সিদ্ধার্থ সিংহ  এর গল্প
সিদ্ধার্থ সিংহ  এর গল্প

লেখক : সিদ্ধার্থ সিংহ 

২০১২ সালের 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। ১৯৬৪ সালে।  ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় 'দেশ' পত্রিকায়। প্রথম ছড়া 'শুকতারা'য়।  প্রথম গদ্য 'আনন্দবাজার'-এ। প্রথম গল্প 'সানন্দা'য়। যা নিয়ে রাজনৈতিক মহল তোলপাড় হয়। মামলা হয় পাঁচ কোটি টাকার। ছোটদের জন্য যেমন সন্দেশ, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, চির সবুজ লেখা, ঝালাপালা, রঙবেরং, শিশুমহল ছাড়াও বর্তমান, গণশক্তি, রবিবাসরীয় আনন্দমেলা-সহ সমস্ত দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতায় লেখেন, তেমনি বড়দের জন্য লেখেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং মুক্তগদ্য। 'রতিছন্দ' নামে এক নতুন ছন্দের প্রবর্তন করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুশো একচল্লিশটি। তার বেশির ভাগই অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বেস্ট সেলারেও উঠেছে সে সব। এ ছাড়া যৌথ ভাবে সম্পাদনা করেছেন লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে। তাঁর লেখা নাটক বেতারে তো হয়ই, মঞ্চস্থও হয় নিয়মিত। তাঁর কাহিনি নিয়ে ছায়াছবিও হয়েছে বেশ কয়েকটি। গান তো লেখেনই। মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে। তাঁর ইংরেজি এবং বাংলা কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কয়েকটি সিনেমায়। বানিয়েছেন দুটি তথ্যচিত্র। তাঁর লেখা পাঠ্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে। ইতিমধ্যে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, সন্তোষকুমার ঘোষ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, নতুন গতি পুরস্কার, ড্রিম লাইট অ্যাওয়ার্ড, কমলকুমার মজুমদার জন্মশতবর্ষ স্মারক সম্মান, কবি সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা।

আমার ছেলে কিচ্ছু খায় না 

ডাক্তারের উল্টো দিকের চেয়ারে বসে মুখ কাঁচুমাচু করে কাজরী বললেন, ডাক্তারবাবু, আমার ছেলে কিচ্ছু খায় না। এর আগেও দু’জন চাইল্ড স্পেশালিস্টকে দেখিয়েছিলাম। এই যে তাঁদের প্রেসক্রিপশন... বলেই, আগে থেকে বের করে রাখা তিন-চারটে কাগজ উনি এগিয়ে দিলেন ডাক্তারবাবুর দিকে। ডাক্তারবাবু সেগুলিতে চোখ বোলাতে লাগলেন। 
কাজরী আবার বললেন, ও কিচ্ছু খাচ্ছে না, কী করা যায় বলুন তো? 
ডাক্তারবাবু প্রেসক্রিপশনগুলোয় চোখ বোলাচ্ছেন। বিশাল চেম্বার। দারুণ সাজানো-গোছানো। এ সি চলছে। সাত দিন আগে নাম লেখাতে হয়েছে। এর আগে যে দু’জন ডাক্তারকে দেখিয়েছিলেন, তাঁদের একজন পাড়ার ডাক্তারখানায় বসেন। অন্য জন একটু দূরে। 
ওর ছেলে কিচ্ছু খাচ্ছে না শুনে সহেলীর মা বলেছিলেন, কোন ডাক্তার দেখাচ্ছিস? সুনীল ডাক্তার? কত টাকা ভিজিট? চল্লিশ টাকা? 
কাজরী বলেছিলেন, সুনীল ডাক্তারকে দেখিয়ে কোনও কাজ না হওয়ায় লেক মার্কেটের কাছে একজন খুব বড় ডাক্তার বসেন, তাঁকে দেখিয়েছিলাম। তাঁর ভিজিট দুশো টাকা। শুনে সহেলীর মা বলেছিলেন, ধুর, এ সব রোগের ক্ষেত্রে একদম লোকাল ডাক্তার দেখাবি না। বাচ্চার ব্যাপার তো, একটু ভাল ডাক্তার দেখা। তাতে যদি দু’পয়সা বেশি লাগে তো, লাগুক, বুঝেছিস? 
সহেলী ওর ছেলের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। বাচ্চাদের স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে ওঁরা মায়েরা স্কুলের কাছেই একটা ঘর ভাড়া নিয়ে বসেন। সেখানে নানা কথা হয়। আর সব কথাতেই সহেলীর মায়ের কথা বলা চাই। যেই শুনেছেন ওঁর ছেলের কথা, অমনি আগ বাড়িয়ে বলতে শুরু করলেন, সহেলীকে যিনি দেখেন, তার তো ডেটই পাওয়া যায় না। ভীষণ ব্যস্ত। একেবারে সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী। এক ওষুধেই কাজ হয়ে যায়। তবে ভিজিট একটু বেশি। আটশো টাকা। 
— আটশো টাকা! আঁতকে উঠেছিলেন কাজরী। 
— হ্যাঁ, আটশো টাকা। সুনীল ডাক্তারের চল্লিশ আর এর আটশো। তফাত তো হবেই, না? 
— ডাক্তারের নাম কী? 
— নাম? নামটা কী যেন বেশ। ওর বাবা জানে। দাঁড়া। জি়জ্ঞেস করি... বলেই, টপাটপ বোতাম টিপে মোবাইলে ধরলেন স্বামীকে। এই, আমরা সহেলীকে যে ডাক্তার দেখাই, তাঁর নামটা কী গো? ও, আচ্ছা আচ্ছা। না, কাজরী আছে না, ওর ছেলেও তো কিছু খেতে চায় না, তাই। আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে, রাখছি। 
স্বামীর সঙ্গে কথা বলেই আফসোস করেছিলেন সহেলীর মা, না রে, ও-ও নামটা জানে না। আসলে ওর অফিসের এক বন্ধুর স্ত্রী ওই ডাক্তারের খোঁজ দিয়েছিলেন। উনি হয়তো জানতে পারেন। কিন্তু ওঁর নম্বরটা আমার কাছে নেই। 
— তা হলে ওই ডাক্তারকে তোরা কী বলে ডাকিস? 
— ডাক্তারবাবু বলে। 
— না না, তা বলছি না। বলছি, তোরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলিস, তখন ওই ডাক্তারের কথা বলার সময় তোরা কী বলিস? 
— বলি, আটশো টাকার ডাক্তার। 
— আটশো টাকার ডাক্তার? ও, তা আমাকে দে না ওই ডাক্তারের ঠিকানাটা। 
— ওর চেম্বার তো গড়িয়াহাটায়। 
— গড়িয়াহাটায়? রোজ বসেন? 
— ধুর, অত বড় একজন ডাক্তার রোজ রোজ বসবেন? উনি বহু জায়গায় বসেন। বড় বড় সব নার্সিংহোমে। তবে আমাদের কাছাকাছি হল গড়িয়াহাট। 
— ওখানে কবে কবে বসেন? 
— সপ্তাহে দু’দিন। মঙ্গল আর শনি, সন্ধে ছ’টা থেকে রাত আটটা। 
— ভালই হল। আজ তো বৃহস্পতিবার। তার মানে কাল শুক্র, পরশু শনি। তাই তো? তা হলে এই শনিবারই ওকে নিয়ে যাব। 
— আরে, ও ভাবে গেলে কি উনি দেখবেন নাকি? আটশো টাকার ডাক্তার বলে কথা। প্রচুর ভিড় হয়। এক মাস আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। 
— এক মাসে আগে! 
— তা হলে আর বলছি কি? দাঁড়া, তোকে একটা নম্বর দিচ্ছি, এখানে ফোন করে কথা বলবি। আমার কথা বলতে পারিস। আসলে যে ছেলেটা নাম লেখে, সে আমাকে খুব ইয়ে করে... মানে, ওকে বলবি, তুই আমার বন্ধু। একটু রিকোয়েস্ট করবি, ডেডটা যাতে একটু আগে করে দেয়। দেখবি, ও ঠিক করে দেবে।
স্বামী বাড়ি ফেরার পর পরই কাজরী বায়না ধরেছিলেন, তিনি তাঁর ছেলেকে নতুন ডাক্তার দেখাবেন। স্বামী গাঁইগুঁই করতেই তাঁর মুখের উপরে বলে দিয়েছিলেন, তুমি যদি টাকা দিতে না চাও, দিয়ো না। আমি আমার বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসব। সহেলীর মা সহেলীকে ওখানেই দেখায়। এটা একটা প্রেস্টিজ ইস্যু! 
অগত্যা ডাক্তারের জন্য আটশো এবং যাতায়াত বাবদ আরও পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দিয়েছিলেন ওঁর স্বামী। অবশ্য টাকা হাতে পাওয়ার সাত দিন আগেই ফোন করে চেম্বার থেকে উনি ডেট নিয়ে নিয়েছিলেন। 

কাজরীর মুখের দিকে তাকালেন ডাক্তার, তা হলে ও কী খায়? 
— কিচ্ছু না। 
— কিচ্ছু না মানে? 
— সেটাই তো বলছি, ও না কিচ্ছু মুখে তোলে না। 
— কিচ্ছু না? 
— না। 
ডাক্তার ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। 
ঠিক এ ভাবেই মাঝেমাঝে ভ্রু কুঁচকে যায় কাজরীর। যখন তাঁর ছেলে হঠাৎ হঠাৎ জানতে চায়, এটা কী, ওটা কী? উনি যে জানেন না, তা নয়। জানেন বাংলাটা। ইংরেজির জন্য তখন তার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। এই তো সে দিন, বিকেলবেলায় মুড়ি মেখে ছেলেকে দিতে গিয়ে বললেন, নে, মুড়িটা খেয়ে নে। বলতে গিয়েই মনে পড়ে গেল, তাঁর ছেলেকে যে মেয়েটি পড়ায়, সে বারবার করে বলে দিয়েছে, বউদি, ও কিন্তু ইংরেজিতে খুব কাঁচা। ওর সঙ্গে যতটা সম্ভব ইংরেজিতে কথা বলবেন। পুরো না হলেও ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে। তাতে ওর অন্তত স্টক অব ওয়ার্ড বাড়বে। অথচ কাজরী ইংরেজি জানেন না। ছোটবেলায় পড়তেন পাড়ার একটা পাতি বাংলা মিডিয়াম স্কুলে। এখনও ঠিক করে স্কুল বলতে পারেন না। বলেন ইস্কুল। মার্ডারকে মাডার। ফাস্ট ফুডকে ফাস ফুড। এমন বিদ্যে নিয়ে মাধ্যমিকে ব্যাক পাওয়ার পরে পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে বইয়ের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। তার পরে ছেলের জন্য আবার এই বই নিয়ে বসা। শ্বশুর-শাশুড়ি, এমনকী ওঁর  স্বামীও বলেছিলেন, ইংরেজি মিডিয়ামে ভর্তি করাতে হলে বাবা-মাকেও একটু ইংরেজি জানতে হয়। না হলে নার্সারি থেকেই দু’জন মাস্টার রাখতে হবে। তার চেয়ে ভাল দেখে কোনও একটা বাংলা মিডিয়ামে ছেলেকে ভর্তি করে দিই। কাজরী রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, যত দিন পারবেন, তিনি নিজেই ছেলেকে পড়াবেন। আর সে জন্যই আবার নতুন করে পড়া শুরু করেছিলেন তিনি। যতটা পারতেন, ছেলের সঙ্গে ইংরেজিতেই কথা বলতেন। 
ইংরেজিতে কথা মানে, ছেলেকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে ঘুরতে হয়তো কোনও গাছে একটা প্রজাপতিকে বসতে দেখলেন, অমনি ছেলেকে তিনি বলতে লাগলেন, ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ, কী সুন্দর একটা বাটারফ্লাই। বা টাপুরটুপুর বৃষ্টি দেখিয়ে বলতে লাগলেন, দেখছিস, কী রকম রেইন হচ্ছে। কিংবা ছেলের খাবার বাড়তে বাড়তে ক’হাত দূরে থাকা চামচটা দেখিয়ে বললেন, যা তো বাবা, ওই স্পুনটা নিয়ে আয় তো। এই রকম। এতে ছেলেকে দারুণ ইংরেজি শেখাচ্ছি ভেবে মনে মনে খুব গর্ববোধ করতেন তিনি। এই তো সে দিন ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি থেকে ফেরার সময় কেকার সঙ্গে তাঁর দেখা। কেকা যেই জিজ্ঞেস করল, কোথায় গিয়েছিলি? ও অমনি দুম করে বলে ফেলল, শ্রেয়াদের বাড়ি গিয়েছিলাম। ওর মেয়েকে যে বাংলা পড়ায় তার ঠিকানাটা নিতে... 
— বাংলা টিচার! কেন? 
— আর বলিস না। আমার ছেলেটা না একদম বাংলা জানে না। 
— সে কী রে? তুই তো বাংলা স্কুলেই পড়তিস। আর তোর ছেলে কিনা বাংলা জানে না? 
— কী করব বল? ওর আর সব বিষয়ে ঠিক আছে। কোনও প্রবলেম নেই। কিন্তু বাংলা পড়তে গেলেই ওর গায়ে জ্বর আসে। 
— সে জন্য বাংলা মাস্টার খুঁজতে বেরিয়েছিস? 
— আর বলিস কেন? 
— কোন ক্লাস হল ওর? 
— এই তো সবে টুয়ে উঠল। 
— কত পেয়েছে বাংলায়? 
— একচল্লিশ। 
— একচল্লিশ? কতয় পাশ? 
— চল্লিশে। 
— চল্লিশে পাশ, একচিল্লশ? না না, পড়াশোনার ব্যাপারে একদম অবহেলা করবি না। প্রথম থেকেই নজর দে। না হলে পরে কিন্তু পস্তাতে হবে। আমার মেয়েও তো একদম বাংলা জানত না। তার পর মাস্টার রাখার পরে এখন খানিকটা ঠিক হয়েছে। এখন থেকেই ওর জন্য একটা ভাল মাস্টার রাখ। বুঝেছিস? 
ও বুঝেছিল। কিন্তু ওর ছেলে বুঝতে পারছিল না ব্যাপারটা। তাই কেকা চলে যেতেই ও মাকে বলেছিল, আচ্ছা মাম্মি, আমি বাংলায় কত পেয়েছি, সেটা তো তুমি আন্টিটাকে বললে, লেকিন বাকিগুলোতে কত পেয়েছি, তা তো বললে না! 
— বললে থুতু দিত। তোমার মনে নেই, কত পেয়েছ? অঙ্কে গায়ে-গায়ে, আর ইংরেজিতে তো এক্কেবারে এই এত্ত বড় একটা গোল্লা। মনে আছে, দু’-দুটো বিষয়ে ফেল। ক্লাস টুতেই গার্জিয়ান টু সি... আবার কথা বলছ? 
— লেকিন, আমি তো পড়ি মাম্মি। 
— ছাই পড়ো। সারাক্ষণ খালি টিভি, টিভি আর টিভি। 
— হ্যাঁ, টিভি দেখি। লেকিন, প্রোগ্রামের মাঝে মাঝেই যে অ্যাড হয়, তখন তো পড়ি। 
— ও ভাবে পড়া হয় না, বুঝলে? 
— তুমিই তো সবাইকে বলো, আমি খুব পড়ি। 
— কেন বলি, তুমি যখন বাচ্চাকাচ্চার বাবা হবে, তখন বুঝবে। 
— লেকিন মাম্মি, আমরা তো দিদুনের বাড়ি গিয়েছিলাম। তুমি যে আন্টিটাকে বললে, শ্রেয়া আন্টির মেয়েকে যে বাংলা পড়ায়, তাঁর ঠিকানা আনতে গিয়েছিলে... 
— চুপ। একটাও কথা বলবি না। খালি বকবক বকবক। একটু চুপ করে থাকতে পারিস না? ছেলে কী বলতে যাচ্ছিল, উনি ফের ধমকে উঠলেন, চুপ। বলেই, মনে পড়ে গেল ছেলেকে উনি বাংলায় বকছেন। অমনি বললেন, স্যরি। সাট আপ। রেগে গেলে মানুষ কেন যে মাতৃভাষায় কথা বলে, বুঝি না! বাঙালি বাচ্চাদের বাংলা না জানাটা যে কত গর্বের, সেটা অন্যান্য মায়েদের সঙ্গে দু’মিনিট কথা বললেই টের পাওয়া যায়। সবারই এক কথা, আমার বাচ্চার ইংরেজিতে কোনও অসুবিধে হয় না। কিন্তু বাংলাটায় ভীষণ কাঁচা। থার্টি নাইনের বাংলা কী? জিজ্ঞেস করো, বলতে পারবে না। কী যে করি! এই ‘কী যে করি!’ বলাটা আসলে কিন্তু গর্ব করে বলা। 
তাই বাংলা নয়, উনি জোর দিয়েছিলেন ইংরেজিতে। কিন্তু তাঁর ছেলেকে যে তিনি কিছুই শেখাতে পারেননি, সেটা উনি বুঝতে পেরেছিলেন, সি বি এস সি বোর্ডের একটা স্কুলে ওকে নার্সারিতে ভর্তি করাতে গিয়ে। রেজাল্টের দিন দেখলেন, তাঁর ছেলের নামই ওঠেনি। তাই উনি ঠিক করলেন, যে করেই হোক, দরকার হলে ডোনেশন দিয়ে ছেলেকে ভর্তি করাবেন। 
স্বামী একদম রাজি নন। তাই বাবাকে গিয়ে ধরলেন। তোমার নাতিকে সামনের সপ্তাহেই স্কুলে ভর্তি করতে হবে। কিন্তু তোমার জামাইয়ের হাতে এখন, এই মুহূর্তে একদম কোনও টাকাপয়সা নেই। তুমি যদি ডোনেশনের টাকাটা এখন দিয়ে দাও, তা হলে খুব ভাল হয়। ও পরে তোমাকে দিয়ে দেবে, বলে বাবার কাছ থেকে কায়দা করে টাকাটা ম্যানেজ করে নিয়ে এসেছিলেন। সেটা আর দেওয়া হয়নি। সেটা যে কত টাকা, তাও মনে করতে চান না তিনি। এবং তিনি যে ভাবে চান, ছেলেকে সে ভাবে পড়াতে পারছেন না বলে, নার্সারি ওয়ানেই রাখতে হয়েছে একটা মেয়েকে। সেই মেয়েটিই সে দিন বলে গিয়েছে, যতটা পারবেন, ওর সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলবেন। 
সেটা বলার জন্যই বিকেলবেলায় ছেলের দিকে মুড়ি-মাখা বাটিটা এগিয়ে দিয়ে, নে, মুড়িটা খেয়ে নে, বলেও, থমকে গিয়েছিলেন। ক’দিন আগেই বাসে করে ফেরার সময় একটা হকারের কাছ থেকে তিন টাকা দিয়ে একটা বই কিনেছিলেন তিনি। বেঙ্গলি টু ইংলিশ। কয়েক পাতার পাতলা একটা চটি বই। সেই বইটা উল্টেপাল্টে মুড়ির ইংরেজিটা দেখে নিজেই হেসে ফেললেন! ফ্রাইডরাইস! মুড়ি ইংরাজি ফ্রাইডরাইস! তা হলে আমরা যাকে ফ্রাইডরাইস বলি, সেটার ইংরেজি কী? 

— ও কবে থেকে খাচ্ছে না? ডাক্তার প্রশ্ন করতেই কাজরী সচকিত হলেন। নড়েচড়ে বসতে বসতে বললেন, প্রথম থেকেই। তবে সেটা আরও বেড়েছে, ওই গানের ক্লাসে গিয়ে। 
গানের কথা বলে ফেলার পরেই নিজেকে একটু সামলে নিলেন কাজরী। কিছু দিন আগে একটা বিয়ে বাড়িতে গিয়ে তাঁর এক পুরনো বান্ধবীর সঙ্গে দেখা। দেখা আরও অনেকের সঙ্গেই। সেখানে সবাই সবার খোঁজখবর নিচ্ছিল। কে কী করছে, কার বর কী করে, কার বাচ্চা কোন ক্লাসে পড়ে। কথায় কথায় কাজরী বলেছিলেন, তাঁর ছেলের গান শেখার কথা। বলতে বলতে তাতে রং চড়ছিল। এক সময় বলে ফেললেন, নিজের ছেলে বলে বলছি না, এই বয়সেই ও যা গায়, কী বলব... ও যেখানে যায়, সেখানেই, সবাই ওকে গান করার জন্য ধরে। পাড়ায় কোনও ফাংশন হলেই হল, ওকে চাই। পাড়ার সবাই তো বলেই, ও আপনাদের ছেলে না, ও আমাদের ছেলে। শুধু গানের জন্য। স্কুলে যাবে, সেখানেও। এমনকী টিফিন পিরিয়ডে ওর আন্টিরা পর্যন্ত ওকে ডেকে নিয়ে যান। ও যার কাছে গান শেখে, তিনিও তো বলেন, ওর মধ্যে পার্স আছে, ও যদি গানটাকে ধরে রাখতে পারে, ও একদিন... 
আশপাশের লোকেরা যত মাথা নাড়ছেন, উনিও তত বলে যাচ্ছেন— এই তো তোন একটা চ্যানেলে ছোটদের গানের কমপিটিশন হচ্ছে না? ওর মাস্টার তো ওর নাম দিয়েই দিচ্ছিল। আণি বলে দিয়েছি, না। একদম না। এক্ষুনি না। আগে লেখাপড়াটা করুক। তার পর এ সব। কারণ, ও যদি ফার্স্ট হয়ে যায়, তা হলে তো আর নিস্তার নেই। মুম্বই যেতেই হবে। একের পর এক গানের রেকর্ড করতে হবে। সিনেমার জন্য গান গাইতে হবে। তোরাই বল, এতে পড়াশোনার ক্ষতি হবে না? ওদের স্কুল আবার প্রচণ্ড স্ট্রিক্ট। নাইন্টি এইট পারসেন্ট না থাকলে... সবাই ভিড় করে শুনছিলেন। হঠাৎ পাশ থেকে সেই বন্ধু বলে উঠলেন, ঠিক বলেছিস, এখন গান করলেও তো কত নাম। দেখিস না, লতা মঙ্গেশকর, মান্না দে, শান। এঁরা গান করেই যা রোজগার করেন, তাতেই তাঁদের সংসার চলে যায়। আর চাকরি বাকরি করতে হয় না। 
প্রথমটা চট করে বুঝতে না পারলেও, কাজরী যখন দেখলেন, মুখ টিপে টিপে সবাই হাসছেন, তখন বুঝতে পারলেন, ওই বন্ধুটা তাঁর কথা নিয়ে ব্যাঙ্গ করছেন। 
এর পরেই ওঁদের জমাটি আসর ভেঙে যায়। যে যার মতো এ দিক ও দিক ছড়িয়ে পড়েন। সে দিন ওঁর কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে রাখলেও তিনি আর কোনও দিনই ওঁকে ফোন করেননি। তার পর থেকে ছেলের গানের কথা কাউকে বলতে গেলেই ওঁর মনে পড়ে যায়, ওই বন্ধুর কথা। তাই ডাক্তারবাবুকে ছেলের গানের কথা বলে ফেলেও কথা ঘোরালেন কাজরী আসলে এমনিতেই ও কিছু খেতে যায় না। 
— সকালে কী খায়? 
— কিচ্ছু না। 
— জলও না? 
— না, জল খায়। 
— দুধ? 
— হ্যাঁ, দুধ খায়। আধ গ্লাস। 
— দুধের সঙ্গে? 
— কিচ্ছু না, ওই একটু কর্নেফ্লক্স। 
— তার পর? 
— তার পর আর কিচ্ছু না। সামান্য লবণ দিয়ে একটা দেশি ডিম, ব্যস... 
— দুপুরে? 
— দুপুরেও তাই। কিচ্ছু খায় না। শুধু একটু স্টু, ছোট্ট এইটুকুনি এক পিস মাছ আর একটু ভাত, ব্যস। 
— তার পরে? 
— তার পরে আর কিচ্ছু না। সেই বেলা চারটে নাগাদ একটা আপেল আর একটু সিজিন ফল। 
— সন্ধেবেলা? 
— কিচ্ছু না। ঘরে যা হয়, তাই। কোনও দিন ম্যাগি করে দিলাম, কি কোনও দিন একটা এগরোল কিনে দিলাম... 
— আর কিছু? 
— না না, আর কিচ্ছু না। ওই কখনও সখনও একটু চিপস্‌ বা এটা ওটা সেটা, ব্যস। 
— রাতে? 
— রাতে খেলে তো ধন্য হয়ে যেতাম। কিচ্ছু খায় না। ওই একটু ভাত, একটু তরকারি, কখনও দু’-চার পিস চিকেন বা একটু মাছ কিংবা একটা ডিম। ডিমটা ও খুব ভাল খায়। 
— আর কিছু খায় না? 
— না। সে জন্যই তো আপনার কাছে এসেছি। না খেয়ে খেয়ে আমার ছেলেটা, কি বলব ডাক্তারবাবু, একেবারে ঝেঁটার কাঠি হয়ে গেছে। 
— ও কোথায়? 
— গানের ক্লাসে। আসলে সপ্তাহে একটা দিন ক্লাস তো। তাই ভাবলাম, আপনি যদি এই প্রেসক্রিপশনগুলো দেখে আর আমার মুখের কথা শুনে কোনও ওষুধ-টসুধ দিয়ে দেন, তা হলে... এর পর যে দিন আসব, সে দিন না হয়... 
— না, ওকে আনতে হবে না। 
— ও! আপনি বুঝে গেছেন, ওর কী হয়েছে? 
— হ্যাঁ। 
— কী হয়েছে ডাক্তারবাবু? 
— কিছু না। 
— কিন্তু ও যে একদম খেতে চায় না... জানেন? আমাদের পাড়ায় একটা ছেলে আছে। সবাই ওকে ভয় পায়। বড়রা পর্যন্ত  সমঝে চলে। সে দিন তাকে সামনে দাঁড় করিয়েও ওকে এতটুকু খাওয়াতে পারিনি। 
— শুধু ওই ছেলেটা কেন? ওর সামনে যদি একটা বাঘ এনেও দাঁড় করিয়ে দেন, ও আর খাবে না। 
— কেন ডাক্তারবাবু? খাবার দেখলেই ও পালায় কেন? 
— ও কেন? ও ভাবে যদি আমাকেও আপনি খাওয়ান, দেখবেন, পরের দিন থেকে আমিও খাবার দেখলে পালাচ্ছি। আর ওর বয়স তো সবে সাত বছর... 
— কেন? আমি কি ওকে বেশি খাওয়াচ্ছি? 
— বেশি না। খুব বেশি। হিসেব করে দেখবেন, ও যা খায়, আপনিও তা খান না। সুতরাং এ সব নিয়ে একদম ভাববেন না। পারলে এক-আধ বেলা ওকে না খাইয়ে রাখুন। খেতে না চাওয়া পর্যন্ত ওকে কোনও খাবার দেবেন না। দেখবেন, খিদে পেলে ও নিজেই আপনার কাছে এসে খাবার চাইবে। জোর করে কখনও খাওয়াতে যাবেন না। জানবেন, না খেলে কেউ মরে না, খেয়েই মরে। 
ডাক্তারের কথা শুনে কাজরী হাঁ হয়ে গেলেন। তিনি কত আশা করে এসেছিলেন, ডাক্তারবাবু তাঁকে এই পরীক্ষা করাতে বলবেন, সেই পরীক্ষা করাতে বলবেন, এত এত ওষুধ দেবেন, তা নয়, উেল্ট বলছেন কি না, যা খায়, সেটাও কমাতে! পারলে দু’-এক বেলা না খাইয়ে রাখতে! এ কেমন ডাক্তার রে বাবা! এর ভিজিট আটশো টাকা! যাক বাবা, আর কিছু না হোক, একটা কাজ তো হল, এ বার থেকে সহেলীর মায়ের মতো তিনিও বড় মুখ করে বলতে পারবেন, আমি আমার ছেলেকে আটশো টাকার ডাক্তার দেখাই। সেটাই বা কম কী! 


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান