মাসুদ খানের কবিতা
মাসুদ খানের কবিতা
নাম

তারপর চুপচাপ চলে যাব কোনো একদিন,
দূরসম্পর্কের সেই মাথানিচু লাজুক আত্মীয়টির মতো,
নিজের নামটিকেই ভুলে ফেলে রেখে, তোমাদের কাছে।
গিয়ে বার্তা পাঠাব— এসেছি তাড়াহুড়া করে,
ভুলে গেছি তাই।
পাঠিয়ে দিয়ো তো নামটিকে।
উত্তর পাব না কোনো।
কিছুদিন অনাথের মতো ঘুরে ফিরে
আমার সে-নামও নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে একদিন তোমাদের ছেড়ে।
আমিও বিলীন, আর নামও লুপ্ত, থাকবে শুধু তিলেক শূন্যতা।
আর তা পূরণ করতে এসে যাবে অন্য এক ভাবী বিলুপ্ততা।

অপ্রাকৃত

ছোট্ট একটি ট্রেন— কিশোরী-বয়সী। অসুস্থ, অর্ধবিকল।
পরিত্যক্ত লোকোশেড ছেড়ে
নিশীথে বেরিয়ে পড়ে একা, নিশ্চালক।
সারারাত কোথায়-কোথায় কোন পথে ও বিপথে ঘুরে বেড়ায়...
কিছুটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, গ্রাম-গঞ্জ-শহর পেরিয়ে...
রেললাইন ছেড়ে নেমে যায় মাঠে। চলতে থাকে মাঠের ভেতর
পৌষের শূন্য শীতার্ত মাঠ...
সুখী মানুষেরা ঘুমে। অসুখীরা নির্ঘুম, ঊনপ্রাকৃতিক—
দীর্ঘনিশ্বাসের আতশবাতাসে একাকার তাদের ঐহিক-পারত্রিক।
ঘুমে-ঢুলুঢুলু স্টেশনের বিধ্বস্ত কোণে
কয়েকজন নির্দন্ত নুলা ভিখারি সোল্লাসে মেতেছে সম্মিলিত স্বমেহনে।
পথ থেকে এক পথকিশোরকে গাড়িতে উঠিয়ে নিচ্ছে দুই সমকামী
সদ্যমৃত শিশুর লাশ তুলে নিয়ে পালাচ্ছে এক শবাহারী।
কাঁপতে কাঁপতে এগোচ্ছে চোখবাঁধা এক হতভাগা,
ক্রমে ক্রসফায়ারের দিকে।
তা দেখতে পিছু নিয়েছে দুই রোঁয়া-ওঠা ঘেয়ো ক্ষুধার্ত কুকুর
আর রাজ-রহমতে সদ্য-ছাড়া-পাওয়া এক মৃত্যুসাজাপ্রাপ্ত খুনি।
বাসায় বাসায় বন্দি, নির্যাতিতা শিশু পরিচারিকাদের স্ফুট-অস্ফুট কান্না...
এসব কোন অ্যাবসার্ড নাটকের নিষ্ঠুর নাট্যায়ন, ঘূর্ণমান নাটমঞ্চে!
শেষ অঙ্ক থেকে পিচকারির বেগে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে সমাপ্তিসংগীত—
পরাজিত মানুষের শোচনা ও খুনির নৈশ নিভৃত অনুশোচনা
এ-দুয়ের মিশ্ররাগে জেগে-ওঠা এক নিষ্করুণ গান।
প্রাকৃত-অপ্রাকৃতের ভেদ ভুলিয়ে-দেওয়া সব দৃশ্যনাট্য ঠেলে
উজিয়ে চলেছে সেই পালিয়ে-বেড়ানো ট্রেনটি।
কেউ কি দেখেছে ট্রেনটিকে?
—কেউ না।
শুধু পরান মল্লিকের চির-রোগা রাতজাগা ছেলেটি বারবার বলে যাচ্ছে—
“অনেক রাতে জানালা খুলে দেখি-কি,
আগাগোড়া ফিনফিনে কুয়াশা-কালারের হিজাবে মোড়া
নূপুর-পরা এক ঘরপালানো বউ
ত্রস্তপায়ে ঝুমঝুম শব্দ তুলে চলে যাচ্ছে দূরে
আরো অধিক কুয়াশার ভেতরে।”
কিন্তু কেউ বিশ্বাস করছে না তার কথা।

ধীবর 

তুমি তো ধীবর জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে
জাল ফেলে নিশ্চুপ। এই ধৈর্যের রূপ
আহা কোথাও তো দেখি না রে।
এমন জাদুর জালে কত মাছে, শৈবালে
ছুটে এসে দেয় আত্মাহুতি।
তুমি জাত-জলদাস, তবু এ কী পরিহাস
মাছে তব জাগে অনুভূতি!
ধীবরের শাদা মন, সদা ভাবছে কখন
নদী জাগে মাছের জোয়ারে!
তুমি তো ধীবর জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে।
জল ও জালের লীলা, তরলে ভাসায় শিলা
ঘাই মারে মৎস্যরতন
জাল নয়, কালাচাঁদ, মায়া লাগানোর ফাঁদ,
ত্রিভুবনে কী আছে অমন?
জালের মায়ায় ম’জে, ধীবরের খোঁজে-খোঁজে
ধেয়ে আসে আধেয়, আধারে।
তুমি তো ধীবর জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে।
একে তো ঘোলাটে পানি, তদুপরি কানাকানি,
জলে নাকি কামট, কুমির
তবুও ধীবর বলে, কখন নামব জলে
মনপ্রাণ উতলা, অধীর।
মন তবু মানে তার, প্রাণটা তো অনিবার
ছুটে যায় ইশারা আকারে
তুমি তো ধীবর জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে।
এমন নদীর বাঁকে তেঁতুলের গাছ থাকে
তেঁতুল পাকতে থাকে ক্রমে।
কুমির কামুক বটে ঠেলিয়া ডাঙায় ওঠে
পাকা-পাকা তেঁতুলের ভ্রমে।
ধীরে ধীরে বয় বায়ু, আরো ধীরে পরমায়ু
বেড়ে যায় মীন-সংসারে।
তুমি তো ধীবর জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে।
জল ও জালের খেলা সারাদিন সারাবেলা
মাছেরা মারছে খালি ঘাই
জাল সে তো নয়, চাঁদ, মায়া লাগানোর ফাঁদ,
ওরকম আমার যে নাই!
ওপারে মাছের দেশ, লীলার তো নাই শেষ,
আমি থাকি নদীর এপারে।
তুমি তো ধীবর জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান