক  মিলন মেলায় জুয়েল দোকান দেয় খেতের আইলে । চৈত্রের দাবদাহে আগত মানুষেরা পানির জন্য ছটফট করে ।
ঘুন্টিঘর  থেকে আনা কোক, মিনারেল, আইসক্রিম মুহূর্তে বিক্রি হয়ে যায় । তার স্টকে যা ছিল সব বেচা শেষ । আনন্দে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে সে মানুষের কারবার দেখে ।
নিকট আত্নীয়,  রক্তের আত্নীয়,  আত্নার আত্নীয়রা মিলন মেলার সময়টুকু অপলক নয়নে চেয়ে থাকে ভাব বিনিময় করে । 
সারা বছর এদিনের জন্য তাদের অপেক্ষার অন্ত থাকে না  । 
অনেকদিন পর চোখাচোখি হতেই  কান্নাকাটির দমক জাগে । মাঝেমাঝে হাহাকার করে ওঠে কেউ কেউ । 
ছাতা মাথায় সে ঘুরে ঘুরে দেখে ।
আর অবাক হয়ে । 
প্রতিবছরের এই একই দৃশ্য তার কাছে নতুনতর লাগে ।

তার চোখ পড়ে থুত্থুরে বুড়ি ও তার পাশে বসে থাকা এক কিশোরীর ওপর । 
আকুলিবিকুলি করে ওঠে তার মন । 
দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ধান চারার মৃদল দোল লাগে তার হৃদয়পটে । 
লাভ এ্যট ফার্স্ট সাইট  !
তা কি বনেদীপনা দেখে হয় ? 
তার মন উতলা হয়ে ওঠে । তার ঘ্রাণেন্দ্রিয়
আমের মুকুল আর বাতাবিলেবুর ফুলের সুবাসে একাকার হয়ে যে মোহন সুবাস সৃষ্টি করে তার গন্ধ পায় । 
কিন্তু বুড়ির আর কিশোরীর দৃষ্টি বড়ই উদাস ।  কারণ তার বাংলাদেশি আত্নীয় এখনো যে এলো না ।
ও বুড়ি মা, এমন করে কি দেখছেন তে ?
কাঁটাতারের ওপাশে বসে থাকা বুড়ি উঠে দাঁড়ায় । 
আর কহিস না বাও, নেকমরদের হাটে মোর ছুটু বহিনের মায়াডার বেহা হইচে  ।
তিনডায় আসপার কথা, এলাও কোন পাত্তা নাই ! 
তারপর অনেককথা হয় বুড়ির সাথে ।  জমে ওঠে খেঁজুরে আলাপ । 

মেলা ভাঙে ।  সবাই ফিরে যায় । 
দিন গড়াতে থাকে ।  ঘুন্টিঘরে বসে বাংলা ছায়াছবির গান শোনে আর সুফিয়ার মুখ মনে করার চেষ্টা করে  । 
দোকানে চা খেতে খেতে একদিন সুজনের কাছে মনের আকুতি জানায়  ।  সুজন ডাকসাইটে ছেলে ।  সীমান্তে চোরাকারবারির সাথে জড়িত । লাইনম্যান, বিজিবি, বিএসএফ সবার সাথে ওর দহরম মহরম সম্পর্ক  ।  সে ব্ল্যাকদার সুজন নামে সমধিক পরিচিত । এমনকি 
পশ্চিম দিনাজপুরের অনেক জায়গা তার চেনাজানা আছে ।  
সে আশ্বস্ত করে জুয়লকে ।  
ঠিকানাটা তার কাছে দিয়ে খোঁজ খবর নিতে বলে ।  সুফিয়ার খালাতো বোনের বাংলাদেশে বিয়ে হয়েছে । নাম আয়েশা ।   তাদের বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায় না তাকে ।  সপরিবারে ঢাকায় ।  সে এখন গার্মেন্টস শ্রমিক । 
দোকানের চায়ের কাপে স্টিলের চামচ দিয়ে চিনি মিশাতে মিশাতে পড়শি দেশের ষোড়শী তন্বীর কল্পনায় মোহিত হয় । চেহারাটা ছায়াময় হয়ে ওঠে  । 
উদাস করা ভাবালুতা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে দিনমান ।
এক ভাতঘুমের দুপুরে অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে জুয়েলের  ফোনে ।
: হ্যালো জুয়েল ।  মুই সুজন কহচুঁ  ।
সুজনের ফোন পেয়ে আঁৎকে ওঠে । বেচাইন স্বরে জানতে চায়---
: হু, কি খবর হইল বাহে ?
: আরে মিয়া খবর এক্কেরে পাক্কা । সব ফিট কর রাখিচুঁ । তুই বেহার প্রস্তুতি  লে ।  আর মোর ঘটকালির ফিসটা ভুলে যাইস না ফির ।
: কিন্তু হামার তো পাসপোর্ট, ভিসা কিছুই হয়নি এলাও ।
: আরে মুই থাকিতে তোর ওগিলা লে চিন্তা না করবা লাগবে । রাখচুঁ । পরে কথা হবে ।
জুয়েলের বাড়িতে সবার প্রবল আপত্তি । এক রকম জোর করেই বিয়েটা করে সে । বিয়ের রাতে কাঁটাতারে লেগে তার উরুর মাংস কেটে  যায় ।
দূর্বাঘাস মুখে চিবিয়ে ক্ষতস্থানের রক্তপাত থামায় । 

সুজন মাগনা কোন কাজ করে না । তাকে দশহাজার টাকা সম্মানী দেয়া হয় । 
বুকভরা আবেগ নিয়ে তারা ঘর বাঁধে ।  কোল আলোকিত করে আসে ফুটফুটে একটা মেয়ে । মেয়ের নাম রাখে হ্যাপি । 
মুখে এক চিলতে স্বর্গীয় হাসি লেগে থাকে তার । 
পাসপোর্ট এখন ঠাকুরগাঁওয়ে করা যায় শুনে 
পাসপোর্ট করে ফেলে ইতোমধ্যে ।
শ্বশুরঘর থেকে দুঃসংবাদ আসে । সেই বুড়ি আর বেঁচে নেই । 
দাফনের কাজে তাদের যাওয়া লাগবে ।  তখন ভিসা লাগানোর ফুরসত কই  । 
সুজন ব্ল্যাকদার মারফত তারা সীমান্ত পাড়ি দেয়।  ঐ রাতেই ফিরে আসে জুয়েল ।  মা মেয়ে থেকে যায় শ্বশুরবাড়ি । 

গ্রামময় একটা দুর্বোধ্য অস্থিরতা আর ভয়ের সৃষ্টি  হয় । দোকানের টিভিতে চীন, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে শত শত মানুষের লাশ দেখে বুক কাঁপে তার ।
করোনা করোনা  !  ওলা বিবি !  আকাল আসছে বাহে আকাল।
কেউ বলে আল্লার গজব  ! 
দোকানে আড্ডাবাজ মানুষের কথা শুনে পেরেশান হয়ে যায় সে ।
হুলস্থুল কান্ডে ঘটে যায় একদিন ।  গ্রামের লোকজন খালি রং চা খেতে চায় । তাও আবার গোলমরিচ আর কালোজিরা দিয়ে । কিন্তু রং চায়ে আদা ছাড়া সে কিছুই দেয় না ।
গোলমরিচ রাখবো নি, কালোজিরাও নাই !
কিয়ের দোকান করিস তুই রে । লোকজন
অযথা ধমকাধমকি করে তাকে ।
কাল সে গিয়েছিল শ্বশুর বাড়ি থেকে সুফিয়া আর হ্যাপিকে আনতে ।
সুজনই সব ব্যবস্থা করে দেয় ।  আট দশজন মেয়ের একটা দল নিরাপদে পার করায় সুজন ।
এরমধ্যে বিএসএফের  টহলরত একটা গাড়ি আসে । সুজন আর জুয়েলের আসতে দেরি হয়।
শেষমেষ কাঁটাতার পার হয় দুজন দুমুখে যাত্রা করে । 
জংলা মত একটা জায়গায় সে লুকানো সাইকেল নিয়ে রওনা দেয় ।
এমন সময় ঘটে ঘটনাটা । 
আকাশ কাঁপিয়ে বাজখাঁই টাস সসস  শব্দে 
আরেকটা বুলেট এসে মাথা ছিন্নভিন্ন করে দেয় । 
টহলরত বিএসএফ সিপাহী পৈশাচিক আনন্দে গোঁফে তা দেয় ।
তাকে কে বুঝাবে জুয়েল কোন চোরাচালানের সাথে জড়িত নয়, সে ব্ল্যাকদার নয় ।
শুধু মাত্র সুফিয়ার ভালবাসাটুকুই সে চুরে করেছে মাত্র । সে কারো সাতপাঁচেও নেই ।  
মহামারি রোগ যেন তার ভালবাসার মানুষ কলিজার টুকরা মেয়েটাকে ছুঁতে না পারে তার কসুর করেছে শুধু  । 
পাষাণ বিএসএফ সদস্যরা যদি বুঝতো ---একজন স্বামীর বা একজন বাবার হৃদয়ের আকুতি !



সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান