মহাত্মা লালন শাহ  দেহ এবং আত্মার  স্বরূপ উন্মোচনের  চেষ্টা করেছেন -- মুরশাদ সুবহানী
মহাত্মা লালন শাহ  দেহ এবং আত্মার  স্বরূপ  উন্মোচনের  চেষ্টা  করেছেন  --  মুরশাদ সুবহানী

 

  (জন্ম: ১৭৭৪ এবং মৃত্যু: ১৭ অক্টোবর ১৮৯০, ছেঁউরিয়া, কুষ্টিয়া)

                                     -  

লালন শাই বা লালন সাঁই   ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক রহস্যময় কবি এবং  বাঙালি বাউল গীতিকার তিনি এই উপমহাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় বাউল শিল্পী গীতিকার ছিলেন তাঁর বিশ্বাস ছিল   আল্লাহ, এবং অন্যান্য সৃষ্টিকর্মের শক্তির উপর লালন ফকির তাঁর গানগুলিতে    আত্মা দেহের মধ্যে সর্ম্পক  খোঁজার চেষ্টা করছেন তাঁর ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ছিল    তাঁর গানগুলি থেকে সুপারিম পাওয়ার খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন, আধ্যাত্মিক তত্ব দর্শনের মাধ্যমে লালন শাহ  একজন ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন তাঁর গানগুলি অনেক কবিকে অনুপ্রাণিত প্রভাবিত করেছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অ্যালেন গিন্সবার্গ লালন  শাই গানের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন কবি গুরু  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদাহ  থেকে প্রায় কিলোমিটার দূরে ছেউঁরিয়ায  এটি লালন শাহ আখড়া   কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লন্ডনে তাঁর হাভার্ড ইউনিভার্সিটির  ভাষণে ( ১৯৩৩ খ্রী:) প্রথম লালন শাহের প্রশংসা করেন এবং তাঁকে বিশ্ব মাঝে পরিচয় করিয়ে দেন,  'রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন যে এটি সত্য যে আমি আমার অনেক গান নাটকগুলিতে বাউল ( লালন) এর সুরে রচনা করেছি'

লালন শাহ  প্রাথমিক জীবনকাল   আনন্দদায়ক ছিল না কথা সবাই জানেন  তাঁর প্রাথমিক জীবন ছিল দুখময় কয়েকটি সূত্র জানায়, লালন শাহ  মুর্শিদাবাদে হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং অন্যান্য সূত্রে জানা যায় যে, লালন বর্তমানে বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই নিয়ে গবেষক মহলে নানা তর্ক আছে আছে কিংবদন্তী গুজব আমরা এগুলোকে এই লেখা থেকে এড়িয়ে যাবো অধ্যাপক মনসুরউদ্দীন লিখেছেন, লালন জন্ম থেকেই হিন্দু ছিলেন তাঁর মা পদ্মাবতী দেবী নামে পরিচিত ছিলেন পিতার নাম মাধব কিন্ত  লালন নিজে  কখনও তাঁর পরিচয় পরিষ্কার করেননি  তিনি জাতের বিষয়ে জানতে চাইলে গানের মাধ্যমে সেটির উত্তর দিয়েছেন বিষয়টি আমরা এই লেখায়  আলোচনায় আনবো লালন শাহ বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তাঁকে নদী তে ভাসিয়ে দেওয়া হয়

লালন গবেষক  অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের মতে, প্রায় দুই শত  বছর আগে কালিগঙ্গা নদী কূলে ভেসে আসে   ১৬/১৭   বছর বয়সী এক যুবক   হাফেজ   মালম, দেখেন যে ছেলেটির মুখ এবং শরীরে  পক্স- এর  দাগ হাফেজ   মালমের  কোন সন্তান ছিল না তিনি এবং তার চার ভাই তাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যান তিনি  তার স্ত্রী মতিজান লালনের সেবাযতœ করতে থাকেন লালন সুস্থ হলে  তার নাম জিজ্ঞেস করায়  সে উত্তর দেয়, তার নাম লালন

 

লালন শাহ সুস্থ হয়ে তাঁর  নিজ গ্রামে ফিরে যান এবং  অবস্থা বর্ণনা করলে  নিজ সম্প্রদায় তাকে অস্বীকার কারণ সে মুসলমান পরিবারে আশ্রয় নিয়েছে বলে এই কারণে লালনের উপর গবেষণা করেছেন এমন কয়েকজন  গবেষক বলেন, লালন হিন্দু ছিলেন নিজ সম্প্রদায় গ্রাম থেকে ফিরে আসাই ছিল   লালনের টার্নিং পয়েন্ট ফিরে এসে লালন শাহ   কুষ্টিয়া জেলার ছেঁউরিতে  একটি আখড়া  স্থাপন করেন

লালন ফকির একটি গানের দল  প্রতিষ্ঠা করেন  এবং সিরাজ সাঁই  দ্বারা অনুপ্রাণিত হন 

লালন শাহ দর্শন: বাউল  লালন সাঁইয়ের  গানগুলি আধ্যাত্মিক চিন্তার কেউ কেউ মনে করেন,  লালনের গানগুলো হচ্ছেএকিন’(বিশ্বাস) এবং   সুফি ইজম   লালনের গান সুফিবাদের এটি অস্বীকার করেন অনেকেই তারা  বলছেন, ইসলামিক দার্শনিক শব্দ থেকে এসেছে সুফি ইজম লালন শাহ গান  বিশুদ্ধ ইসলামী চিন্তা বিশ্বাসের উপর পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত কথা বলার কোনো সুযোগ নেই

লালন ফকির সব সময়  ধর্মীয় সংঘাতের বিরুদ্ধে ছিলেন তাঁর আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা বিভিন্ন দার্শনিক তত্বের বিশ্বাসের  সাথে যুক্ত তাঁর বাউল গানে  হিন্দু, জৈনবাদী বৌদ্ধ ইসলামী দর্শন  বিশ্বাস এগুলো রয়েছে এর জন্য তার গান শুদ্ধ ইমলামী  সুফি ইজম হিসেবে আমলে নেননি ইসলামিক চিন্তাবিদরা তাদের মতে,  মিশ্র দার্শনিক ধর্ম বিশ্বাস ছিল লালনের

সবাই লালনকে তাঁর ধর্মজাত জানতে চাইলে তিনি  গানের মাধ্যমে তা প্রকাশ করেন ,    সব  লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে লালন কয় জাতের  কী রূপ/ আমি  দেখলাম না দুই নজরে....‘ কেউ মালা কেউ তছবি গলায়, তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়/ যাওয়া কিংবা আসার বেলায়/ জাতের চিহ্ন রয় কার রে......... লালন সে জেতের ফাতা ঘুচিয়াছে সাধ বাজারে’.....   

 

 লালন শাহ কোনো বিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করেননি অ্যাকাডেমিক শিক্ষা তাঁর ছিল না ভাবলে অবাক হতে হয়; তিনি আধ্যাত্মিক   দেহ তত্বের উপর এত সুন্দর গান কিভাবে রচনা করেছেন

আমাদের চারদিকে রকম প্রতিভাবান অনেক মানুষ আছেন, যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, কিন্তু সাহিত্য অঙ্গন, সঙ্গীত-নাটক , চিত্রকলায় যা দিয়েছেন তা তুলনাহীনতাঁরা এই জ্ঞান ঐশ্বরিকভাবে এবং পারিপার্শ্বিক থেকে লাভ করেছেন ফকির বাউল লালন শাহ তাদের একজন

একজন কবি-গীতিকার তাঁর সৃষ্টি কর্ম দিয়ে নিজ আসন করে নেন লালন সাঁই তাঁর সৃষ্টি কর্মে বাউল সম্রাট হয়ে আছেন

 

কাঙাল হরিনাথের নাম জানেন অনেকেই তাঁর আসল নাম হরিনাথ মজুমদার কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালিতে তিনি ১৮৩৩ সালে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি ছিলেন, বাউল সম্রাট লালনের বহু সংখ্যক ভক্তের মধ্যে একজন তিনি শুধু বাউল গানের চর্চাই করতেন না, রাজনীতির  সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল  তিনি   প্রকাশিকা বার্তাপত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত এই পত্রিকায় তিনি বৃটিশ শাসনকালে  গরীব - দুখী মানুষের কথা লিখতেন পত্রিকাটি প্রথমে পাক্ষিক পরবর্তীতে সাপ্তাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় টানা প্রায় ১৮ বছর এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় পরে সরকারের মুদ্রণনীতির কঠোরতার কারণে গ্রামবার্তার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায় তিনি (কাঙাল হরিনাথ) বাউল সম্রাট লালন সাঁইয়ের একনিষ্ঠ ভক্ত-শিষ্য থাকায় তাঁর মাধ্যমে লালন সাঁই সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানা যায়তিনি ছাড়াও অন্যদের কাছ থেকেও লালন সাঁই সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়

মহাত্মা গান্ধীজীর ২৫ বছর আগে লালন শাহ এই উপাধি লাভ করেন :

মহাত্মা গান্ধীর  ২৫ বছর আগে বাউল লালন শাহ  পেয়েছিলেনমহাত্মাউপাধি পাক্ষিক হিতকরীতে তাঁর মৃত্যুর পর ছাপা হয়, ‘লালন ফকিরের নাম পত্রিকাটিতে লেখা হয় অঞ্চলে কাহারও শুনিতে বাকি নাই শুধু অঞ্চলে কেন, পূর্বে চট্টগ্রাম, উত্তরে রংপুর, দক্ষিণে যশোহর এবং পশ্চিমে অনেকদূর পর্যন্ত বঙ্গদেশের ভিন্ন দুই স্থানে বহুসংখ্যক লোক এই লালন ফকিরের শিষ্য; শুনিতে পাই ইহার শিষ্য ১০ হাজারের ওপর ইঁহাকে আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি; আলাপ করিয়া বড়ই প্রীত হইয়াছি

মহাত্মা গান্ধীর ২৫ বছর আগে লালন সাঁইকে মহাত্মা উপাধি দেওয়া হয় কোন  অনুষ্ঠানে তাঁকে এই উপাধি দেওয়া হয়েছিল , তা সঠিকভাবে জানা যায় না তবে ভক্ত-অনুরক্ত শিষ্যরা তাঁকে মহাত্মা বলে অভিহিত করতেন এটাই স্বাভাবিক লালনের সাথে যাঁদের পরিচয় ছিল তাদের মধ্যে কাঙাল হরিনাথ একজন তাঁর সাথে গভীর হৃদিক সম্পর্ক ছিল লালন শাহলালনের গান প্রচারে ছিল তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছাড়া বিশিষ্ট লেখক   মীর মোশাররফ হোসেন, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, জলধর সেনের সঙ্গেও লালনের সম্পর্ক ছিল লালনের ভক্ত-অনুরক্তরাই তাঁকে মহাত্মা হিসেবে বিশ্বাস করতেন  

সঙ্গীতের বিভিন্ন শ্রেণী বিন্যাসে লালন সঙ্গীত :

সঙ্গীতের বিভিন্ন শ্রেণী বিন্যাস আছে ক্ল্যাসিক ( রাগ সঙ্গীত), আধুনিক, ভাটিয়ালী, পল্লীগীতি,

মুর্শিদি, মারফতী, বাউল, গম্ভীরা ,সারি-জারি ইত্যাদি বাউল সঙ্গীত মারফতি সঙ্গীতের ধারায় বিভিন্ন বাউলরা পূর্বে একতারা, দোতারা  বাজিয়ে গাইতেন ,এখনও গান তবে আধুনিক সময়ে নানা সঙ্গীত যন্ত্র এর সাথে যুক্ত করেও গাওয়া হয় মারেফত শব্দের অর্থ জানা জ্ঞান এটি ইসলামী পরিভাষা থেকে এসেছে বাউল গান বিশেষ সুরের মারফতী গান বাউল গানের মধ্যে ইসলাম, হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের অনেক কথা পাওয়া যায় লালন সাঁইয়ের গানে  বিভিন্ন ধর্মতত্বের কথা, দেহতত্বের কথা রয়েছেশ্রেণী বিভাজন না করে মহাত্মা লালনের গানকে বাউল সঙ্গীত হিসেবেই অভিহিত করছি

সব সঙ্গীতের মধ্যে লালন সঙ্গীতের সুর বাণী আমাদের মুগ্ধ করেছে মুগ্ধ হয়েছেন, স্বয়ং কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  হাভার্ড ইউনির্ভাসিটি ভাষণে বিশ্ববাসীর কাছে  লালন শাহ নামে একজন গীতিকার , বাউল গায়ককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন  আধ্যাত্মিক গীতিকার হিসেবে  শুধু তাই নয়, তিনি সর্বপ্রথম লালন গীতি সংগ্রহ করেপ্রবাসীপত্রিকায় প্রকাশ করেন।। লালন গবেষক,অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন তাঁর এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, তখন থেকেই সুধি মহল এই গানের প্রতি আকৃষ্ট হনলালনগীততথা  বাউল গানে কবি  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কত বেশী  আকৃষ্ট হয়েছিলেন তা বোঝাতে গবেষক,অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য উপস্থাপন করে তার উদ্ধৃতি দিয়েছেন-

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘ আমার লেখা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন, বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখা সাক্ষাৎ আলাপ আলোচনা হোত আমার অনেক গানে আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি; এবং অনেক গানে অন্য রাগিনীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেছে এর থেকে বোঝা যাবে , বাউলের সুর বাণী কোন এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে আমার মনে আছে, তখন আমার নবীন বয়স-শিলাইদহে (কুষ্টিয়া) অঞ্চলেরই এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিল,

কোথায় পাব তারে

আমার মনের মানুষ যে রে

হারায়ে সেই মানুষ, তার উদ্দেশ্যে,

দেশ বিদেশে বেড়ায় ঘুরে

এই গানটি লালন শাহের ভাব শিষ্য গগন হরকরার রচনাতার পূর্ণনাম বাউল গগন চন্দ্র দাস তিনি শিলাইদহের বাসিন্দা ছিলেন কথা সবাই জানেন,এই গানের সুরে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান

আমার সোনার বাংলা

আমি তোমায় ভালোবাসি।।

চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস,

আমার প্রাণে বাজায় বাঁশী।।

এই গানের ১০ লাইন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহিত হয়

এই গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করে  কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালন শাহ এবং তাঁর ভাব শিষ্য গগন হরকরাকেই সম্মানিত করা হয়েছে

 

 কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে লালন সাঁই বয়সে অনেক বড় ছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিশোর বয়সের আগেই লালন শাহ আধ্যাত্মিক তত্বের বাউল গান গ্রামেগঞ্জে মানুষের মনে প্রোথিত হয়ে যায় এবং তিনি তাঁর শিষ্যরা বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে গান-বাজনা করে পরিচিতি লাভ করেন লালন শাহ নিরক্ষর ছিলেন তিনি নিজে গানের চরণ লিখতেন না, তাঁর মনে গানের ভাব উদয় হলে শিষ্যদের মধ্যে অনেকে ছিলেন, সেটা লিখতেন অনেকরে নাম জানা যায়  তাদের মধ্যে অন্যতম ফকির মানিক মনিরুদ্দিন শাহ্ বাঁধা গান লিখে নিতেন যদিও লালন শাহ গান লিখতে মানা করতেন, বলতেন   লিখিস না, ছিনায় রাখ্ সব গান লোকে জানলে সারা বিশ্বে হৈচৈ হবে কেউ বুঝবে কেউ বুঝবে নামনিরুদ্দিন শাহ্ লিখে রাখতেন মনিরুদ্দিন নিজ হাতে কয়টা গানের খাতা লিখেছিলেন তার বিস্তারিত তথ্য সঠিকভাবে পাওয়া যায়নি তবে বছর পাঁচেক আগে একটি খাতা কারিকরপাড়ার ফকির আনোয়ার হোসেন ওরফে মন্টু শাহের বাড়িতে পাওয়া যায় বলে লালন গবেষকদের তথ্য মতে জানা যায় অরিজিনাল খাতাটিতে পর পর ৫৯৭টি গান আছে মনিরুদ্দিনের হাতের লেখা পরিচ্ছন্ন এত বড় খাতায় কোথাও তেমন কাটাছাটা ছিল না পাণ্ডুলিপির শেষভাগে আদ্যক্ষরের বরাতে সাজানো আছে ঝকঝকে সূচিপত্র তবে কাঙাল হরিনাথের নাম খুব কম ক্ষেত্রেই গবেষকগণ উল্লেখ করেছেন তিনি একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনিও লালনের গান লিখে রাখতেন বলে জানা যায় 

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ  ঠাকুর পরবর্তী সময়ে লালন শাহ ১২ শত গান  প্রবাসীপত্রিকায় প্রকাশ করে স্থায়িত্ব দিয়েছিলেন এই কারণে হারিয়ে যেতে পারেনি তাঁর অনেক গান কবি গুরু লালন সাঁইয়ের গান প্রকাশ না করলে হয়েতো অনেক শিষ্য গুলো তাঁদের নামে চালিয়ে দিতেন

উনিশ বিশ শতকের প্রথামার্থে বাউল মতবাদের বিকাশ ঘটেএই মতবাদের প্রবক্তাদের অন্যতম মহাত্মা লালন সাঁই বহু সংখ্যক মানুষ এই মতবাদের প্রতি আকৃষ্টি হন আধ্যাত্মিক তত্বের ধারণায় আধ্যাত্মিক তত্বকে আমি দুই ভাগে দেখি- একটি হচ্ছে মারেফাত এবং আর একটি হলো বাতেনি তত্ব বাতেনি তত্বের ভেদ একমাত্র আল্লাহ রাছুল (.)ছাড়া আর কেউ জ্ঞাত ননমারেফাত  হলো জাহিরি তত্ব, এই তত্ব নানা জন নানাভাবে বিবৃত করেছেন লালন সাঁইয়ের আধ্যাত্মিক তত্ব দেহ আত্মার সাথে সম্পর্কিত   তিনি বাতেনি তত্বকেও প্রকাশ করতে চেয়েছেন তাঁর বাউল গানের মাধ্যমে এসবকে   সুফি ইজম বলে ধারণা করেন অনেকে বিশিষ্ট   ইসলামী চিন্তাবিদ, পন্ডিত ব্যক্তিত্ব জনাব  আবদুল মান্নান মুন্সী  সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর বিবেচনা পুন: বিবেচনা গ্রণ্হে   বাউল তত্বকে   বিশুদ্ধ সুফি ইজম বলেননি

মুসলমান হিন্দু শাস্ত্রের অনেক বিশারদও লালনগীতিকে গান হিসেবে দেখেছেন, আধ্যাত্মিক মতবাদ হিসেবে নয় লালন সাঁইয়ের বাউল গান বিরোধী ঘোষণা দিয়েছেন, মাওলানা রেয়াজ উদ্দিন আহমেদ ১৯২৬ সালে তিনি বলেছেন,‘ আজ বাঙালার ৬০/৭০ লক্ষ অশিক্ষিত মুসলমান , বাউল ফকিরের মারফতি ধোঁকায় পড়িয়া পবিত্র ইসলাম পরিত্যাগ পূর্বক তাহাদের দলে সামিল হইয়া গিয়াছেএই ৬০/৭০ লক্ষ বাউল ফকিরগণকে প্রকাশ্যভাবে পরিচয় করা যায় কিন্তু আরও এমন বহু সংখ্যক বাউল মত পোষণ কারী ব্যক্তি আছে, যাহাদিগকে প্রকাশ্যভাবে পরিচয় করা সুকঠিন এই উভয় প্রকার প্রত্যক্ষ অপ্রত্যক্ষৃ..মুসলমান বাউলদের সঙ্গে হিন্দু বাউলদের সংখ্যা যোগ করলে সময়  অন্তত: এক কোটি জনতা বাউল ভাবাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল তা নি:সন্দেহে বলা যায়ৃৃ.কিন্তু বাউল মতবাদ বিনা বাধায় সহজে এরূপ প্রসার লাভ করেনিমুসলমান হিন্দু সমাজের একাংশ মতবাদ প্রচারে বাউলদের বাধা প্রদান করে(রেয়াজ উদ্দীন আহমদ, বাউল ধ্বংস ফতওয়া পৃ: ৬১) লালন শাহ শিষ্যদের একজন দুদ্দু শাহেরলালনজীবনীবিষয়ক পুঁথিতে এই সম্পর্কে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে-

নানা দেশ তে শেষে আসে নানাজন

তর্ক করিতে কেহ করে আগমন।।

চক্কর ফক্কর আর মানিক মলম

কোরবান, মনিরুদ্দিন আসে কতজন

ৃৃৃকোরবান আলী ছিলেন পাবনা জেলার অধিবাসীপাবনা জেলার রাধানগর গ্রামেপূর্বোক্ত তোফাজ্জল হোছেনের সঙ্গে লালন শাহ ধর্মীয় বাহাছ ( বিতর্ক)হয় . এস. এম লুৎফর রহমানের ভাষ্য মতে,সকল স্থানেই লালন জয়লাভ করেন এবং বাউল মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন

বাউল সাধক, মহাত্মা লালন সাঁইয়ের জীবনাচরণ রহস্যময়: তিনি জাত-কূলের চেয়ে আধ্যাত্মিক তত্বে গানের প্রতি ছিলেন মনোযোগী এই কারণে বাউল গানের জগতে তিনি শ্রেষ্ঠ আসনে আসীন হয়ে আছেন তাঁর সম্পর্কে কিছু সঠিক তথ্য, কিছু কল্প-কাহিনী মিশ্রিত তথ্য আছে নিজে যেহেতু কিছু বলতেন না, সে কারণে তাঁর ভক্তরাও হয়তো তেমন কিছু বলেননি সঙ্গীত সাধনাই ছিল তাঁর মুখ্য কাজএই আলোচনায় আমরা কল্প-কাহিনীকে বর্জন করার চেষ্টা করেছি নারী- পুরুষ মিলিয়ে তাঁর অসংখ্য ভক্ত ছিল,েএখনও আছে

 প্রারাম্ভে আমরা লালন শাহ গানকে কেউ কেউ সুফি ইজম বলেছনে আমরা ইজম সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করেছি এপার এবং অপার বাংলায় বাউলরা এখনও তাঁর গান গাইছেনমহাত্মা লালন শাহ জন্ম মৃত্যু দিনে কুষ্টিয়া জেলায় তাঁর আখড়ায় মেলা হয়বাউল এবং অন্যান্য শিল্পী তাঁর গান গেয়ে আমাদের শুধু মুগ্ধ করেন না, তাঁকে বাঙালীর প্রাণের মাঝে বাঁচিয়ে রাখেন 

 

লালন সাঁই সিরাজ সাঁই নিয়ে গবেষকগণ দ্বিধাবিভক্ত:

      মহাত্মা লালন সাঁইয়ের গুরু ছিলেন, সিরাজ শাহ, তিনি সিরাজ সাঁই নামেও পরিচিত সিরাজ শাহ্ সম্পর্কে সামান্য ধারণা পাওয়া যায় কোনো কোনো গবেষক তাঁর অস্তিত্বই অস্বীকার করেছেন তাদের মতে, সিরাজ শাহ নামে কেউ ছিলেন না এটা কাল্পনিক এই লেখায় আমরা লালন শাহ, সিরাজ শাহকে নিয়ে রচিত বিভিন্ন কল্প-কাহিনী, কিংবদন্তীকে এড়িয়ে যেতে চাই কল্পনা প্রসূত বিষয় ইতিহাস এবং গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে না কল্পনায় কবিতা রচনা করা যায়, কোনো ব্যক্তির জীবন নিয়ে লেখা যায় না

সিরাজ সাঁইয়ের কোনো অস্তিত্বই নেই এই মতবাদীদের সাথে আমরা দ্বিমত পোষণ করি লালন শাহ অনেক গানে সিরাজ সাঁইয়ের নাম এসেছেএটাই প্রতিষ্ঠিত করে সিরাজ সাঁই নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন তিনি লালন শাহ ধর্ম পিতা ছিলেন পাল্কী চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেনলালন শাহ তাঁর ঘরে প্রতিপালিত হয়েছেন মহাত্মা লালন শাহ যদি তাঁর ঘরে প্রতিপালিত হন, তাহলে লালন গবেষক   অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের   হাফেজ মলম বসন্ত রোগে আক্রান্ত  লালনকে কালিগঙ্গা নদীর ঘাট থেকে উদ্ধার করে তার গৃহে আশ্রয় দিয়ে প্রতিপালন করেন এই তথ্যের কোনো ভিত্তি থাকে না লালন শাহকে নিয়ে  গবেষণা করতে  যারা গেছেন, তাদের অনেকেই লালন সিরাজ শাহ-এর মৃত্যুর অনেক পরে যাওয়ায় অনেক তথ্য  জনশ্রুতি থেকে  পেয়েছেন সিরাজ সাঁই সম্পর্কে খুব গভীরভাবে গবেষণা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি কেউ কেউ আবার করলেও লোকের জানা তথ্য ছাড়া  কোন সঠিক তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে পারেননি লালন শাহ এবং সিরাজ সাঁই দুজনের জীবনই রহস্যাবৃত্ত লালন শাহ নিজের সাধানায় নিমগ্ন থেকেছেন দল নিয়ে ফকিরী বাউল গান করতে বেড়িয়েছেন আবার ফিরেছেন ছেঁউরিতে নিজ আখড়ায় মহাত্মা লালন শাহ অনেক গানেই সিরাজ সাঁইয়ের নাম উঠে এসেছে তিনি তাঁকে গুরু হিসেবে মান্য করতেন লালন শাহ একটি গান :

আশেকে গঠল বিহারী

জ্ঞানের বাতি শীঘ্র গড়ি

জ্বালাও অতি

তাড়াতাড়ি৷৷

......................

চন্দ্রবানকে করলে সাধন

পানা দিবেন সাঁই নিরাঞ্জন

সিরাজ সাঁই কয় শোনরে লালন

সামান্যে কি হয় ফকিরি

মহাত্মা লালন শাহ এই রকম অনেক গানেই সিরাজ সাঁইয়ের নাম পাওয়া যায় বাউল সম্রাট লালন শাহ নিজে যখন সিরাজ সাঁইয়ের অস্তিত্বের কথা বলছেন, সেক্ষেত্রে সিরাজ সাঁইয়ের কোনো অস্তিত্ব নেই কথা আর মেনে নেওয়া যায় না

লালন গবেষক . এস.এম লুৎফর রহমান অপর গবেষক জনাব মুহম্মাদ মনসুর উদ্দিনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, তিনি সিরাজ সাঁইয়ের ঠিকানা জনাতে গিয়ে লিখেছেন ,‘ সিরাজ শাহ নদীয়া জেলার হরিনারাণপুর (হরিনারায়ণপুর) গ্রামের একজন পাল্কী বাহক ছিলেন

 আমরা জানি ভারতের  নদীয় জেলা বাংলাদেশের  কুষ্টিয়া জেলার নিকটবর্তী লালন গবেষক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য় . মুহম্মাদ মনসুর  উদ্দিনের এই তথ্যের প্রতিবাদ করে বলেছেন, ‘ তাঁর (উপেন্দ্রনাথের)বাড়ী হরিনারায়ণপুর গ্রামে গ্রামে লালন গুরু সিরাজ সাঁই বলিয়া কোন পাল্কী বাহক ছিলৃ.. তাহা তিনি কোন দিন শোনেন নাইঅপরদিকে   কুষ্টিয়ার কুমারখালীর  বাসিন্দা ভোলানাথ মজুমদার বলেছেন, ‘ লালন গুরু সিরাজ সাঁইয়ের বাড়ী ফরিদপুর জেলার কালুখালী স্টেশনের নিকটে কোন গ্রামেতিনি সুনিদির্ষ্ট করে গ্রামের নাম বলতে পারেননি গুলোকে আমরা নানা মুনির নানা মত হিসেবেই মনে করছি

 

 

   একাধিক ভাষাবিদ , ইতিহাস-সচেতন (মরহুম) মৌলভী ওয়ালীর ভাষ্য মতে,   সিরাজ শাহ এবং লালন শাহ একই গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন

In his language, 'Both were born at the village Horishpur, Sub-division Jhenedah, District Jessore.'

'

তাঁর এই তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায় , লালন শাহের একজন শিষ্য দুদ্দু শাহ লেখায়-

তিনি লিখেছেন, ‘ কুলবাড়ী হরিশপুর সিরাজ শা বাস

পাল্কি টানিয়া করে জীবিকার অন্বাষ 

আমরা তার্কিক বিতর্কে যেতে চাচ্ছি না আর সিরাজ সাঁই আমাদের লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় নয় সিরাজ সাঁই ছিলেন, লালন শাহ তাঁর গানে নিজেই এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন

সাধক মরমী এবং আধ্যাত্মিক তত্বের বাউল সম্রাট লালন শাহ দেহ আত্মার মধ্যে  যোগ সূত্র স্থাপন করার শুধু চেষ্টাই করেননি, তিনি মারফতি বাতেনি তত্বে জানার চেষ্টাও করেছেন বাউল কবি লালন শাহ গান:-

         খাঁচার ভিতর অচিন পাখি

     

         কেমনে আসে যায়

         ধরতে পারলে মনবেড়ি

         দিতাম পাখির পায়

         আটকুঠরী নয় দরজা আঁটা

        তার মধ্যে ঝরকা কাঁটা

        ৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃ

        খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার

        কোন বনে পালায়

        ৃৃৃৃৃৃৃৃ

অচিন পাখি বলতে আত্মাকে বুঝানো হয়েছে এই আত্মা কেমন বুকের মধ্যে আসে এবং চলে যায়

মানুষের জীবন এবং মৃত্যু নিয়ে তত্ব কথা লালন বলছেন, এই আত্মাকে যদি তিনি ধরতে পারতেন তাহলে তার পায়ে বেড়ি দিতেন, যাতে আত্মা আর চলে যেতে না পারে

 কিন্তু তা কি সম্ভব? সম্ভব নয় তাই লালন সাঁই বললেন, খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার কোন বনে পালায় দেহ আত্মার মধ্যে সম্মিলন হলো, যা ক্ষণিকের একদিন এই আত্মা চলে যাবেঅর্থাৎ মানুষ মারা যাবে এখানে বলে রাখা ভাল শুধু মানুষ নয়, যার জীবন আছে তার মৃত্যু আছে

 

 

বাউল সাধক লালন সাঁই গেয়েছেন,

আমার ঘর ঘরখানায় কে বিরাজে করে

আমি জনম রে একদিন না দেখলাম তারে

নড়েচড়ে ঈশান কোণে

দেখতে পাইনে দুই নয়নে,

ৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃ.

বাঞ্ছা করি পরকে চেনা,

লালন বলে, পর বলতে পরওয়ার,

আমি কি রূপ, সে কিরুপ ওরে

বাউল লালন সাঁইয়ের এই গানটিও দেহতত্বের আমি আগেই বলেছি, এলমে মারফত হলো জানা তত্বের একটি বিষয় এই তত্বের মাধ্যমে লালন সাঁই বাতেনি ভেদতত্ব জানার ইচ্ছা করেছেন তিনি বলছেন, তাঁর ঘরে অর্থা দেহের মধ্যে কে বিরাজমান ? এখানে সৃষ্টিকর্তার অবস্থানকেই বোধ করি বুঝাতে চেয়েছেন লালন সাঁই তাঁর দেহ-ঘরে বিরাজমান আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছেন না কিন্তু উপলব্ধি করছেন তত্ব জ্ঞানে তাঁর অস্তিত্ব লালনের জিঞ্জাসা, লালন কি রূপের আর সৃষ্টিকর্তার রূপ বাউল লালন সাঁই আর একটি গানে বললেন,

  বেদ-বেদান্ত পড়বি যত

   বাড়বে রে তোর লগনা

আপন খবর আপনার হয় না

এখানে লগন অর্থে লগনা বলেছেন বেদ- বেদান্ত পড়লে বাড়বে লগনা অর্থাৎ দৈবানুকূল্যে}

 

লালন সাঁই গাইলেন,

বাড়ির কাছে আরশী নগর

(একঘর) সেথা পড়শী বসত করে-

আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।।

গেরাম বেড়ে অগাধ পানি

নাই কিনারা নাই তরণী পারে,

বাঞ্ছা করি দেখব তারে

ৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃ..

 

ক্ষণেক থাকে শূণ্যের উপর

(ওসে) ক্ষণেক ভাসে নীরে।।

পড়শী যদি আমায় ছুঁতো,

যম যাতনা সকল যেতো দূরে

সে আর লালন একখানে রয়-

তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে

মহাত্মা লালন সাঁইয়ের এই গানটিও মারফতি তত্বের এই তত্বের মধ্য দিয়ে তিনি বাতেনি তত্ব ভেদ জানার চেষ্টা করেছেন  নানা বিদগ্ধ জন নানাভাবে এই গানের ব্যাখা করেছেন আমরা খুব সহজ করে এই গানের আলোচনা করতে চাই এটি এলমে  মারেফত দর্শনের  এবং মনের ভাব জগতের কাব্যগীতির মাধ্যমে তিনি আধ্যাত্মিক এক নিগুঢ় তত্বের কথা ব্যক্ত করেছেন এবং বাতেনী তত্বের ভেদ জানার চেষ্টা করেছেন, সাধক লালন শাহ এই গানের তাত্বিক দিক হলো : লালন সাঁই বলছেন বাড়ীর কাছে আরশী নগর সেখানে পড়শী বসত করে   এই পড়শী বলতে তিনি সৃস্টিকর্তাকে বুঝাতে চেয়েছেন কিন্তু লালন শাহ একদিনও তার দেখা পাননিক্ষণেক থাকে শুন্যের উপর ক্ষণেক ভাসে নীরেঅর্থাৎ পানিতে আয়তাল কুরশীতেআল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের আসন সম্পর্কে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘আসমান এবং পৃথিবীব্যাপী আল্লাহর কুরশী (আসন)আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন সর্বত্র বিরাজমান লালন আরশী নগরের সেই পড়শী আল্লাহ দর্শন লাভের চেষ্টা করেছেন, তাঁর গানের মধ্য দিয়ে

 

নুহ নবীর আমলে প্লাবনের কথা স্মরণ করে  লালন শাহ গাইলেন,

 এলাহি আলামিন গো আল্লা বাদশা আলমপানা তুমি

ডুবায়ে ভাসাইতে পার, ভাসায়ে কিনার দাও কার

রাখ মার হাত তোমার, তাইতে তোমায় ডাকি আমি ।।

নুহ নামরে এক নবীরে ভাসালে অকূল পাথারে

আবার তারে মেহের করে আপনি লাগাও কিনারে

জাহের  আছে ত্রিসংসারে আমায় দয়া কর স্বামী ।।

নিজাম নামে বাটপার সেত, পাপেতে ডুবিয়া রইত

তার মনে সুমতি দিলে, কুমতি তার গেল চলে

আউলিয়া  নাম খাতায় লিখলে জানা গেল এই রহমি ।।

নবী না মানে যারা, মোয়াহেদ কাফের তারা

সইে মোয়াহদে দায়মাল হবে বেহিসাব দোজখে যাবে

আবার তারা খালাস পাবে, লালন কয় মোর কি হয় জানি ।।

লালন শাহ  নুহ নবী সম্পর্কে বলেছেন এটি জাহেরী তত্বের একটি মারফতি গান  পবিত্র কোরআনে নুহ নবী প্লাবন সর্ম্পকে বর্ণিত হয়েছে  পবিত্র বাইবেলেও এই বিষয়টি এসেছে  একটু ভিন্নভাবে তবে হিন্দুশাস্ত্রীয় গ্রন্হে সম্পর্কে কোনো তথ্য আছে কিনা আমার জানা নেই(এটা আমার অক্ষমতা) লালনের রচনা সুর করা এই গানের গীতিকাব্যে যে শব্দ এসেছে, সেগুলোর অর্থ আলোচনার দাবি রাখে এলাহী-যার কোন ইলাহ নেই, লা-শরিক আল আমিন অর্থ-সত্য মোয়াহেদ মানে হলো-যারা পরমে বিশ্বাস করেন নাকাফেরের বিস্তৃত অর্থ আছে সহজ মানে হলো-যারা সত্যকে গোপন করে রাখে প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো- কাউকে হঠাৎ করে কাফের বলা আল্লাহ রাছুল(:) নিষেধ করেছেন কোনো গুরু গম্ভীর আলোচনা করে আমরা আমাদের পান্ডিত্য প্রকাশ করতে চাই না  কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কথা বিশ্বাস করিযাহা লোকে বোঝে না , তাহা কোনো সাহিত্য নহেপ্রবন্ধ বা কবিতা সাহিত্যেরই শাখা   ক্ষেত্রেও এই কথাটি প্রযোজ্য বটে

এবার লালন শাহ এই গানের সম্যক আলোচনায় আসি- তিনি নুহ(:) সময়ে প্লাবনের কথা স্মরণ করেই বলেছেন, ‘এলাহি আলামিন গো আল্লা বাদশা আলমপানা তুমি

ডুবায়ে ভাসাইতে পার, ভাসায়ে কিনার দাও কার

রাখ মার হাত তোমার, তাইতে তোমায় ডাকি আমি ।।

লালন সাঁই বলছেন, এলাহী  তিনিএই জগতের বাদশা ইচ্ছা করলে কাউকে ডুবিয়ে দিতে পারেন, আবার দয়া করে ডুবন্ত কাউকে তুলে আনতে পারেন এরপর তিনি নুহ নবী সম্পর্কে বলছেন, তাঁকে অকূল পাথারে ভাসিয়ে আবারমেহের’(দয়া)  করে তাঁকে কিনারে আনা হলো মরা, বাঁচাতাঁর’ (সৃষ্টিকর্তার হাতে) লালন বলছেন, এই বিষয়টি জাহের আছে ত্রিসংসারে সঠিক কথা , আগেই বলেছি এটা মারেফাত তত্ব(জাহেরী তত্বযা প্রচার করা হয়েছে আমাদের জানার জন্য) তিনি নিজাম নামে একজনকে বাটপার উল্লেখ করে বলেছেন, তাকে সুমতি (হেদায়া দিলে), সে কুপথ ত্যাগ করে সুপথে এলো এবং একজন আউলিয়া (দরবেশ)হয়ে গেলেন তথ্যটিও সবার মধ্যে প্রচারিত আছে মোয়াহেদ(এই শব্দের অর্থ হলো- যারা পরমে বিশ্বাস করেন না) এবং কাফের(সত্য গোপনকারী) যারা দোজখে যাবেন আবার সৃষ্টিকর্তা তাদের ক্ষমা করে দিলে তারা বেহশত বা স্বর্গে যাবেন লালন সাঁইয়ের নিজের চিন্তা –‘আবার তারা খালাস পাবে, লালন কয় মোর কি হয় জানি ।।

মহাত্মা লালন সাঁই চেষ্টা করেছেন, দেহ আত্মার মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করার তিনি জাহেরী তত্বের মধ্য দিয়ে জানার চেষ্টা করেছেন, বাতেনী তত্ব কথা তিনি দেহ আত্মার মধ্যে যোগ সূত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন লালন সাঁই-এর দর্শন তত্ব  বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে এখনো তাঁকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে এখানেই মহাত্মা লালন সাঁই সার্থক এবং তাঁকে আধ্যাত্মিক তত্বে বাউল তত্বের যুগ স্রষ্টা বলে অবহিত করলে অত্যুক্তি হবে না আর আধ্যাত্মিক তত্ব হলো শৃংখলার নাম ১৭ অক্টোবর লালন সাঁইয়ের মৃত্যু বার্ষিকী , তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

(উৎস সূত্র : লেখার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে)


 

(লেখক : সাহিত্যের সেবক   অ্যাডভোকেট জজকোর্ট,পাবনা)


 

 

 


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান