আমিনুল ইসলামের কবিতা : প্রকৃতির দ্বৈরথে জীবনের পাঠ ।। সরকার আবদুল মান্নান
আমিনুল ইসলামের কবিতা : প্রকৃতির দ্বৈরথে জীবনের পাঠ ।। সরকার আবদুল মান্নান

কবিতার কোনো গোত্র নেই, জাত-পাত নেই , ভাগ-বিচার নেই। যারা কবিতাপ্রেমী মানুষ, রসজ্ঞ ও সংবেদনশীল, কোনো কবিতা পড়ে তারা যদি বোধের কোনো নতুন দিগন্তে পৌঁছোন তাহলেই সেই কবিতা গ্রাহ্য, কবিতাপদবাচ্য। কবিতা হয়ে উঠার এই যে মানদ-, সহৃদয় সংবেদ্যতার প্রশ্ন- এর পিছনে কি কোনো ব্যাকরণ আছে, কোনো নিয়ম-নীতি , সিদ্ধান্ত? হয়তো আছে , এবং তা পরিহার্য বটে, অপরিহার্য নয়। ভালো কবিতার নিয়ম-নীতি আবিষ্কারের চেষ্টা বহুকাল ধরেই হয়ে এসেছে, হচ্ছে এবং হবেও। এ নিয়ে সমালোচকদের আগ্রহের শেষ নেই। ফলে কবিতার পরিমাণ তার আলোচনা-সমালোচনার পরিমাণের তুলনায় অতি সামান্য। কেন? কারণ এর ব্যাকরণহীনতা। যদি ভালো কবিতা হয়ে উঠার নির্দিষ্ট ব্যাকরণ থাকত, তাহলে সেই ব্যাকরণের মধ্যে ফেলে এর ভালোত্বের শেষ বিচার করে ফেলা যেতো। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। কবিতার কেন, ভালো কোনো শিল্পকর্মের শেষ বিচার নেই, সিদ্ধান্ত নেই, পরিণতি নেই। এ জন্যই ভালো কবিতার মধ্যে উন্মোচনের রহস্য চিরকালই থাকে, যুগের পর যুগ , শতকের পর শতক রসজ্ঞ পাঠক তাই নতুন উপলব্ধি ও ভাব-ভাবনা দিয়ে নতুন করে বুঝতে চায় কবিতা। এভাবে বোঝার এক নিরন্ততার মধ্যে ভালো কবিতা স্থান করে নেই। এর মানে কি এই যে, আলোচনা-সমালোচনাই ভালো কবিতার ভালোত্বের মানদ-? যার কবিতা নিয়ে যত বেশি আলোচনা হবে তিনিই তত বড় কবি? এই ভাবনা নিশ্চয়ই সঠিক নয়। সমকালে আলোচনার ঝড় তুলে আমরা অনেক কবিকে আবার মিলিয়ে যেতে দেখেছি। আবার বছরের পর বছর নিস্তব্ধতার মধ্যে থেকে অসীম শক্তি নিয়ে জেগে উঠতে দেখেছি কোনো কোনো বিরলপ্রজ কবিকে। সুতরাং সমকাল প্রতারকও বটে। এ শুধু জাগিয়ে তোলে না- চিরনিদ্রায় শায়িতও করে। সুতরাং কবিতা বিচারের ভার সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াই উত্তম। কিন্তু তবুও কবিতা নিয়ে পাঠকের ভাবনা থাকেই এবং সেই ভাবনার কথা কোনো কোনো পাঠক ব্যক্ত করার স্পর্ধা প্রকাশ করতে পারেন। আমিনুল ইসলামের কবিতা নিয়ে আমিও মূর্খ এক পাঠকের স্পর্ধার পরিচয় তুলে ধরছি।

 

আমিনুল ইসলাম চাকরি-বাকরি আর ঘর-গৃহস্থালি নিয়ে আপাত দৃষ্টিতে আটপৌরে মানুষ। কিন্তু ভিতরে ভিতরে পদ্যদেবির পদতলে কবে যে মাথা রেখেছেন, নিজেও তা নিশ্চয়ই জানেন না। কেননা ২০০২ সালে তন্ত্র থেকে দূরে শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে বোধের যে প্রগাঢ়তা ও প্রকাশের পারিপাট্য লক্ষ করা যায়, তাতে মনে হয় কাব্যদেবির আশ্রয় তিনি লাভ করেছেন অনেক আগেই। সুতরাং মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে তাঁর ব্রতযাত্রার পরিণাম উপলব্ধি করা যায়। সংবেদনার যে মাত্রায় একজন সামাজিক মানুষ প্রেমিক ও দ্রোহী হয়ে উঠতে পারেন, আমিনুল ইসলাম সেই সংবেদনাঋদ্ধ মানুষ। দৃশ্যের উপরিস্তর তাঁর বিবেচ্য নয়- এ আমজনতার অধিকার। তিনি রুদ্ধশ্বাস গভীরে পৌঁছে সমাজ-সভ্যতার জটিল এক জগতে পা রাখেন, যেখানে বাঘ ও মহিষ এক ঘাটে জল খায়। কিম্ভূতকিমাকার যে জগৎ, আমিনুল ইসলাম সেই জগতের রেখাচিত্র অঙ্কন করেন নিজস্ব এক ভাষায়। কিন্তু তাই বলে যে তাঁর কবিতায় প্রেম নেই তা নয়। কিন্তু তা একান্তই উপলক্ষ। লক্ষ্যাভিমুখি এক জীবন-যন্ত্রণার গরল তিনি উগ্রে দেন শব্দের পেয়ালায়। আর এখানেই কবি আমিনুল ইসলামের শক্তির পরিচয়। মহানন্দা এক সোনালি নদীর না কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘শৃঙ্খলিত কোকিলের গান’। এই কবিতাতেই আমরা আমিনুল ইসলামের যন্ত্রণার জায়গাটি বুঝে নিতে পারি। এক উন্মুক্ত ও সর্বসুন্দর মুখরিত শৈশবের পর যে জীবন আমরা লাভ করি তার ক্লেদাক্ত স্বরূপের সুদীর্ঘ এক ইতিহাস রচিত হয়েছে এই কবিতায়। কবিতার অংশবিশেষ :

                        

তালপাতায় মুখরিত বেজেছে শৈশব

রাখালের বাঁিশতে লাউয়ের ডগার মতো নেচেছে কৈশোর।

আর মাঝির গানে স্বপ্নের তরঙ্গচূড়ায়

পালের নৌকার মতো যৌবনের নাচানাচি

কতদিন তীরে বসে দেখেছে জেলেরা!

কখনো বা বাউলের একতারার সুরে

ভোঁ-কাটা ঘুড্ডি হয়ে উড়ে গেছে মন।

 

শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের এই যে ফুল্লজীবন- সময়ের বিপুল বিপর্যস্ততার মধ্যে এই জীবন প্রৌঢ়ে এসে বিস্ময়কর জটিল ও সংকটাময় হয়ে ওঠে। আমিনুল ইসলাম একই কবিতায় সেই জীবনের রক্তাক্ত স্বরূপ অঙ্কন করেছেন; তিনি লিখেছেন :

 

অথচ আজ কোলাহলে বন্দি আমি!

মাতাল ষাঁড়ের শিঙে লন্ডভন্ড মঞ্চ

নিষাদকন্যার প্রসারিত হাত

আমার গলা জড়িয়ে টানে

মৃত্যুর মহড়া চালায় দুবেলা।

 

জীবনের মধ্যে আশ্চর্য এই প্রবেশের ভিতর দিয়ে আমিনুল ইসলাম একে একে উন্মোচন করে চলেন এই জীবনের গ্লানি, নিরাশ্রয় ও নিষ্ঠুরতা। একই কাব্যগ্রন্থের ‘পদ্মার পাড়ে বসে’ কবিতায় তিনি নিরাশ্রয়ী মানুষের যে চিত্র এঁকেছেন সেখানে পদ্মা প্রতীক মাত্র। অধিকন্তু এই কবিতার মধ্যেও আমাদের প্রত্যেকের স্নিগ্ধ-সুন্দর দুরন্ত এক শৈশবের মর্মন্তুদ পরিণতির আস্বাদ মিলে। আমাদের প্রত্যেকের শৈশবই যেন সর্বনাশা এক পদ্মার পাড়ে জিম্মি। আমিনুল ইসলাম লিখেছেন :

 

ও পদ্মা! স্বপ্নের ভূমিলিপ্সু পড়শী!

ওই হাঙরপেট চিরে একবার দেখাও তো দেখি-

কোথায় আমার সেই মার্বেল খেলার গলি!

 

এই একই অনুভাবনার বিস্তার ঘটেছে বিভিন্ন কবিতায়। কিন্তু বোধ আর বুননের ভিন্নতায় সেই অনুভাবনা বারবারই অনন্যতার আবেদন নিয়ে সমাগত। ‘এই নদী এই হাওয়া’ কবিতায় নদী-নালা, গাছ-গাছালি আর পাখ-পাখালির এই দেশে বিপর্যস্ত জীবনের ছবি এঁকেছেন আমিনুল ইসলাম। তিনি লিখেছেন :

 

যুবকের চোখে বাঁধা অশ্বের পটি

পিতৃকুলজী নিষেধাজ্ঞার খাতায়

বোধের মিনারে উঠেছে বিভেদচটি

পায়ের ধুলো জমেছে পুঁথির পাতায়।

শ্মশানে ডাকিয়া সুমনাকে পিশাচীনি

জীবনের মানে শোনায় প্রেতস্বরে

কুটিল শহরে আড়ালের বিকিকিনি

মগজ পড়েছে নগদের খপ্পরে

 

আমিনুল  ইসলামের কবিতার মূলগত আবেদনের মধ্যে বিশ্বাসের সংকটের জায়গা বেশি নয়। কিন্ত এ সময়েরর একজন কবি হিসেবে তিনি এই সংকটের স্বরূপ ভালো করেই বোঝেন। ফলে তার বিভিন্ন কবিতায় বিশ্বাসের সংকট বিচিত্র রূপে ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু তার এই রূপ প্রত্যক্ষ নয়। অধিকন্তু কতগুলো ইঙ্গিৎ ও শব্দবন্ধনের ভিতরকাঠামোর অর্থময়তায় এই সংকট বোধের জগতে আলোড়ন তোলে। ‘স্রোত’ শীর্ষক কবিতায় প্রায় দুষ্প্রাপ্যতার অবয়বে স্থান পায় বিশ্বাসের সংকট। ইসলাম লিখেছেন :

 

অলখ জোয়ারে ভাসে থই থই ভাপা পিঠা দিন;

স্মৃতিচারী পাকুড়ের পলাতকা সুরেলা দুপুর;

দাদুর দুচোখ-ছোঁয়া পশমি গোধুলি; স্বপ্নমাখা

পরীদের ডানাঘঁষা বসন্তের রাত, ভাসে সেও।

 

বিশ্বাসে পাহাড় নড়ে। কিন্তু যেখানে অবিশ্বাস কিংবা বিশ্বাসের সংকট সেখানে সবকিছুই ভাসমান, অস্থায়ী । আমিনুল ইসলাম গভীর বেদনার সঙ্গে এই সংকটের স্বরূপ চিহ্নিত করেছেন। আর এরই পাশে স্থানে পেয়েছে স্বার্থান্ধ জীবনের আখ্যান। ‘নিষিদ্ধ প্রসঙ্গ’ শীর্ষক কবিতায় আমিনুল ইসলাম এই স্বার্থান্ধতার রকমফের তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন :

 

শোষণের হাত দ্যাখো জোটবদ্ধ অভিন্ন মুদ্রায়

তোমার উলঙ্গ দৌড়ে তালি দেয় তুখোড় বাহানা

নন্দিত ভক্তির ব্যাজ সাঁটো বটে বিজিত সত্তায়

জেনে রাখো, ছাই ও কুলোয় দক্ষ রাজার ললনা!

 

আমিনুল ইসলামের সুপ্রচুর কবিতায় যন্ত্রণাদগ্ধ মানুষের আর্তির পরিচয় আছে। সমাজ সভ্যতার বিচিত্র অসংগতি অন্যায়, শোষণ ও লাঞ্ছণার বিষয়ে তিনি সংবেদশীল, ক্ষুব্ধ, দ্রোহী। কিন্তু তাই বলে মানব-মানবীর প্রেমের সম্পর্কে তিনি কম সংবেদনশীল নন। ফলে তাঁর প্রচুর কবিতার মধ্যে ভিন্ন ঘরানায় স্থান পেয়েছে প্রেমকাতরতা । প্রেমের কবিতার একটি প্রথাগত রূপৈশ্বর্য ও বিষয় বৈভবের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। বিচিত্র অনুষঙ্গে মানব-মানবীর লীলালাস্যই সেখানে মুখ্য। আমিনুল ইসলাম মোহন প্রেমের এই প্রথাগত আখ্যান রচনা করেন না। সংঘাতময় জীবনের বিচিত্র ক্ষতকে তিনি তুলে ধরেন জীবন-প্রেমিকের বিস্ময়কর অন্তর্লোক থেকে। ফলে নারী নয়, পুরুষ নয়, আটপৌরে প্রতিদিন নয়-বরং এসবকিছু নিয়েই সৃষ্টি হয় তাঁর প্রেমের কবিতার প্রবল জীবন-তৃষ্ণা। প্রচন্ড এক সংবেদনার মধ্যে কবি আমিনুল ইসলামের কবিতা প্রাণময় হয়ে ওঠে। এই সংবেদনা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রেমের সীমা অতিক্রম করে  যায় অবলীলায় এবং ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকজ্ঞান ও লোকজীবন তাৎপর্যপূর্ণ সফলতায় ধরা দেয় কবির প্রেমভাবনার অবয়বে। ফলে পালটে যায় পরিচিত ডিকশন, প্রবল প্রতাপান্বিত ফর্ম। আর সেই বিচূর্ণ কবিভাষার সমাধিস্থলে গজিয়ে ওঠে  আমিনুল ইসলামের প্রেমের কবিতার নতুন এক ভাষিক জগৎ, স্বতন্ত্র এক গঠনসৌষ্ঠব।  জীবনের প্রতি গভীর মমত্ববোধ আমিনুল ইসলামের কবিতার অন্তর্গত শক্তি। ফলে সমকালের বিচিত্র দুর্দৈবের মধ্যেও তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে অবিনাশী জীবনের গান। বোধের এই সততা ও দায়বদ্ধতায়  আমিনুল ইসলামের প্রেমসমগ্র হয়ে ওঠে জীবনসমগ্র -আর্তনাদের মধ্যে আনন্দিত উত্থান। অধিকন্তু তাঁর প্রেমের কবিতার সঙ্গে এত সব জাগতিক ভাবনা জড়িয়ে থাকে যে নিখাঁদ প্রেমবোধ অনেক সময়ই ব্যাহত হয়। প্রেমের কবিতার এই ভিন্নতাই আমিনুল  ইসলামের কবিতার  স্বাতন্ত্র্য।

 

মূলত শেষ হেমন্তের জোছনা কাব্যগ্রন্থ থেকেই আমিনুল ইসলামকে আপন স্বভাবে চেনা যায়। এখানে এসে বদলে গিয়েছে তাঁর বোধের জগৎ, অনুভব অনুভাবনার জগৎ এবং সর্বোপরি কবিতায় শব্দের তাৎপর্যময় জগৎ শুরু থেকেই তিনি এদেশের খাল-বিল-নদী-নালা ও  আলো-বাতাসের কবি। সেইরুটাই এ পর্যায়ে এসে অনেক বেশি ঋদ্ধ হয়েছে , অনেক দূর এগুয়ে যাওয়ার প্রাণরস লাভ করেছে। ফলে নদী, বৃক্ষ, মেঘবৃষ্টি ও পাহাড় নিয়ে তিনি যে মমতাময় কবিতার এক জগৎ  নির্মাণ করেছেন সেই নির্মিতির প্রতিটি রঙ ও রেখায় অফুরন্ত প্রাণের স্পর্শ লাভ করা যায়। এই সব কবিতায় নদী, খাল-বিল, বৃক্ষ, বৃষ্টি, পাহাড়া ইত্যাদি একটি বস্তুময় অভিধার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে নানা সূত্রে জীবনের মানচিত্র  হয়ে ওঠে এবং সেই জীবন সর্বাঙ্গ সুন্দর না হলেও জীবনের কোমলতা ও মধুরতা সকল অসুন্দরকে ছাপিয়ে আশ্চর্য উজ্জ্বলতা লাভ করে। গদ্য কবিতার মধ্যে এই বোধ গদ্যের ভেতরগত ছন্দে স্রেতিস্বিনীর প্রবল ধারা পেয়ে যায়। এবং সেই স্রোতের মধ্যে মিশে থাকে ক্লান্তি হরণের নির্ভার  আশ্রয়। কোথাও কোথাও শব্দ নিয়ে জোরাজোরি থাকলেও উপলব্ধির নির্মলতা সেই চেষ্টাকে অতিক্রম করে যায়। ফলে পাঠক অকৃত্রিম আপনজনের অনুভাবনার আস্বাদ লাভ করেন। ‘নদীর গল্প’ শীর্ষক কবিতা থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করছি :

 

আমাদের পাড়ায় বেড়ে উঠেছিলো দুটি নদী; গ্রামবাসীরা আদর করে

নাম রেখেছিল পদ্মা যমুনা। কানামাছি খেলতে খেলতে কখন যে

তারা বউ বউ শিখেছিল, পড়শি বৃক্ষলতা ছাড়া আর কেউ তা লক্ষ

করেনি। কোনো এক শুক্লাতিথিতে জোছনার পরী এসে চিরকুট দিয়ে

গেলে শুরু হয় সম্মিলিত সমুদ্রগামিতা। পদ্মার গান আর যমুনার নাচে

মেতে ওঠে বাতাস; ঝড়ের রাতে তারা মিথুনরত পায়রা হয়ে যায়।

 

এই কবিতায় আমিনুল  ইসলামের নদী ও জীবনের মধ্যে যে সংরাগ রচনা করেছেন তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝতে কবিতার শেষাবধি  আমাদের যেতে হয় এবং যাত্রাপথে তিনি রাখেন  জীবনের  পেলবতার আলপনা। কিন্ত  যেখানে ‘নদী ও খালের  গল্প’  সেখানে বিশুষ্কতার অশনিসংকেত আমাদের ভবিতব্যকেই প্রকট করে তোলে। তিনি লিখেছেন : ‘‘রমনার খালগুলো রেশনজলে উপচে ওঠে/যদিও ডুবতে গেলে/হাঁটুতেই হাহাকার।’’ এরপর একে একে আমরা যখন তাঁর ‘নদী এক’, ‘নদী দুই’, ‘নদী তিন’, ‘নদী চার’ প্রভৃতি কবিতা পাঠ করি তখন তাঁর নদী আর জীবনের ভাবনাগুলোর পূর্ণতা আমাদের মুগ্ধ করে। এবং আমরা ধবল মেঘের দিনগুলির প্রেমভাবনা পেরিয়ে সহসাই বৃক্ষে জীবনের আস্বাদ লাভ করতে পারি। কেননা,  কবি জানেন, বৃক্ষ জলেরই গর্ভজ স্বপ্রাণ অস্তিত্ব। আর  এই  বৃক্ষবন্দনার মধ্যে আমিনুল ইসলাম জীবনের যে পাঠ  রচনা করেন  ‘বৃক্ষ এক’, ‘বৃক্ষ দুই’,  বৃক্ষ তিন’, কবিতার মধ্যে তার  পরিধি শেষ  হয় না। অধিকন্তু সুপ্রচুর কবিতার মধ্যে তিনি জীবনের সংজ্ঞার্থ বৃক্ষের  রূপ ও রূপকল্পে রচনা করেছেন। ‘বৃক্ষ তিন’ কবিতার অংশবিশেষ :

 

বলাইয়ের স্বভাবহেতু পরজন্মে বৃক্ষ হয়ে জন্মাবি-

পিতামহের এহেন মন্তব্যে

সুবজশাখার দোলা আর পাতার প্রাসাদের সান্ধ্যসংগীত

আমার অনাগত বাগানে একদিন মুখরতা রচেছিল;

ফলে আসার সময়

একটি কুলশিশু একধরনের গ্রাম-সম্পর্কের হাত বাড়িয়ে

পথের সাথি হয়ে বসে।

 

প্রকৃতি আর জীবনের মেলবন্ধনের কাব্যভাবনার এই বিস্তার ২০০৯ সালের একুশের গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত কুয়াশার বর্ণমালা কাব্যগ্রন্থে লক্ষ করা যায় । আর সেই বিস্তারের অন্য এক মাত্রার পটভূমি ও ভূমিকা রচিত হয়ে এই কাব্যগ্রন্থের কবিতা ‘কুয়াশার বর্ণমালা’-এর মধ্যে। কবি লিখেছেন :

 

প্রথম শীতের হাত; সেই হাতে রচিত আস্তানা।

তথাপি সংহার নয়, ফসলের পক্ষে ছিল গান।

উন্মুক্ত চলনবিল, বাতাসে ডানার ধ্বনি-

আর জলজুড়ে মুগ্ধতার ছবি : খুশি ফলে

ঈর্ষাতুর আলোরাও। আর ছায়ার পাশে

জমেছিল অকৃত কর্তব্য। প্রকৃতির জবাবদিহিতা?

 

কবিতাটির এই চরণ কয়টির মধ্যে আমরা মুগ্ধতার ছবি পাই। সমৃদ্ধ প্রকৃতি এবং এর অকৃপণ উদারতায় কবিও মুগ্ধ, তৃপ্ত আমিনুল ইসলামের কবিতার জীবনের এই অর্থময়তা ও কৃতার্থতার ছবি প্রায় সর্বত্র। কিন্তু এখানেই শেষকথা নয়। জীবনের অন্য এক অধ্যায় আছে যেখানে নিঃশেষিত হওয়ার দিকেই সকল সৌন্দর্য ও পূর্ণতার ক্রমিক এগুয়ে যাওয়া । আর এখানেই আমিনুল ইসলামের কবিতার বুকফাটা ক্রন্দন।  সুতরাং কুয়াশার বর্ণমালা কবিতার শেষাংশে লেখা হয়ে যায় :

 

কিন্তু কে নেবে ? বসন্ত করেনি ভুল।

অথচ এখন কোথায় পাখি! শূন্যবিলে

যতসব বিভ্রান্তির ছায়া; রৌদ্রের গায়ে রঙ।

নিঃসঙ্গ দুহাতে পালক কুড়িযে রাখি।

ধূসর শিল্পীর হাতে গড়ে ওঠে যাদুঘর।

পুনঃপুন বিজ্ঞাপন কিউরেটের পদে;

তবু একমাত্র অ্যাপ্লিক্যান্ট-আমাদেরই দুখু বাঙাল ।

 

এই কবিতার মধ্যে কুয়াশার বর্ণমালা কাব্যগ্রন্থের অনুকল্পের আস্বাদ মিলে। বিপরীতের ঐক্যতানে জীবন ও জগতের  দ্বৈরথ আঁকতে চেয়েছেন তিনি। ফলে সেই নদী , বৃক্ষ, পাহাড় আর প্রকৃতির বিচিত্র সুন্দরের কাছে খুঁজতে গিয়েছেন জীবনের সংজ্ঞার্থ।

 

২০১০ সালে প্রকাশিত হয় আমিনুল ইসলামের পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি। এই কাব্যগ্রন্থে নানা স্বাদের কবিতার আমাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। দীর্ঘ পঙ্ক্তির ঠাস বুননের জমাট কবিতা, মাঝারি আয়তনের কবিতা এবং ছোট কবিতার সমারোহে এই কাব্যগ্রন্থটি কবিতার গড়নসৌষ্ঠবে যেমন বেশ বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে তেমনি বিষয়-বৈচিত্র্যও লক্ষণীয়। দেশজ ও বৈশ্বিক পটভূমিতে আমিনুল ইসলামের সহজাত প্রকৃতিচেতনা, প্রেম ও স্মৃতিকাতর প্রেমানুভাবনা, ফেলে আসা জীবনের বেদনাঘন অনুভব, আধুনিক জীবনের রক্তক্ষরণ, ইতিহাস-চেতনা, অবচেতনার অন্তরালবর্তী রাজনীতি, মানবিকতা ও স্নেহানুভব ইত্যাকার বিচিত্র ভাবনানিচয়ে এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পথের আখ্যানই হয়ে উঠেছে কাব্যগ্রন্থটির মূল উপজীব্য। ‘পথ বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি’ শীর্ষক কবিতা থেকে কিছু অংশ উল্লেখ করি :

 

আলোর প্রদীপ হাতে যে-সুমনা দেখিয়েছিল মাইলস্টোনহীন পথ,

রাজপ্রাসাদের ষড়যন্ত্রে তাকে আর পথের সাথি করে নিতে পারিনি।

তারপর কত মেহেদি-প্ররোচনা; সেসবের গোড়ায় লোভের গুদাম

দেখে শামুকের মতো গুটিয়ে নিয়েছি। কিন্তু পুরানো দোষে শেষাবধি

এক পূর্ণকলা চাঁদকে ভালোবেসে দেখি- আমার অন্ধকার মোড়ে তার

দেয়ার মতো কিছু নেই; এক রাহুর সঞ্চয়ী হিসাবে সে তার সবটুকু

জোছনা বন্ধক রেখে বসে আছে ভাঙামেঘের উঠোনে। তারপরও

জোছনার জন্য উপবাসী থেকেছি রাতের পর রাত। শেষ স্টেশনে

পৌঁছে গেছি- এমনটি মনে করে যখন লাগেজের ভবিষ্যত নিয়ে

ভাবছি- তখন বিপরীত ট্রেন হতে নেমে-আসা তোমার সঙ্গে দেখা।

 

আমিনুল ইসলামের স্বপ্নের হালখাতা শীর্ষক কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। এই কাব্যগ্রন্থে এসে প্রলম্বিত ভাবনার জমাট বুনন অনেকাংশেই কমে গেছে। এবং ইতঃপূর্বে ভাবনার যে সংহতি বিষয়বৈচিত্র্যকে অতিক্রম করে একটি সমগ্রতার আস্বাদ এনে দিয়েছে এই কাব্যগ্রন্থে তার পরিবর্তে এসেছে বিচ্ছিন্নতা, ক্ষণিকতা এবং কোথাও কোথাও ছন্দ নিয়ে ভাবনার প্রয়াস। তবে কবির কল্পনাপ্রতিভার যে মূলগত বনিয়াদ- প্রেম, প্রকৃতি ও নিসর্গ- এই কাব্যগ্রন্থে তার বিচ্ছিন্ন প্রবাহ অব্যাহত আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমাজ, সভ্যতা ও জীবনের বিচিত্র বিপর্যয় নিয়ে কবির সংক্ষোভ। একটি আলোকোজ্জ্বল পৃথিবী ক্রমেই তিনি হারিয়ে যেতে দেখেন অন্ধকার গহীনে। যা কিছু শুভ, সুন্দর ও কল্যাণকর, যা কিছু সৌন্দেয়ের, আনন্দের, উৎসবের তা যেন ক্রমেই অকল্যাণ, অসুন্দর আর বিষাদের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। এই বোধ তাড়িত করছে কবিকে। ‘স্বপ্নের হালখাতা’ নামক কবিতার মধ্যেই কবির এই বেদনাবোধের পরিচয় আছে। তিনি লিখেছেন :

 

ও আমার পালকদিনের সাথি-

তুমিও ভুলে গেছো-

আমের ঘ্রাণে মাতোয়ারা ছায়া,

জোছনায় ভাসা মহানন্দার আকাশ;

তোমার মুখখানি আর নতুন চরের উপমা নয়;

তোমার নামটি এখন ঘুমহীন রাতের হাতে নিরাশার তসবিহদানা...

 

জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার (২০১২), শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ (২০১৩), জোছনার রাত বেদনার বেহালা (২০১৪), আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস একাউন্ট (২০১৫), প্রণয়ী নদীর কাছে (২০১৬) এবং ভালোবাসার ভূগোল (২০১৭) ইত্যাকার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আমিনুল ইসলামের জীবনাভিজ্ঞতার অন্য এক বলয় উন্মোচিত হয়েছে।   ইতঃপূর্বে স্বপ্নের হালখাতা নামক যে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে- এই কাব্যগ্রন্থগুলো তার সম্প্রসারণ নয়। জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার কাব্যগ্রন্থের ৫৮টি কবিতার মধ্যে জীবন ও জগৎ নিয়ে কবির যে ভাবনার পরিচয় বিধৃত হয়েছে তা অনেকাংশেই উন্মূল , অবিন্যস্ত ও আত্যন্তিক। আধুনিকোত্তর ভাবনানিচয়ের মধ্যে কখনই চিন্তার শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয় না। এবং সমগ্রতার আস্বাদ অনেকাংশে তিরোহিত। উল্লিখিত অন্যান্য কাব্যগ্রন্থেও বিচূর্ণ ভাবনাস্রোতের মধ্যে ক্ষুব্ধতা, যন্ত্রণা ও স্লেশমিশ্রিত যে তীব্র অভিঘাত লক্ষ করা যায়, তা এই পর্বের কবিতাকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে।

 

আমিনুল ইসলামের একটি নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি হয়েছে। এই কাব্যভাষার মধ্যে পেশাগত কারণে দাপ্তরিক শব্দের উল্লেখযোগ্য ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এছাড়া সময়ের দ্রুত পরিবর্তনের ফলে সময়ানুগ যে নতুন এক ভাষিক জগৎ তৈরি হয়েছে একবিংশ শতকের সূচনালগ্ন থেকে, আমিনুল ইসলাম সেলুলার যুগের সেই ভাষাকেও সাগ্রহে ব্যবহার করতে চেয়েছেন তাঁর কবিতায়। কাব্যভাষার মধ্যে অন্বয়ের অনিবার্যতার যে নিয়তি মহৎ শিল্পের পূর্বশর্ত- আমিনুল ইসলামের কবিতায় তার আত্যন্তিকতা সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায়।

----------০০০---------

 

সরকার আবদুল মান্নান

অধ্যাপক-গবেষক-প্রাবন্ধিক


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান