একান্ত সাক্ষাৎকারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ~ আত্দতৃপ্তি হচ্ছে মৃত্যুর সমান
একান্ত সাক্ষাৎকারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ~ আত্দতৃপ্তি হচ্ছে মৃত্যুর সমান

তৎকালীন ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহাকুমার মাইজপাড়া গ্রামে ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন কবি-কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলা কবিতার ওপর প্রথম ভিন্নমাত্রিক অভিঘাত করেন তাঁর কৃত্তিবাস কবিতা-পত্র সম্পাদনার মাধ্যমে_যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। প্রথম জীবনে কবিতার জন্য তিনি জাগতিক জীবনের যেকোনো প্রাপ্তিকেই হেলায় তুচ্ছজ্ঞান করেছেন, ভেসেছেন নিজের গণ্ডির ভেতরে-বাইরে অপার বাউণ্ডুলেপনার স্বকীয় সৃজনশীলতায়। কৃত্তিবাস প্রকাশনার উত্তরোত্তর ঋণের বোঝা কমাতেই উপন্যাসের জন্য প্রথম কলম ধরেন। অতঃপর বাকিটুকু হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যের অভাবিত ইতিহাস। বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তরুণ সুনীলের পরপর দুটি উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রূপদান করেন। তাঁর শ্রেষ্ঠকীর্তি ঐতিহাসিক ট্রিলজি সেইসময়, পূর্ব-পশ্চিম এবং প্রথম আলো তাঁকে এনে দেয় কিংবদন্তিতুল্য সম্মান ও জনপ্রিয়তা। সেইসময় উপন্যাসের জন্য ভারতীয় সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান ১৯৮৫ সালে। আনন্দ পুরস্কারে দুবার নন্দিত হন, ১৯৭২ এবং ১৯৮৯ সালে। বঙ্কিম পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বর্তমানে ভারতীয় সাহিত্য আকাদেমির সভাপতি। সম্প্রতি তাঁর কলকাতার ফ্ল্যাটে শিলালিপির পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন অদ্বয় দত্তশিলালিপি :

সুদীর্ঘকাল সাহিত্যের সব শাখায় সমান গুরুত্বে কাজ করতে গিয়েসাহিত্য সম্পর্কে এই বয়সে এসে আপনার সম্যক উপলব্ধিটা কী রকম?

সুনীল : উপলব্ধির কথা তো মুখে বলা যায় না। উপলব্ধিকে উপলব্ধি করতে হয়। ১৫ বছর বয়সে আমার প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল। তার মানে ধরো, ষাট বছর ধরে লেখালেখি করছি।

শিলালিপি : একজন লেখক তাঁর লেখার টেবিলে যখন চরিত্র সৃষ্টি করেন, ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করেন, তখন তাঁর ভেতরে যে সৃজনশীলতার আনন্দ অনুভব হয়, তা কি কল্পনায় ঈশ্বরের সৃজন-আনন্দের মতোই?

সুনীল : ঈশ্বরের তুলনা করে কোনো লাভ নেই। শিল্পীরা নানা রকম সৃষ্টির মধ্যে এক রকম আনন্দ তো অবশ্যই পান। আবার অনেক সময় সেটা জীবিকার ক্ষেত্রেও কাজে লেগে যায়। আমরা যে ভাবি, শুধু আনন্দের জন্য সৃষ্টি তা তো নয়। প্রফেশনালিজম কথাটা বাংলায় শুনতে খারাপ লাগে। আমার চমকে উঠে ভাবি_ এ কী! উনি টাকা-পয়সার জন্য লিখছেন! বিদেশে কিন্তু অ্যামেচার আর প্রফেশনাল লেখকদের মধ্যে সুস্পষ্ট তফাৎ আছে।

শিলালিপি : সাহিত্যিকদের জীবনে অমোঘ অনিশ্চয়তা কি তাঁর সৃজনশীলতাকে সমৃদ্ধ করে বলে মনে করেন?

সুনীল : আমি তা মনে করি না।

শিলালিপি : এলোমেলো বোহেমিয়ান জীবন?

সুনীল : এটা যার যার নিজস্ব পদ্ধতি। ওটা কেউ ঠিক করে দেয় না বা ওভাবে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথ কি এলোমেলো জীবনযাপন করতেন? জীবনানন্দ দাশও মোটেই এলোমেলো জীবনযাপন করতেন না, কিন্তু আবার শরৎচন্দ্র করতেন। নজরুল করতেন।

শিলালিপি : এলোমেলো জীবনযাপন ব্যাপারটা না হয় ইচ্ছাকৃত; কিন্তু জীবনের অমোঘ অনিশ্চয়তায় তো কারো হাত থাকে না।

সুনীল : ইচ্ছাকৃত নয়। ওটা ওর ধাতুর মধ্যে রয়েছে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ওরকম ছটফট না করে থাকতে পারবে না। আবার শঙ্খ ঘোষ শান্তভাবে থাকবে, এগুলো ইচ্ছাকৃত নয়, এগুলো তার স্বভাবের মধ্যেই আছে।

শিলালিপি : প্রথম জীবনের অমোঘ অনিশ্চয়তার অভিজ্ঞতা অনেক লেখককে ভীষণভাবে সমৃদ্ধ করেছে। আপনাকেও। অর্ধেক জীবনে যেমনটি আমরা পাই। একদিকে বেকার জীবনের হীনমন্যতা, অন্যদিকে... আপনি কি মনে করেন, মানুষের জীবনের অনিয়ন্ত্রিত অনিশ্চয়তা ভালো লেখক হওয়ার অন্যতম অনুঘটক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে?

সুনীল : ওই সময় পরস্পরবিরোধী দুটি কাজ করে। একটা হচ্ছে-বেকার জীবন; লোকের কাছে অপমানিত হতে হচ্ছে, প্রত্যাখ্যাত হতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে একটা তেজও থাকে-ধুত্তুরি, এসব কিছুই আমি গ্রাহ্য করি না। আমি সব ভেঙেচুরে দেব। দুই রকমই কাজ করে। অনিশ্চিত জীবন আমি তো ইচ্ছাকৃতভাবে বেছে নিয়েছি। ধরো, একটা সময়ে স্কলারশিপ পেয়ে আমেরিকা চলে গেলাম। সেই সময় আমেরিকায় থেকে যাওয়া তো খুবই সহজ ছিল। কিন্তু বাংলা ভাষার টানে আমি ফিরে আসি। তখন এখানে জীবিকা নির্বাহ করা ভীষণ কঠিন ছিল। আমেরিকা থেকে ফিরে এসে আমি কী করব, না করব, কিছুই জানি না। চাকরিবাকরি কিছুই ছিল না। তবুও ফিরেছিলাম ঝুঁকি নিয়ে। এমনও হতে পারত, দেশে এসে কিছুই করতে পারলাম না, লেখাটেখা কারো কিছুই পছন্দ হলো না। না খেতে পেয়ে মরে গেলাম-তাও হতে পারত।

শিলালিপি : এর সঙ্গে এটা কি আমরা বলতে পারি যে বড় প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে আপনার সৃষ্টিকর্মের মূল্যায়ন এমনভাবে এত সহজে নাও হতে পারত?

সুনীল : দেখো, পৃষ্ঠপোষকতা তো এমনি এমনি হয় না। বড় প্রতিষ্ঠান তো কাউকে পোষ্যপুত্র রাখে না। সেখানে তোমার যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়। ধরো, আমার প্রথম লেখা তো আমি ডাকে পাঠিয়েছি এবং ছাপা হয়েছে। সুযোগ আবার কী!

শিলালিপি : কিন্তু আমরা দেখতে পাই, বড় বড় প্রতিভা আছে_ যারা বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের ধ্বজাধারী না বলে অনেক ক্ষেত্রেই যথার্থ মূল্যায়ন পান না, বেশি মানুষের কাছে সহজে পেঁৗছান না?

সুনীল : এটা ঠিকই যে কোনো কোনো লেখকই থাকেন এমন যাঁরা কোনো প্রতিষ্ঠানে যেতে চান না, যাঁরা প্রতিষ্ঠানবিরোধী হন। কেউ কেউ ছোট কাগজে লিখতে, নিভৃতে থাকতে ভালোবাসেন। আবার কেউ কেউ চান, আমার লেখা যাতে বেশি লোক পড়ে সে জন্য আমি বড় জায়গায় যাব। একেকজন লেখকের মানসিকতার ওপর এসব নির্ভর করে।

শিলালিপি : একজন মহৎ কবির জন্মের জন্য মহৎ অডিয়েন্স বা পাঠকমণ্ডলী দরকার। হুইটম্যানের এ ভাবনার সঙ্গে আপনি কতটা একমত?

সুনীল : এ কথা অনেক লেখকই বলেছেন, শুধু হুইটম্যান নন, টি এস এলিয়টসহ আরো অনেকেই। পাঠক সমাজ যতটা তৈরি, সাহিত্য ঠিক ততটাই হবে। যদি পাঠক সমাজের রুচি নিচের দিকে থাকে তাহলে উচ্চমার্গের সাহিত্য সৃষ্টি হবে না।

শিলালিপি : আপনার নিজের ক্ষেত্রে কি কথাটা সত্য? অর্থাৎ আপনার নিজের পাঠক সমাজ যদি নিম্নরুচির হয় তাহলে আপনার দ্বারাও কি উচ্চমার্গের সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হবে না?

সুনীল : নিশ্চয়ই। আমরা তো কতগুলো জিনিস লিখতে পারি না। ইচ্ছে করে, তবুও পারি না। কারণ সেসব লেখা, বিশেষ করে কেউ পড়বে না বা বুঝবে না।

শিলালিপি : শুধু পাঠকদের জন্যই সাহিত্য সৃষ্টি? অর্থাৎ পাঠক-অডিয়েন্সের গ্রহণযোগ্যতায় প্রশ্ন থাকলে তা লেখা যাবে না? আর বেশির ভাগ নাই-বা বুঝতে পারল, উত্তর-প্রজন্মও তো না বুঝে ওঠা লেখার ভেতর সার্থক শিল্পরস খুঁজে পেতে পারে। তাদের কথা ভেবেও কি লেখা যায় না?

সুনীল : আমাদের মতো লেখক যারা অর্থাৎ পত্রপত্রিকায় লেখা না দিলে আমাদের মারবে ধরে (হেসে)। আমাদের তো উপায় নেই যে একলা বসে বসে নির্ভৃতে এক্সপেরিমেন্ট করে লিখতে পারি। মানে যাকে বলে একদম অ্যাবসট্রাক্ট লেখা। যার মানে বোঝা দুরূহ। সেই লেখা কি আমরা লিখতে পারি? সেজন্য আমরা করি কী, অন্য অনেক লেখার মধ্যে আমাদের সেই অ্যাবসট্রাক্ট ভাবনাগুলো একটু একটু করে মিশিয়ে দিই।

শিলালিপি : তার মানে, আপনি লিখতে চান ঠিকই, কিন্তু পাঠক সমাজের গ্রহণযোগ্যতার অভাব বোধ থেকে পিছিয়ে আসেন...

সুনীল : তুমি একটা লেখা লিখলে কিন্তু কেউ তা বুঝল না, তা হলে তা লিখে লাভটা কী? এটা কবিতার ক্ষেত্রে হয়। কবিতা কয়টা লোক বোঝে? কবিতার মধ্যে এই বিমূর্ত ভাবটা থাকে। আর কবিরা জানেন আমার বেশি পাঠকের দরকার নেই।

শিলালিপি : আপনার 'কবি' ও 'কথাশিল্পী' সত্তার মধ্যে কোনটাকে বেশি সৃজনশীল ও আনন্দদায়ক বলে মনে করেন?

সুনীল : আনন্দদায়ক যদি বলো তবে 'কবি'সত্তা। কথাসাহিত্যে তো বড্ড পরিশ্রম করতে হয়, তাই না?

শিলালিপি : আপনার কাছে লেখালেখির আনন্দ ও কষ্টসাধ্য শ্রমের মধ্যে আনুপাতিক অনুভূতিটা কী রকম?

সুনীল : লেখালেখিটা কষ্টেরই, আনন্দের নয়। শারীরিক কষ্ট, মানসিক কষ্ট। কষ্টের বোধ সবচেয়ে বেশি। তবে লেখাটা শেষ হতে পারে। একটানা কোনো দুঃখ ও কষ্ট কবিতার ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো না কোনো অতৃপ্তি বা দুঃখবোধ লেখার মধ্যে চলে আসে। লেখার মধ্যে উচ্ছলতা-আনন্দ-টগবগে ভাব সহজে থাকে না।

শিলালিপি : আর বাংলাদেশের পাঠকমহল ও ভারতীয় বইয়ের বিশাল বাজার নিয়ে...

সুনীল : বাংলাদেশে ভারতীয় বইয়ের বিশাল বাজার নিয়ে কী বলব? আমার তো সব বই-ই ওখানে পাইরেট করে বিক্রি হয়। সারা বাংলাদেশেই সেই জাল বই ছেয়ে গেছে। এমনও দেখা গেছে, যে বইটা এখানে প্রকাশ পায়নি, এমন বইও ওখানে বেরিয়ে যাচ্ছে। যেমন ধরো, আমি 'রানু ও ভানু' নামে একটা উপন্যাস পূজা সংখ্যায় লিখেছিলাম, সেটা আমি আনন্দ পাবলিশার্সকে দিয়ে বলেছিলাম, এক্ষুনি বই করবে না, একটু দাঁড়াও, আমি কিছু সংশোধন করব, তারপর বই বেরোবে। কিন্তু বাংলাদেশে পূজা সংখ্যা থেকে উপন্যাসটি বই আকারে ঠিক বেরিয়ে যায়।

শিলালিপি : কিন্তু বাংলাদেশের বই তো এখানে বিশেষ আসে না।

সুনীল : আসে না_তা তো নয়; কোনো বাধা তো নেই। এখানে পাঠক সৃষ্টি করতে হবে। এখানে তো পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের লেখকদের লেখা বেরোয়... এর আগে 'দেশ' পত্রিকার পূজা সংখ্যায় হুমায়ূন আহমেদের লেখা বেরিয়েছে অনেক।

শিলালিপি : কিন্তু সেটা মনে করা হয় বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদের বিশাল জনপ্রিয়তার জন্য। সেই জনপ্রিয়তার রেশ ধরে 'দেশ' পত্রিকার বাড়তি কাটতির জন্য...

সুনীল : কিন্তু এটাও তো সত্যি, এ দেশের পাঠকদের কাছে হুমায়ূন আহমেদকে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আর 'দেশ' এখানেই সর্বাধিক বিক্রি হয়।

শিলালিপি : দু'একজন, যেমন হুমায়ূন আহমেদকে দিয়ে কি পাঠকদের প্রকৃত মন জয় হচ্ছে?

সুনীল : বাংলাদেশের পাঠকদের সার্বিক মন জয় করে ছাপা সম্ভব হয় না_এটা যেমন সত্যি, তেমনি এখানকার পাঠকদের কাছে ওইসব লেখক পরিচিত হয়ে উঠছে, তাতে এখানে তাদের একটা বইয়ের বাজার তৈরি হতে পারে। শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে এখন অনেকের বই-ই ছাপা হয়, বিক্রি হয়। আগে যেমন বলা হতো একেবারেই বিক্রি হয় না, সেটা কিন্তু এখন আর সত্য নয়; হয়তো তা খুব বেশি নয়। তার জন্য আগে এখানে মার্কেট তৈরি করতে হবে।

শিলালিপি : সম্পাদকের চাপে লিখে যাচ্ছেন, অনেকটা ঠিকাদার লেখা; ক্লান্তি আসে না?

সুনীল : কী বলছ, ঠিক বুঝতে পারছি না।

শিলালিপি : মানে, কিছু লেখা আছে, যা ঠিকাদারি গোত্রের লেখা, চাপে পড়ে লেখা, সম্পাদকদের ফরমায়েশি লেখা যাকে বলে...

সুনীল : কী ধরনের লেখা?

শিলালিপি : গল্প-উপন্যাস-কবিতা। ধরুন উপন্যাস...

সুনীল : সম্পাদকদের চাপে পড়ে এখন আর আমি উপন্যাস লিখি না।

শিলালিপি : আগে তো লিখেছেন যথেষ্ট।

সুনীল : সে তো অল্প বয়সে যখন আমার দারিদ্র্য ছিল, খাওয়া-পরার সমস্যা ছিল, লিখে আমার খেতে হতো, তখন অনেক লিখেছি। ছোটখাটো সিনেমা পত্রিকায়, অমুক পত্রিকায়, তমুক পত্রিকায়। অনেক লেখা হয়তো হালকা হয়েছে। তবে ওরকম একটা লেখা বেশি জনপ্রিয় হয়ে গেছে। যেমন ধরো 'অরণ্যের দিনরাত্রি'। সেটা আমি হেলাফেলা করে আমার পত্রিকার (কৃত্তিবাস) ধার মেটানোর জন্য লিখেছিলাম। সেটাই সিনেমা হলো, জনপ্রিয়ও হলো খুব। কাজেই হেলাফেলা করে লেখাও কখনো কখনো উত্তীর্ণ হয়। এখন অবশ্য আমি ওরকমভাবে সম্পাদকদের অনুরোধে কিছু লিখি না। এখন আমি যা লিখি স্বতঃস্ফূর্তভাবে লিখি।

শিলালিপি : মনে হয় না কখনো, আপনার লেখায়-ভাবনায়-সৃজনশীলতায় রিপিটেশন হচ্ছে? পৌনঃপুনিকতা আসছে? সুনীল : যদি পাঠকদের মনে হয়, হতে পারে, তাহলে লিখব না।

শিলালিপি : আপনার নিজের কী মনে হয়? পৌনঃপুনিকতা কি আপনাকে আবদ্ধ করছে?

সুনীল : মনে তো হয় না। আমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দিক ও বিষয়বস্তু নিয়ে বৈচিত্র্যময় লেখা লিখি।

শিলালিপি : পাঠক হিসেবে আপনার নিজের লেখার সমালোচনা কিভাবে করবেন?

সুনীল : নিজের লেখার সমালোচনা তো এক লাইনে বলতে পারি_সার্থক লেখা একটাও এখনো লিখতে পারিনি। আমাকে যখন প্রশ্ন করা হয়, নিজের কোন লেখাটা আপনার পছন্দ_আমি উত্তরে বলি, যে লেখাটা এখনো লেখা হয়নি।

শিলালিপি : এমন কোনো লেখার কথা জানতে চাইছি_যা লিখতে না পারার যন্ত্রণা বয়ে বেড়ান।

সুনীল : অনেক আছে। অনেক কবিতা মাথায় আসে-যা শেষ পর্যন্ত লেখাই হয় না। গদ্য লেখারও অনেক বিষয়বস্তু মাথায় ঘোরে, কিন্তু মনে হয়, আমি তার উপযুক্ত নই এখন। এখনো ঠিকঠাক তৈরি হয়ে উঠতে পারিনি। এমন অনেক আছে।

শিলালিপি : খুব আত্দতৃপ্তি পেয়েছেন এমন একটি লেখার নাম...

সুনীল : শোনো, আত্দতৃপ্তি হচ্ছে মৃত্যুর সমান। যেই লেখক মনে করে-আহ্ খুব ভালো লিখেছি-যা যা লিখেছি দারুণ লিখেছি-সেই লেখক আর এগোতে পারে না।

শিলালিপি : সেইসময়, প্রথম আলো ও পূর্বপশ্চিম -এই তিন ঐতিহাসিক ট্রিলজির পরবর্তী অর্থাৎপূর্ব পশ্চিমের পরবর্তী পটভূমির আর কি কোনো উপন্যাস আমরা পেতে পারি?

সুনীল : আমার চেষ্টা আছে। শেষ আরেকটা লিখে যাব আশা করছি। খুব বড় একটা পরিকল্পনা আছে। দেখা যাক কতটা পারি। পাঁচ পুরুষের কাহিনী লিখব। ধরো, আমার ঠাকুরদাদা থেকে শুরু করে অর্থাৎ আমার ঠাকুরদাদা, আমার বাবা, আমি, আমার ছেলে এবং আমার নাতি-এই যে বিরাট বিবর্তন হয়েছে...; আমার ঠাকুরদাদা গ্রামের টোলের পণ্ডিত ছিলেন, আর আমার নাতি জন্ম থেকেই আমেরিকার নাগরিক। কত বড় পরিবর্তন! এই সময়কালটাও তো প্রায় ১০০ বছরের ওপরে! এটা নিয়ে একটা লেখার ইচ্ছে আছে। এতে কিন্তু আমি আমার পরিবারের কথা লিখব না। তুলনা দিলাম; কিন্তু কাল্পনিক...

শিলালিপি : অর্থাৎ আপনাদের এই পাঁচ প্রজন্ম যে 'সময়'টাতে জীবনধারণ করেছেন, সেই সময়কালে পৃথিবীর যে বিবর্তন-পাঁচ পুরুষের ভেতর দিয়ে সেটাকে তুলে ধরবেন?

সুনীল : হ্যাঁ।

শিলালিপি : মানুষকে পৃথিবীর জন্য কতটা বিপজ্জনক বলে মনে করেন?

সুনীল : পৃথিবী তো বেশ অনিরাপদ হয়ে গেছে। এই পৃথিবীর পরিবেশ সবচেয়ে বেশি নষ্ট করেছে মানুষ। হিংসা আর এত অস্ত্র সংগ্রহ করেছে, সেগুলো শেষ পর্যন্ত মানবজাতির জন্য আত্দঘাতী হয়ে দেখা দিতে পারে।

শিলালিপি : কয়েক বছর আগে দেশ পত্রিকায় আপনার লেখা 'রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার অতঃপর পুনরাবিষ্কার' শিরোনামে একটি লেখা পড়লাম। আপনাদের প্রথম জীবনে এই যে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করা এবং পরে তাঁকে...

সুনীল : ব্যাপারটা কী ছিল জানো, রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করার কারণটা ছিল এই...ঠিক রবীন্দ্রনাথ না; আমি তো অনেক জায়গায় লিখেছি-তখন তো আমরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা মুখস্থ করতাম, রবীন্দ্রনাথের গান গাইতাম অথচ মুখে রবীন্দ্রনাথের নিন্দা করতাম। তার কারণ হচ্ছে, তখনকার দিনের যারা রবীন্দ্রভক্ত, তারা সব সময় এমন একটা ভাব করত যে রবীন্দ্রনাথের পর আর কিছু হবে না। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা সাহিত্যে আর যেন কিছু নেই! তরুণ লেখকরা কিছুই লিখতে পারে না। তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার জন্যই রবীন্দ্রনিন্দা ছিল আমাদের সেই ক্ষোভের প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের লেখার বিষয়ে কোনো ক্ষোভ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ তখনো আমাদের যেভাবে মুগ্ধ করত এখনো করে। তা ছাড়া এখন সেই অবস্থাটা চলে গেছে। এখন আর কেউ রবীন্দ্রনাথই শেষ কথা বলে মাথা ঘামায় না। এখন তো রবীন্দ্রনাথকে ক্লাসিক্যাল পর্যায়ে ফেলা হয়েছে। ক্লাসিক্যাল পর্যায়ের লেখকদের সঙ্গে তো দ্বন্দ্বযুদ্ধ করতে হয় না। তাদের মাথায় রেখে দিলেই হয়। এ জন্য রবীন্দ্রনাথের লেখা এখন আবার নতুন করে পড়লে আমার বেশ ভালো লাগে।

শিলালিপি : এমন লেখার পরিমাণ কতটা_যেসব লেখা ছাপা আকারে দেখে আপনার কষ্ট হয়েছে, লজ্জা লেগেছে?

সুনীল : অনেক আছে। কোনো লেখাই আমাকে তেমন সন্তুষ্ট করে না_সে তো আগেই বলেছি। তা ছাড়া অনেক লিখলে... অনেকে তো বলেন, রবীন্দ্রনাথের চেয়েও আমি বেশি পাতা লিখে ফেলেছি, সেই লেখার মান যেমনই হোক। কত লেখা কত জায়গায় ছড়িয়ে আছে তা আমি নিজেও জানি না। এর মধ্যে অ-নে-ক লেখা আছে খুবই দুর্বল, পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়।

শিলালিপি : মহাকাব্যিক ঢঙে উপন্যাস আপনার হাতে যেভাবে, যে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় সৃষ্টি হয়_তাতে আমাদের আকাঙ্ক্ষা আরো বেড়ে যায় যে এমন ঐতিহাসিক লেখা যদি আপনার কাছ থেকে আরো পাওয়া যেত!

সুনীল : ইতিহাসের চরিত্রদের নিয়ে উপন্যাস লেখা অনেক পরিশ্রমের কাজ। এবার ঐতিহাসিক পটভূমিতে একটা গল্প লিখেছি। অনেকেই বলছেন, এসব তো আগে জানতাম না! আমি লিখেছি, বার ভুঁইয়াদের মধ্যে কেদার রায় এবং ঈশা খাঁ_এদের দুজনের খুব বন্ধুত্ব ছিল। এরা যদি একসঙ্গে লড়াই করত তবে অনেক কিছু করতে পারত। কিন্তু পারল না। গল্পটার মধ্যে আছে, ঈশা খাঁ করল কী কেদার রায়ের বিধবা বোনকে জোর করে বিয়ে করল। সেই বিয়ের কারণে দুজনের ঘোর শত্রুতা শুরু হয়ে গেল। কী দুঃখের কথা! ওরা একতাবদ্ধ হলে হয়তো মোগলের বিরুদ্ধে জিততেও পারত। প্রথমে তাই করেছিল। কিন্তু পরে ওই বিয়ের কারণে দুজনে জাতশত্রুতে পরিণত হলো। তাতে দুজনের সমূহ ক্ষতি হলো। এক পর্যায়ে দুজনই ধ্বংস হয়ে গেল। গল্পটার নাম_'কীর্তিনাশার এপারে-ওপারে'_পদ্মার এক নাম কীর্তিনাশা। সেই কীর্তিনাশা তাদের সব কীর্তি ধুয়েমুছে শেষ করে দিয়েছিল।

শিলালিপি : নতুন করে জীবন সাজানোর সুযোগ পেলে কী কী সংশোধনী আনতে দ্বিধা করতেন না?

সুনীল : আমি যে জীবনটা কাটিয়েছি_তাতে আমার কোনো অনুতাপ নেই। বেশ ভালোই কাটিয়েছি। তবে নতুন করে জন্ম নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলে মেয়ে হয়ে জন্মাতাম। পুরুষ জন্মটা দেখলাম, মেয়েদের জীবনটা কেমন_সেটা দেখতাম। যদিও জানি এটা একটা হাইপোথেটিক্যাল কোশ্চেন, তবুও বলছি।

শিলালিপি : 'বিবাহ' নামক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী রকম?

সুনীল : 'বিবাহ' তো একটা কৃত্রিম প্রতিষ্ঠান, প্রকৃতি প্রদত্ত না, জোর করে সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। উত্তরাধিকারের ব্যাপারটা ঠিক রাখার জন্য। না হলে জীবজন্তুদের ভেতরে যেমন বিবাহ নেই মানুষের ভেতরে তা থাকার কথা না। জীবজন্তু থেকে মানুষ তো প্রকৃতিগতভাবে আলাদা কিছু না। মানুষও তো একটা জন্তু। বিবাহ শুধু সামাজিক সুবিধার জন্য রাখা হয়েছে, সম্পত্তির জন্য। জীবজন্তুদের তো সম্পত্তি নেই, তাই বিবাহও নেই।

শিলালিপি : বিবাহপ্রথায় বিশ্বাসী নন, কিন্তু বিবাহিত, এই সুদীর্ঘ বিবাহিত জীবন সম্পর্কে যদি কিছু বলেন...

সুনীল : জানো তো, আমার বিবাহিত জীবনটা খুব ভালো। আমি অন্যদের দিকে তাকিয়ে দেখি তাদের অনেকেরই দাম্পত্য জীবনে কত অদ্ভুত সব অশান্তি বাসা বাঁধে। তা বউয়ের সঙ্গে আমার ভালোই সম্পর্ক। অনেক দিন তো হয়ে গেল।

শিলালিপি : যোগ্য সহধর্মিণী...

সুনীল : যোগ্য কি না জানি না, আমি তার যোগ্য কি না তাও জানি না। এমনও তো হতে পারে, সে হয়তো আমার চেয়ে ভালো। কিন্তু আমাদের দুজনের মধ্যে বেশ ভাব আছে। আর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা_তোমাদের তো সবে শুরু হলো_বেশি দিন বিবাহিত জীবনযাপনের পর যদি দেখা যায়, তাদের মধ্যে তখনো বেশ ইয়ার্কির সম্পর্ক আছে, দুজন দুজনকে নিয়ে মজা করছে_তা হলে বুঝবে ভালো আছে। আর যদি দুজনই ফরমাল হয়ে যায় বা গম্ভীর হয়ে থাকে এবং দিন দিন তা বাড়তে থাকে_সেটা খুব খারাপ লক্ষণ। আমার স্ত্রীর সঙ্গে, জানো তো, এখনো আমার বেশ ইয়ার্কি-ঠাট্টা চলে।

শিলালিপি : স্ত্রীর পর আপনার জীবনে আর কে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে?

সুনীল : (হেসে) সেটা বলব কেন? সেটা বলব কী! পারিবারিকভাবে বললে মায়ের কথা...

শিলালিপি : বাংলাদেশ তো আপনার কাছে ভীষণ নস্টালজিক জায়গা। যেমন কয়েক দিন আগে আপনার একটা লেখায় পড়লাম, যদি বর্ধমানের কোনো প্রত্যন্ত গ্রামে আপনার জন্ম হতো তাহলে সেই জন্মভিটা নিয়ে আপনার মনে কোনো আদিখ্যেতাই থাকত না। যেহেতু মাদারীপুরের মাইজপাড়ায় আপনার জন্ম, শৈশবও কেটেছে এবং সেটা এখন একটা ভিন্ন দেশ, তাই চাইলেও সেখানে সহসা যাওয়া সম্ভব নয়_এই টানাপড়েন আপনাকে খুব যন্ত্রণা দেয়?

সুনীল : হ্যাঁ, ঠিকই, শৈশব মানুষের কাছে ভীষণ মধুর। আর মানুষ যা সহজে পায় তার প্রতি আসক্তি এবং আকর্ষণ কম থাকে। উল্টোভাবে যা আমার নিজের তা দুর্লক্ষ্য হয়ে গেলে কষ্ট তো লাগবেই।

শিলালিপি : আপনার সেই জন্মভূমি বাংলাদেশ, স্বপ্নের বাংলাদেশ আপনার চোখে কী রকম হলে ভালো লাগবে?

সুনীল : বাংলাদেশের যখন জন্ম হয় তখন আমাদের অন্য রকম একটা আশা ছিল। আমাদের শুধু নয়, বাংলাদেশের বহু মানুষ, যারা কোনো না কোনোভাবে দেশ স্বাধীনের লড়াইয়ে নেমেছিল, আশা করেছিল যে এটা একটা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ তো হবেই; এখানে বাংলা ভাষার প্রকৃত মর্যাদা রক্ষিত হবে, বাংলা সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষিত হবে, বাঙালিরা অর্থনৈতিকভাবে আরো সমৃদ্ধি অর্জন করবে এবং ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে প্রগতির পথে এগিয়ে যাবে। তার অনেক কিছুই হয়নি। ভারতেও যেমন স্বাধীনতার পর আমরা যা যা আশা করেছিলাম, তা তো হয়নি। অনেক কিছুই হয়নি।

শিলালিপি : আপনি যখন আপনার খোলামেলা বা বিতর্কিত ভাবনাগুলোকে প্রকাশ করতে ভয় পান, যখন আপনার মনে হয় যে আপনার ভেতরটা স্বআরোপিত বা বাধ্যগত কিছু নিষেধাজ্ঞার ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে আছে_তখন আপনার সেই ভাবনাগুলোকে আপনি কতটা কবিতায় এবং কতটা গদ্য বা গল্পে বা উপন্যাসে প্রকাশ করেন?

সুনীল : আমি একটা জিনিসই ভয় পাই, সেটা হচ্ছে ধর্মীয় সমালোচনা। আমার মনের মধ্যে ধর্ম সম্পর্কে অনেক বক্তব্য আছে। কিন্তু সব সময় এটা লিখে প্রকাশ করি না। তার কারণ হচ্ছে, আমি একটা জিনিসকে খুব ঘৃণা করি_দাঙ্গা। আমার লেখার কারণে যদি কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি হয়, তবে আমাকে আত্দহত্যা করতে হবে। আমি চাই না, আমার লেখার জন্য একটাও নিরীহ প্রাণ নষ্ট হোক। আসলে ধর্ম জিনিসটাকে নিয়ে আমি যতটা লিখতে পারতাম, ততটা লিখি না। এই একটা বিষয় বাদ দিয়ে আর কোনো বিষয়ে আমার কোনো ভয় নেই।

শিলালিপি : আপনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।

সুনীল : তোমরাও ভালো থেকো। 

(কালের কন্ঠ থেকে)


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান