মিন্টু সারেং এর গুচ্ছকবিতা
মিন্টু সারেং এর গুচ্ছকবিতা

পরিত্যাক্ত শরীর

 

যখন বারডেম হিমাগারে

আমার লাশ পড়ে থাকবে

তখন কান্নার জন্যে

এক ফোটা জল খোঁজে পাবেনা

 

তোমার কোমল হাত সেদিন

আমার হিম শীতল নিষ্প্রান দেহটাকে

বার বার এড়িয়ে যাবে

মরে যাওয়া স্বপ্নের মতো

 

এমন সময় তোমার গোলাপি ঠোঁট

বরফাক্রান্ত শীতার্ত জিহ্বা  ভিজিয়ে নেবে

তুমি আশাহত মেঘের শরৎ বৃষ্টি  ভেবে

বার বার মুখে মাখবে কালো গোলাপ

 

তোমার অস্থিরতা ভনিতার বিনোদন হবে

হিম শীতল নিস্তব্ধ রাত ডাহুকী  কন্নায়

মনে পড়বে চাঁদনী রাতে হাতে হাত রেখে

হেঁটে যাওয়া ভরাকাটাল অন্ধকার পথে

 

তবু তুমি নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছো কুর্পর  লোবানে আতরের গন্ধ মাখা

পরিত্যাক্ত শরীর।আসা যাওয়া মানুষের

বিবর্ণ সবুজ মানচিত্রে লাল রক্তিম ঘুমন্ত চোখে।

একাকাশ অনন্ত সীমায়, তোমারই গান গাই

 

উঠেছে অরুন্ধুতি আকাশ জুড়ে ভোরে,কুয়াশা কেটে আলোক রশ্নি

কদম ফোটা ছোঁয়া,জলজ মাঠ জুড়ে

কলমি লতার ফাঁকে,ডাহুক ছানা ছুটে,

চোখা-চোখি বেঁধেছে বাসা নুয়ে পড়া ঋুজ্জু শাখে

 

চর্যাগীতির চরন বাজে, আমাদের মায়াবী সুরেলা রাগে

তান পুরায়, সময় কাটে সুরের নগ্ন পায়ে হেঁটে,

পড়ন্ত বেলায় সন্ধ্যারতী, কীর্তন অবেলা,

কে আজ আরতী থামায়, পুজারি খেলা।

 

একাকাশ অনন্ত সীমায়, তোমারই গান গাই,

তোমার ঐশী ছুটে আসে মহাকাল  প্রান্তর থেকে

কখনো ভেবেছো বিস্ময়, উদয়স্ত আষাঢ় লগ্নে,

কে কখোন কোথায় যাবে?

যদি বাঁশি বাজে!

 

এই তুমি গড়েছো মুরতি, মানুষকে মানুষের করে,

আজ তুমি হয়ে গেছো অবিশ্বাস,মানুষের বিশ্বাস

নিয়েছো কেড়ে,তুমি কি করেছো খোদাই, তোমাকে,

অলৌকিক পাহাড়ের গায়ে, ফেলেছো নিঃশ্বাস

এই চারপাশে ঘিরে থাকা আপন স্বজনের ঘাড়ে।

 


জীবনের চিহ্ন বুঝি এভাবেই মুছে যায়,ঠাকুর?

(রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর তোমার জন্মদিন, ১৪২৪)


 

আজ রবী ঠাকুরের জন্মদিন

ঠাকুর ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ,ছিল সেবা দাস,ছিল অনেক দাসী,আর ছিল  বাঁশি,

কাজের লোক,আর ছিল স্বজনের ভরা মজলিস।

 

আমার বলতে, আমাদের তেমন কেউ ছিলনা না,

ভাবনার পানশিতে' জল পড়ে পাতা নড়ে' তাও ছিল না,

অষ্ট প্রহর কষ্টে কাটা, নুন আনতে আমাদের পান্তা পুরাতো, বাবা কোন এক সরকারি অফিসের কেরানি,

আমাদের কোন দাসিও ছিল না,

মা'ছিলেন আমাদের দাস এবং দাসি,

আট ভাই বোন জন্মদিয়েছেন,আর জীবনভর খেটেছেন

কত রাত কেটেছে' মা' নামক এই দাসীর উপোস করে।

 

আজ ভাবনার বায়োস্কোপ, তার টেনে আনা ফিতায়

সে দিন গুলির কত ছবি ভাসমান,দিব্য দৃষ্টির নিমগ্নতায়,

রবী ঠাকুর আমার গুলু আপনার সাথে কোন মিল নেই

আমাকে মার্জনা করবেন,আপনার মতো অতো বড় মানুষের সাথে, এই অভাজনের জীবন মেলাবার জন্যে।

 

কত রাত আমি আপনাকে পাঠ করেছি

আত্মীয় জীবন বোধে, আমি আমাকে খুঁজে পাইনি

দু: কষ্টের সাথে অনেক মিল খুঁজেছি

আপনার দুঃখ বেদনা আমার সাথে মেশেনি,

আপনার আবেগি বিলাস,ঈশ্বর চন্দ্রের ' দুঃখ' বিলাসের

মতো নয়,কেমন যেন আয়েসি জীবনের পরিহাস,

আপনি গ্রাম্য জীবন নিয়ে ভেবেছেন,

কলকাতার নগরাজ, আপনি পদ্মায় ভেসেছেন,

সোনার তরীতে বসে,

আপনি লালন কে নিয়েছেন,নিজকে জাত চেনানোর জন্যে,লালনের সুর নিয়েছেন,হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ,

আমি সেই রয়ে গেলাম, একান্তই দীন নাথ।

 

আপনার সাথে আমি কেবল অমিল খুঁজি

কারন আমাদের বেদনা, হাসি-আনন্দ আমাদেরই বুঝি

আমার সোনার বাংলা,আমি এখনো ভালবাসি।

 

আমাদের চিত্রানদী নেই,মরে গেছে অনেক আগেই,

আমাদের তিস্তাও আজ মৃত প্রায়

জীবনের চিহ্ন বুঝি এভাবেই মুছে যায়, ঠাকুর?

 


প্রিয়তি-----৩১

( একটু ভাবিস)

 

প্রিয়তি,

জলের সূত্র ধরে ছোট বেলায় আর্কিমিডিসকে চিনেছি,আজ মধ্য বয়েসে এসেও প্রেমের সূত্র বুঝিনি,কতটুকু

প্রেম দিলে কতটুকু ভালবাসা উপচিয়ে পড়বে,কতটা জায়গা

দখল করবে,হৃদয়ের পাত্রটাতে?

 

তুই কি বুঝতে পারিস, প্রিয়তি।

 

কখনো মেপে দেখেছিস,

আমি তোকে কতটা প্রেম দিয়েছি,

হৃদয়ের পাত্র থেকে, ঠিক সময়ে কতটুকু ভালবাসা

হ্যাঁ প্রিয়তি, কতটুকু ভালবাসা উপছে পড়ে ছিল?

তোর কি জানা আাছে?

 

প্রিয়তি,

আর্কিমিডিসের বস্তুুর জায়গা দখলের

সেই জলের পাত্রের সূত্রটি

এতদিন পরে, কেন মনে পড়লো একটু ভাবিস।

 

 

প্রিয়তমা স্বদেশ, তুমি বলো আরেকবার

 


 

আজ আর নদী নেই এখানে এখন, নদী হারিয়েছে যৌবন, বিগত নারীর মতো, জোয়ার আসেনা এখন ডাকেনা প্রেমের বান।

এইতো সেদিন তোমাকে নিয়ে পাল তোলা নৌকায় কেটেছে আমার সময়,

তুমি যেন নদী, এখন গিয়েছো মরে,

বান আসেনা, না কোন যৌবন জোয়ার।

 

এই হলো আমাদের হত্যার মহোৎসব,

নদী নয় প্রতিনিয়ত প্রিয় নারীকে, জীবন প্রকৃতিকে

খুনের পরিবেশ পরিচিতিকে কেমন করে,

অনেক বিবেক মানুষের মানচিত্র মুছে শুধু

আত্মার বিনাশে নেমেছে, আমাদের দৃশ্যমান অনুভুতি।

 

তুমি আমি সকলে কি এক বিরাগে

নিজেকে করছি বিনাশ,সমতার অন্তরালে

চলমান দস্যুতা, বন-পাহাড়-জল-জঙ্গলে

আধিয়ারা রাত্রীর অন্ধ অমাবস্যায় ঘিরেছে

আর কত বাকি আঁধার সমাবেশ

ডেকেছি গ্রহে শ্যামলী সর্বনাশ।

 

নদী -জল-জঙ্গল-বন-বনানী, প্রিয় নয় কার

প্রিয়তমা স্বদেশ তুমি বলো আরেকবার।

 


আরেক বার তোমার হাতটি ধরে দাঁড়াতে চাই


 

যখন মাটিতে প্রথম দাঁড়ালাম

আজ মনে পড়ে না কার হাত ধরেছিলাম

আমি যখন হাটতে শিখলাম,মনে পড়ছেনা

কে আমাকে বলে ছিল হাটো

কে সে হাত বাড়িয়ে ছিল, কে সাহস দিয়েছিল,

আজ আমার মনে পড়ছেনা,কার বাড়ানো হাতে,

আমি আমার প্রথম কদম রাখলাম,

কিছুই এখন আর বলতে পারছিনা,

তবে কেউ একজন আমার প্রথম কদমটি দিয়ে

পৃথিবীর বুকে আমার পথ চলা সুগম করেছেন,

আজ তাকে আমার আনন্তরিক অভিবাদন।

পৃথিবীর পথে হেঁটে

পা পা করে

আজ আমি বিশ্ব পরিব্রাজক,

হাটতে হাটতে খোলা চোখে দখেছি,

রূপ-রস-গন্ধ ভরা,চারপাশ,দেখেছি সমুদ্র-নদী,

পাহাড় -বন- বনানি,মানুষের বেঁচে থাকার অপার

রহস্যময় শস্য ভান্ডার,দিগন্ত জোড়া ফসলের প্রান্তর।

আমি আজ হাটতে ভুলে গেছি,

চার পাশে লোভ-লালসা-বিত্ত্বের বৈভবে

চলছে লুটের মহাকাল,হিংসা,প্রতি- হিংসার, জিগাংসা

মানুষের মৃত্যু আজ কেনা বেচা করার জমাট ব্যাবসা

আজ পৃথিবীর পথে হাটা আমি বড় শংকিত,

কখোন ঘাতক মৃত্যু দেয় হানা,

আমার বেড়ে উঠা শহর নগর আজ বড় একা

লাল গোলাপের মতো এখন আর পুস্প বৃষ্টি হয়না

হায়নার আস্তিনে গুজানে আছে ছুরি,চাপাতি,

আগ্নেয়াস্র-বোমা,বা নি:শব্দ খুনী হাত,

অথবা গুম করে পুঁতে ফেলার বিকৃত দুর্বৃত্ত্বপনা।

আজ আমার হাটার পা অসাড় মুর্ত্যমান পৃথিবীতে,নিঃশব্দে হানা দিয়েছে করোনা,

আজ আমি পথ হাটি না

মানুষের মানচিত্র পড়ি ঘটমান দু:সময়ের রাতে।

কে আমাকে হাটতে শিখিয়েছে, প্রথম কদম ফেলার

যুগিয়েছে সাহস,আজ আমি তাকে খুঁজি,

আরেকবার আমাকে সাহস দাও দৃপ্তপায়ে হেটে যাওয়ার

কোথায় আমার সেই স্বজন,

আসো আরেকবার আমি তোমার হাতটি ধরি,

আরেক বার দাঁড়াতে চাই

দু:সময়ের পৃথিবীতে সাহসী পথ চলার।

অনাবৃত


 

চিত্ত যখন অনাবৃত,তখন প্রেমে কি হবে পোশাক পরিধান, ভালবাসায় অনাদৃত শারীরিক কাম চলুক অন্তর্যামী। মুঠোয় থাকুক মিনার সম মানবিক স্থাপত্য,

শোভিত নিম্নগামী ঝর্নার গোলাপ পাপড়ি। ঝিনুক নিয়ে

যখন খেলায় মত্ত মধ্যমা,জলসিক্ত রসায়ন শারীরবৃত্তের একটি উপনিষদের মাঝে রসাল ঘ্রান। 

 

আজ এই বদ্ধ উন্মাদ সময় কি করে কাটাই আবদ্ধ নীড়ে,

বনশ্রী তোমার অনিন্দ্য লেকে

আজ আমার ডুবতে স্বাদ জাগে, বড় বেশি স্পর্শ কাতর

কেমন প্রেম জাগে।

 

পাড়ের ঢাল বেয়ে আমিতো

নেমে যাচ্ছি ক্রমশ ঝর্ণাধারায়

এবার যে আমাকে নাইতে হবে

বনশ্রী তোমার অনিন্দ্য লেকে।

সুর তোলা গানে তাল যন্ত্রে

তোমার ছন্দপাত হোক, আমার শারীরিক কাম চলুক বজ্রাঘাতে,ভালবাসা আজ অনাবৃত, প্রেমে কি পোশাক মানাবে?

 

অতিক্রান্ত নিপাট রতিদেবী ভেনাসের রতিপ্রাসাদ থেকে শুরু হোক স্বস্তি, তোমার আমার মনে বয়ে যাক ঝড়

আনন্দ নদী।ভেসে যাই অসুস্থ

কালে, ধরণী, ওরে শুনি কু-ঝিকঝিক  ঝাঁকুনি।

 

কি পোশাক পরাবে প্রেমে

ভালবাসা থাক অনাবৃত, রাতে খেলে জোছনার লুটোপুটি তাও দেখেনি কৃষ্ণে।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান